সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

বাধা ডিঙাতেই পারছে না কক্সবাজার বিমানবন্দর

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ০২:০০ এএম

সমুদ্রের নীলাভ জলরাশি ভেদ করে কক্সবাজারে অবতরণ করবে ‘এ-৩৮০’-এর মতো বিশালাকৃতির উড়োজাহাজ। বিমানবন্দরটি রিজিওনাল হাব হিসেবে গড়ে তোলাই মূল উদ্দেশ্য। প্রথমবারের মতো সমুদ্রের ভেতরে ব্লক তৈরি করে রানওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। লম্বা সময় ধরে কাজ হলেও পদে পদে আসা বাধা ডিঙাতেই পারছে না প্রকল্পটি। এজন্য প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা অনেকটা অসহায়। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরের বড় বাধা ৩৩০০ পরিবার। নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। এখনো ৪ দশমিক ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে আজ শুক্রবার দুপুরে বিমানবন্দরটি পরিদর্শনে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিমানবন্দরের সর্বশেষ পরিস্থিতি হালনাগাদ জানাবেন প্রধান উপদেষ্টাকে। এজন্য বেবিচক সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। ইতিমধ্যে সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে, যা প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করবে বেবিচক কর্তৃপক্ষ।

বেবিচক সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউসূস আজ দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দর পরিদর্শন করবেন। দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করবেন। বিমানবন্দরের উন্নয়নের সর্বশেষ হালনাগাদ তাকে অবহিত করা হবে। এজন্য বেবিচক লিখিত সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করবেন।

বেবিচকের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দর দিয়ে গড়ে ২৫-৩০টি যাত্রীবাহী ও ৬-১০টি কার্গো বিমান উড্ডয়ন অবতরণ করছে। যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরটি রিজওয়াল হাব হিসেবে গড়ে তুলতে দিবারাত্রি পুনঃলোডেট বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ নিশ্চিতকরণের জন্য ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে নানা বাধা এসেছে। বিশেষ করে বিমানবন্দরের আশপাশে বসতভিটা থাকায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিমানবন্দরের অনুকূলে বন্দোবস্তকৃত ভূমি হতে পুরনো ঝিনুক মার্কেটে ১৪টি দোকান ও বস্তিসহ ৪২ পরিবার অপসারণ করা যাচ্ছে না। বিমানবন্দরের অনুকূলে ঝিনুক মার্কেট এলাকায় অবশিষ্ট ০.০৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না। বিমানবন্দরের ৪.৫৬ একর জমিতে স্থিত গণপূর্ত ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের স্থাপনা অপসারণ না হওয়ায় জমিটি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের অপারেশনাল এলাকার অভ্যন্তরে সেনাবাহিনী কর্তৃক দাবিকৃত ৬.৫৭ একর জমির মধ্যে ৪.৬৪ একর ভূমিতে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের বাধা প্রধান করায় ফায়ার স্টেশন ভবন, ড্রেনেজ, পেরিফেরিয়াল রোড ও সিকিউরিটি বাউন্ডারি ওয়াল ইত্যাদি নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিমানবন্দরের অনুকূলে ৬৮২ একর জমির মধ্যে ৯৭ একর জমিতে ৩ হাজার ৩০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সমুদ্রে রানওয়ের কাজ ৯৬ ভাগ শেষ হয়েছে। বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে ৯৪ ভাগ। সমুদ্রে ২২০০ ফুট দৈর্ঘ্য প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ লাইট স্থাপনসহ মেইনটেনেন্স স্ট্রিল ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে ৮৩ ভাগ। রানওয়ের চারপাশে নিরাপত্তা সীমানা প্রাচীর ও নিরাপত্তা টহল রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ২৬ ভাগ। রানওয়ের চারপাশে ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণ করা হয়েছে ৫৫ ভাগ। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যাত্রী চলাচল বৃদ্ধি পাবে। কার্গো ও যাত্রী বিমানের ফ্লাইট বেড়ে যাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের জিডিপি বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য হ্রাস পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখবে। এসব বিষয় প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হবে।

বেবিচক সূত্র জানায়, প্রায় দশ বছর আগে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নতি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বসতভিটা উচ্ছেদ-সংক্রান্ত জটিলতায় সময় দীর্ঘ হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেও দ্বিতীয় পর্যায়ের অত্যাধুনিক রানওয়ে সম্প্রসারণের প্রকল্প নামে নেওয়া হয়। আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আকাশপথে দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশনা পেয়ে বেবিচক কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। বিমানবন্দরের বর্তমান ৯ হাজার ফুট দীর্ঘ রানওয়েকে মহেশখালী চ্যানেলের দিকে আরও ১ হাজার ৭০০ ফিট সম্প্রসারিত করে ১০ হাজার ৭০০ ফিটে উন্নীত করা হয়। সম্প্রসারিত হতে যাওয়া ১৭০০ ফিট রানওয়ের ১৩০০ ফিটই থাকবে সাগরের পানির মধ্যে। দেশে এই প্রথমবারের মতো সমুদ্রের ভেতরে ব্লক তৈরি করে রানওয়ে সম্প্রসারিত করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, কক্সবাজার সমুদ্রতীর ঘেঁষে অত্যাধুনিক এজিএল সিস্টেম তৈরি করা হবে, যা রাতে অন্ধকারে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় দেখা দেবে অনন্য এক নৈসর্গিক দৃশ্য। মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলীতে সাজানো হয়েছে গোটা এয়ারপোর্টের ড্রয়িং ডিজাইন। এয়ার ফিল্ড লাইটিং সিস্টেম, সমুদ্রের জলাবদ্ধতা রক্ষা, সমুদ্র পুনরুদ্ধার, নমনীয় ফুটপাত, সমুদ্রের যথাযথ পদ্ধতিতে আলোক ব্যবস্থার মতো দৃষ্টিনন্দন বস্তুর সমাহার থাকছে এখানে। মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলীতে সাজানো হয়েছে গোটা বিমানবন্দরের ড্রয়িং ডিজাইন। সমুদ্র তীরবর্তী রানওয়েতে ওঠানামা করবে পৃথিবীর সব বিশালাকৃতির উড়োজাহাজ।

তিনি আরও বলেন, গত বছর প্রকল্পের রানওয়ে নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধীরগতিতে চলছে রানওয়ে নির্মাণ, রানওয়ের স্ট্রেনথেনিং বাড়ানো, ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনদের পুনর্বাসনে পাশের বাকখালী আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য সেতু নির্মাণসহ বেশ কিছু কাজ। প্রকল্প এলাকার কিছু জমি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার এখনো সমাধান হয়নি। রাত্রিকালীন ফ্লাইট চালু করতে না পেরে বিপুল রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে সরকার। প্রকল্পটি সময়মতো শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর কক্সবাজার হবে চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ১০ হাজার ৫০০ ফিট। কক্সবাজারের কাজ শেষ হলে ঢাকা হয়ে যাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম রানওয়ে। সমুদ্রে যতটুকু রানওয়ে যাবে সেখানে পানিতে ব্লক, জিওটিউবসহ অন্যান্যা সামগ্রী ব্যবহার করে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। প্রথমে আমরা চেয়েছিলাম রানওয়েটি শহরের দিকে সম্প্রাসারণ করা যায় কি না। তাছাড়া শহরের দিকে করলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা বিমানবন্দরের দিকে চলে আসবে। অনেকেই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। পরে সমুদের দিকে চূড়ান্ত করা হয়।

বেবিচকের প্রকৌশলী বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৪৭-৪০০ ও এয়ারবাসের ৩৮০-এর মতো উড়োজাহাজ সহজেই ওঠানামা করতে পারবে। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৭৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেবিচক। এটি আামাদের স্বপ্নের প্রকল্প। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এই নিয়ে কাজ করছি। নির্মাণকাজে তিন শতাধিক শ্রমিক যুক্ত। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে। থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থাই ওখানে আছে। আশা করছি প্রতিবন্ধকতা শেষ করে দ্রুত কাজ শেষ করা যাবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত