আজ শুক্রবার ভোরে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করাই এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছে জেরুজালেম। ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নাতাঞ্জের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রসহ একাধিক স্থানে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছে।
‘রাইজিং লায়ন’ নামের এই সামরিক অভিযানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র এবং উচ্চপদস্থ সামরিক নেতৃত্বও লক্ষ্যবস্তু হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। জবাবে ইরান যে কোনো মুহূর্তে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে ইরানে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা ইসরায়েলের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি।” তাঁর দাবি, এই অভিযান কয়েক দিন ধরে চলবে এবং ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও নাতাঞ্জের ইউরেনিয়াম সুবিধাই মূল টার্গেট ছিল।
নাতাঞ্জের এক বাসিন্দা রয়টার্সকে জানান, পারমাণবিক স্থাপনার আশেপাশে একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইরানের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থাটিকে জানিয়েছেন, দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জরুরি বৈঠক ডেকেছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবর অনুযায়ী, তেহরান ও তার আশেপাশে একাধিক বিস্ফোরণ হয়েছে। দেশটির আকাশপথ রক্ষায় বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে।
ইসরায়েলি সেনার এক মুখপাত্র দাবি করেছেন, তারা ডজনখানেক পারমাণবিক ও রণাঙ্গন সুবিধায় আঘাত হেনেছে। তাঁর মতে, ইরান ইতোমধ্যেই ১৫টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মতো ইউরেনিয়াম মজুদ করে ফেলেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সতর্ক করে বলেন, “ইরান শিগগিরই ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাতে পারে, যার লক্ষ্য হবে ইসরায়েলি নাগরিক ও অবকাঠামো।”
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্পষ্ট করেছেন, এই হামলায় ওয়াশিংটনের কোনো ভূমিকা নেই। তিনি বলেন, “ইসরায়েল একতরফাভাবে এই অভিযান চালিয়েছে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য এখন মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত আমেরিকান নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।” তিনি ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে যোগ করেন, “মার্কিন স্বার্থ বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না— এটা নিশ্চিত করতে হবে।”
সিএনএনের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সংকট নিয়ে জরুরি মন্ত্রিসভা বৈঠক ডেকেছেন। এই হামলার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩ ডলার বেড়ে গেছে।
রবিবার ওমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও, এখন তা অনিশ্চিত বলে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালাতে পারে। তবে তিনি তখনও কূটনৈতিক সমাধানকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ইসরায়েল গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছিল। মার্কিন কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে ইসরায়েল যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।
হামলায় নিহতদের তালিকা
ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ মাধ্যম তাসনিম জানিয়েছে, এই হামলায় দুই শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁরা হলেন ড. মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি ও ড. ফেরেইদুন আব্বাসি।
এছাড়া ইসলামিক রেভ্যুলিউশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)-এর প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামিও নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে তাসনিম ও তেহরান টাইমস।
তেহরানের চারপাশে হামলা
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী তেহরান শহরকে ঘিরে থাকা কমপক্ষে ছয়টি সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে। পারচিন সামরিক কমপ্লেক্স, উচ্চপদস্থ কমান্ডারদের বাসভবন এবং কয়েকটি আবাসিক ভবনও টার্গেট করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি পরিকল্পিত অপারেশন ছিল।
ইসরায়েলের প্রস্তুতি
ইসরায়েলের সকল রাজনৈতিক শিবির ইরানকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। তাই এই হামলাকে কেন্দ্র করে দেশটিতে পূর্ণ রাজনৈতিক ঐক্য দেখা যাচ্ছে। ইরানি প্রতিশোধের আশঙ্কায় হাজার হাজার রিজার্ভ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে সেনা সূত্রে জানা গেছে।