বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

কোচরাই কেন বারবার উপেক্ষিত?

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারের আট ক্যাটাগরিতে এবারও রাখা হয়নি কোচদের

আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ১০:১৯ পিএম

বিগত কয়েক বছর ধরে ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদান রাখা ক্রীড়াবিদ, সংগঠক, পৃষ্ঠপোষক, সংস্থা, ক্রীড়া সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকারদের স্বীকৃতি জানিয়ে আসছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সে ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৫ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মোট আটটি ক্যাটাগরিতে দেওয়া হবে এই পুরস্কার। তবে এবারও এ স্বীকৃতির জন্য বিবেচিত হবেন না দেশের কোনো কোচ।

ক্রীড়াবিদদের নেপথ্যের কারিগরদের এবারও স্বীকৃতির বাইরে রাখছেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবকখ্যাত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, যা দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের কোচদের ভীষণভাবে হতাশ করেছে।

গত বছর ৫ আগস্ট এই পুরস্কার মনোনীতদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তবে আগের দিন সন্ধ্যায় ‘অনিবার্য কারণে’ সেই অনুষ্ঠান স্থগিত করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে ১৭ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান ঘটেছিল। স্থগিত হওয়া সেই অনুষ্ঠানও পরে আর আয়োজন করেনি ক্রীড়া পরিষদ। ফলে সেবার যে ১০ জন ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, তাদের হাতে পৌঁছায়নি সম্মাননা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ গত বছরের মনোনীতদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়েই চলতি বছরের জন্য আবেদন চেয়ে বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সেখানে বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকেছেন কোচরা।

এবার যে আট ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হবে, সেগুলো হলো- আজীবন সম্মাননা, খেলোয়াড়/ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, উদীয়মান খেলোয়াড়/ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া অ্যাসোসিয়েশন/ফেডারেশন/সংস্থা, ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষক/স্পন্সর ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার। এই আট ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীদের নির্ধারিত ফরমের মাধ্যমে ৭ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিবের কাছে আবেদন করার অনুরোধ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনটি ক্রীড়াঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন খেলার কোচদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের দেশসেরা কোচ আব্দুল্লাহ হেল কাফি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে লেখেন, ‘কোচ ছাড়া ক্রীড়াবিদদের মানোন্নয়ন অসম্পূর্ণ। এবারও উপেক্ষিত ক্রীড়াবীদ গড়ার কারিগররা! জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ২০২৫ সালের “জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার” সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটি পড়ে সত্যিই হতাশা ও বিস্ময়ে হতভম্ব হতে হয়। যেখানে খেলোয়াড়, সংগঠক, সাংবাদিক, পৃষ্ঠপোষক, এমনকি ধারাভাষ্যকারদের মতো বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিদের পুরস্কারের আওতায় আনা হয়েছে, সেখানে খেলোয়াড়দের গড়ে তোলার মূল কারিগর, কোচদের কোনো স্বীকৃতির স্থান নেই। এটি শুধু অবিচার নয়, এটি ক্রীড়াজগতের প্রতি এক প্রকার আত্মপ্রতারণা। বারবার পুরস্কার ও স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তাদের উপেক্ষা করার প্রক্রিয়া এক ভয়ংকর সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে, যেখানে মাঠের অদৃশ্য নায়কদের মূল্যায়ন করা হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, কার হাত ধরে তৈরি হয় এই ক্রীড়া তারকারা? কে দাঁড়িয়ে থাকেন মাঠের একপাশে সকাল-সন্ধ্যা, সূর্য-বর্ষায়? কার কৌশল, পরিশ্রম, ত্যাগ, মানসিক শক্তির ফলেই জয় হয় দেশের?’

দীর্ঘ এই পোস্টের মধ্য দিয়ে কাফি নিজেদের অধিকারের কথা তুলে ধরে চেয়েছেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে একটা শিক্ষা দিতে। তার মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া না জানালেও বিষয়টি ভীষণভাবে ছুঁয়ে গেছে অন্যদেরও। চলতি বছর আবাহনীকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা জেতানোর পর সম্প্রতি বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পাওয়া সাবেক ক্রিকেটার হান্নান সরকার মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে দেশের নানা খেলার অসংখ্য কোচদের বঞ্চিত করা হয়েছে, ‘আমি মনে করি যেকোনো খেলায় কোচদের বড় একটা ভূমিকা থাকে। পেছন থেকে একজন কোচ একজন ক্রীড়াবিদকে প্রতিষ্ঠিত হতে কাজ করে যান। সরকার যেখানে নানা অঙ্গনে মানুষকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তখন অবশ্যই কোচদেরও এই স্বীকৃতির আওতায় আনা উচিত।’

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক প্রধান কোচ গোলাম সারওয়ার টিপু অবশ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘স্বাভাবিক’ ভাবেই নিয়েছেন। বর্ষীয়ান এই ফুটবল তারকা বলেন, ‘ক্রীড়াঙ্গন যে সঠিক পথে, সঠিক হাতে নেই, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। আমার এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতেই ভালো লাগে না। সারা দুনিয়ায় যখন কোচদের সর্বোচ্চ স্থানে রাখা হয়, সেখানে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোচদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ তো দেখেও শেখে। তাদের কি কিছুই চোখে পড়ে না?’

বাংলাদেশ যুব হকি দলকে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে যাওয়া কোচ মওদুদুর রহমান শুভও ব্যথিত সরকারের এমন সিদ্ধান্তে, ‘একজন খেলোয়াড়কে গড়ে তোলা, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে কোচদের অবদান অনস্বীকার্য। তাই আমি মনে করি সরকার যখন ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদান রাখাদের স্বীকৃতি দেবে, তখন কোচদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।’ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম, এনডিসি কোচদের স্বীকৃতির তালিকায় না থাকার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘২০১৮ সালের নীতিমালা আইন অনুযায়ী আটটি ক্ষেত্রে যোগ্যদের পুরস্কৃত করা হবে। নীতিমালায় কোচদের রাখা হয়নি। আইনের বাইরে গিয়ে তো কিছু করা সম্ভব নয়। তবে কোচরা কিন্তু আজীবন সম্মাননার জন্য আবেদন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠকদের চেয়ে কোচদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।’

বৃহস্পতিবার জাতীয় স্টেডিয়ামে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে এসে ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার নিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ‘এটা (পুরস্কার) একটি স্বীকৃতি। এটি যেন প্রকৃত ও যোগ্যরা পায়, সেটা নিশ্চিত করা হবে। প্রকৃত খেলোয়াড়রা এটা পেলে সামনে অন্যরাও খেলাধুলায় আকৃষ্ট হবে।’ উপদেষ্টা হয়তো জানেন-ই না, দেশের অসংখ্য খেলার যোগ্য কোচরা এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিতই নন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত