শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ছায়ানট-শহীদ মিনারে সন্জীদা খাতুনকে শেষ শ্রদ্ধা

আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৪:১০ এএম

পুরোদমে যখন স্বাধীনতা দিবস আর বাংলা বর্ষবরণের প্রস্তুতি চলছিল ছায়ানটে তখনই হুট করে নেমে আসে বিষাদ। গত মঙ্গলবার মারা যান ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সন্জীদা খাতুন। তার মৃত্যুতে আনন্দ আয়োজন বদলে যায় শোকের অনুষ্ঠানে। গতকাল বুধবার সেই ছায়ানট ভবনেই শেষবারের মতো বিদায় জানানো হলো সেখানকার ‘মিনু আপা’ বলে পরিচিত সন্জীদা খাতুনকে। এদিকে সন্জীদা খাতুনকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। গতকাল বেলা আড়াইটায় সন্জীদা খাতুনের কফিন শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। অশ্রু, গান, কবিতা ও ফুলে তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’সহ বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করেন শিল্পীরা। তাকে শেষবারের মতো দেখতে হাজির হয়েছিলেন অনেকে।

গতকাল সকাল থেকেই ছায়ানট ভবনে ভিড় করেন শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তাদের দীর্ঘ লাইন ছায়ানট ভবন ছাড়িয়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে গিয়ে ঠেকে।

সন্জীদা খাতুনকে শেষ বারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ছায়ানটসহ, নালন্দা, কণ্ঠশীলনের মতো দেশের অগ্রগণ্য প্রায় সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। তিনি চলে গেলেন এমন সময়ে, যখন বাঙালি বৈশাখবরণে নানা প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই ষাটের দশক থেকে বাংলা বর্ষবরণ নাগরিক পরিমণ্ডল থেকে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি।  তার মরদেহ ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসন্তের গান  ‘ঝরা পাতা গো’ গেয়ে শোনাচ্ছিলেন শিল্পীরা। শেষযাত্রার এই আয়োজনে ‘তুমি যে সুরের আগুন’, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’, ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি’, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘সম্মুখে শান্তিপারাবার’, নজরুলের ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির নির্মল’সহ বেশ কিছু গান গেয়ে ছায়ানটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিদায় জানান তাদের গুরুকে। এই গানের শুদ্ধ সুর তারা সন্জীদা খাতুনের কাছেই শিখেছেন। একদিকে শিল্পীদের কণ্ঠে গান, অন্যদিকে সারিবদ্ধভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন। ছায়ানটের উঠানে আসা হাজারো মানুষের চোখে জল। কেউ কেউ কেঁদেছেন অঝোর ধারায়। ছায়ানটে সন্জীদা খাতুনের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হয় ‘আগুনের পরশমণি’ এবং সবশেষে জাতীয় সংগীত গেয়ে।

ছায়ানটের সহসভাপতি মফিদুল হক বলেন, ‘রমনার বটমূলে এখন যে বর্ষবরণ কোটি বাঙালির আবেগে জায়গা নিয়েছে, তার পেছনের মানুষটি সন্জীদা খাতুন। সারা দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। গান শিখিয়েছেন, শিক্ষকতা করেছেন। গবেষণা করেছেন। মানুষকে ভালোবেসেছেন। তিনি অতুলনীয় কর্মগুণেই সবার মাঝে থাকবেন।’

সাবেক সংসদ সদস্য ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত বলেন, সন্জীদা খাতুন বাঙালি সংস্কৃতির জন্য আজন্ম কাজ করেছেন। তিনি সারা পৃথিবীতেই বাঙালিকে উঁচুস্থানে নিয়ে যেতে কাজ করেছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পথ ধরে তিনি আলো বিলিয়েছেন। সেই আলোতে আমরা আলোকিত হয়েছি।

সন্জীদা খাতুন একক কোনো বৈশিষ্ট্যে আবদ্ধ ছিলেন না। একাধারে শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজের দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন। গত মঙ্গলবার ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯১ বছর বয়সে তিনি জীবনের মায়া সাঙ্গ করেন। সাংস্কৃতিক সংগঠক রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘সন্জীদা খাতুন এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন। শুদ্ধ সংগীতের প্রসারে তিনি সারা দেশে কাজ করেছেন, অসংখ্য মানুষের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করেছেন। যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন, তারা আলোকিত হয়েছেন।’

গতকাল বেলা সোয়া ১টার দিকে সন্জীদা খাতুনের মরদেহ ছায়ানট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে  নেওয়া হয়। সেখানে দীর্ঘদিন অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন সন্জীদা খাতুন। বেলা আড়াইটায় তার কফিন নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষ বিদায় জানান। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শ্রদ্ধা অনুষ্ঠান শেষে সন্জীদা খাতুনের মরদেহ ফিরিয়ে নেওয়া হবে হাসপাতালের হিমঘরে। পরের আনুষ্ঠানিকতা কী হবে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি তার পরিবার।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত