রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

মুক্তিযুদ্ধ একমাত্রিক ছিল না

আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৫, ০২:১৪ এএম

গতকাল ২৬ মার্চ ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১-এর সেই দিনে এক তরুণ চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার নির্জন রেডিও স্টেশন থেকে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। তার আগের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র জনগণের ওপর। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সব থেকে বড় ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ একটু-আধটু প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করলেও, তা পাকিস্তান আর্মির তোপের মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। সেই সময় অস্ত্রের সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বঙ্গসন্তানদের অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আপাত দৃষ্টিতে বিকল্প কোনো পথ ছিল না। তখন ঐতিহাসিক চট্টগ্রামে বাঙালি রেজিমেন্টের তরুণ মেজর জিয়ার লড়াইয়ের বার্তা তামাম পূর্ব বাংলাকে উদ্বেলিত করেছিল। ওই দিনটিই তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ, বাংলাদেশের বিজয় দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক রয়েছেন, যারা আরও গভীর বিশ্লেষণ করবেন। আমরা যারা সীমান্ত পাড়ের লোক, বাংলাদেশ আজও তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। কখনো সখনো বলি বটে যে, যতদিন যাবে ততদিন নতুন নতুন বহু তথ্য উঠে আসবে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসের পুনর্পাঠে সহায়তা করবে। ইতিহাসের অনেক মিথের মৃত্যু ঘটবে। জন্ম নেবে নয়া ইতিহাস। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের।

১৯৭১ সালে আমরা নিতান্তই বালক। সত্যি কথা বলতে কি, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউন বা জিয়াউর রহমানের সেই বজ্র নির্ঘোষ উই রিভোল্ট কোনোকিছুই সেভাবে জানার সুযোগ হয়নি। কিন্তু এটুকু স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তখনই মুজিবময়। আজ যখন প্রাপ্ত মনস্ক হয়ে ভাবি বা মুজিব বন্দনার আবেগ সরিয়ে খোলা মনে ভাবি, তখন এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কোনো না কোনো নির্দিষ্ট কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে কাল্ট ফিগার বা লার্জার দ্যান লাইফ করে গড়ে তোলার পেছনে নিঃসন্দেহে এদেশের শাসকদের পরিকল্পনা ছিল। সেই সময়ের বিশ্বব্যবস্থা ছিল অগ্নিগর্ভ। দেয়ালে দেয়ালে সেøাগান দেখতাম বিশ্বে এনেছে নতুন দিন, মাও সে তুং আর হো চি মিন। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ নেতৃত্বাধীন দল যখন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ নিয়ে শ্রেণিসংগ্রাম থেকে সরে গেল, তখন থেকেই বামপন্থি মহলে তারা অধঃপতিত, সংশোধনবাদী। অপরদিকে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে সারা বিশ্বের অসংখ্য দেশে বিপ্লবী স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ছে জনগণের মধ্যে। ভারতে তখন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার। শ্রীমতী গান্ধী আপাতভাবে সমাজতান্ত্রিক মনে হলেও তিনি কমিউনিস্ট বিরোধিতায় সতত সক্রিয়। ষাটের দশক থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ক্রমবর্ধমান নকশাল আন্দোলন দমনে তিনি অতি সক্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ষাট সত্তর দশকে নকশালবাড়ির রাজনীতির বিপুল প্রভাব। পাশাপাশি বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের বিস্তৃত এলাকায় দলিত, আদিবাসীদের মধ্যে লাল রাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা বাড়ছে। সেনা নামিয়েও কমিউনিস্ট প্রভাব দমনে ব্যর্থ হচ্ছে কংগ্রেস সরকার।

একপাশে কমিউনিস্ট চীন। উত্তর-পূর্বে মায়ানমার থাকিন থাং টুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট গেরিলাদের মুক্তাঞ্চল। পূর্ব বাংলায় ঊনসত্তর সাল থেকে আওয়াজ তুলেছে শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধরো, সমাজতন্ত্র কায়েম করো। ঊনসত্তরের আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থানের নেতা রেড বা লাল মওলানা ভাসানী। শেখ মুজিব ছিলেন উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ছিল বাঙালি সামন্ত মুৎসুদ্দি শ্রেণির প্রতিনিধি। পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীলরা কখনো বলেন না যে, শেখ মুজিব ছিলেন আদ্যন্ত কমিউনিস্টবিরোধী। ফলে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে নেতা হিসেবে প্রথম পছন্দ যে শেখ মুজিব হবেন সেটাই স্বাভাবিক। ১৯৭০-৭১ সালে কংগ্রেসের দোসর ছিল মস্কোপন্থিরা। স্বাভাবিকভাবেই সব দেশেই রুশপন্থি লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ মুখে সমাজতন্ত্রী হলেও কার্যত ছিল সাম্রাজ্যবাদের সেবা দাস। ঝড়পধষরংস রহ ড়িৎফ নঁঃ ওসঢ়ৎরধষরংস রহ ফববফ। ভারতেও রুশপন্থি লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরাই শেখ মুজিবুর রহমানের এমন এক ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছিলেন যা ভারত সরকারের পছন্দ। ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত রেডিওতে তো বটেই, সর্বত্র মাত্রাছাড়া মুজিব বন্দনা আজও জনমনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেখ সাহেবের ভূমিকাকে এমন উচ্চতায় রেখে গেছে, যা মিথ হয়ে রয়ে গেছে। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেই আপনার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা নামিয়ে আনা হবে। অথচ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা নিয়ে নতুনভাবে গবেষণার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমরা জানি মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তানের রাজনৈতিক কৌশল। বস্তুত ওই মামলাই জনমনে শেখ সাহেবকে নায়কের মর্যাদা দিয়েছিল। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি মুজিবকে, দরকার হলে বাস্তিল দুর্গ ভেঙে বন্দিমুক্ত করার মতো জেল থেকে ছিনিয়ে আনব আন্দোলন করে। তা তিনি করেও ছিলেন। ঊনসত্তরের তীব্র গণআন্দোলনের জেরেই পাক শাসকরা শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুজিব অবশ্য কৃতজ্ঞচিত্তে বয়স হয়েছে বলে ভাসানীকে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আসলে মুজিব তখন পাকিস্তান শাসকদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করে ক্ষমতা ভাগাভাগির স্বপ্নে বিভোর। ভাসানী ওদিকে আওয়াজ তুলেছেন গোলটেবিল না রাজপথ! জনগণের প্রতিধ্বনি উঠেছে রাজপথ রাজপথ। ক্ষমতার ভাগ নিতে আন্দোলনের পথ থেকে কখনোই পিছু হটার বান্দা ছিলেন না মওলানা ভাসানী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে ইদানীং বেশ কিছু লেখালেখিতে বলা হচ্ছে যে, এ কোনো ষড়যন্ত্র নয়। শেখ মুজিব পাকিস্তানকে ভাঙতে সত্যি সত্যিই ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। শেখ সাহেব, তাজউদ্দীন আহমদ এবং মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠজন, ডাক্তার এম এ করিমের ‘কাসিমবাজার থেকে আগরতলা’ বইয়ে বিস্তারিত লেখা আছে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল একাধিক সত্তা। একদিকে তিনি ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। চরম দক্ষিণপন্থি বরিশালের চিত্তরঞ্জন সুতার, ডাক্তার কালিদাস বৈদ্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখায় সক্রিয়, পাশাপাশি ২৫ মার্চ সন্ধ্যাবেলায় তাজউদ্দীন আহমদ যখন তাকে ছোট্ট টেপরেকর্ডার এগিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করতে অনুনয় বিনয় করছেন, তখন শেখ সাহেব সোজাসাপটা জানিয়ে দিচ্ছেন তাজউদ্দীন, তুমি কি চাও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বিপদে পড়ি! জানতে পারলে পাকিস্তান সরকার আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দেবে। ৭ মার্চের যে ঐতিহাসিক ভাষণ মুজিব দিয়েছিলেন, শোনা যায় সেখানেও তিনি শেষে জয়বাংলা, জয় পাকিস্তান বলেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ কখনোই একমাত্রিক ছিল না। আর তার সর্বাধিনায়ক মোটেও শেখ মুজিব ছিলেন না। লিবারেশন ওয়ারের আসল যোদ্ধা ছিলেন দেশের জনগণ। তৎকালীন পূর্ব বাংলার খুব কম পরিবার ছিল যারা কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মেনে মুজিব ২৫ মার্চের আগে গোপন ডেরাতেও গেলেন না। দলের কর্মী-সমর্থকদের অপ্রস্তুত অবস্থায়, বিপদের মুখে ফেলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ধরা দিলেন। অথচ পাকিস্তান আর্মি যে ক্র্যাকডাউন করবে তার খবর তিনি বহু আগেই জানতেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বহু প্রাক্তন সেনানায়ক আমাকে বলেছেন যে পাকিস্তান যে যুদ্ধ প্রস্তুতি করছে তা আমরা, বাঙালি সেনাবাহিনীর লোকজন বারবার মুজিব ভাইকে খবর পাঠিয়েছি। তিনি পাত্তা দেননি।  তখন তিনি ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সঙ্গে শান্তি বৈঠক করছেন। আমরা যদি আগে আঘাত হানতাম, তাহলে এত রক্তক্ষয় হতো না। এমনকি ২৫ মার্চ রাতের দিকেও শেখ মুজিব তাজউদ্দীন আহমদকে বলেছেন, ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো’ আমি বন্ধ ডাকছি। ততক্ষণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা শুরু করে দিয়েছে। কত প্রাণ চলে গেল। ইতিহাস নতুন করে নির্মিত হোক। বলি বটে যে হোক। কিন্তু কাজটা কঠিন। খুবই কঠিন। প্রচলিত ইতিহাসকে নির্মোহ দেখা সহজ নয়। আমাকে যারা একটুও চেনেন তারা জানেন যে বাংলাদেশকে আমি ভালোবাসি। সুদিনে, দুর্দিনে তার পাশে থাকতে চাই। তার মহান স্বাধীনতা দিবসে অতি সাধারণ এক ভারতের নাগরিকের কুর্নিশ।

লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা এবং লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত