জলাবদ্ধতার দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে এবার একযোগে চলছে ১৫২ প্রকল্প। ২০১৭ সালে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ নিরসনে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পটি সংশোধন হয়ে এখন ৮ হাজার ৬২৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। একে একে নেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকার আরও তিন প্রকল্প। এখন এসব প্রকল্পের সঙ্গে চলতি মাস থেকে যুক্ত হয়েছে আরও ৫ কোটি টাকার ১৪৮ প্রকল্প। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতার কবল থেকে চট্টগ্রাম মুক্তি পাবে।
জলাবদ্ধতা নিরসন কাজে বর্তমান সরকারের চার উপদেষ্টা তা মনিটরিং করছেন। উপদেষ্টা ও সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কেউ চট্টগ্রামে এলেই জলাবদ্ধতা নিয়ে সমন্বয় সভা করেন এবং খাল পরিদর্শনে যান। এতে মাঠপর্যায়ের কর্তাদের মধ্যেও কাজের গতি ফিরেছে। গত চার মাসে উপদেষ্টা পর্যায়ে সাতটি সমন্বয় সভা হয়েছে। এসব মিটিং থেকে ৩১ মে পর্যন্ত টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত ৮ মার্চের সমন্বয় সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে ফলপ্রসূ উন্নয়ন দেখাতে হবে। আর তা দেখালেই বাজেট নিয়ে সমস্যা হবে না। আগামী মে মাসের মধ্যে হয়তো চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ শেষ হবে না। কিন্তু তারপরও সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে বর্ষার আগেই জলাবদ্ধতার কাজের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে হবে।’
উপদেষ্টার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ নগরীর বাকলিয়ায় বির্জা খাল খনন এবং বিএনপি কাট্টলী এলাকার নাজির খাল ও কালিরছড়া খাল সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আওতায় টিআর কর্মসূচির অধীনে নেওয়া হয়েছে প্রকল্প।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪ থেকে ১৫২ প্রকল্প কীভাবে : চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আওতায় নগরীর ৩৬টি খাল খনন ও সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি পাঁচটি খালে রেগুলেটর নির্মাণ, খালের উভয়পাড়ে রাস্তা নির্মাণসহ নানাবিধ কাজে সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির অনুমোদন পেয়েছিল ২০১৭ সালে। ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার সেই প্রকল্প পরবর্তীকালে সংশোধনের মাধ্যমে ৮ হাজার ৬২৬ কোটিতে উন্নীত হয়। এখন পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ কাজ হওয়া এ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে অনুমোদন হওয়া এ প্রকল্পে যখন নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না তখন সিডিএ চাক্তাই খাল থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে আরও একটি প্রকল্প নেয়। এ প্রকল্পের অধীনে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর নির্মাণ ও রাস্তা নির্মাণসহ বাজেট ধরা হয় ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ২ হাজার ১৮৯ টাকা পাওয়া প্রকল্পটির ৮৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। উভয় প্রকল্প আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। অন্যদিকে এ দুই প্রকল্পে যখন নগরীর সব নালা ও খাল সংস্কার হচ্ছে না তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কালুরঘাটে হালদা নদীর মোহনা পর্যন্ত ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর নির্মাণের প্রকল্প নেয় ২০১৯ সালে। ১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৯৯৬ কোটি পাওয়া গেছে এবং কাজ হয়েছে ৭১ শতাংশ। এ তিন প্রকল্পের আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বারইপাড়া খাল খননের প্রকল্প নিয়েছিল ২০১৪ সালে। কিন্তু অর্থাভাবের কারণে থমকে যাওয়া প্রকল্পটি কয়েক দফায় সংশোধন করে ২০১৯ সালে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা পাওয়া প্রকল্পটির শেষ হয়েছে ৮৪ শতাংশ কাজ।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জলাবদ্ধতার সমাধানে প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ ওঠে নগরীর রাস্তার পাশের নালাগুলো থেকে পানি খালে যায় না। তাহলে এখন নালাগুলোকে সংস্কার করতে হবে। তখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এ টাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের অধীনে মাঠপর্যায়ে ১৪৮ প্রকল্পের মাধ্যমে নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের নালাগুলো থেকে মাটি উত্তোলনের কাজ করছে। তাহলে আগের চার প্রকল্পের সঙ্গে নতুন ১৪৮ প্রকল্প যুক্ত হওয়া জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২-তে।
১৪৮ প্রকল্পে কী কাজ করবে : জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ১৪৮ প্রকল্প নেওয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নগরীর নালাগুলোকে সংস্কারের জন্য টিআর কর্মসূচির আওতায় এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যেহেতু টিআরের আওতায় বড় বাজেটের প্রকল্প নেওয়া যায় না, তাই ছোট ছোট আকারে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।’
টিআর কর্মসূচির আওতায় কী কী কাজ করা হচ্ছে জানতে চাইলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের রাস্তার পাশের নালাগুলো থেকে আমরা মাটি উত্তোলন করছি। এমন অনেক নালা থেকে মাটি উত্তোলন করছি যেখানে গত ৫০ বছরেও কাজ করা হয়নি। আর এসব নালা দিয়ে পানি চলাচল করতে পারত না বলে রাস্তা দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো এবং জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ হতো।’ তিনি বলেন, টিআর কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী কোনো প্রকল্প ৩ লাখ ৯০ হাজারের বেশি হতে পারবে না। তাই আমরা পুরো নগরীর গুরুত্ব বিবেচনা করে একেকটি নালাকে কতগুলো খন্ডে ভাগ করে কাজ করার অনুমতি দিয়েছি বিভিন্ন কোম্পানিকে। এজন্য প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
নালাগুলো থেকে মাটি উত্তোলনের কাজটি খুব কার্যকর হবে উল্লেখ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘বৃষ্টির সময় দেখা যায় খালে পানি নেই কিন্তু রাস্তায় পানি জমে আছে। তাই রাস্তার পাশের নালাগুলোর সঙ্গে খালের সংযোগ থাকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি। এখন রাস্তার পাশের নালাগুলো থেকে মাটি উত্তোলন করা হলে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ কমে আসবে।’
এবার কি সুফল আসবে : চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম বলেন, ‘এবার যেভাবে কাজ এগিয়ে চলছে অন্যান্য বছরের মতো নগরবাসী জলাবদ্ধতা দুর্ভোগে ভোগবে না।’ একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে সব সংস্থাকে নিয়ে কাজ করছি। এতে কাজে গতিও এসেছে। খাল থেকে ময়লা আবর্জনা অপসারণের পাশাপাশি নগরবাসী যাতে খালে আবর্জনা না ফেলে সেজন্য সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছি। এ ছাড়া খাল সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোও মাঠে নেমেছে। সর্বোপরি এবার আগের চেয়ে ভোগান্তি কমে আসবে।’
জলাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, ‘আমরা পতেঙ্গায় কর্ণফুলীর মোহনা থেকে হালদা পর্যন্ত থাকা খাল দিয়ে যাতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য রেগুলেটর বসাচ্ছি। আশা করছি বর্ষায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করবে না। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ভালো রেজাল্ট পাবে নগরবাসী।’
অন্যদিকে চাক্তাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত কর্ণফুলী নদী থেকে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে ১২টি খাল দিয়ে। এ প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ বলেন, ‘১২টি রেগুলেটরের মধ্যে ১০টি খালে রেগুলেটর বসানোর কাজ শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। ফলে আসন্ন বর্ষায় জোয়ারের পানি প্রবেশের সুযোগ থাকবে না।’