পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ ইরান ও ইসরায়েলের বৈরিতার ইতিহাস অনেক পুরনো। মধ্যপ্রাচ্যের নানা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাও তাই নতুন কিছু নয়। তবে গতকাল শুক্রবার ইসরায়েল ইরানে একাধিক স্থানে বড় পরিসরে হামলা চালিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হামলা পুরো অঞ্চলকে বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতের শঙ্কাও তীব্র হচ্ছে। কেননা সাম্প্রতিক অতীতেই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে তাই ইরান-ইসরায়েলের সামরিক শক্তি কেমন ও কতটা তীব্র সে প্রশ্ন ঘুরে ফিরছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দুই শত্রু দেশ পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সংঘর্ষে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন তারা সরাসরি মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, একে অপরকে আঘাত করার ক্ষমতা এবং নিজ নিজ ভূখণ্ড রক্ষা করার কৌশল নিয়ে বিশ্লেষণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) প্রকাশিত দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুসারে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা তুলে ধরা হলো।
সৈন্যসংখ্যা : ইরানের সক্রিয় সামরিক সদস্য সংখ্যা ৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে রয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার, আইআরজিসিতে ১ লাখ ৯০ হাজার, নৌবাহিনীতে ১৮ হাজার, বিমানবাহিনীতে ৩৭ হাজার ও বিমান প্রতিরক্ষা শাখায় ১৫ হাজার সদস্য। এছাড়া ইরানের রিজার্ভ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার। ইরানে ১৮ বছর বয়সের অধিক পুরুষদের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলের সক্রিয় সেনাসদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে রয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌবাহিনীতে ৯ হাজার ৫০০ ও বিমানবাহিনীতে ৩৪ হাজার সদস্য। ইসরায়েলের রিজার্ভ বাহিনী আরও বড় সেখানে সদস্য সংখ্যা ৪ লাখ ৬৫ হাজার। ইসরায়েলেও ১৮ বছরের অধিক বয়সী অধিকাংশ পুরুষ ও নারীর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের নিয়ম রয়েছে।
সামরিক ব্যয় : ২০২৩ সালে ইরান সামরিক খাতে ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এটি ২০২২ সালের তুলনায় ০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। একই বছরে ইসরায়েল সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
স্থলবাহিনী : ইরানের স্থলবাহিনীর রয়েছে ১০ হাজার ৫১৩টির বেশি ট্যাংক, ৬ হাজার ৭৯৮টির বেশি কামান (আর্টিলারি গান) এবং ৬৪০টির বেশি সাঁজোয়া যান। ইরানের সেনাবাহিনীর অধীনে রয়েছে ৫০টি হেলিকপ্টার ও আইআরজিসির কাছে রয়েছে ৫টি হেলিকপ্টার। অন্যদিকে ইসরায়েলের রয়েছে প্রায় ৪০০ ট্যাংক, ৫৩০টি কামান এবং ১ হাজার ১৯০টির বেশি সাঁজোয়া যান।
বিমানবাহিনী : ইরানের বিমান বাহিনীর হাতে রয়েছে ৩১২টি যুদ্ধবিমান। আইআরজিসির অধীনে রয়েছে আরও ২৩টি যুদ্ধবিমান। বিমান বাহিনীর রয়েছে ২টি ফাইটার হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর কাছে ৫০টি এবং আইআরজিসির অধীনে রয়েছে আরও ৫টি। অন্যদিকে ইসরায়েলের কাছে রয়েছে ৩৪৫টি যুদ্ধ-উপযোগী বিমান এবং ৪৩টি ফাইটার হেলিকপ্টার।
নৌবাহিনী : ইরানের রয়েছে ১৭টি কৌশলগত সাবমেরিন, ৬৮টি টহল ও উপকূলীয় যুদ্ধজাহাজ, ৭টি করভেট, ১২টি ল্যান্ডিং শিপ, ১১টি ল্যান্ডিং ক্র্যাফট এবং ১৮টি লজিস্টিক ও সহায়ক সরঞ্জাম। অন্যদিকে ইসরায়েলের রয়েছে ৫টি সাবমেরিন এবং ৪৯টি টহল ও উপকূলীয় যুদ্ধজাহাজ।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত ‘আয়রন ডোম’ নামক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও কয়েকটি ব্যবস্থা রয়েছে যা মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করে। ডেভিড’স স্লিং ব্যবস্থা ৪০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে পারে। অ্যারো সিস্টেম ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে আঘাতকারী ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে সক্ষম। আর ইরানের রয়েছে ‘আজারাখশ’ নামের নতুন একটি স্বল্পপাল্লার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
ইরানের বিমান প্রতিরক্ষায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। এর মধ্যে রয়েছে ৪২টির বেশি রাশিয়ার তৈরি দূরপাল্লার এস-২০০, এস-৩০০ এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি বাভার-৩৭৩; ৫৯টির বেশি মাঝারিপাল্লার যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এমআইএম-২৩ হক, এইচকিউ-২জে ও খোরদাদ-১৫ এবং ২৭৯টি স্বল্পপাল্লার চীনে তৈরি সিএইচ-এসএ-৪ ও ৯কে৩৩১ টর-এম১।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র : ইরানের অস্ত্রাগারে রয়েছে অন্তত ১২ ধরনের মাঝারি ও স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে টোন্দর-৬৯, যার পাল্লা ১৫০ কিলোমিটার; খোররামশাহর ও সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ইসরায়েলের রয়েছে অন্তত চার ধরনের ছোট, মাঝারি এবং মাঝারি-পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে লোরা ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২৮০ কিলোমিটার, আর জেরিকো-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৪,৮০০ থেকে ৬,৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
পারমাণবিক সক্ষমতা : ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা আনুমানিক ৯০টি। এসব অস্ত্র তাদের মজুদের অংশ। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি অত্যন্ত উন্নত পর্যায়ে রয়েছে।