কুমিল্লার মুরাদনগরে ছয় বছরের শিশুকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী (গ্রাম্য মাতব্বর) নিপীড়নের শিকার শিশুটির বাড়িতেই বসায় সালিশি বৈঠক। সেখানে যার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সেই বাবুল মিয়াকে (৫০) জুতাপেটা এবং ৫ হাজার টাকা ‘জরিমানা’ করা হয়। ‘জরিমানা’র সেই টাকা শিশুটির পরিবারের সদস্যদের জোর করে হাতে ধরিয়ে দেন মাতব্বররা। শুধু তাই নয়, সালিশে শিশুটির পরিবারকে জানানো হয়, মাতব্বরদের সিদ্ধান্ত না মেনে থানায় অভিযোগ করলে ছাড়তে হবে বসতভিটা। ঘটনাটি ঘটেছে মুরাদনগর উপজেলা সদর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। বাবুল মিয়া একই গ্রামের আবদুল বারেকের ছেলে।
কুমিল্লার এই ঘটনাটি ছাড়াও ধর্ষণ-নিপীড়নবিরোধী কর্মসূচিতে উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের পাঁচটি জেলা থেকে নতুন করে আরও ৭ নারী-শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে নারী-শিশু ধর্ষণসহ নারী নিপীড়ন, খুন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিও অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রবিবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন ও মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর মধ্যে ঢাকায় একটি মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ‘ধর্ষণ’ শব্দটি ব্যবহার না করার অনুরোধের মাধ্যমে বাস্তবে ধর্ষকের পক্ষ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি মনে করেন, বিষয়টি কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তার (ডিএমপি কমিশনার) এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা উচিত, প্রত্যাহার করা উচিত।
মুরাদনগরে শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সালিশের মাধ্যমে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ ৬ জন মাতব্বর নিপীড়নের অভিযোগ ওঠা বাবুল মিয়ার কাছ থেকে নেয় ৫ হাজার টাকা। সেই ৫ হাজার টাকা আবার ৬ মাতব্বরের মধ্যে বণ্টন নিয়ে বাধে বিপত্তি। চার মাতব্বর নেয় ১ হাজার টাকা করে এবং দুজনকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা করে। সমহারে টাকার ভাগ না পেয়ে মাতব্বররা একে অপরের বিরুদ্ধে তুলছেন অভিযোগ।
নিপীড়নের শিকার শিশুটির নানি বলেন, ‘আমার স্বামী বেঁচে নেই। আমার মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকে। তার ৬ বছরের মেয়ে আমার কাছেই থাকে। গত ৫ জানুয়ারি বাবুল মিয়া আমার নাতনির হাতে ১০ টাকা দিয়ে বলে, ‘চলো তোমাকে মজা কিনে দেব’। সে (নিপীড়নের শিকার শিশু) সরল বিশ্বাসে বাবুলের সঙ্গে যায়। বাবুল একপর্যায়ে তাকে একটি ঘরের পেছনে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে। তাৎক্ষণিক আমার নাতনি বাড়িতে এসে কান্না করতে করতে ঘটনাটি জানায়। এই ঘটনার পর চার দিন খুব অসুস্থ ছিল সে।’
শিশুটির নানি আরও বলেন, ‘বিষয়টি গ্রামের মাতব্বরদের জানালে তারা আমাকে পরামর্শ দেয় সালিশ ডাকার জন্য। আর যদি মাতব্বরদের কথা অমান্য করে থানা পুলিশ করি তাহলে আমার খুব ক্ষতি হতে পারে। এই ভয়ে ঘটনার ১৫ দিন পর আমি সালিশ ডাকি। সালিশে মাতব্বররা অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য কোনো সাক্ষী প্রমাণ হাজির হতে দেয়নি। বিচারে রায় দেওয়া হয় অভিযুক্ত বাবুলকে ৬টি জুতার বাড়ি এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা। বর্তমানে আমি শিশু নাতনিটি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। বাবুলের পরিবার থেকে আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যদি মুখ খুলি তাহলে আমাকে গ্রামছাড়া করবে।’
ওই সালিশে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাতব্বর বলেন, ‘ইউপি সদস্য শাহীনকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে কাজ করেছে বাবুল মিয়ার পরিবার। সেই সুবাদে তাকে বাঁচানোর জন্য সালিশ ডেকে নামমাত্র জরিমানা করে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। সালিশের পর আবার অভিযুক্তর কাছ থেকে শাহীনসহ ৬ মাতব্বরের জন্য নেওয়া হয় ৫ হাজার টাকা। সেই ৫ হাজার টাকা থেকে ইউপি সদস্য শাহিন, জাফর আলীর ছেলে বাবুল, সৈয়দ আলীর ছেলে বাবুল ও শাহজালাল নেন ১ হাজার টাকা করে। বাকি ১ হাজার টাকা দেওয়া হয় কবির ও সাগরকে। সালিশের পরে ওই নারীকে বলা হয়েছে, যদি থানা পুলিশ করে তাহলে গ্রাম থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এই ঘটনার সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে বিচার হওয়া উচিত।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য শাহিন বলেন, ‘বিচারে (সালিশে) আমি উপস্থিত ছিলাম, আর বিচারের জুড়ি বোর্ডের রায়ে সম্মতি প্রদান করেছি মাত্র। বিচার পরিচালনা করেছে গ্রামের মুরব্বিরা। বিচারের রায় অনুযায়ী অভিযুক্ত বাবুল মিয়াকে তার বড় ভাই তাহের মিয়া জুতাপেটা করে এবং জরিমানার ৫ হাজার টাকা শিশুটির নানির হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
৫ জেলায় আরও ৬ নারী-শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ : নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুত্রবধূকে ধর্ষণের অভিযোগে শ্বশুরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত সোমবার রাত সোয়া ৩টার দিকে ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটে। অভিযোগ পেয়ে গত শনিবার রাতে উপজেলার চরপার্বতী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের নিজ বাড়ি থেকে আসামি আহসান উল্যাহকে (৫৫) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি একই ওয়ার্ডের মৃত আলী আহামদের ছেলে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আলাদা দুটি ঘটনায় দুই শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি ঘটনায় মোহর আলী (৫৯) নামে এক বৃদ্ধকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। রাজশাহীতে ৯ বছরের শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে এনামুল হক (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে এলাকাবাসী।
চট্টগ্রাম নগরে ভিক্ষুক নারীকে (৩৫) অটোরিকশায় তুলে নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে অটোরিকশাটির চালক মো. আবদুল আলীকে (৫৫) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। লালমনিরহাটের আদিতমারীতে শারীরিক ও বাকপ্রতিবন্ধী (২৮) নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মো. শাহিন মিয়া (২৮) নামে এক আইসক্রিম বিক্রেতাকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া জেলার সদর উপজেলার গোকু-া ইউনিয়নে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মেছের আলী (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ধর্ষণ-নিপীড়নবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত : ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে গতকাল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করুন, এখনই!’ শীর্ষক মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। এতে অংশ নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানের ওপরে নারীদের নিরাপত্তার সবচেয়ে বেশি নিশ্চিত করা বা নারীর অধিকার হরণের প্রতিরোধ করার দায়িত্ব, সেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তথা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন বলেন ধর্ষণ শব্দটা ব্যবহার না করার জন্য, গণমাধ্যম- আপনাদের যখন অনুরোধ করে তখন আমাদের অবাক হতে হয়। তাদের এই অবস্থানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনার বাস্তবে ধর্ষকের পক্ষ নিচ্ছেন। ধর্ষকের সুরক্ষা দেওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। এটা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তার এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা উচিত, প্রত্যাহার করা উচিত।’
এর আগে গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গণমাধ্যমে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি ব্যবহার না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘আমি দুটি শব্দ খুব অপছন্দ করি, এর মধ্যে একটি হলো ধর্ষণ। আপনাদের কাছে অনুরোধ, এটা ব্যবহার করবেন না। আপনারা ‘নারী নির্যাতন’ বা ‘নিপীড়ন’ বলবেন। আমাদের আইনেও নারী ও শিশু নির্যাতন বলা হয়েছে। যে শব্দগুলো শুনতে খারাপ লাগে, সেগুলো আমরা না বলি।’
মাগুরায় ধর্ষণ-নির্যাতনে নিহত আট বছরের শিশুটির ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে। সকালে শহরের চৌরঙ্গীর মোড়ে এ কর্মসূচির আয়োজন করে সেভ দ্য উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন নামে একটি সংগঠন। এছাড়া বেলা ১১টায় একই দাবিতে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে একটি মানবাধিকার সংস্থা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের শাহবাজপুর ইউনিয়নে বাকপ্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো এবং সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যে প্রতিবেদনটি তৈরি।