মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

ছেলে হারিয়ে এখন ভিটে হারানোর শঙ্কায় পরিবার

আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪১ এএম

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার মঠবাড়ী ইউনিয়নের অলহরী জয়দা গ্রামের বাসিন্দা নির্মাণশ্রমিক মোতাহার আলীর ছেলে মো. কাউছার। কাউছারও নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। অভাবের কারণে গত ১৬ মাস আগে সৌদি আরবে যান কাউছার। সেখানে দাম্মাম শহরে সাক্কো নামের একটি কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। কাউছার ৭ লাখ টাকায় সৌদি আরবে যান। এর মধ্যে ৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে দাদনে, বাকি আরও ২ লাখ টাকা নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে। দাদনের প্রতি লাখ টাকার জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা লাভ দিতে হয়। দাদনের টাকা দিতে গিয়ে দুটি এনজিও থেকে আরও ২ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন কাউছারের পরিবার। তিনি প্রতি মাসে বাড়িতে ৫০-৫৫ হাজার টাকা পাঠালে তার পুরোটাই সুদ দিয়ে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এখন সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে।

গত ৩ মার্চ সৌদি আরবে এক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কাউছারের। তার মৃত্যুতে দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছেন স্বজনরা। ভিটাবাড়ি হারানোর শঙ্কায় পড়েছে পরিবারটি। একই সঙ্গে কাউছারের লাশ আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সেই শঙ্কায় দিন গুনছেন কাউছারের স্বজনরা।

সৌদি আরবে কাউছারের সহকর্মীদের বরাতে স্বজনরা জানান, ৩ মার্চ দাম্মাম শহরের একটি এলাকায় গ্যাস সঞ্চালন লাইনের কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় কাউছার মারা যান। তার মৃত্যুর খবরটি দেশে পৌঁছায় প্রতিবেশী এক প্রবাসীর মাধ্যমে। কাউছারের মৃত্যুতে শুধু পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমারই হয়নি, তার বাবার ওপর চেপে বসেছে ঋণের বোঝা। তিন বছর আগে কাউছারের সঙ্গে বিয়ে হয় জেসমিন আক্তারের। তাদের ঘরে কারিমাতুন জান্নাত রাফা নামের ১৫ মাসের এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান রয়েছে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে রেখে কাউছার বিদেশ যাওয়ার আট দিনের মাথায় রাফার জন্ম হয়। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পড়া জেসমিন স্বামী হারিয়ে কন্যা রাফাকে নিয়ে পড়েছেন অতুল পাথারে।

জেসমিন বলেন, ‘তিন বছর হয়েছে আমাদের বিয়ের। এক বছরের মতো আমার কাছে ছিল। তারপরই বিদেশ, বিদেশ করছিল। আমি অনেক না করছি। ঋণ কইরা বিদেশ যাওয়ার দরকার নাই। কারণ আমরা গরিব মানুষ, ঋণ কইরা বিদেশ গেলে কী আপদ-বিপদ হয়। তোমার বিদেশ যাওয়ার দরকার নাই, তাও না মাইনা গেছে। পরে আমি মাইনা নিছি। কইলাম আঙ্গর ভালো লাইগাই তো গেছে। আমার ঝির (মেয়ের) ভবিষ্যতের লাইগাই তো আল্লাহ পাঠাইছে। এহন তো এই তৌফিকও নাই বাবুরে ১০ টেহার মজা কিইনা দিমু। বাবুরে তো কুলে লওয়ার ভাগ্যও হইল না তার।’

কাউছারের প্রতিবেশী আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মোতাহারের বড় ছেলে কাউছার। বিদেশ যাওয়ার আগে বাবা-ছেলে একসঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করে মোটামুটি ভালোই চলছিল। আরেকটু ভালোভাবে চলার জন্য পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছিল। হঠাৎ শুনি এই খবর, এখন তো এক হচ্ছে, ছেলের মরদেহ পাচ্ছে না, আরেক হচ্ছে মানুষের ঋণ, আরেক হচ্ছে কাজ করতে পারছে না। এতগুলা মানুষের খানার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। এগুলো নিয়া তার মাথা একটু অন্যরকমই হয়ে গেছে।’

কাউছারের চাচা আতাহার আলী বলেন, ‘আমাদের পাশের বাড়ির এক চাচাতো ভাই বিদেশ থাকে। তার মাধ্যমে আমরা প্রথম কাউছারের মারা যাওয়ার খবর পাই। সে মারা গেছে কয়েক দিন হলো, অথচ এখনো তার চেহারাটাও দেখতে পেলাম না। কী হাল অবস্থায় আছে তাও জানি না। লাশটা আইনা দিব, সরকারের কাছে আমাদের আবেদন এইডাই। আমার ভাইডা অসুস্থ হইয়া পড়ছে। অনেক ঋণ-ফিন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।’

কাউছারের বাবা মোতাহার আলী বলেন, ‘আমার সব স্বপ্ন শেষ। এত কষ্ট, ঋণ-কর্যা আমি যার জন্য করলাম তাকেই আল্লাহ নিয়ে নিল। আমি এখন কী করব। একদিকে ঋণের চিন্তা, অন্যদিকে ছেলের বউ, নাতিন এবং আমার পরিবারের বিশাল ব্যয় কীভাবে মেটাব সেই চিন্তা। দেশে মরলে তো ছেলের মরদেহ দেখার ভাগ্যটা অন্তত হইত। এখন কোনোদিন সেই ভাগ্যও হবে না, আল্লাহই ভালো জানেন।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত