বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সিপিডির গবেষণা

রিটার্ন দেয় না ৯১ শতাংশ নিবন্ধিত কোম্পানি

  • ২০২৩ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা
  • রিটার্ন দাখিল না করাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্যের প্রস্তাব
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১১:২৬ পিএম

দেশে মোট যে রাজস্ব আহরণ হয় তার মধ্যে ২০ শতাংশ করপোরেট কর থেকে আসে। কিন্তু বাংলাদেশের কর কাঠামোতে নানা ধরনের জটিলতা বিদ্যমান। বিশেষ করে নানা ক্ষেত্রে যেমন অব্যাহতি দেওয়া আছে, তেমনি অনেক কোম্পানি ঠিকমতো কর পরিশোধ করে না। আর নিবন্ধিত যত কোম্পানি আছে, তার মধ্যে ৯১ শতাংশই রিটার্ন দাখিল করে না। রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করার জন্য আইন সংস্কার করতে হবে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে যারা রিটার্ন দাখিল থেকে বিরত থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার উদ্যোগ নিতে হবে।

করপোরেট করের বিষয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এসব কথা জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সংগঠনটির ধানমন্ডির কার্যালয়ে সোমবার ‘কর ন্যায্যতার দৃষ্টিতে উত্তরণকালীন সময়ে করপোরেট করের সংস্কার’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। প্রতিবেদনে করপোরেট কর ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট তামিম আহমেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের অধীনে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ২ লাখ ৮৮ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার ৩৮১টি কোম্পানি রিটার্ন দাখিল করে, যা মোট নিবন্ধিত কোম্পানির মাত্র ৯ শতাংশ। এটি করপোরেট কর আহরণের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। অনেক কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে রিটার্ন দাখিল করে না। যেসব কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে রিটার্ন দাখিল করছে না তাদের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এজন্য বিদ্যমান কর আইনে সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ছাড়া বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে ১২ শতাংশ করপোরেট কর রয়েছে। এ কর ন্যূনপক্ষে ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত বলে মনে করে সিপিডি। আগামী অর্থবছর থেকেই পোশাক খাতে ১৫ শতাংশ করপোরেট কর নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। সিপিডি মনে করেন, নির্দিষ্ট কিছু খাতকে কর অব্যাহতি এবং নানা ধরনের কর প্রণোদনা দেওয়া হয়। এটি কর ন্যায্যতার ক্ষেত্রে বড় বাধা। প্রতিষ্ঠানটি একটি ন্যায্যতাভিত্তিক কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব খাতের জন্য যৌক্তিক করপোরেট কর নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়। কোনো নির্দিষ্ট খাতকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া ন্যায্যতাভিত্তিক কর কাঠামোর অন্তরায় বলে মনে করে সিপিডি। এজন্য কোনো খাতেই ১৫ শতাংশের কম করপোরেট কর থাকা উচিত নয় বলে মনে করে সংগঠনটি।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কর ফাঁকির কারণে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ হারিয়েছে করপোরেট কর ফাঁকির কারণে। ২০২৩ সালে আনুমানিক করপোরেট কর ফাঁকির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সাল থেকে কর ফাঁকির পরিমাণ বেড়েছে, ২০১২ সালে ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে তা ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায় পৌঁছায়। বৈশ্বিক অবস্থার মতো বাংলাদেশেও করপোরেট কর কমতির দিকে। পোশাক, আইসিটিসহ অনেক খাত কর সুবিধা পেয়ে থাকে। ২ লাখ ৮৮ হাজার কোম্পানি রেজিস্টার্ড, কিন্তু ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিশন করেছে মাত্র ৯ শতাংশ কোম্পানি বা ২৪ হাজার ৩৮১ কোম্পানি। এটা একটা বড় বৈষম্য। যারা কর দিচ্ছে তাদের ওপর করের বোঝা বাড়ছে।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী দিনে সরকার যদি উচ্চমাত্রায় রাজস্ব না পায়, তাহলে ভর্তুকি, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, দক্ষ জনবল তৈরি করা সরকারের পক্ষে সহজ হবে না। প্রত্যক্ষ কর, অপ্রত্যক্ষ কর ও করবহির্ভূত আয় এই তিন উৎস থেকে মূল রাজস্ব আদায় করি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে করপোরেট খাত থেকে। প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব এখান থেকে আসে। আর ভ্যাট থেকে আসে ৪০ শতাংশ রাজস্ব। এ দুই উৎস থেকে প্রায় ৬০ ভাগ রাজস্ব প্রতি বছর আসছে। এজন্য করপোরেট কর ও ভ্যাটের সংস্কার নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই।

তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেট এলে বিভিন্ন চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে তাদের নিজেদের খাতের কর হার কমানোর জন্য। এর ফলে কর নিয়ে সরকারের যে লক্ষ্য, তা প্রায়ই বিচ্যুত হয়, এটা খোলস আকারে থেকে যায়। যার পরিণতি ভালো হয় না। কর জিডিপির বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামী দিনে একটি কাঠামো প্রণোয়ন করা প্রয়োজন। তিনি জানান, সরকার যেসব খাতে কর ছাড় দেয়, সেটি দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই মুখ্য।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছি, ২০২৩ সালে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি কর ফাঁকি হয়েছে। এনবিআর কী পরিমাণ প্রতিক‚ল পরিবেশে কাজ করছে। শুধু যে কর ফাঁকি তা নয়, করজালের বাইরেও অনেক খাত ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের করজালের মধ্যে আনা যায়নি। এই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি রোধ করতে পারলেও বড় পরিমাণ অর্থ বা রাজস্ব আদায় সম্ভব।’

তিনি বলেন, ডিজিটালইজেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ব্যবসায়ী ও এনবিআরের স্বার্থে এটা করা জরুরি। অথচ এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের এক ধরনের অনীহা রয়েছে। বাংলাদেশে যেকোনো লেনদেন একক ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে যেকোনো লেনদেন ট্রেস ও ট্র্যাক করা যায়। সেটার আলোকে দাখিলকৃত রিটার্নকে ভেরিভাই করা যায়।

ক্রিশ্চিয়ান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন বলেন, বেশিরভাগে নিম্ন আয়ের দেশ প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যখন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করছি প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।

সিপিডি বাংলাদেশের ক্রমাগত কর ফাঁকি সমস্যার পেছনে বেশ কয়েকটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চকরের হার, দুর্বল প্রয়োগ, জটিল আইনি কাঠামো এবং কর ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি। সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে, উচ্চমাত্রার কর ফাঁকি সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে এবং যারা আইন অনুসরণ করে তাদের ওপর বোঝা বাড়িয়ে দেয়।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত