শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

বাংলা সাহিত্যের তুখোড় গোয়েন্দারা

আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪২ এএম

বাংলা ভাষায় প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে বিতর্কের বিষয়টি বেশ মজার এবং জটিল। জটিলতা থাকলেও বাংলা সাহিত্যের আছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং দুর্দান্ত কিছু গোয়েন্দা চরিত্র ও কাহিনি। তাদের মধ্য থেকে কিছু চরিত্র নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা চরিত্রের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। যদিও এই ধারার সূচনা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে, তবে বাংলা সাহিত্যে একাধিক জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় গোয়েন্দা চরিত্রের জন্ম হয়েছে, যারা তাদের তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার মাধ্যমে পাঠকদের মুগ্ধ করেছে। বাংলা সাহিত্যের আছে এমন কিছু প্রিয় বাংলা গোয়েন্দার সম্পর্কে, যারা একদিকে যেমন সাহসী ও সৎ, তেমনি রহস্য সমাধানে তাদের বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা, দস্যু বনহুর, কাকাবাবু, তিন গোয়েন্দা, কুয়াশা, মাসুদ রানা ও মিতিন মাসি এই চরিত্রগুলো বাংলার গোয়েন্দা কাহিনিকে করে তুলেছে দারুণ উপভোগ্য।

বক্সী

১৯৩৪ সালে পথের কাঁটাতে নিপাট বাঙালি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী এসে যেন সাহিত্যের পর্দায় নতুন এক ঝলক দেখালেন। ইংরেজি সাহিত্যের শার্লক হোমস যেমন কিংবদন্তি, ঠিক তেমনি বাংলা সাহিত্যের ব্যোমকেশও হয়ে উঠলেন। আজও এমন কিছু পাঠক আছেন, যারা বিশ্বাস করেন কেয়াতলা রোডে ব্যোমকেশ আর সত্যবতীর বাড়ি আছে, আর পাড়ার মোড়ে অজিতের সঙ্গে দেখা হলে তাদের সঙ্গে গল্পের শুরু হয়ে যাবে। শার্লক আর ব্যোমকেশের মিল রয়েছে তাদের তীক্ষèবুদ্ধি ও অপরাধী মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে, তবে ব্যোমকেশের বিশেষত্ব হলো সে কোনো নেশাগ্রস্ত প্রতিভা নয়, বরং একজন মধ্যবিত্ত বাঙালি যে প্রেমে পড়ে, পরিবারকেও তৈরি করে এবং অজিতের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করে। চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত, ব্যোমকেশ ছিল জীবন্ত কিংবদন্তি। তার চেহারা, পাজামা-পাঞ্জাবি বা ধুতি-পাঞ্জাবি সব কিছু মিলিয়ে এক রসবোধসম্পন্ন, তীক্ষèদৃষ্টি যুবক।

ফেলুদা

সত্যজিৎ রায় ফেলুদা তৈরি করেছেন এমন এক গোয়েন্দা চরিত্র, যিনি শুধু বাংলায় নয়, বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। যদিও ব্যোমকেশ বক্সী গোয়েন্দার রাজ্যে প্রথম, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কিন্তু কিছুতেই কম জনপ্রিয় নয়। ফেলুদা পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন, তবে গুলি ছোড়ার ব্যাপারে একটু বিরত; বরং বিশ্লেষণ আর অ্যাবজার্ভেশন ছিল তার আসল শক্তি। ফেলুদার সঙ্গী ছিল তার খুড়তুতো ভাই তোপসে, যে সবসময় পকেটে পেন-পেপার নিয়ে গোয়েন্দাগিরির গল্প লিখে যেত। আর বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলি বা জটায়ু, তিনিও ফেলুদার অভিযানের এক অবিচ্ছেদ্য সাথি। এই গোয়েন্দার কাহিনিতে ছিল মগলাল মেঘরাজ, সিধু জ্যাঠা আর গোয়েন্দা কাহিনিগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা অদ্ভুত চরিত্র। ফেলুদা কিন্তু শারীরিক শক্তি বা অস্ত্র ব্যবহার করতেন না। শার্লক হোমসের মতো রহস্য সমাধান করতে তার অলৌকিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল। আর একটা কথা, চারমিনার সিগারেট এটা ছিল তার ট্রেডমার্ক। ১৯৬৫ সালে, ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ গল্পটি প্রকাশিত হলে বাঙালি সাহিত্য থেকে শুরু করে পুরো উপমহাদেশে একটা দারুণ হইচই পড়ে যায়। ফেলুদার প্রথম গল্পটা সন্দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছিল, আর এরপর থেকে ৩৫টি গল্প এবং চারটি অসম্পূর্ণ কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে।

দস্যু বনহুর

রোমেনা আফাজের সৃষ্ট একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রিয় চরিত্র দস্যু বনহুর। দস্যু বনহুর বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত গোয়েন্দা চরিত্র। তার প্রথম কাহিনি থেকে আজ পর্যন্ত ১৩৬টি গোয়েন্দা কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। দস্যু বনহুরের গল্প শুরু হয় এক রোমাঞ্চকর ঘটনার মাধ্যমে। ছোটবেলায় এক নৌ-দুর্ঘটনায় চৌধুরী বাড়ির ছেলে মনির হারিয়ে যায়। এই ঘটনাটি বদলে দেয় তার জীবন। সেখান থেকেই দস্যু সর্দার কালু খাঁ তাকে উদ্ধার করে এবং তাকে দস্যু বনহুর হিসেবে গড়ে তোলেন। কালু খাঁ বনহুরকে গরিবের বন্ধু এবং চোরাকারবারিদের শত্রু হিসেবে গড়ে তোলে। তার মতো একজন সাহসী এবং ন্যায়পরায়ণ চরিত্র পায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষরা এক নায়কের আদর্শ।

দস্যু বনহুর তার জীবনে বহু সংকট এবং বিপদ সামলেছেন, সব সময় তিনি সঠিক পথে চলতে চেয়েছেন এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তার চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার নির্ভীক মনোভাব, সাহসিকতা এবং সততা। তিনি গরিবের জন্য একজন পূজনীয় নায়ক এবং অপরদিকে চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসীদের কাছে তিনি ছিলেন একজন জমদূত একজন নির্দয় শত্রু। দস্যু বনহুরের শত্রুদের কাছে তার নায়কোচিত শক্তি ভীতির কারণ হয়ে উঠত, কারণ তিনি শুধু শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন না, তার মেধা এবং কৌশলও ছিল অতুলনীয়। দস্যু বনহুরের কাহিনিগুলো প্রায়ই অ্যাডভেঞ্চার এবং মিশনভিত্তিক থাকে, যেখানে তিনি নানান জটিল এবং রহস্যময় পরিস্থিতিতে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করেন। সিরিজের স্লোগানটি ‘সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক দস্যু বনহুর’ এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা প্রতিটি গল্পে বনহুরের ন্যায়পরায়ণ চরিত্রের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

কাকাবাবু

তিনি রাজারায় চৌধুরী নামেই পরিচিত, কিন্তু সবার কাছে কাকাবাবু নামেই খ্যাত। সরকারি চাকরি করেন, তবে সবচেয়ে বড় কাজ তার রহস্য অনুসন্ধান। একটা পা ভাঙা, আর সেই স্ক্রাচ হাতে হাঁটেন তিনি, তবে হাল ছাড়েন না। আর কেমন জানি ইচ্ছা করেই, তার লেখক মনে হয় তার দুই হাতে অনেক বেশি শক্তি দিয়ে দিয়েছেন, যাতে এক পা খোঁড়া থাকলেও তার বিশ্লেষণী শক্তি যেন একেবারে অটুট থাকে। কাকাবাবু অবিবাহিত নির্বিঘ্নে রহস্যের খোঁজে ছুটে যান। আর তার অবিরাম অভিযানে সন্তু, অর্থাৎ সুনন্দ, সঙ্গী হয় সবসময়। মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গী জোজো, যেটা মনে হতে পারে একটু গুলবাজ টাইপের, কিন্তু আসলে একেবারে সহায়ক। আর তাদের চারপাশে সবসময় দেখা পাওয়া যায়, দেবলীনা দত্ত, শৈবাল দত্ত, রিনি, আর নরেন্দ্র ভার্মার। কাকাবাবুর প্রথম কাহিনি ‘ভয়ংকর সুন্দর’ নামে ১৯৭৯ সালে আনন্দমেলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর থেকে ২০১২ পর্যন্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মোট ৩৬টি কাকাবাবুর কাহিনি লিখেছেন।

তিন গোয়েন্দা

রবার্ট আর্থারের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ সিরিজের অনুপ্রেরণায় বাঙালি সাহিত্যে জন্ম নিল ‘তিন গোয়েন্দা’ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেল যে, লেখক রকিব হাসান একটানা ১৬০টি বই লিখে ফেললেন। আর তারপর শামসুদ্দিন নওয়াবও এই সিরিজে কিছু বইযোগ করে দিলেন। তবে একে ‘রহস্য কাহিনি’ বলা যাবে না, একেবারে অ্যাডভেঞ্চার আর মজার মিশ্রণ। তিন গোয়েন্দা হলেন কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড আর মুসা আমান। কিশোর পাশা, একমাত্র বাঙালি, যিনি ছোটবেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারিয়ে, বড় হন তার চাচি মেরি আর চাচা রাশেদ পাশার কাছে। আর আমেরিকান রবিন মিলফোর্ড তো বইয়ের ম্যানিয়া, বইপাগল বলতে যা বোঝায়। আর মুসা আমান, যে দেখতে পেশিশক্তিওয়ালা, তার কালো ত্বক আর শক্তি একেবারে ট্রাম্পকার্ড। তিনি আমেরিকান-আফ্রিকান। তাদের হেডকোয়ার্টার পুরনো একটি মোবাইল হোম স্যালভেজ ইয়ার্ডে, আর এখান থেকেই তারা পুরো অপারেশন চালায়, যেমন গোপন মিশন, রহস্য উদঘাটন, এমনকি হলিউড মুভি পরিচালক ডেভিড ক্রিস্টোফারের সঙ্গে কিছু গোপন মুভি ক্লু রিলেটেড কেসও সলভ করে।

কুয়াশা

কাজী মোতাহার হোসেনের সুযোগ্য পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট চরিত্র কুয়াশা প্রথমে পাঠকদের সামনে আসে ১৯৬৫ সালে, যখন তার প্রথম বই ‘কুয়াশা-১’ প্রকাশিত হয়। কুয়াশা পেশায় একজন বিজ্ঞানী, যিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞানের সাধনায় উৎসর্গ করেছেন। তার জন্মস্থান কুষ্টিয়া। মাত্র ১৭ বছর বয়সে, জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল স্যান্ডেনবার্গের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ ছাড়েন এবং ১৫ বছর পর দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি গোপনে গবেষণা চালান, মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে। কুয়াশা নিজের কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হলে, কখনো কখনো অবৈধ পথও বেছে নিতে দ্বিধা করেন না, যার ফলে আইনের চোখে তিনি একজন ফেরারি আসামি। তার একমাত্র বোনের নাম মহুয়া। দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে কুয়াশা সিরিজের প্রকাশনা বন্ধ রয়েছে।

মাসুদ রানা

তরুণ মাসুদ রানা বাংলাদেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট, যার সাংকেতিক নাম এম আর নাইন। তার পেশা গুপ্তচরবৃত্তি এবং তিনি বিশ্বখ্যাত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড সিরিজের ছায়ায় তৈরি একটি চরিত্র। মাসুদ রানার পরিচালিত সংস্থার নাম ‘রানা এজেন্সি’। তার বাবা জাস্টিস ইমতিয়াজ চৌধুরী। মাসুদ রানা পৃথিবী এবং তার বন্ধুদের বিভিন্ন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে মিশনে নামে এবং তার এই চরিত্রের স্রষ্টা আনোয়ার হোসেনের মতে, ‘সে টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।’ মাসুদ রানার প্রথম সিরিজের বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। এরপর থেকে, বর্তমানে পর্যন্ত, মাসুদ রানা নিয়ে প্রায় চারশ বই লেখা হয়েছে। মাসুদ রানা সিরিজের প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে আছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান, সোহেল, বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী, গিলটি মিয়া, সোহানা এবং রূপা যারা এই সিরিজের প্রাণ।

মিতিন মাসি

মিতিন মাসি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সৃষ্টি, বাংলা সাহিত্যের নারী গোয়েন্দাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও নারী গোয়েন্দার সংখ্যা বাংলা সাহিত্যে কম, মিতিন মাসি সেই ঘাটতি কিছুটা হলেও পূর্ণ করেছেন। এক আধুনিক, স্বশিক্ষিত এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান মহিলা গোয়েন্দা, যিনি তার ভাগ্নি টুপুর-কে নিয়ে নানা রহস্যের সমাধান করেন। মিতিন মাসির কাহিনিগুলো বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মিতিন মাসির আসল নাম প্রবাল গুপ্তা। তিনি একজন আত্মনির্ভরশীল, স্পষ্টবাদী এবং সাহসী নারী গোয়েন্দা। তার কাহিনিগুলো সাধারণত শহুরে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের চারপাশে আবর্তিত হয়। মিতিন মাসির গোয়েন্দাগিরির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং বিশ্লেষণী। তা ছাড়া তিনি আত্মরক্ষার জন্য কারাতে জানেন, যা তাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। মিতিন মাসির চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য সংযোজন, যেখানে নারীর বুদ্ধিমত্তা, স্বাবলম্বিতা এবং আত্মবিশ্বাস প্রদর্শিত হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের কাছে তিনি একটি অনুপ্রেরণা।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত