দারিদ্র্য ফাঁদ এমন এক বৈষম্য ফাঁদ, যা প্রজন্মে হস্তান্তরিত হতে পারে। অথবা মাকড়সার জালের মতো বৈষম্য নিজেকে ধরে রাখে। পুরুষ শাসিত সমাজে একজন নারীর অবস্থান বৈষম্যের নির্দেশক, যেখানে একজন নারী সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার থেকে প্রায় বঞ্চিত। তাদের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত। কারণ সামাজিক নিয়ম ‘ভেতর’ ও ‘বাহির’ হিসেবে কাজ শনাক্ত করে দিয়েছে। এগুলোর সামাজিক প্রতিক্রিয়া খুব ভয়ংকর : মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, বাড়ির বাইরে কাজ করা মহিলাদের জন্য দুষ্কর এবং পুরুষের চেয়ে মহিলারা কম আয় করে। এর ফলে মহিলাদের নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক পরিণতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, মহিলারা ঘরে-বাইরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এমন অসম সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো অতি সহজে পুনরুৎপাদিত হতে থাকে। যদি একজন নারীর মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, চুপচাপ থাকা এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলা ভালো এবং সুন্দর মেয়ে মানুষের লক্ষণ, তা হলে বিশ্বাসটি সে তার মেয়ে অথবা ছেলের বউয়ের কাছে সংক্রমিত করবে। তেমনি ধনী-দরিদ্রের ক্ষমতা বৈষম্য গরিবের ওপর ধনীর আধিপত্যকে স্বীকৃতি দেয়। উদাহরণ হিসেবে একজন কৃষি শ্রমিকের কথা বলা যায়, যে একজন শক্তিশালী ভূস্বামীর জন্য কাজ করছে। অজ্ঞতা ও অপুষ্টির কারণে সে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না। আবার সে তার ‘প্রভুর’ কাছ থেকে নেওয়া ঋণের জালে বন্দি। যদি দেশের আইন তার পাশে দাঁড়াবার জন্য অপেক্ষা করেও, সে কিন্তু অজ্ঞতা ও অভাবের কারণে রাজনৈতিক ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানের সুযোগ নিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এমনিভাবে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অসমতা অসম সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের দুষ্টচক্রে আটকে আছে।
দুই. প্রেক্ষিত বাংলাদেশ। আদিকাল থেকে অর্থনীতিবিদদের কাছে প্রবৃদ্ধির পরিমাণগত দিকটা অধিকতর গুরুত্ব পেয়ে আসছে, যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সে ধারার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে অর্জিত কৃতিত্বমূলক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ঐ প্রবৃদ্ধির গুণগত অবস্থান তিন দিক থেকে বিবেচনা করা যায় : দারিদ্র্য হ্রাসের হার, আয় বিন্যাস ও কর্মসংস্থন। সেটাই হচ্ছে, ভালো প্রবৃদ্ধি যে প্রবৃদ্ধি দ্রুত গতিতে দারিদ্র্য হ্রাস করে, কম বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং খুব দ্রুততার সঙ্গে উদ্বৃত্ত খাত থেকে ঘাটতি খাতে শ্রম টেনে নেয়। দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে প্রশংসনীয় কৃতিত্ব দাবি করতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ দাবি আজ স্বীকৃত, তার পুনরুক্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যেমন, সত্তর দশকের আয়-দারিদ্র্যের প্রকোপ ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ২৫ শতাংশে। এ উন্নতির পেছনে বড় অবদান রেখেছে লতিয়ে ওঠা মাথাপিছু আয়। বিশেষত, আশির দশকের পর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের মুখে অব্যাহতভাবে জিডিপি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়ে যায় এবং খুব সহজেই আমরা চিত্তাকর্ষক এ রূপান্তরের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি। এর ফলে একদিকে যেমন দারিদ্র্য হ্রাসের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম আগের প্রজন্মের চেয়ে অধিকতর দ্বিগুণ সচ্ছল জীবনযাপন করছে। তারপরও, দারিদ্র্যের দহন প্রতিনিয়ত তাড়া করছে অসংখ্য মানুষকে। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্য রেখার নিচে বাস করছে বলে জানা যায়। সমাজবিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস, মাথাপিছু আয়ের অব্যাহত দ্রুত বৃদ্ধিই এদের দারিদ্র্য রেখার ওপরে টেনে তোলার ক্ষেত্রে বড় রকমের অবদান রাখতে পারে।
তিন. যতটা ভাবা যায়, সম্পর্ক ততটা সরলরৈখিক নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি হলে দারিদ্র্য হ্রাস দ্রুত নাও হতে পারে। প্রবৃদ্ধি বৈষম্য ও দারিদ্র্য সম্পর্ক নিয়ে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। লক্ষ করা গেছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশ থেকে খুব একটা ভিন্নতর নয়। এখানেও ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য দারিদ্র্য হ্রাসের ওপর প্রবৃদ্ধির প্রভাবকে সংকুচিত করে রাখছে। যদি বৈষম্যের কথাই বলি, গিনি সহগ ১৯৮৩/৮৪ সালের ০.৩৯ থেকে ২০২৪ নাগাদ ০.৪৯-তে গড়ায়। বৈষম্যের এ বিস্তার শুধু দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেনি; ক্রমবর্ধিষ্ণু বৈষম্য সমাজে একটা ক্ষুদ্র অংশের হাতে আয় পুঞ্জীভবন করত আপেক্ষিক বঞ্চনার জন্ম দিয়ে চলছে। এ রুঢ় বাস্তবতা আমাদের সামনে আজ সামাজিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রকটভাবে উপস্থিত। আর, নাগরিকদের জীবন মানের বেলায় পর্বত-প্রমাণ বৈষম্য যে কী ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ তো ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছেই। তবে বৈষম্য-তাড়িত অসন্তোষ কখন দানা বেঁধে ‘গণবিপ্লবে’ রূপ নেবে, তা নির্ভর করে সমাজের আয়-বৈষম্য সহ্য করার ক্ষমতার ওপর। যেমন বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তীব্র বৈষম্যের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
চার. এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে, বেড়ে ওঠা আয়-বৈষম্য শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই সমস্যা। উদাহরণ হিসেবে ভারত ও চীনের কথ উল্লেখ করা যায়। সেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনই বাড়ছে বৈষম্য। আর, অর্থনৈতিক অধ্যয়নে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেট্সের সাড়া জাগানো ইনভারটেড ইউ হাইপোথেসিসের-এর কথা নিশ্চয় মনে আছে। তার মতে, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য (বিশেষত আয়-বৈষম্য) বৃদ্ধি পায়, তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবার পর বৈষম্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেতে থাকে। এটা ঘটে মূলত এ কারণে যে, দরিদ্র জনগণ দীর্ঘকালের প্রবৃদ্ধিজনিত উপচেপড়া প্রভাবগুলো থেকে ক্রমশ লাভবান হতে থাকে। হতে পারে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের মধ্যে বিরাজমান এ বিপরীতমুখী সম্পর্ক কুজনেটসের প্রতিপাদ্যের প্রতি কিছুটা হলেও সমর্থন জানায়। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে, ধারণাটি ইতিমধ্যে প্রচুর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং প্রশ্ন উঠেছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে কি তাহলে এ প্রবণতা অবশ্যম্ভাবী? এ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা হয়েছে। যদিও-বা শেষ হয়েছে কোনো উপসংহার ছাড়াই। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আপাতদৃষ্টিতে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক থাকার তেমন কোনো কারণ নেই। অনেক দেশে সম্পদের প্রারম্ভিক বিতরণ তির্যকভাবে অসম থাকার ফলে এবং ওই দেশগুলোতে বৈষম্য হ্রাস সংক্রান্ত কৌশল ও নীতিমালার ব্যর্থতাই এ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে ইন্ধন জোগায়। যাই হোক, আয়ের পুনর্বণ্টন দুটি উপায়ে দারিদ্র্য হ্রাসের পথ প্রশস্ত করে। প্রথমত, আয়ের স্থায়ী পুনর্বিন্যাস বিতরণ প্রভাবের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, এটা প্রবৃদ্ধি সাপেক্ষে দারিদ্র্য প্রভাবগ্রাহকতা বা স্থিতিস্থাপকতাকে স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করে। এর ফলে যে কোনো প্রবৃদ্ধির হারের মাত্রায় দারিদ্র্য হ্রাসের বেগ বেড়ে যায়। অর্থাৎ, এ জাতীয় পুনর্বিন্যাস তখন দ্বৈত পুরস্কার বা ডাবল ডিভিডেন্ড বয়ে আনে : একদিকে প্রবৃদ্ধি নিজেই দ্রুততর হয় আর অন্যদিকে যে গতিতে প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায়, তাও বেগবান হতে থাকে।
পাঁচ. গিনি সহগ নিচে নামিয়ে আনতে গেলে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার যথেষ্ঠ নয়; চাই একটা সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ‘পাপীদের’ জন্য যথাযথ শাস্তির বিধান করা। আর তা হলেই বৈষম্য নামক ‘পাপের’ মাত্রার পরিসমাপ্তি না ঘটলেও, তা যে অনেকটুকু হ্রাস পাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিরাজমান প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল সংস্কার ছাড়া বৈষম্য কমানোর প্রচেষ্টার মানে দাঁড়ায়, পেটে কৃমি দূর না করে পুষ্টিকর খাবার ভক্ষণ করা। কিন্তু এই অভাগা বাংলাদেশে তা কতটা সম্ভব, সে প্রশ্ন উঠছে প্রতিনিয়ত। বিরাজমান ব্যবস্থায় এ কাজটি করা খুব কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন হবে কর কাঠামোতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা দূর করে কর ফাঁকি রোধ করা, সাধারণভাবে সম্পত্তি কর পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং কর ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটানো। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাদেক আহমেদের মতে, সরকারি ব্যয় পুনর্বিন্যাসের প্রভাব থেকে আসবে জিডিপির ২ শতাংশ এবং অতিরিক্ত করের জোগান থেকে ২.৫ শতাংশ দিয়ে সামাজিক সুরক্ষার জন্যে জিডিপির ৪ শতাংশ জোগান দেওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে বিভিন্ন ধরনের অপচয় থেকে অবমুক্ত অর্থ। সেটা করতে পারলে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিজনিত বিস্তারিত পরিকল্পনা আয় বিতরণ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত অধিকতর সমতা বিধান করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা যায়।
সুশাসনের মাধ্যমেও আয় বিন্যাসে উন্নতি ঘটানো যায়। আইনের শাসনের উপস্থিতি, যথাযথ বিধিমালা ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে চলতে এবং কাজ করতে দেওয়ার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সমতা বিধানের স্বার্থে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি, দম্ভ ও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা এবং এ ঋণ পরিশোধ না করে ‘খাজনা’ খোঁজার প্রবণতা, অবশ্যই রুখতে হবে। অন্যদিকে, একটা অপেক্ষাকৃত ন্যায়সংগত সমাজ বাস্তবায়িত করতে হলে শেয়ারবাজারে অনৈতিক বাণিজ্য এবং অন্যান্য বিকৃতি, কর ফাঁকি, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি, জোর করে জমি দখল ইত্যাদি রোধ করার মাধ্যমে সমাজের উঁচু ৫ ভাগের হাতে কুক্ষিগত এসব আয় কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই, কুক্ষিগত সম্পদের পেছনে (এবং বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে) কাজ করছে বলিষ্ঠ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা যা বন্ধ না হলে বৈষম্য কমবে বলে মনে হয় না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, রাজউক, কর বিভাগ, পৌরসভা ইত্যাদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রেখে, নিয়মকানুন ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে চলতে দিলেই একদিকে যেমন অর্থনৈতিক নৈরাজ্য নির্বাসিত হতে পারে তেমনি আয় বিন্যাসের উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়