শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

৫০ বিঘা এলাকা জুড়ে মাটিচাপা রাজপ্রাসাদ!

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৪৬ এএম

যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের সালতাপীরের ঢিবিতে খনন শুরু করেছে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর। গত ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া প্রাথমিক খননেই একটি রাজপ্রাসাদের অস্তিত্বের অপেক্ষায় রয়েছেন প্রতœ বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনুমান ৫০ বিঘা ভূমির চারপাশে পরিখাবেষ্টিত রাজপ্রাসাদ চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে। এ সীমানার মধ্যে শান বাঁধানো পুকুর ও সীমানা প্রাচীরের অস্তিত্ব এখন স্পষ্ট।

প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, পুরো সীমানার মাঝ বরাবর একটি উঁচু ঢিবি, যেটাকে স্থানীয়রা সালতাপীরের ঢিবি বা বুড়িমার থান বলে থাকে, সেটি ১০ দিন খনন করে মসজিদ আকৃতির একটি স্থাপনার সন্ধান মিলেছে। এ স্থাপনা সামনে রেখে স্থানটি মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন বলে অনুমান করছেন গবেষক দলের প্রধান প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন। তিনি বলেন, প্রাথমিক খননে দুই স্তরবিশিষ্ট দেয়াল দেখা গেছে, যা এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনার ইতিহাসে নতুনত্ব এনেছে। সব মিলিয়ে যশোরের ইতিহাস নতুন করে গবেষণা ও ভাবার সময় এসেছে।

যশোর-মাগুরা সড়কের রাজাপুর বাজার থেকে পশ্চিমের পাকা রাস্তা ধরে ৩ কিলোমিটার গেলেই ফুলবাড়ী পীর সিদ্দিন আউলিয়া মাজার ও স্কুল। সেখান থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই ওসমানপুর গ্রাম। এ গ্রাম লাগোয়া সালতা মাঠ। চারদিকে ধানক্ষেত, ফসলি জমির মাঝে প্রায় ৫০ বিঘা উঁচু ভূমি। কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও ফলদ, কোথাও বনজ গাছের বাগান। চারপাশের একই আকৃতির ধানক্ষেত সুস্পষ্ট পরিখার প্রমাণ দিচ্ছে। উঁচু ভূমির মধ্যে ঘন জঙ্গলবেষ্টিত সবচেয়ে উঁচু ভূমিই সালতাপীরের ঢিবি। স্থানীয়রা যাকে বুড়িমার থান বা ‘বুড়োমার দরগা’ বলে থাকে।

স্থানীয়দের বিশ্বাস, বুড়িমার থান ও দেড় কিলোমিটার দূরের পর ফুলবাড়ী বাজারের দীঘি ও হজরত সিদ্দিন আউলিয়া (র.)-এর মাজার একই সূত্রে গাথা। সিদ্দিন আউলিয়া ওই বুড়ি মায়ের ছেলে। বাগেরহাটের পীর আউলিয়া খানজাহান আলী (র.) এই এলাকায় যখন এসেছিলেন, হজরত সিদ্দিন (র.) সেই সময় এসেছিলেন। জিন-পরীরা এখানকার দীঘি খনন করে। এ বিশ্বাস থেকেই জঙ্গলঘেরা ঢিবিতে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে, মানত করে, ধূপ-ধুনা দেয়, মুরগি-খাসি ছেড়ে দিয়ে মানত শোধও করে স্থানীয়রা। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষ গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা সেখানে মিলিত হয়।

ঢিবিসংলগ্ন উঁচু ভিটার কয়েক বিঘা জমির মালিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আকবার আলী খান। তিনি জানান, নানাবাড়ির সম্পত্তির ওয়ারিশ সূত্রে এ জমির মালিক তিনি। এ স্থান ভয়ের জায়গা ছিল। মানত-পূজা, রান্না সবই হয় এ দরগায়। বালামুসিবত এলে অনেকেই রাত জেগে জিকির-আসগার করে। জমিতে গাছ লাগাতে গিয়ে ইটের টুকরো পান। কয়েক বছর আগে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি সরিয়ে ঘরের ভিত্তি বা দেয়ালের মতো কিছু পেয়েছিলেন, লোকে নিষেধ করায় আর খনন করেননি।

তার জ্ঞাতিভাই ষাটোর্ধ্ব কৃষক আবদুর রাজ্জাক জানান, তিনি এটি মসজিদ কি না দেখার জন্য গড়ের পশ্চিম দিকে লম্বা করে খননকাজ করেছিলেন, স্থানীয়রা তাকে বিভিন্ন ভয় দেখায় এবং তাদের চাপে তিনি খনন বন্ধ করেন। ওই গ্রামের ৬৩ বছরের আক্তারুজ্জামান খানও একই রকম কথা শোনান। তারা কেউ এর ইতিহাস জানেন না, পূর্বপুরুষের কাছে বংশানুক্রমে বিভিন্ন কথা ও কাহিনি শুনেছেন আর মানুষকে বিশ্বাস ও ভক্তি করতে দেখেছেন। হিন্দু-মুসলিম সবাই এখানে আসেন, সম্মান করেন।

যশোর জেলার চতুর্থ প্রতœঢিবি হিসেবে সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের এ সালতা গ্রামের সালতাপীরের ঢিবিতে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষামূলক প্রতাত্ত্বিক খননকাজ শুরু হয়েছে। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক লাভলী ইয়াসমিনের নেতৃত্বে গঠিত আট সদস্যবিশিষ্ট অভিজ্ঞ টিম খননকাজ পরিচালনা শেষে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত নমুনা নিয়ে গবেষণা করবেন। প্রতœতত্ত্ব বিভাগের নিয়মানুসারে গবেষণা শেষে এটা কোন আমলের স্থাপনা, কোন সভ্যতা বা যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত সেসব বিষয় অনুসন্ধান ও গবেষণার ফল জানাবেন। সরকারিভাবে খননকাজ হচ্ছে বলে প্রতিদিন সালতা ওসমানপুরসহ আশপাশের গ্রাম থেকে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু-যুবক স্থানটিতে ভিড় করছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে যশোর সদর উপজেলায় পরিচালিত প্রতœতাত্ত্বিক জরিপের সময় এই এলাকায় মাঝারি আকৃতির উচ্চতা বিশিষ্ট ঢিবিটি শনাক্ত হয় এবং প্রাথমিক ৫ থেকে ১০ দিনের খননকাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬৮ সালের প্রতœসম্পদ আইন অনুযায়ী এর প্রতœতাত্ত্বিক গুরুত্ব পরিলক্ষিত হওয়ায় ঢিবিটিকে জরিপ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর।

প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন জানান, প্রাথমিকভাবে ঢিবির নিচে আদি ঐতিহাসিক থেকে আদি মধ্যযুগের বিলুপ্ত সাংস্কৃতিক নিদর্শন লুকায়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটা মুসলিম সভ্যতার একটি নিদর্শন। এর দুই স্তরবিশিষ্ট দেয়াল এতদঅঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনার সঙ্গে নতুনত্ব এনেছে। সালতাপীরের ঢিবিটি অন্তত ৫০ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে, এর কেন্দ্রস্থলে মূল ঢিবি, চারপাশে পরিখাবেষ্টিত, রয়েছে পুকুর ও শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের চিহ্ন এবং মূল ঢিবিটির অন্তত ৬০ ফুট দূরত্বে চারদিকে প্রাচীরের চিহ্ন।

তিনি মনে করেন, এটা ছিল কোনো শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল, পুরাতন কোনো সভ্যতার অংশ। তবে গবেষণা শেষে এর উত্তর মিলবে জানিয়ে তিনি নিশ্চিত করেন, স্থাপনাটি মুসলিমদের। যেহেতু ফুলবাড়ী বাজারের দীঘিটি ও পাশে মাজার রয়েছে, হতে পারে এই কেন্দ্রের রাজত্ব এর চারপাশে বিস্তৃত ছিল, তবে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। আশপাশে বারোবাজারের বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনা ও মুসলিম সভ্যতা, অদূরের দীঘি ও পীর হজরত সিদ্দিন আউলিয়া (র.)-এর মাজার এবং খলিফাবাদ বা বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ-দীঘির সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না, তা অধিদপ্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে। এখান থেকে প্রাপ্ত প্রতœতাত্ত্বিক বস্তু, বিলুপ্ত স্থাপত্যকাঠামো পুনরুদ্ধার, স্তরবিন্যাস সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে আপেক্ষিক সময়কাল নির্ধারণের পাশাপাশি ঢিবির পরম সময়কাল নির্ধারণের লক্ষ্যে প্রতœস্থান থেকে কার্বন-১৪ টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, গবেষকরা দাবি করেন যশোরের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়, কিন্তু মণিরামপুরের দমদম পীরের ঢিবিসহ জেলায় হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতার অনেক নিদর্শন রয়েছে। ফলে নতুন করে গবেষণা ও ভাবার সময়ও এসেছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত