ভূমিকা : তিস্তা নদী একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী, যা ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ভাগ করা হয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভারতে বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে ওপরের অংশ থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রবন্ধে ভারতের পানি প্রত্যাহারের নীতির প্রভাব বিশেষ করে পাঁচটি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা : রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তিস্তা নদী এবং পানি ভাগাভাগির বিরোধের পটভূমি : তিস্তা নদী হিমালয় পর্বতমালা থেকে উদ্ভূত হয়ে ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত। ঐতিহাসিকভাবে, এই নদী উভয় দেশের লাখ লাখ কৃষকের জন্য একটি জীবনদায়িনী সম্পদ। তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ বহু দশক ধরে চলে আসছে। একটি প্রস্তাবিত চুক্তি মোতাবেক তিস্তার পানির ৫০ শতাংশ বাংলাদেশকে বরাদ্দ করার কথা ছিল, যা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিবন্ধকতার কারণে কখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। ফলস্বরূপ, ভারত তার ব্যারাজ এবং সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, যার ফলে বাংলাদেশে বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে (ডিসেম্বর-মে) তীব্র পানির সংকট দেখা দেয়।
একতরফা পানি প্রত্যাহারের বাংলাদেশে প্রভাব
(ক) কৃষি উৎপাদনশীলতার হ্রাস : তিস্তা নদী নির্ভরশীল বাংলাদেশের জেলা যেমন রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা এই নদী থেকে সেচের জন্য অত্যন্ত নির্ভরশীল। ভারতে একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে কৃষি উৎপাদনশীলতা তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে ফসলের ফলন, চাষের ধরন এবং কৃষি খরচে বড় প্রভাব পড়েছে।
ফসলের ফলন হ্রাস : তিস্তার পানি সংকটের কারণে একাধিক খাতে ফসল উৎপাদন কমে গেছে। ধান উৎপাদন : বোরো ধান, প্রধান শুষ্ক মৌসুমের ফসল, যা ধারাবাহিক সেচের প্রয়োজন, এর উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা প্রভাবিত হচ্ছে। গম এবং ভুট্টার চাষ : এই ফসলগুলোও আর্দ্রতার অভাবে ফলন কমেছে, যার ফলে গুণগতমান এবং উৎপাদন কমে গেছে। পাট উৎপাদন : পাট চাষের জন্য পানির প্রয়োজন এবং পর্যাপ্ত পানি না থাকায় পাটের গুণগতমান কমে গেছে, যা পাট শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সবজি চাষ : উচ্চমূল্য ফসল যেমন টমেটো, আলু এবং পেঁয়াজের উৎপাদন সেচের অভাবে কমেছে, যার ফলে স্থানীয় বাজারে মূল্য ওঠানামা করতে দেখা যাচ্ছে। চাষের ধরন পরিবর্তন : পানি পাওয়ার অস্থিরতার কারণে, চাষিরা তাদের চাষের ধরন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন, যার ফলে কম পানি প্রয়োজন এমন, তবে কম লাভজনক ফসল চাষে মনোনিবেশ করেছেন। ধান থেকে খরা সহনশীল ফসলের প্রতি আগ্রহ : চাষিরা ক্রমশ ঋতুবেগ, সরিষা এবং বাজরা চাষ করছেন, যা কম পানি লাগে, তবে এর লাভ কম। মাল্টি-ক্রপিং সিস্টেমের হ্রাস : যারা আগে তিনটি ফসল (যেমন- বোরো ধান, আমন ধান এবং সবজি) চাষ করতেন, তারা এখন পানি সংকটের কারণে এক বা দুটি ফসল চাষ করেন, যা কৃষি উৎপাদন এবং আয় কমিয়ে দিয়েছে। ভূমি পতিত রাখা : কিছু কৃষি জমি শুষ্ক মৌসুমে চাষ না হওয়ার কারণে পতিত পড়ে থাকে, যা ভূমির উৎপাদনশীলতা এবং গ্রামীণ বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সেচ খরচ বৃদ্ধি : পৃষ্ঠের পানির অভাবের কারণে, চাষিরা পানির জন্য বেশি করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে : উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি : ডীপ টিউবওয়েল এবং শ্যালো পাম্প চালানোর জন্য ডিজেল এবং বিদ্যুতের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষিকে আরও অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষ : অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার কারণে পানি স্তরের অবনতি হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি পানি সংকট তৈরি করছে। ছোট কৃষকদের আর্থিক চাপ : ছোট কৃষকরা, যারা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের অতিরিক্ত খরচ বহন করতে পারে না, তারা আর্থিক সংকটে পড়ছেন, অনেকেই ঋণের বোঝা চাপাতে বাধ্য হচ্ছেন বা চাষ বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই সমস্যাগুলোর সম্মিলিত প্রভাব বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, গ্রামীণ জীবিকা এবং কৃষির স্থিতিশীলতা বিপন্ন করছে। একটি ন্যায্য পানি ভাগাভাগি চুক্তি ছাড়া এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার ফলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা হতে পারে।
খ) বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশগত প্রভাব : তিস্তা পানি একতরফা প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে গুরুতর পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক অবনতি, জীববৈচিত্র্য হারানো এবং জলবায়ু সম্পর্কিত দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জলাভূমি এবং নদী তীর শুকানো : তিস্তার পানি প্রবাহ উল্লেখযোগ্য কমে যাওয়ার ফলে অনেক শাখা নদী, উপনদী এবং পার্শ্ববর্তী জলাভূমি (হাওর, বেল এবং প্লাবন এলাকা) শুষ্ক হয়ে গেছে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল)। একসময় সমৃদ্ধ জলাশয় যেমন চর এলাকা এবং তিস্তা সংযুক্ত ছোট নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাকৃতিক বাসস্থান হারাচ্ছে। মাছের সংখ্যা হ্রাস : মৎস্য খাত, যা হাজার হাজার মানুষের জীবিকা অর্জনের প্রধান উৎস, তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিস্তা নদীতে প্রচুর মাছ প্রজাতি ছিল, যেমন- রুই, কাতলা, পাঙাশ, বোয়াল এবং অন্যান্য ছোট মাছের প্রজাতি, যেগুলো ধারাবাহিক পানি প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পানির স্তর কমে যাওয়ার কারণে মাছের প্রজনন এবং অভিবাসন প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে মাছের সংখ্যা কমে গেছে। নদীভাঙন বৃদ্ধি : তিস্তা নদী এখন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, যার কারণে আকস্মিক বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী খরা ছাড়াও নদীভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীভাঙনের ফলে কৃষকরা বসতবাড়ি, কৃষিজমি হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। ফলে শহরমুখী হচ্ছেন।
তিস্তার পানি প্রবাহের হ্রাস এবং নদী তীরের শুকানো স্থানীয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়িয়েছে এবং স্থানীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি করেছে।
গ) সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ : তিস্তা নদীর এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনগণের জীবিকা ও স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। যারা আগে নদী থেকে কৃষি, মৎস্য ও দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতেন তারা এখন আর্থিক সংকট, দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়েছেন।
কৃষকরা সংকটে : কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে অনেক ছোট এবং প্রান্তিক কৃষক তাদের আয় বজায় রাখতে সংগ্রাম করছেন। সেচ খরচ বৃদ্ধি এবং কম ফলনের ফলে অনেকেই ঋণ নিয়ে বা জমি ও গবাদিপশু বিক্রি করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। মৎস্যজীবীরা চাকরি হারাচ্ছেন : মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে হাজার হাজার মৎস্যজীবী তাদের প্রধান আয়ের উৎস হারিয়েছেন। পানির অভাব : তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে গৃহস্থালির জন্য পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যা জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দিয়েছে।
ঘ) পাঁচটি ক্ষতিগ্রস্ত জেলার প্রভাব
রংপুর : সেচ প্রকল্পগুলো পানি সংকটের কারণে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। লালমনিরহাট : নদী তীরের ভাঙন হাজার হাজার পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করেছে, যার ফলে গ্রামীণ দারিদ্র্য বেড়েছে। নীলফামারী : কম পানি এবং সেচ ব্যবস্থার অভাবে স্থানীয় কৃষকদের শস্য চাষ করতে অসুবিধা হয়েছে। কুড়িগ্রাম : নদী তীরের শুষ্কতা এবং পানির অভাবে কৃষি উৎপাদন কমে গেছে, বিশেষ করে বোরো ধান ও সবজি। গাইবান্ধা : নদীর তীর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এলাকার কৃষকরা উৎপাদনশীলতা হারিয়েছেন, যার ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে।
সমাধান এবং সুপারিশ : তিস্তা নদী ভাগাভাগি সমস্যা সমাধানে কয়েকটি সুপারিশ দেওয়া যেতে পারে : ক. ভারত-বাংলাদেশ পানি চুক্তি : একতরফা পানি প্রত্যাহারের বদলে একটি যুগোপযোগী পানি চুক্তি প্রয়োজন, যা দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে। খ. সেচ প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ : পানির ব্যবহার কমানোর জন্য সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করা উচিত। গ. বন্যার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি : নদী তীরের ভাঙন এবং জলাবদ্ধতা মোকাবিলা করার জন্য স্থায়ী সুরক্ষা প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন। ঘ. ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি : কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা, যেন তারা টেকসই কৃষি প্রথা অনুসরণ করতে পারে।
তিস্তা নদীর পানি একপাক্ষিকভাবে ঊর্ধ্বগামী ব্যবহারকারীদের দ্বারা প্রত্যাহার করার কারণে উত্তরাঞ্চলীয় বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। একটি ন্যায্য এবং টেকসই পানি ভাগাভাগি ব্যবস্থা ছাড়া এই সংকট আরও গভীর হবে, যার ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত হবে, দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশের ক্ষতি হবে। এই সমস্যার সমাধান করতে, বাংলাদেশকে কূটনৈতিক আলোচনা, টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু অভিযোজন ব্যবস্থা এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক সমাধানগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিস্তা অববাহিকায় পানি নিরাপত্তা, খাদ্য স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে একটি সুষম এবং সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট