ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম, খুন, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এমন নানা ঘটনা বেশ আলোচনায় ছিল। তার মধ্যে ২০১৮ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহতের ঘটনাটি দেশ জুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। বিশেষ করে তিনি নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তে মেয়ের সঙ্গে আলাপনের একটি অডিও টেপ প্রকাশ্যে আসার পরই ওই মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়েছিল। মানুষজনের মনে সারাক্ষণ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল একটি বাক্য ‘আব্বু, তুমি কানতেছ যে...?’
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে এই আলোচিত ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ‘আমলনামা’ নামের একটি ওয়েব ফিল্ম মুক্তি পেয়েছে। এটি পরিচালনা করেছেন নির্মাতা রায়হান রাফী। তবে সিনেমাটি ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত একরামুলের স্ত্রী আয়েশা বেগমের দাবি, আমলনামা দেখে একশ্রেণির দর্শক বছর ছয়েক আগের সেই ঘটনার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। তারা তার পরিবারকে দোষারোপ করছেন!
একরামুলের স্ত্রী আয়েশা বেগমের অভিযোগ
গত রবিবার সকালে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্টে সেসব অবতারণা করেছেন একরামুলের স্ত্রী আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, ‘(পরিচালক) রায়হান রাফী একটি কাল্পনিক মুভি বানিয়েছে, এই মুভিতে রায়হান রাফী নিজেই প্রথমে স্বীকার করেন যে, মুভিটি কোনো সত্যি ঘটনার সঙ্গে মিল নেই, তিনি তার মনমতো করে কাল্পনিকভাবে এই মুভি বানিয়েছেন। আর আপনারা আজ এই মুভি দেখে আমাদের দোষারোপ ও লজ্জিত করছেন। আপনারা এই মুভিটা আমার স্বামীর ঘটনা বলে অপপ্রচার করছেন, আমার স্বামী কোনো ধরনের মাদকদ্রব্যের সঙ্গে জড়িত ছিল না। আমার স্বামীকে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে এবং নির্মমভাবে হত্যা করেছে।’
‘আমলনামা নির্মিত হয়েছে সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে’ মুক্তির আগে এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন সিনেমাটির সংশ্লিষ্টরা। নির্মাতা রায়হান রাফী বলেছিলেন, ‘আমরা একটা সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণা নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এটা মূলত ফিকশন। আমরা ঘটনার ইনার ফিলিংটা (অন্তর্নিহিত মনোভাব) ধরার চেষ্টা করেছি। এমন ঘটনা অনেক হয়েছে, দর্শকরা সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন।’
এদিকে, অনেকে আমলনামা সিনেমাটির গল্পের সঙ্গে সত্যিকার ঘটনা মিলিয়ে নিহত একরামুলের পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন আয়েশা বেগম। ফলে নির্মাতা রাফীকে বিষয়টি নিয়ে আরও স্পষ্টভাবে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ফেসবুক পোস্টে আয়েশা বেগম বলেন, ‘‘আজ আপনারা এই মুভি দেখে আমার স্বামীর আসল ঘটনা বলে উল্লেখ করছেন। রায়হান রাফী যদি বলে যে এই মুভি একরামুল হকের সত্যি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করতে বাধ্য হব। আর আমি রায়হান রাফীকে বলব, ‘এই মুভিটি একরামুল হকের আসল ঘটনার সঙ্গে কোনো মিল নেই’ এই কথাটা সবার সামনে বলার জন্য অনুরোধ করছি।’’এদিকে, আয়েশা বেগমের পোস্টে আলোচনায় এসেছে দৈনিক প্রথম আলোর একটি ফটোকার্ড, যেটির শিরোনাম ছিল ‘‘অনেকে বলছেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়েই ‘আমলনামা’।’’ এ বিষয়ে আয়েশা বেগমের ভাষ্য, ‘‘প্রথম আলো এই ঘটনাকে একরামুল হকের আসল ঘটনা বলে প্রচার করেছে, এই মুহূর্তে আমাকে ও আমার দুই মেয়েকে জাতির সামনে অপমান, লজ্জিত ও দোষারোপ করছেন। আর পুরো জাতি জানে আমার স্বামী কোনো রকম মাদকদ্রব্য ও অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে আজ মাদকের বিরোধিতা করেছিল তাই খুনিরা আমার স্বামীকে অন্যায়ভাবে ও নাটকীয়ভাবে হত্যা করে। আর আমি প্রথম আলোকে বলব তারা যা প্রচার করেছে তা ভুলবশত করেছে, আর যদি তারা তা স্বীকার না করে তাহলে আমি ও আমার দুই মেয়ে মিলে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করতে বাধ্য হব। আর আমি প্রথম আলোকে অনুরোধ করছি যে, অতি শিগগিরই এই ঘটনাটি ‘একরামুল হকের ঘটনার সঙ্গে কোনো মিল নেই’ এই কথাটি সবার সামনে বলার জন্য।’’
যা বলছেন রায়হান রাফী
আয়েশা বেগমের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য মুখ খুলেছেন নির্মাতা রায়হান রাফীও। রবিবার (১৬ মার্চ) সামাজিকমাধ্যমের এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমলনামা’ কোনো নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মাণ নয়, এটা সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি। ‘আমলনামা’ অনেকগুলো সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত একটি ফিকশন। প্রত্যেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ এই সিনেমা।
প্রসঙ্গত, সিনেমাটির চিত্রনাট্য করেছেন রায়হান রাফী ও এসএম নজরুল ইসলাম। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, সারিকা সাবরিন, তমা মির্জা, কামরুজ্জামান কামু, গাজী রাকায়েত, গীতশ্রী চৌধুরী, হাসনাত রিপন, জান্নাতুল মাওয়া ঝিলিক, এ কে আজাদ সেতু, ইনায়া আর্যা প্রমুখ।