শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি

আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ১২:২৬ এএম

পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে শিক্ষার অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর সংগত কারণও আছে। একটি জাতিকে উন্নতির ক্রমবর্ধমান পথে ধাবিত করতে হলে, শিক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ‘শিক্ষাই সব শক্তির মূল।’ এই বাক্যটি চারশ বছরের আগের হলেও বাক্যটির নিহিতার্থ অবহেলা করার অবকাশ নেই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে শিক্ষা কোন ধরনের ভূমিকা পালন করে, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তারপরও আমাদের দেশের শিক্ষার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কিছু কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব একটি গুরুতর সমস্যা, যা শুধু শিক্ষার মানই নয়, বরং সমাজ কাঠামোকে পরিবর্তিত ও প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যক্তিক ও সামাজিক উন্নয়নের নৈতিক দায় ও পেশাগত দায়িত্বের কারণে শিক্ষকদের বলা হয়, জাতির বিবেক। পেশাগত জীবনে শিক্ষকদের যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার কথা, তা দলীয় আনুগত্য এবং স্বার্থপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কারণে, বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর ফলে  যেমন শিক্ষকদের পেশাগত মান-মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে, তেমনি শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

শিক্ষক রাজনীতির নেপথ্যে যত কারণই থাকুক না কেন, এটি শিক্ষার মতো সম্মানজনক পেশায় গভীর উদ্বেগ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠার বদলে শিক্ষকরা হয়ে উঠছেন নৈতিক অধঃপতন, বৈষম্য ও বিভাজনের মূর্ত প্রতীক। ফলে শিক্ষক রাজনীতি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায়ই দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হয়েছে, যা শিক্ষার গুণগতমান ও উদ্দেশ্যকে ক্ষুন্ন করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে পরিবর্তন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রতিটি সরকারই তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সময় পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সংকীর্ণ ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব শুধু পাঠ্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায়ও এর প্রভাব সুস্পষ্ট।

যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্য বা পরিচয় অনেক সময় নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন, যা শিক্ষার গুণগতমানকে ব্যাহত করছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিল, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি বন্ধ হবে। কিন্তু অভ্যুত্থানের প্রায় নয় মাস পেরিয়ে গেলেও তা বন্ধ হয়নি এবং স্থিতিশীলতাও ফেরেনি। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে নেওয়া হয়নি কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। এখনো অব্যাহত রয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মতো ঘটনা। শিক্ষক-কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সংগঠনের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের একটি অংশ এসব অপকর্মে জড়িত বলে অভিযোগ। দেশের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি ও অনিয়মের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বত্র দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে। শিক্ষা খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি শুধু সরকারের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে না, বরং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বাড়াচ্ছে; বিঘ্নিত হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা কার্যক্রম। বিগত সরকারের সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক দলীয় রাজনীতি প্রকট হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে রয়েছে অনিয়ম। দলীয় পদ-পদবি ও আঞ্চলিক প্রীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, মেধা ও গবেষণাকে অবহেলা করা হয়েছে। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পঙ্গু হওয়ার পথে। গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই অভিভাবকহীন হয়ে গিয়েছিল। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ সবাইকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এ থেকে কী বোঝা যায়?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে হলে শিক্ষক নিয়োগে মেধার মূল্যায়ন করতে হবে, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজি বন্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে যদি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। শিক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎও ধ্বংস করছে। শিক্ষার্থীরা যদি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে বড় হয়, তাহলে তারা সমাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে। এটি জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে। শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে।

অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গুণগত পরিবর্তন হবে এবং স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ে অপচয়, রাজনৈতিক প্রভাব, টেন্ডারে অনিয়ম ও ছাত্ররাজনীতির নামে চাঁদাবাজি এখনো চলমান। সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা না থাকায় দুর্নীতির শিকড় গভীর হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষায় ঘুষ, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ না হলে অর্থাৎ মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে, সব ধরনের সংস্কার ও অগ্রগতি ব্যর্থ হয়ে পড়বে। সরকারের উচিত, শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে কঠোর ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। আতশ কাচ যেমন সূর্যের সাধারণ রশ্মিকে বহু গুণ বাড়িয়ে কাগজে আগুন ধরাতে পারে, তেমনি প্রকৃত শিক্ষার শক্তি মেধাকে প্রজ্বলনের মাধ্যমে জাতিকে করতে পারে নিরাপদ, প্রজ্ঞাময় ও সমৃদ্ধিশালী।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত