ওয়াশিংটনে ক্ষমতার পরিবর্তন ইউরোপে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ইউরোপের রাজনৈতিক মহল একাধারে ভীত এবং সতর্ক। বলা বাহুল্য কেউ কেউ উল্লসিতও। যারা উদারপন্থি তারা ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি এবং জলবায়ু সংক্রান্ত নীতি নিয়ে চিন্তিত, অন্যদিকে উগ্র ডান ও কট্টরপন্থিরা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডায় নতুন বাতাস পাওয়ার আশায় বিহ্বল।
এখন প্রশ্ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে ইউরোপ কীভাবে প্রভাবিত হবে? ইইউ কী কৌশলেই বা আসন্ন চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে নিজেদের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে পারবে? মোটা দাগে তিনটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা যায়, যেসব ক্ষেত্রে আগামী বছরগুলোতে ইউরোপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করতে হতে পারে।
প্রথমত : বিষয়টি রাজনৈতিক। ট্রাম্পের রাজনৈতিক দর্শন ইউরোপ তথা সারা বিশ্বের জন্যই হুমকিস্বরূপ। ইউরোপকে তাই শক্তিশালী করতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ইউরোপকে অবশ্যই আটলান্টিক মহাদেশের প্রতিরক্ষায় অবদান রাখতে হবে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এর অর্থ হচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের আজকের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডকে নিজেদের আওতাভুক্ত করার যে দাবি করেছেন, তা অনেক ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকদের ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড কিনতে প্রস্তুত। উল্লেখ্য, স্বায়ত্তশাসিত এই বিশাল আর্কটিক দ্বীপটি ডেনমার্কের অন্তর্গত।
সপ্তাহখানেক আগে ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন। গ্রিনল্যান্ডের অধিবাসীরাও চান না আমেরিকার সঙ্গে একীভূত হতে। কিন্তু ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড কব্জা করতে মরিয়া। ঠিক যেমন মরিয়া হয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পানামা খালের দখল পেতে। এই অভীপ্সায় তিনি গত সপ্তাহে তার বিদেশমন্ত্রীকে পানামা পাঠিয়েছিলেন হুমকি-ধমকি দিতে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, গ্রিনল্যান্ড বিষয়ে ট্রাম্পের এই আগ্রাসী পদক্ষেপ হয়তো ডেনমার্ককে তার প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে রাজি করার একটি কৌশল। একই সঙ্গে এটি সমগ্র ইউরোপের জন্য একটি সতর্ক সংকেতও বলে মনে করছেন অনেকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পরিবর্তন ন্যাটো প্রতিরক্ষা জোটেও তৈরি করেছে আশঙ্কা। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে, ট্রাম্প প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের সাধারণ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির বর্তমান দুই শতাংশ থেকে দ্বিগুণেরও বেশি করে পাঁচ শতাংশে উন্নীত করতে চান। ট্রাম্প আরও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, যেসব দেশ প্রতিরক্ষা ফান্ডে খুব কম অর্থ প্রদান করে তারা সম্ভাব্য রাশিয়ান আক্রমণের ক্ষেত্রে মার্কিন সহায়তার ওপর নির্ভর করতে পারবে না। মার্কিন সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রাখার স্বার্থে কোনো কোনো দেশ ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করতে এখন বাধ্য হচ্ছে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, বহুপাক্ষিক সহযোগিতার গুরুত্ব ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তারা বলছেন, ন্যাটো আমাদের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন এই প্রতিরক্ষা জোটের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও শর্তসাপেক্ষ হয়ে পড়বে। তাই আমাদের প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা করতে হবে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন ও যুদ্ধকে ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে দেখে এবং দেশটিকে সামরিকভাবে সমর্থন করার জন্য তাদের অব্যাহত ইচ্ছা আছে কি না তা নিয়েও বড় প্রশ্ন রয়েছে। ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের ট্রাম্পের পক্ষ থেকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, ইউক্রেনের প্রতি তার সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
দ্বিতীয়ত : বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা। আটলান্টিকের উভয় পাড়ের অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে পারে। এর ফলে বাড়তে পারে, বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ এবং বিশে^র অন্যান্য স্থান থেকে আমদানির ওপর দশ থেকে বিশ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে চান। বর্ধিত শুল্ক আরোপের উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে বিনিয়োগ এবং পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নিয়ে আসা। গত অক্টোবরে এক নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠানে ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছিলেন, জার্মান গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো ভবিষ্যতে আমেরিকান কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে যারপরনাই ক্ষুব্ধ দেশ দুটি। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা আমাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ইউরোপকে এক হাত নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল। ট্রাম্প বারবার বলেছিলেন, ইউরোপ আমাদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করেছে। এর জবাব তারা পাবে। ইউরোপ সংগতকারণেই এখন জবাবের অপেক্ষায়। ইইউ কমিশন বিভিন্ন বিকল্পের প্রস্তুতি নিয়ে সতর্কভাবে পা ফেলছে। ইইউ তার হাতে থাকা কার্ডগুলো একসঙ্গে না খেলে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক এক করে টেবিলে রাখতে চাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর মধ্যে একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধ এড়ানোই এখন ইইউর মূল লক্ষ্য। ট্রাম্প যতটা না রাজনীতিবিদ তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায়ী। ব্যবসায় নিজের লাভ ও বিজয়ই তার আরাধ্য। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে তাকে আর ব্যবসা বলা যায় না। রীতিমতো যুদ্ধ। আর বাণিজ্য যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সব পক্ষই হেরে যায়। ইউরোপ থেকে রপ্তানি পণ্যে যদি দশ থেকে বিশ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে এমন পণ্য ইউরোপকে খুঁজে বের করতে হবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য খুব দরকারি ও আকর্ষণীয়। এই কৌশলটি তাদের আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। ইউরোপ হয়তো প্রথম এই কার্ডটি খেলতে চাইবে।
তৃতীয়ত : সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ। প্ল্যাটফর্ম এক্স-এর কর্ণধার ইলন মাস্ক আমেরিকার রাজনীতিতে একজন প্রভাবশালী খেলোয়াড় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইউরোপের অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, ট্রাম্পের প্রচারণায় বিশাল অংকের অর্থ জোগানদাতা মাস্ক নিজস্ব আর্থিক প্রভাব এবং তার ২০ কোটিরও বেশি অনুসারীকে ইউরোপীয় দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। মাস্ক যে ইউরোপীয় রাজনীতিতে জড়িত হতে চান, তার লক্ষণ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জার্মান ফেডারেল নির্বাচনের আগে মাস্ক ডানপন্থি পপুলারিস্ট এএফডির প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেছেন। ইউরোপের নেতাদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, মাস্ক হলেন হিমশৈলের চূড়া মাত্র এবং ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্টর মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসন ও আমেরিকান প্রযুক্তি জায়ান্টদের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের যূথবদ্ধতা আমেরিকার অস্বস্তির কারণ। এই শক্ত বন্ধনের কারণে আমেরিকার ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি প্রায় অকার্যকর। প্রযুক্তি জায়ান্টদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ইউরোসেপ্টিক ভোটার এবং উগ্র ডানপন্থি শক্তির মধ্যে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে ইউনিয়নের মধ্যে সন্দেহ ও অস্বস্তি সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারেন ট্রাম্প।
মিডিয়া জায়ান্টদের একচেটিয়া প্রভাব অর্থনীতি, বাজার ও গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। এই প্ল্যাটফর্মগুলো কীভাবে ইউরোপে ব্যবহার করা হবে তা তদারক ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কঠোর নীতিমালা ও নির্দেশিকা প্রণয়নের কথা ভাবা হচ্ছে। বিষয়টি সত্যি উদ্বেগজনক যে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি কেবল একটি মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে তার বার্তাগুলো ইউরোপীয় ভোটারদের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। যেসব দেশে তিনি নিজে নাগরিক নন সেসব দেশের উগ্র ডান ও চরমপন্থি শক্তিকে সমর্থন ও উসকে দেওয়ার জন্য এক্স প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছেন। ইউরোপে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চায় নিশ্চিত অর্থেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে মার্কিন এই মিডিয়া আধিপত্য। ইলন মাস্ক যে তার পরিকল্পনায় কিছুটা সফল হয়েছেন, তা বোঝা গেল ইইউ পার্লামেন্টের বিতর্কে। সেখানে পপুলারিস্ট ডানপন্থি সদস্যরা তাকে ডিজিটাল ইস্যুতে অগ্রণী এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার একজন প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করেছেন। তারা বলেছেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোনোভাবেই আইনের শাসন বা গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মত প্রকাশের নামে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে অন্যের মতকে ভিউ না দিয়ে, তথ্য-প্রমাণবিহীন নিজের সুবিধাবাদী মতকে ছড়িয়ে দেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য?
সার্বিক বিবেচনায় ইউরোপ শক্ত অবস্থান বেছে নিয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ বৈঠক থেকে উচ্চারিত হয়েছে শক্ত কথা। ট্রাম্পের অবস্থানের জবাবে ইইউ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়ার তাগিদ এসেছে। কথা উঠেছে, আমেরিকাকে পিঠ দেখানোর। এজন্য অন্য মহাদেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো একটি কমন শুল্কনীতি মেনে চলে। দেশগুলো সম্মিলিতভাবে যদি আমেরিকার ওপরও একই হারে উচ্চ শুল্ক ধার্য করে বসে, তবে ট্রাম্প কী করবেন? মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ইইউ সংসদের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে আমেরিকায় ক্ষমতা পরিবর্তনের পরিণতি ও করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে। সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখলাম।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক