মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হলেও তার ভেতরে রয়েছে এমন কিছু নেতিবাচক প্রবৃত্তি, যা তাকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে। সেই নেতিবাচক প্রবৃত্তিগুলো পরিহার করতে কোরআনে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, মানুষের মাঝে রয়েছে অকৃতজ্ঞতা, তর্কপ্রিয়তা, ত্বরাপ্রবণতা, হতাশা, কৃপণতা, অহংকার ইত্যাদি মন্দ স্বভাব। এসব স্বভাব কেবল তার পার্থিব জীবন নয়, বরং পরকালীন মুক্তির পথকেও বিপদগ্রস্ত করে তোলে। তাই কোরআনে এসব স্বভাব থেকে দূরে থাকতে সতর্ক করা হয়েছে। এখানে কোরআনের আলোকে মানুষের কিছু নেতিবাচক স্বভাব উল্লেখ করা হলো, যেন আমরা সেগুলো থেকে বিরত থাকতে পারি এবং সুন্দর চরিত্র গঠনে সচেষ্ট হই।
শয়তানের ফাঁদে পা দেওয়া : কোরআন ও হাদিসে অসংখ্যবার সতর্ক করার পরও মানুষ শয়তানের ফাঁদে পা দেয়, যা তার ইহকালীন ও পরকালীন বিপদের কারণ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমাকে সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে উপদেশ পৌঁছানোর পর। শয়তান মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত ২৯)
অকৃতজ্ঞতা : মানুষ তার স্রষ্টা ও তার উপকারী বন্ধুর প্রতি অকৃতজ্ঞ, যা নিন্দনীয়। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের দিয়েছেন তোমরা তার কাছে যা কিছু চেয়েছ তা থেকে। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই অতি মাত্রায় জালেম, অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৪)
তর্কপ্রিয় : ঝগড়া-বিবাদ ও কুতর্কে লিপ্ত হওয়া মানুষের মন্দ স্বভাব, যা পরিহার করা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষের জন্য এই কোরআনে বিভিন্ন উপমার দ্বারা আমার বাণী বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। মানুষ বেশিরভাগ ব্যাপারেই বিতর্কপ্রিয়।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত ৫৪)
ত্বরাপ্রবণ : তাড়াহুড়া করা মানুষের স্বভাব। আল্লাহ তাড়াহুড়া পছন্দ করেন না। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ত্বরাপ্রবণ, শিগগিরই আমি তোমাদের আমার নিদের্শনাবলি দেখাব। সুতরাং তোমরা আমাকে ত্বরা করতে বলো না।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৭)
মানসিক অস্থিরতা : মানসিক অস্থিরতা মানুষের একটি মন্দ স্বভাব। কেননা মানসিকভাবে অস্থির ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থির চিত্তরূপে।’ (সুরা মাআরিজ, আয়াত ১৯)
হতাশাগ্রস্ত হওয়া : কোরআনের দৃষ্টিতে হতাশা পরিহারযোগ্য মন্দ স্বভাব। কোরআনে মানুষের এই স্বভাবের নিন্দা করে বলা হয়েছে, ‘যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ স্পর্শ করে সে হয় অতি কৃপণ।’ (সুরা মাআরিজ, আয়াত ২০-২১)
অনুগ্রহ উপেক্ষা করা : আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ থেকে বিমুখ হওয়া নিন্দনীয়। বিমুখ হওয়ার অর্থ হলো অনাগ্রহ দেখানো ও যথাযথ মূল্যায়ন না করা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করি, তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং দূরে সরে যায়। আর তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করলে সে একেবারে হতাশ হয়ে যায়।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৮৩)
মিথ্যাচার : মিথ্যাচার জঘন্যতম পাপ। অসংখ্য মানুষ এ পাপে জড়িয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা দূরে থাকো মিথ্যাকথন থেকে।’ (সুরা হজ, আয়াত ৩০)
সম্মান ও সম্পদের মোহ : সম্মান ও সম্পদের মোহ বহু পাপের কারণ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে অপর কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা সেটার লালসা করো না।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৩২)
আল্লাহকে ভুলে থাকা : মহান আল্লাহকে ভুলে থাকা নিন্দনীয়। কোরআনে এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ‘মানুষ বলে, আমার মৃত্যু হলে আমি কি জীবিত অবস্থায় উত্থিত হবো? মানুষ কি স্মরণ করে না যে, আমি তাকে পূর্বে সৃষ্টি করেছি, যখন সে কিছুই ছিল না?’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত ৬৬-৬৭)
মৃত্যুকে ভুলে থাকা : মানুষ পার্থিব জীবনে এমনভাবে চলাফেরা করে, যেন কোনো দিন তার মৃত্যু হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমার আগে কোনো মানুষকে অনন্ত জীবন দান করিনি, সুতরাং তোমার মৃত্যু হলে তারা কি চিরজীবী হয়ে থাকবে? জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দ্বারা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যানীত হবে।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৫)
পরকালকে ভুলে থাকা : মৃত্যু-পরবর্তী জীবন ও পরকালীন জবাবদিহি ভুলে থাকা মানুষের একটি মন্দ স্বভাব। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ কি মনে করে যে তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেওয়া হবে?’ (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ৩৬)
অপব্যয় ও অপচয় : অপব্যয় ও অপচয় দূষণীয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা খাও ও পান করো, কিন্তু অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৩১)
নিজেকে অমুখাপেক্ষী ভাবা : মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে সে আল্লাহর মুখাপেক্ষী। কিন্তু বহু মানুষ নিজেকে অমুখাপেক্ষী ভাবে। তাদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, ‘বস্তুত মানুষ সীমালঙ্ঘন করেই থাকে। কেননা সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে। তোমার প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত।’ (সুরা আলাক, আয়াত ৬-৮)
কৃপণতা : কৃপণতা মানুষের অতিশয় নিন্দনীয় স্বভাব। পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে কৃপণতার নিন্দা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু, বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮০)
অহংকার : অহংকার বা আত্মম্ভরিতা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম স্বভাব। আল্লাহ অহংকার অপছন্দ করেন এবং তা মানুষের পতন ডেকে আনে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কোনো উদ্ধত-অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লুকমান, আয়াত ১৮)
হিংসা-বিদ্বেষ : ইসলামের দৃষ্টিতে হিংসা একটি মানসিক ব্যাধি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ হিংসা থেকে পানাহ চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই, যখন সে হিংসা করে।’ (সুরা ফালাক, আয়াত ৫)
আত্মগৌরব : আত্মপ্রশংসা ও আত্মগৌরব মানুষকে বাস্তবতাবিমুখ করে। ইসলাম আত্মগৌরব থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। কে আল্লাহভীরু এ সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত।’ (সুরা নাজম, আয়াত ৩২)
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত মানুষের মন্দ স্বভাবগুলো উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের সতর্ক করার জন্য, যেন আমরা তা জানতে পারি, বুঝতে পারি এবং সেগুলো থেকে দূরে থাকতে পারি। এসব স্বভাব মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় এবং ব্যক্তিজীবনে অনুশোচনা আর সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে। অহংকার, হিংসা, কৃপণতা, মিথ্যাচার, তাড়াহুড়া, হতাশা বা শয়তানের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হওয়া এসব প্রবৃত্তি মানুষকে সৎপথ থেকে বিচ্যুত করে এবং আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে। তাই কোরআন শুধু তিলাওয়াত করলেই হবে না, বরং আত্মগঠনের পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কোরআনের আয়াতগুলো যেমন সতর্কবাণী বহন করে, তেমনি তা কল্যাণের পথ দেখায়। যারা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে এবং মন্দ স্বভাব ত্যাগ করে, তাদের জন্য রয়েছে প্রশান্তিময় জীবন ও সফল পরকাল। আমাদের উচিত কোরআনের শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগানো, আত্মশুদ্ধির চর্চা করা এবং নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের প্রচেষ্টা চালানো। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআনের আলোয় আলোকিত করে মন্দ স্বভাব পরিহারের শক্তি ও তওফিক দান করুন। আমিন।