আজ মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস অডিটোরিয়ামে তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওইদিন বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পুলিশ পদক পরিয়ে দেবেন তিনি। পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষ্ঠানটি সফল করতে পুলিশ সদর দপ্তর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
গতকাল সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরের নীতিনির্ধারকদের একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে আইজিপি, সব এডিশনাল আইজিপি, ডিআইজি, ৫ মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ পুলিশ সদর দপ্তরের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে পুলিশ সপ্তাহ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে।
এদিকে, পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে কথা বলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম, উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর ও উপ-প্রধান তথ্য কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহছান প্রমুখ।
আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন মামলায় মূল আসামির সঙ্গে নিরীহ লোকদের আসামি করা হচ্ছে, তা সত্য। এসব মামলায় নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না। ৫ আগস্টের পর একটি মহল হয়রানির উদ্দেশ্যে মূল আসামির সঙ্গে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে মামলায় আসামি করছে। এ বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে।’ তিনি স্বীকার করেন, কোনো অপরাধে জড়িত ৫-১০ জন থাকলেও অনেক সময় ৩০০ জনের নাম অভিযোগে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে তিনি আশ্বস্ত করেন, তদন্তে প্রকৃত অপরাধীরাই গ্রেপ্তার হবেন, নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার হবেন না।
পুলিশ সপ্তাহ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, ‘আড়ম্বরপূর্ণ নয়, এ বছর আমরা কার্যকর পুলিশ সপ্তাহ পালন করতে চাই। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পরিকল্পনা শুনে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া এবার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারা তাদের অভিমত জানাবেন।’
আইজিপি আরও বলেন, জুলাই মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি জড়িত অনেক পুলিশ সদস্য বর্তমানে বিদেশে পলাতক রয়েছেন। দেশে থাকা অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং বিদেশে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হবে। গণঅভ্যুত্থান চলাকালে গুলি চালানো ও গুলির নির্দেশদাতাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টির বেশি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৬০০টিরও বেশি হত্যা মামলা। তদন্ত শেষ না হলে দায় নির্ধারণ ও প্রকৃত নির্দেশদাতা চিহ্নিত করা কঠিন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। পুলিশ সংস্কার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বাহারুল আলম বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশনের পক্ষে মত দিয়ে আসছি। সেখানে গ্রেপ্তার, মামলা ও তদন্ত ইত্যাদি বিষয় কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে বদলি, বেতন ও পদোন্নতির মতো বিষয়গুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনেই থাকবে। সংস্কার কমিশন নীতিগতভাবে এসব বিষয়ে একমত হলেও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।
পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশ পদক নিয়ে আগের মতোরই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পদক পেতে অতিরিক্ত আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত ইউনিটপ্রধানদের কাছেও তদবির করেছেন। বিগত পুলিশ সপ্তাহগুলোতেও তদবির করে অনেকে পদক ‘ছিনিয়ে’ নিয়েছেন। এ নিয়ে নানা সমালোচনার ঝড় উঠলেও কেউ বাদ যাননি। এবার ৬২ জনকে পদক দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, অন্যবারের মতো এবার ঢাকঢোল পিটিয়ে জাঁকজমকভাবে পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন করা হবে না। অনুষ্ঠানসূচিতে ব্যাপক কাটছাঁট করা হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে কুচকাওয়াজ (প্যারেড) হবে না। আরও হবে না রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠক। ইতিমধ্যে পুলিশ সপ্তাহ সামনে রেখে কিছু দাবিদাওয়া উপস্থাপন করার সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়েছে।
যেসব দাবি উত্থাপন হবে পুলিশ সপ্তাহে : পুলিশ সপ্তাহে যে দাবিগুলো উত্থাপন করা হবে, তা হলো স্বাধীন পুলিশ কমিশন, এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ ভাতা, পুলিশের যানবাহন বৃদ্ধীকরণ, মৃতদেহের দাফন/সৎকারের সুবিধার্থে পুলিশের অনুকূলে আর্থিক বরাদ্দ প্রদান, পুলিশের অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বতন্ত্র সাইবার ইউনিট প্রতিষ্ঠা, পুলিশের বিভাগীয় হাসপাতালে জনবল বৃদ্ধি ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামদ সরবরাহসহ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, নারী পুলিশবান্ধব কর্মপরিবেশ বিনির্মাণ, ভূমিবিরোধ, বালু-জলমহাল ও হাটবাজার ইজারা এবং পরিবেশ আইনসংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রতিরোধসহ বিবিধ ক্ষেত্রে সৃষ্ট আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ব্যয় সংকোচনের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক আইন/নীতিমালা থাকা প্রয়োজন, একই পদে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর অবসরকালে সুপার নিউমারারি/অফিসিয়িটিং পদোন্নতি প্রদান (কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত), ডিজিটালাইজড পুলিশি ব্যবস্থা প্রবর্তন ও পুলিশের দ্বি-স্তরবিশিষ্ট নিয়োগের প্রচলন করতে হবে। অন্যান্য বছরের যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল, তার মধ্যে হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন বাতিল, গ্রেড-১-এর সংখ্যা আরও বাড়ানো, ডিআইজির পদ বাড়ানো, সুপার নিউমারারি পদসংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন আরও পুলিশ নিয়োগ, সব সদস্যের জন্য বিশেষ ভাতা চালু, পুলিশের জন্য আলাদা মেডিকেল কলেজ চালু, অ্যাভিয়েশন ইউনিট চালু, উন্নত অস্ত্রসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা, গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো, আবাসন সংকট সমাধানের প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করা হবে। আরও কিছু নতুন দাবিও উত্থাপন করা হবে।
কর্মসূচির বিষয়ে একটি রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার পুলিশ সপ্তাহ হওয়ার কথা ছিল না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশ ছিল টালমাটাল অবস্থায়। নতুন আইজিপি আসার পর অনুষ্ঠানটি করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও সরকারের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা আসতে দেরি হচ্ছিল। এবার প্যারেড অনুষ্ঠান বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিন দিনের অনুষ্ঠানমালা : আজ (২৯ এপ্রিল) মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় রাজারবাগ পুলিশ অডিটোরিয়ামে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা পুলিশের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখবেন। তা ছাড়া ইউনিটপ্রধানরা ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা জানাবেন প্রধান উপদেষ্টাকে। দুপুর ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে দরবার শেষ হবে। দুপুর ২টায় প্রীতিভোজ হবে। বেলা সাড়ে ৩টায় আইজিপি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। ৩০ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় পুলিশ অডিটোরিয়ামে এসবি, সকাল সোয়া ১০টায় সিআইডি, বেলা ১১টায় র্যাবের প্রেজেন্টেশন হবে। দুপুর ১২টায় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সম্মেলন হবে। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ট্যুরিস্ট, পিবিআই ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের প্রেজেন্টেশন হবে। সন্ধ্যা ৭টায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠক হবে। ১ মে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১২টা পর্যন্ত এপিবিএন, রেলওয়ে, নৌপুলিশের প্রেজেন্টেশন হবে। এরই মধ্যে সকাল ১০টায় পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির স্টল পরিদর্শন ও বার্ষিক পুনাক সমাবেশ হবে। দুপুর ১২টায় বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময় সভা হবে। বেলা ৩টায় শিল্পাঞ্চল পুলিশের প্রেজেন্টেশন হবে। বিকেল পৌনে ৪টায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাধারণ সভা হবে। সন্ধ্যা ৭টায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তাদের পুনর্মিলনী হবে। রাত ৯টায় ডিনারের মাধ্যমে পুলিশ সপ্তাহের সমাপ্তি হবে বলে জানা গেছে।