শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বিশ্ববাণিজ্যে কালো মেঘ

আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ০২:১৩ এএম

হামলা-পাল্টা হামলায় ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সপ্তাহ পার হতে চলেছে। দুই দেশের উত্তেজনা বৈশ্বিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রুটে ছড়িয়ে পড়েছে। যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করছে। এর ফলে জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজ চলাচল খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যা সামগ্রিক উৎপাদনব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। এতে বিশ্ববাণিজ্যে ব্যাপক অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

জানা গেছে, যুদ্ধের প্রভাবে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে জ¦ালানি তেলের দাম। গতকাল বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেল বা ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১ দশমিক ৫৬ ডলার বা ২ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে ৭৪ দশমিক ৭৯ ডলারে বিক্রি হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেলের দাম ১ দশমিক শূন্য ৪২ ডলার বা ১ দশমিক ৪২ শতাংশ বা ২ শতাংশ বেড়ে ৭৩ দশমিক ১৯ ডলারে বিক্রি হয়। এর আগে গত শুক্রবার ইরানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায় ইসরায়েলের বিমান হামলার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম একলাফে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধের কারণে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজি গ্যাসের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে, যার প্রভাব শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও পরিবহন, কৃষি ও নিত্যপণ্যের বাজারে পড়বে। এতে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি আরও এক দফা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া জনশক্তি রপ্তানিতেও ব্যাপক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও দেশের বাজারে এখনই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রপ্তানিকারকদের জন্য আপাতত কোনো নির্দেশনা না থাকলেও সহসাই খাতসংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাদের সঙ্গে সভা করা হবে। সেখানে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। তবে বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান।

মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধের প্রভাবে তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাব সবার ওপর পড়বে। পোশাক শিল্পেও পড়বে। এই অবস্থায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে আমাদের অনেকগুলো কাজ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি সবার সহযোগিতায় এই কাজ করতে পারব। প্রতিটি যুদ্ধ বিশ্বঅর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। তিনি উল্লেখ করেন, তেলের দাম সবচেয়ে দ্রুত প্রভাবিত হয়, যা পরিবহন খরচ বাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতি আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দেখেছি।’

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘কাতার থেকে এলএনজি হরমুজ প্রণালি দিয়েই আসে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে স্বাভাবিকভাবেই এ রুটে প্রভাব পড়বে। আর যুদ্ধ পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করলে স্বভাবতই রুটটি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ জাহাজ তখন ওই রুট দিয়ে যাওয়ার কথা না। তখন আমাদের এলএনজি নিয়ে ভালোই সমস্যা হবে। অন্যান্য উৎস থেকে সরবরাহ এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে কি না জানি না, কিন্তু এলএনজি আমদানিতে আমাদের প্রধান উৎস কাতার। এলএনজি কার্গোগুলো অনেক দামি। ফলে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে জাহাজ পরিচালকরা নিজ থেকেই ওই রুটে যাবে না। আর যদিও-বা যায় বীমার প্রিমিয়াম এত বেশি হবে যে এলএনজির দাম ব্যাপকহারে বেড়ে যাবে।’

যুদ্ধ বাড়লে সরাসরি প্রভাবের পাশাপাশি পরোক্ষ প্রভাবও রয়েছে উল্লেখ করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘লজিস্টিক ব্যয় তখন বেড়ে যাবে। কারণ জ্বালানির দাম এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে।

ম্যান মেড ফাইবারের তৈরি সুতা ও কাপড়ের ব্যয়ও বেড়ে যাবে, কারণ এর প্রধান কাঁচামাল তেল। যুদ্ধের প্রভাবে সব ধরনের পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে, দাম বেড়ে যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাস্টমাররা পোশাক কেনা কমিয়ে দেবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে।’

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) প্রশাসক সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইরান-ইসরায়েলে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা দেশের আমদানি রপ্তানিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালির তেল, গ্যাস ও আমদানি-রপ্তানির জাহাজের চলাচল ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এখন জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে। এর প্রভাবে তরল গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। এটি হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারেও জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এর একমাত্র সমাধান হলো যুদ্ধ বন্ধ হওয়া।

তিনি জানান, দেশের ব্যবসায়ীরা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হলেও এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে রয়েছে। সহসাই শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এফবিসিসিআই একটি সভা আহ্বান করবে এবং এ পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করবে। আপাতত এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো নির্দেশনা জারি করেনি।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত