সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

জাপান সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা 

রোহিঙ্গা-বিনিয়োগ আঞ্চলিক ইস্যু ঠাঁই পাবে আলোচনায়

  • নিক্কেই ফোরামে বিশেষ বক্তব্য দেবেন ড. ইউনূস
  • ১৫ মে টোকিওতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক
আপডেট : ০৪ মে ২০২৫, ১২:৪৫ এএম

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ মাসের শেষে জাপান সফর করতে পারেন। সফরের সময়সূচি ও দিনক্ষণ সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, চলতি মাসের ২৯ তারিখ থেকে তিনি জাপান সফরে যাবেন। এই লক্ষ্যে ঢাকা-টোকিও প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ঢাকা ও টোকিওর কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্ব সম্পর্ক বিগত ৫০ বছরে ধরেই বাড়ছে। ড. ইউনূসের সফরে এ সম্পর্কে নতুন মাত্রা দেখবে বিশ্ব। জাপানের টোকিওতে আগামী ২৯ ও ৩০ মে নিক্কেই ফোরামের সম্মেলন হবে। ওই সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টাকে বিশেষ বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে ড. ইউনূস সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানিয়েছেন। 

জানা গেছে, এ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। নিক্কেই ফোরাম সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও লাওসের প্রেসিডেন্ট, পালাওয়ের প্রেসিডেন্ট, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, সিঙ্গাপুরের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ভিয়েতনামের উপ-প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ প্রমুখ বক্তব্য দেবেন। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ফিউচার অব এশিয়া’। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক বিষয় ও বিশ্বে এশিয়ার ভ‚মিকা সম্পর্কে খোলামেলা এবং স্বাধীনভাবে তাদের মতামত উপস্থাপন করবেন। 

১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর নিক্কেই ফোরাম আয়োজিত এই সম্মেলনকে এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশি^ক ফোরাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বছর নিক্কেই ফোরামের ৩০তম বার্ষপূর্তি হচ্ছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সফরের বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে আগামী ১৪ মে পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন টোকিও সফর করবেন। সেখানে তিনি প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরের বিষয়ে কী কী ইস্যুতে আলোচনা এবং কী চুক্তি হবে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। 

চীনের সফরের এক মাসের মধ্যে ড. ইউনূসের জাপান সফর নিয়ে এরই মধ্যে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ সফর জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেও বলা হচ্ছে। এরই মধ্যেই জাপানের গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া এ নিয়ে ইতিবাচক খবর প্রকাশ করেছে। এ সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফর শুধু সামাজিক ব্যবসার ক্ষেত্রেই নয়, দুই দেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। জাপানে ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং তার সঙ্গে শীর্ষ করপোরেট ও নীতিনির্ধারকদের সখ্যকে বাংলাদেশ ইতিবাচক কূটনৈতিক অংশীদারত্বের নতুন মাইলফলক হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

তারা মনে করছেন, এ সফর বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তন, তরুণ উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষুদ্রঋণ কাঠামো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। 

১৫ মে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক :

প্রধান উপদেষ্টার সফর উপলক্ষে ১৪ মে পররাষ্ট্র সচিব টোকিও যাবেন। ১৫ মে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠক হবে। জানা গেছে, ওই বৈঠকেই প্রধান উপদেষ্টার সফরের আলোচনার সামগ্রিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। এর মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস), সমুদ্র নিরাপত্তা (মেরিটাইম সিকিউরিটি), প্রতিরক্ষা, কানেকটিভিটি ও অবকাঠামোগত সহযোগিতা, বিনিয়োগের মতো ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। বৈঠকে আঞ্চলিক বিষয় ও অন্যান্য বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। এই বৈশ্বিক ইস্যুতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গা সংকটটি নিয়ে আলোচনা হবে। সম্প্রতি জাপানিজ ভাইস মিনিস্টার এক জরিপের উল্লেখ করে বলেন, ৬০ শতাংশের বেশি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করছে। ইপিএ চুক্তি এগিয়ে নিতে এরই মধ্যে ষষ্ঠপর্যায়ের বাংলাদেশ-জাপান পাবলিক-প্রাইভেট অর্থনৈতিক সংলাপ (পিপিইডি) এপ্রিল মাসে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়।

যা থাকতে পারে প্রধান উপদেষ্টার সফরে :

সফরে ড. ইউনূসের প্রধান আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে থাকবে : সামাজিক ব্যবসা মডেল বিস্তারে জাপানি বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ‘গ্রিন ইনোভেশন ফান্ড’, জাপানি তরুণ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সামাজিক ব্যবসা প্রকল্পের সম্ভাবনা, মাইক্রোফিন্যান্সে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার। ড. ইউনূসের সফরে যাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা : জাইকা উন্নয়ন সহযোগিতা ও যৌথ সামাজিক প্রকল্প নিয়ে, সুনটোরি হোল্ডিংস সামাজিক উদ্যোক্তা তহবিলে অংশীদারত্ব নিয়ে, হিটাচি এবং মিতসুবিশি ইনোভেশন ল্যাব প্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে এবং টোকিও ওসাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাকাডেমিক সহযোগিতা ও ফেলোশিপ প্রোগ্রাম নিয়ে। 

প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরে একাধিক ইস্যুতে সমঝোতা স্মারক সইসহ দুই পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) স্বাক্ষর হওয়ার বিষয়ে দিকনির্দেশনা আসতে পারে।

২০২৩ সালে ড. ইউনূসের জাপান সফর:

বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে জাপান গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। এর আগে ২০২৩ সালেও ড. ইউনূস জাপান সফর করেন। সেখানে তিনি ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস জাপান’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম উদ্বোধন করেন, যার লক্ষ্য ছিল জাপানি উদ্যোক্তাদের সামাজিক ব্যবসার আওতায় আনয়ন। তিনি সেই সফরে জাপানি তরুণদের উদ্দেশে ‘চেঞ্জমেকার লিডারশিপ’ বিষয়ে সেমিনারে বক্তৃতা দেন, যা ব্যাপক সাড়া ফেলে। জাপান সফরকালে ড. ইউনূস দেশটির নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, যেখানে বাংলাদেশ-জাপান যৌথ সামাজিক ব্যবসা প্রকল্প গঠনের আহŸান জানানো হয়।

এর আগে ২০২৩ সালে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রতিরক্ষা সংলাপ, সফর বিনিময়, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কোর্স, সেমিনার, কর্মশালা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অন্য কোনো সম্মত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়গুলো রয়েছে সেই চুক্তির আওতায়। আবার জাপান বাংলাদেশের কাছে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়। গত তিন বছর আগে জাপানি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিমানবাহিনীর জন্য রাডারসহ অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি নিয়ে বাংলাদেশে সরেজমিন পরিদর্শন করে গেছেন। ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস ও আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর কাছে এ সরঞ্জাম বিক্রি করছে জাপান। এরই মধ্যে জাপান সরকার মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়নসহ তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের তহবিল সহযোগিতা দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। মূলত জাপানের এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর; যা প্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হলে সিঙ্গাপুর বন্দরকে ছাড়িয়ে যাবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত