মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

নিয়ন্ত্রণে নেই বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি

আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০২ এএম

দেশে ম্যালেরিয়া নির্মূলে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্বত্য দুই জেলা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৯০ শতাংশই এ দুই জেলায়। এর মধ্যে বান্দরবানে মোট রোগীর ৫৯ শতাংশ ও রাঙ্গামাটিতে ২৯ শতাংশ। সীমান্তবর্তী দুই দেশের মানুষের মেলামেশা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জুমচাষ ও শরণার্থীশিবিরের বাসিন্দাদের চলাফেরার কারণে কোনোভাবেই এ দুই জেলায় ম্যালেরিয়া কমানো যাচ্ছে না। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদিও বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫১ জেলায় ম্যালেরিয়া ছিল না। বাকি ১৩ জেলার মধ্যে সংক্রমণ ছিল। এর মধ্যে ৪ জেলা ম্যালেরিয়ামুক্ত হয়েছে। বাকি ৯ জেলায় এখনো রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ৭ জেলা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাকি ২ জেলায় রোগী নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখনো ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ১১ জেলায় মোট রোগীর মাত্র ১০ শতাংশ রয়েছে। ফলে অধিদপ্তর এই ১১ জেলা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করছে।

এই মুহূর্তে দেশের মাত্র দুই জেলা ম্যালেরিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজেস (এটিডিএস) নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ্যামল কুমার দাস। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা। ম্যালেরিয়া নির্মূলে আমরা দীর্ঘবছর ধরে কাজ করছি। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সংক্রমণের যে মাত্রা সেটি নিম্নমুখী। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথেই আছি।

এই কর্মকর্তা জানান, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫১ জেলা ইতিমধ্যেই ম্যালেরিয়ামুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের চার জেলা ২০২৪ সালেই নির্মূল করতে পেরেছি। বাকি থাকে ৯ জেলা। এগুলো হলো সিলেট জোনের চার জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি।

ডা. শ্যামল কুমার বলেন, এই ৯ জেলার মধ্যে ৭ জেলা নিয়ন্ত্রণে আছে। বাকি ২ জেলা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ ভৌগোলিক কারণ, সেখানকার মানুষের ভাষা, পেশা, যেমন জুমচাষ, কাঠুরিয়া, কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাসিন্দাদের চলাফেরা। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ক্রস বর্ডার। বর্ডারের এ-পাশে ও-পাশে কিছু অনিয়ন্ত্রিত যাতায়াত, সেখানকার একই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সম্পর্ক, ব্যবসা।

এ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে এ দুই জেলায় দেশের মোট ম্যালেরিয়ার ৯০ শতাংশ রোগী। অন্য সাত জেলায়ও এ অবস্থা ছিল। কিন্তু সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। এখন এ দুই জেলা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৩ জেলার ৭৭ উপজেলায় প্রকোপ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৩টি জেলার ৭৭টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে। এর মধ্যে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সর্বাধিক। এ তিন জেলাকে উচ্চ ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়।

মৃত্যু কমেছে ৯৬% ও আক্রান্ত ৮৫% : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে (২০০৮-২০২৪ পর্যন্ত) ম্যালেরিয়াজনিত অসুস্থতা ৮৫ শতাংশ ও মৃত্যু ৯৬ শতাংশ কমেছে। ২০১৩ সালে দেশে মোট ম্যালেরিয়া রোগী ছিল ২৬ হাজার ৮৯১ জন ও সে বছর মারা যায় ১৫ জন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে মোট রোগী ছিল ১৩ হাজার ৯৯ ও মারা যায় ৬ জন। এ বছরের গত মার্চ পর্যন্ত ৬৪১ জন রোগী পাওয়া গেছে ও মারা গেছে একজন।

সর্বোচ্চ মৃত্যু ও রোগী ২০১৪ সালে : অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে (২০১৩-২০২৪) দেশে ২ লাখ ৭০ হাজার ১০৭ জন ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেছে ও মারা গেছে ১৫৯ জন। এর বাইরে এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত রোগী পাওয়া গেছে ৬৪১ ও মারা গেছে একজন।

এই ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেছে ২০১৪ সালে ৫৭ হাজার ৪৮০ ও সর্বোচ্চ মৃত্যুও ছিল সে বছর, ৪৫ জন। এ সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন রোগী ছিল ২০২০ সালে ৬ হাজার ১৩০ ও সর্বনিম্ন ছয়জন করে করে মারা যায় ২০২৩ ও ২০২৪ সালে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী ছিল ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ৭১৯ ও মৃত্যু সাত; ২০১৮ সালে এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ রোগী ছিল ২০১৭ সালে ২৯ হাজার ২৪৭ ও মৃত্যু ৯ জন করে ২০১৫, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে।

মোট রোগীর ৯২% তিন জেলায় : অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ ম্যালেরিয়াপ্রবণ তিন পার্বত্য জেলায় মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৯২ শতাংশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৪ সালে ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলার মোট রোগীর ৫৯ শতাংশই ছিল বান্দরবানে ও ২৯ শতাংশ ছিল রাঙ্গামাটিতে। এরপর খাগড়াছড়িতে ৪ শতাংশ ও কক্সবাজারে ৩ শতাংশ রোগী ছিল। চট্টগ্রামে ছিল মোট রোগীর শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। বাকি আট জেলায় ছিল মোট রোগীর শূন্য দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।

ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের আট জেলায় মোট স্থানীয় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়জন। এই আট জেলার মধ্যে ছয় জেলায় কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে স্থানীয় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা শূন্য।

২ জেলায় কমায় খুবই ধীরগতি, ২ জেলায় বাড়ছে, ১ জেলায় অপরিবর্তিত : গত চার বছরের ম্যালেরিয়া সংক্রমণের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ম্যালেরিয়াপ্রবণ পাঁচ জেলার মধ্যে দুই জেলায় সংক্রমণ খুবই ধীরগতিতে কমছে। বাকি দুই জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। এক জেলায় সংক্রমণ অপরিবর্তিত রয়েছে।

২০২১ সালে বান্দরবানে ছিল মোট রোগীর ৭২ শতাংশ। সেটি ২০২৩ সালে এসে দাঁড়ায় ৬০ শতাংশে। কিন্তু ২০২৪ সালে তা সামান্য কমে ৫৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে রোগী বাড়ছে। রাঙ্গামাটিতে ২০২১ সালে রোগী ছিল মোট রোগীর ২১ শতাংশ। সেটি এখন আরও বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। গত ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর ১ শতাংশ বেড়েছে।

খাগড়াছড়িতে ২০২১ সালে রোগী ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৪ শতাংশ হয়েছে। গত ২০২৩ সালের তুলনায় বেড়েছে দ্বিগুণ। সে বছর রোগী ছিল ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

কক্সবাজারে খুবই ধীরগতিতে কমছে। বর্তমানে এখানে রোগী মোট রোগীর ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে ছিল ৮ শতাংশ। ২০২১ সালে এই জেলায় রোগী ছিল ৫ শতাংশ।

চট্টগ্রামের অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। গত তিন বছর ধরে এখানে রোগী শূন্য দশমিক ৮ শতাংশের ঘরে ওঠানামা করছে। ২০২১ সালে রোগী ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।

চার প্রজাতি মূল বাহক : ডা. শ্যামল কুমার দাস জানান, দেশে ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশার প্রাথমিক চারটি বাহক বা চার প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো অ্যানফিলিপিনেসিস, অ্যানমিনিমাস, অ্যানসানডাইকাস ও অ্যানবাইমাই (অ্যানডিরাস)। এ ছাড়া তিনটি সেকেন্ডারি ভেক্টর রয়েছে অ্যানভেগাস, অ্যান-অ্যানুলারিস ও অ্যান-অ্যাকোনিটাস। এ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা স্থানীয়ভাবে বিশেষ পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া সংক্রমণে ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া অ্যানম্যাকুলেটাস ও অ্যানউইলমরি নামে আরও দুটি প্রজাতি সন্দেহজনক ভেক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আজ ম্যালেরিয়া দিবস : এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসকরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য আমরাই করব ম্যালেরিয়া নির্মূল : নব উদ্যমে, নব বিনিয়োগে ও নব চিন্তায়।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত