হবিগঞ্জের বাহুবলের স্নানঘাট গ্রামে সোমবার ছিল উৎসবের এক দিন। এই গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষটি যে এসেছেন ১১ বছর পর। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরীর পিতৃভিটা এই গ্রাম। তিনি এবার এসেছেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলার জন্য। স্নানঘাটে তাই আনন্দের সীমা নেই। ছোট্ট এক গ্রাম, গোটা গ্রামটাই যেন ভেঙে পড়েছে বিখ্যাত দেওয়ান বাড়িতে। এই বাড়িরই উত্তরাধিকার হামজা। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি গায়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ান বাড়ি ছেলেটিই হয়ে উঠবেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল লিগ-ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার।
স্নানঘাটের মানুষকে ভালোবাসেন হামজা। বাংলাদেশের হয়ে খেলার মূল কারণই তাঁর নিজ দেশের মানুষ। সে হিসেবে পিতৃভিটের মানুষের অধিকারটাই যেন তাঁর কাছে আগে। আগামী ২৫ মার্চ শিলংয়ে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক ঘটবে তাঁর। এ মুহূর্তে ইংলিশ ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর-চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের দল শেফিল্ড ইউনাইটেডে খেলা হামজা সকালে ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে এসেই প্রথম গেছেন স্নানঘাটে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার আগে স্নানঘাটের মানুষের ভালোবাসা যেন তাঁর কাছে সঞ্জীবনী সুধা। নিজ পিতৃভিটের মানুষের ভালোবাসা গায়ে মেখেই হামজা দেশের হয়ে খেলতে নামবেন।
সকালে ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভালোবাসা বলুন কিংবা তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা বলুন, সবই টের পেয়েছেন। সিলেট বিমানবন্দরে বিশৃঙ্খলা আর বাফুফের অব্যবস্থাপনার মধ্যেই মুখে হাসিটা লেগেই রইল হামজার। সংবাদকর্মীদেও ভিড়ের মধ্যেই তাঁর কথা, ‘আমার হৃদয় আজ পরিপূর্ণ।’ বাংলাদেশের হয়ে খেলার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের ভালোবাসা, উন্মাদনাটা টের পেয়েছিলেন। সিলেটে নেমে তাঁর প্রতি আগ্রহ, ফুটবলপ্রেমীদের স্লোগানে স্লোগানে স্বাগত জানাতে দেখে হৃদয় পরিপূর্ণ হওয়ার তৃপ্তিটা পেলেন এদেশের ফুটবলের এই বিশ্বখ্যাত সেনসেশন।
ভালোবাসার বাড়াবাড়িটাও ছিল। পুরো গ্রাম যদি একটা বাড়ির আঙ্গিনায় জড়ো হয়ে যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কাটা থেকেই যায়। বাড়ির পাশেই মঞ্চ বানিয়ে হামজাকে সংবর্ধনা দেওয়ার পরিকল্পনাটাকে তাই কিছুটা সংক্ষেপিত করতেই হলো। তবুও হামজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামবাসীর আবদার মেটালেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় শোনালেন আশাবাদ। ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ উচ্চারণে উদ্বুদ্ধ করলেন সবাইকে। দীর্ঘ বিমানযাত্রার ধকল সয়েও হামজার ঠোঁটে তখনও রইল সেই হাসিটি। ওই হাসি দেখেই গ্রামের মানুষ তৃপ্ত, আনন্দিত। তাঁদের গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত ছেলেটির ওই কয়েকটি কথাতেই যেন সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন, তাঁদের ছেলে, তাঁদেও মুখ উজ্জল করতেই এসেছেন। হামজাকে কয়েকটি কথা বলতে শুনে গ্রামেরই উঠতি ফুটবলাররাও উজ্জীবিত-----হামজার মতো তাঁদেরও যে হতে হবে।
দেওয়ান বাড়ির লাগোয়া এক চিলতে জায়গায় একটা মাদ্রাসা। সেখানে ৫০ জন ছেলে মেয়ে কোরআনে হাফেজ তৈরি হচ্ছে, সেটিও হামজারই টাকায়। গ্রামের এক মুরুব্বীর মুখে গর্ব আর তৃপ্তি----আমাদের ছেলে বিরাট এক কাজ করছে। হামজা সফল হবেই, শুধু স্নানঘাট নয়, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে গর্বিত করবে সে।
বিকেল গড়িয়ে যায়, রমজান মাস। ইফতারের তোড়জোড় শুরু হয় দেওয়ান বাড়িতে। কিন্তু তখনও শতশত মানুষের ভিড় বাড়ির চারপাশ ঘিরে। সবাই হামজাকে এক নজর দেখতে চায়। হামজার বাবা মোর্শেদ চৌধুরীর চেহারায় খানিকটা উদ্বেগ। ইংল্যান্ড থেকে দীর্ঘ বিমানযাত্রা শেষে স্নানঘাটে এসেছে তাঁর ছেলে, একটু তো বিশ্রাম দরকার। কিন্তু এভাবে মানুষ বাড়ি ঘিরে থাকলে সেটা কীভাবে সম্ভব? এমন অবস্থাতেও দেওয়ান বাড়ির আতিথিয়েতায় একটুও ঘাটতি নেই। ১২০০ মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করেছেন তিনি। ভিড়ভাট্টার মধ্যেও তাঁর কড়া নজর। সবাই যেন ইফতার করে যান। মাগরিবের আজান হয় একসময়, দেওয়ান বাড়িতে তখন অপার্থিব এক পরিবেশ।
ইফতারের পর হামজা এলেন সবার সামনে। তাঁর বাড়ির উঠোনে বসেই মুখোমুখি হলেন সংবাদমাধ্যমের। সারাদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি সবার। সিলেট বিমানবন্দরেও কয়েকটি কথা বলেছিলেন। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচকে সামনে রেখে তাঁর জাতীয় দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার সঙ্গে কথা হয়েছে----এটিই সন্ধ্যায় নিজ বাড়ির উঠোনে বসে আবার সবাইকে জানালেন। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথাও উঠে এল। স্পষ্টই বলে দিলেন, বাংলাদেশকে ফুটবলে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান হামজা। লক্ষ্য ২০২৫ সালের এশিয়ান গেমসে ভালো করা, বললেন, ধীরে ধীওে দেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে চান তিনি। এমনকি ২৫ মার্চে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে যে জয় ছাড়া অন্য কোনো কিছু ভাবছেন না, স্পষ্ট কওে সেটিও বলে দিলেন।
ভারত হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশকে মোকাবিলায় অবসর ভেঙে ফেরত এনেছে তাঁদের দলের সবচেয়ে বড় তারকা সুনীল ছেত্রীকে। হামজা এসব নিয়ে ভাবতে চান না। বলেছেনে, ‘আপাতত ভারতকে নিয়ে ভাবছি না। আমরা আমাদের পরিকল্পনা ঠিকমতো করে যেতে চাই।’
এই যে এত মানুষের ভালোবাসা। প্রত্যাশার অযাচিত চাপ কি অনুভব করছেন? হামজার মুখে সেই হাসি----নাহ! চাপ অনুভব করব কেন? আমি তো সবার এই ভালোবাসা উপভোগ করছি।’
স্নানঘাটে ছোটবেলার স্মৃতির বড় জায়গা জুড়ে আছে, ইংল্যান্ড থেকে গ্রামে বেড়াতে এসে ক্রিকেট খেলাটা। সাকিব আল হাসানের প্রতি তাঁর অনেক শ্রদ্ধা। তাঁর সঙ্গে যেকোনো তুলনাকে এক কথায় উড়িয়ে দিলেন, ‘সাকিব আল হাসান কত বছর ধরে খেলে এই জায়গায় নিজেকে নিয়ে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে তুলনার প্রশ্নই নেই। তিনি বাংলাদেশের সেরা তারকা।
দেওয়ান বাড়ির উঠোনে বসে হামজা কথাটা বলেই হাসছেন, সেই হাসিতে মিশে শ্রদ্ধাবোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দেশকে সাফল্য এনে দেওয়ার প্রত্যয়। বাকিটা হামজা ভারতের সঙ্গে শিলংয়ের জন্যই তুলে রেখেছেন।