শহরের পাড়া-মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মাধ্যমে ময়লা সংগ্রহ করা হলেও আবর্জনা ফেলার নির্ধারিত ভাগাড় তৈরি করতে পারেনি রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। খোলা আকাশের নিচে অনেকটা অরক্ষিত পরিবেশে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। ব্যস্ততম সিটি হাটের ভেতরে প্রায় দুই দশক ধরে ফেলা হচ্ছে পুরো শহরের ময়লা। অথচ এখানে সপ্তাহের দুদিন পশু হাট বসে। হাটে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে। অপরিচ্ছন্ন ভাগাড়ের ভেতরেই তারা বাধ্য হচ্ছেন কেনাবেচা করতে। আবার এই ভাগাড়টিও এরই মধ্যে ময়লায় ভর্তি হয়ে গেছে।
এখন এ অবস্থায় সিটি হাটের সামনের ব্যস্ততম বাইপাস সড়কের ধারের ফুটপাতে ফেলা হচ্ছে শহরের আবর্জনা। এতে আশপাশের জনবসতিতে বেড়েছে মশা, মাছির উৎপাত। রাস্তায় যানবাহন ও মানুষের চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। এ সংকটের কথা স্বীকার করেছেন সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষও। তারা বলছেন, এ ইস্যুতে তারাও বিব্রত। ভাগাড়ের নির্ধারিত জায়গা না থাকায় তারাও বেকায়দায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন।
পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে রাজশাহী দেশ জুড়েই আলোচিত। বিশেষ করে রাতের বেলা শহরের ময়লা-আবর্জনা পাড়া-মহল্লা থেকে তুলে সেগুলো ভাগাড়ে ফেলার উদ্যোগটি রাজশাহীবাসীকে দিয়েছে এ সফলতা। কিন্তু এসব ময়লা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ধ্বংস করা হয় না। মানুষ পরিচ্ছন্ন শহর দেখলেও আবর্জনা যে এলাকায় ফেলা হচ্ছে, সেই এলাকার বাসিন্দারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন, স্বাস্থ্যহানিরও শিকার হচ্ছেন।
রাজশাহী শহরের পাড়া-মহল্লার সংগ্রহ করা ময়লা-আবর্জনা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রিকশা-ভ্যানে করে নিয়ে যায় নির্ধারিত সেকেন্ডারি পয়েন্টে। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডেই তৈরি করা হয়েছে এই সেকেন্ডারি পয়েন্ট। বাড়িতে ব্যবহৃত তরিতরকারির উচ্ছিষ্ট থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা পলিথিন ব্যাগ, দোকানপাট বা ছোটখাটো কারখানার বর্জ্য সব ধরনের ময়লা এসব সেকেন্ডারি পয়েন্টে ফেলা হয়। আর সেকেন্ডারি পয়েন্ট থেকে সিটি করপোরেশনের ট্রাকে করে ময়লা-আবর্জনা নিয়ে ফেলা হয় ভাগাড়ে। রাজশাহী শহরে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ টন ময়লা-আবর্জনা উৎপন্ন হয়। আর এসব পরিষ্কার করতে কাজ করেন প্রায় ১ হাজার ৩০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
বাড়ি থেকে সেকেন্ডারি পয়েন্টের ময়লা ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশংসা থাকলেও ভাগাড় ব্যবস্থাপনা নিয়ে বরাবরই অভিযুক্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। সিটি করপোরেশন বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও নির্ধারিত ভাগাড়ের বিষয়ে তাদের উদাসীনতা স্পষ্ট। এমনকি প্রতিষ্ঠার এত বছরও শহরের জন্য নির্ধারিত স্বস্থ্যসম্মত ভাগাড় বানানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রাজশাহী পৌরসভা প্রতিষ্ঠা থেকে সিটি করপোরেশন এ পর্যন্ত একাধিক জায়গায় ভাগাড় বানানো হয়েছে। আবার সেগুলো ভর্তি হয়ে যাওয়ায় নতুন জায়গায় স্থানান্তর করা হয়েছে। রাজশাহী জেলা স্টেডিয়াম এলাকায় একসময় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় বানানো হয়। সেই জায়গা ভর্তির পর সেখান থেকে স্থানান্তর করে বড়বনগ্রাম এলাকায় নেওয়া হয়। কয়েক বছরের আবর্জনায় সেটিও ময়লার স্তূপে পরিনণত হওয়ার পর সেটি বন্ধ করা হয়। সেই স্থানে পরবর্তীকালে বানানো হয়েছে শহীদ জিয়া শিশু পার্ক। এরপর ভাগাড় করা হয়েছে রাজশাহী সিটি হাটে। ভাগাড় বানানোর জন্য সিটি করপোরেশনকে কোনো বাড়তি খরচ করতে হয়নি। উন্মুক্ত জায়গায় ট্রাকে করে ময়লা ফেলতে শুরু করার পরই সেটি ভাগাড় হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে। এজন্য কোনো বাউন্ডারি ওয়ালও তৈরি করা হয়নি। উন্মুক্ত স্থানে ময়লা-আবর্জনা পড়তে পড়তে পুরো এলাকায় এখন হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। হাটের দিন হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত এ দুর্গন্ধময় স্থানেই। এদিকে প্রায় দুই দশক ধরে ময়লা জমতে জমতে এই ভাগাড়টি এখন উঁচু পাহাড়ে রূপ নিয়েছে। ময়লা ফেলার আর কোনো জায়গা হচ্ছে না এখানে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে সিটি হাটের সামনের নওদাপাড়া-কাশিয়াডাঙ্গা বাইপাস সড়কের ধারেই এখন প্রতিদিন জমছে ময়লা। রাস্তার ধারে দুর্গন্ধের পরিবেশ তৈরি করছে এসব আবর্জনা। মানুষকে পথ চলতে হচ্ছে নাকে হাত দিয়ে। বিষাক্ত ময়লার কারণে রাস্তার ধারের বেশ কয়েকটি বড় গাছও এরই মধ্যে মরে গেছে। এলাকা জনবসতিপূর্ণ হওয়ায় স্থানীয় লোকজন এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। পথচারী ষাটোর্ধ্ব আবদুর রহমান বললেন, ভাগাড়ের দুর্গন্ধে তারা অতিষ্ঠ, বাড়িতে সবসময় ভনভন করছে মাছি। আর মশার উৎপাতে দিনের বেলাতেও বসে থাকা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘আমাদের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বলে তো কোনো লাভ হবে না। কারণ যারা ময়লা ফেলে তারা তো আর এই এলাকায় থাকে না। তারা যা করবে সেটাই আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।’
এদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, নির্ধারিত জায়গা না থাকায় একেক সময় শহরের একেক জায়গায় ভাগাড় বানানো হচ্ছে। এসব ভাগাড় সবসময়ই নাগরিক দুর্ভোগের কারণ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার উত্তরাঞ্চলীয় সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের অনেকবারই কথা হয়েছে। তারা বরাবরই একই ধরনের কথা বলে যে, এ নিয়ে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা সফলতা পাননি।
নিজেদের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন বলেন, আধুনিক ভাগাড় ব্যবস্থাপনা নিয়ে কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও তারা সফল হননি। তিনি বলেন, বর্তমানে যেখানে ময়লা ফেলা হচ্ছে সেই ভাগাড়টি ভর্তি হয়ে গেছে। সেখান থেকে এটি সরানোর জন্য অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানকার ময়লাগুলোকে স্বাস্থ্যস্মত উপায়ে ধ্বংস করার জন্যও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। শেখ মো. মামুন বলেন, সামনে বর্ষা মৌসুম, এটি নিয়ে তারা আরও প্রকট সংকটে পড়বেন। এজন্য জরুরিভাবে ভাগাড়ের জন্য জায়গা নির্ধারণ করার কাজ চলছে। নতুন একটি জায়গায় ভাগাড় স্থানান্তরের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন। তবে সহসা ভাগাড় ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনার তথ্য নেই বলে জানান তিনি।