ক্রান্তিকালের মুখোমুখি ভারত
সৌমিত্র দস্তিদার, কলকাতা থেকে | ২১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
সামান্য যে কজন কষ্ট করে হলেও আমার লেখা পড়েন, প্রথমেই তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে বেশ কিছু সময় একটা শব্দও লিখতে পারিনি বলে। কাগজ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এক লাইন লেখারও সময় পাইনি। তার কারণ আমার দেশ এখন এক অস্থির জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এমন এক ভয়ংকর সময় যা কখনো সখনো ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় শিল্পী-সাহিত্যিক, নাট্যকার, সিনেমা পরিচালক, নাগরিকদের বড় অংশ আজ রাস্তায় নেমে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির নানারকম জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে। দেশের সর্বত্র এরকম গণবিক্ষোভ স্মরণকালে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে তরুণ যুবারা রাস্তায় নেমেছিল এটা ঠিক, কিন্তু এবারের লড়াই আরও গভীর ও অনেক ব্যাপক। এ লড়াইয়ে জনতার পক্ষ নিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে সামান্য এই কলাম লেখকও। পেশায় তথ্যচিত্র নির্মাতা। ফলে এখন শুধু ছুটছি আর ছুটছি।
অনেকেই জানেন এবারের গণ-আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল সংসদে সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট সংক্ষেপে সিএএ পাস করার পর থেকে। এই আইনে বলা আছে যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বৌদ্ধ, হিন্দু, শিখ, জৈন অধিবাসীদের মধ্যে যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্যাতিত হয়ে ভারতে এসেছেন তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। দ্রুত আবেদন করার পর পরেই । আপাত দৃষ্টিতে এই আইনে এমন কিইবা আছে যা সারা দেশকে এভাবে নাড়িয়ে দিল! যদি খুঁটিয়ে দেখেন আইনটি তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন এই সংবিধানবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশ এভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে। প্রথমত এই সিএএ-তে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, এই নাগরিক হওয়ার দাবিদার মুসলিম বাদে আর সব সম্প্রদায়ের মানুষ। এই যে একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তুলে তাদের সবাইকে অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে তা শুধু আপত্তিজনকই নয়, সংবিধানবিরোধীও। কেউ কেউ বলছেন যে এই আইনে ভারতে দীর্ঘদিন ধরে যে মুসলমানরা বসবাস করছেন তাদের কোনো বিপদ হবে না। যারা বলছেন হয় তারা অজ্ঞ না হয় সম্পূর্ণ জেনে বুঝে এদেশের পরিস্থিতি আড়াল করে চরম দক্ষিণপন্থি বিজেপির হাত শক্ত করছেন। এই সিএএ প্রণয়ন করার প্রচ্ছন্ন কারণটাকেই অনেকে গুলিয়ে দিচ্ছেন। আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি এনআরসি তালিকায় যে উনিশ লাখ লোকের নাম বাদ পড়েছিল ঘটনাচক্রে তার অধিকাংশই হিন্দু। ফলে ভোট ব্যাংকের রাজনীতির কথা ভেবে শঙ্কিত বিজেপি তড়িঘড়ি নাগরিক আইনে সংশোধনী আনতে সক্রিয় হয়ে উঠল। এবং জানিয়ে দিল যে আগে সিএএ হবে, তারপর এনআরসি। মুশকিল হচ্ছে যদি মেনেও নিই যে এ অবধিও না-হয় সব ঠিকঠাক রয়েছে, সরকার ভালোর জন্যই প্রথমে সিএএ পরে এনআরসি করছে। তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছে। কিন্তু যেটা দুর্বোধ্য তাহলো দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একরকম বলছেন অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরেক রকম মন্তব্য করছেন। ছোট বড় মাঝারি একাধিক বিজেপি নেতা একেকরকম কথা বলেই চলেছেন। কারও কথার সঙ্গে কারও মিল নেই। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নেতার দল কে সত্যি কথা বলছেন তা নিয়েই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে বেশি। সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে কোনো এক গোপন এজেন্ডা চাপিয়ে দিতেই বিজেপি এমন লুকোচুরি খেলছে। একটা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা চলে যাওয়া দেশের নাগরিকদের কাছে নিশ্চিত উদ্বেগের বিষয়।
পাশাপাশি খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে বিজেপি ও সংঘপরিবারের নেতাকর্মীরা যেভাবে, যে ভাষায় দেশেরই নাগরিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করছেন তা শুধু নিন্দের নয়, গর্হিত অপরাধও। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একটা সম্প্রদায়ের পোশাক নিয়ে বিশ্রি ইঙ্গিত করেছেন। যাবতীয় সন্ত্রাসের জন্য তাদের দিকে আঙুল তুলেছেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে নতুন আইনে হিন্দুরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমি জানি শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ ধরনের একটা প্রচার চলছে মোদি সরকার হিন্দু সংহতিতে নিবেদিতপ্রাণ। ফলে তারা যা কিছু করছেন বা করতে চাইছেন তা নিঃসন্দেহে হিন্দুদের স্বার্থে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বলব। এটা এক্কেবারে মিথ্যে প্রচার। এক বড় ধরনের ধাপ্পা। আসলে মোদি অমিত শাহ ব্রিটিশদের মতোই এক সম্প্রদায়কে অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছেন। এই চালাকিটা ভারতের বড়সংখ্যক মানুষ আজ বুঝতে পেরেছেন । ফলে দেশের সর্বত্র আওয়াজ উঠেছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে। এরকম ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন সত্যি বহুদিন ভারত দেখেনি। এই লড়াইয়ের নানান মাত্রা, নানা রং। সব মিলিয়ে নতুন এক জাতীয়তাবাদের পুনর্জন্ম হচ্ছে ভারতে। যা নিঃসন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষ।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন এ আন্দোলন কি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেহারা নিতে পারে? আমি বলব না। আপনি বলবেন, সরকার বদলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি কি তৈরি হয়েছে? তার উত্তরও হবে না। এই আন্দোলনের অভিমুখ, লক্ষ্য আপাতত একটাই। ভারতের সংবিধানে লিখিত ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে বাঁচিয়ে রাখা। দেশভাগ নিছক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হয়েছে এই সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়নেরও সময় এসেছে। দেশভাগের সঙ্গে জড়িত ছিল বিবিধ অন্যান্য প্রশ্নও অর্থনীতি, স্বাধিকার এবং সরকারের চরিত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় না অতি কেন্দ্রায়নের পথে হাঁটবে! কৃষিনীতি ভবিষ্যতে কী হবে! সামন্তবাদ থেকে রেহাই কোন পথে আসতে পারে এসব আপাত আড়ালে চলে যাওয়া প্রশ্নগুলোও নতুন করে সামনে না এনে শুধু হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় বিভাজনকেই প্রধান কারণ বলা সঠিক নয়। ধর্মের মধ্যেও থাকে শ্রেণিদ্বন্দ্ব। নোয়াখালী দাঙ্গা কিম্বা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখতে পাবেন জমির মালিকানা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পুঁজির ভাগবাটোয়ারা বহু বিষয় নিয়ে মতপার্থক্যও দেশবিভাজনের পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছিল। এবারের আন্দোলনে বিজেপির বা সাবেক জনসংঘের বহুদিনের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা ধাক্কা খেয়েছে।
এই গণসংগ্রামে সমাজের সব স্তরের লোকজন শামিল হলেও মূলত সামনের সারিতে আছেন ছাত্র, তরুণ ও মহিলারা। তাদের মধ্যে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুখ মুসলিম সম্প্রদায়ের। স্বাধীনতার আগে সম্ভবত একমাত্র খিলাফত আন্দোলনে এত বেশি সংখ্যক মুসলিম জনতাকে রাজপথে নামতে শেষবার ভারত দেখেছিল। এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এখন যে গণ-আন্দোলন চলছে তা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে তৃণমূল স্তরে। মহাত্মা গান্ধী বলতেন যে ভারতের গ্রাম বাদ দিয়ে স্বরাজ আসতে পারে না। স্বরাজ বা মানুষের স্বাধিকার কতটা ফিরবে এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তা এখনই বলা যাবে না। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর দেড়শো বছরের জন্ম সময় ভারত নতুন এক গণসংগ্রাম দেখছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : ভারতের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা
শেয়ার করুন
সৌমিত্র দস্তিদার, কলকাতা থেকে | ২১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

সামান্য যে কজন কষ্ট করে হলেও আমার লেখা পড়েন, প্রথমেই তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে বেশ কিছু সময় একটা শব্দও লিখতে পারিনি বলে। কাগজ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এক লাইন লেখারও সময় পাইনি। তার কারণ আমার দেশ এখন এক অস্থির জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এমন এক ভয়ংকর সময় যা কখনো সখনো ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় শিল্পী-সাহিত্যিক, নাট্যকার, সিনেমা পরিচালক, নাগরিকদের বড় অংশ আজ রাস্তায় নেমে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির নানারকম জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে। দেশের সর্বত্র এরকম গণবিক্ষোভ স্মরণকালে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে তরুণ যুবারা রাস্তায় নেমেছিল এটা ঠিক, কিন্তু এবারের লড়াই আরও গভীর ও অনেক ব্যাপক। এ লড়াইয়ে জনতার পক্ষ নিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে সামান্য এই কলাম লেখকও। পেশায় তথ্যচিত্র নির্মাতা। ফলে এখন শুধু ছুটছি আর ছুটছি।
অনেকেই জানেন এবারের গণ-আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল সংসদে সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট সংক্ষেপে সিএএ পাস করার পর থেকে। এই আইনে বলা আছে যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বৌদ্ধ, হিন্দু, শিখ, জৈন অধিবাসীদের মধ্যে যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্যাতিত হয়ে ভারতে এসেছেন তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। দ্রুত আবেদন করার পর পরেই । আপাত দৃষ্টিতে এই আইনে এমন কিইবা আছে যা সারা দেশকে এভাবে নাড়িয়ে দিল! যদি খুঁটিয়ে দেখেন আইনটি তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন এই সংবিধানবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশ এভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে। প্রথমত এই সিএএ-তে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, এই নাগরিক হওয়ার দাবিদার মুসলিম বাদে আর সব সম্প্রদায়ের মানুষ। এই যে একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তুলে তাদের সবাইকে অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে তা শুধু আপত্তিজনকই নয়, সংবিধানবিরোধীও। কেউ কেউ বলছেন যে এই আইনে ভারতে দীর্ঘদিন ধরে যে মুসলমানরা বসবাস করছেন তাদের কোনো বিপদ হবে না। যারা বলছেন হয় তারা অজ্ঞ না হয় সম্পূর্ণ জেনে বুঝে এদেশের পরিস্থিতি আড়াল করে চরম দক্ষিণপন্থি বিজেপির হাত শক্ত করছেন। এই সিএএ প্রণয়ন করার প্রচ্ছন্ন কারণটাকেই অনেকে গুলিয়ে দিচ্ছেন। আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি এনআরসি তালিকায় যে উনিশ লাখ লোকের নাম বাদ পড়েছিল ঘটনাচক্রে তার অধিকাংশই হিন্দু। ফলে ভোট ব্যাংকের রাজনীতির কথা ভেবে শঙ্কিত বিজেপি তড়িঘড়ি নাগরিক আইনে সংশোধনী আনতে সক্রিয় হয়ে উঠল। এবং জানিয়ে দিল যে আগে সিএএ হবে, তারপর এনআরসি। মুশকিল হচ্ছে যদি মেনেও নিই যে এ অবধিও না-হয় সব ঠিকঠাক রয়েছে, সরকার ভালোর জন্যই প্রথমে সিএএ পরে এনআরসি করছে। তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছে। কিন্তু যেটা দুর্বোধ্য তাহলো দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একরকম বলছেন অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরেক রকম মন্তব্য করছেন। ছোট বড় মাঝারি একাধিক বিজেপি নেতা একেকরকম কথা বলেই চলেছেন। কারও কথার সঙ্গে কারও মিল নেই। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নেতার দল কে সত্যি কথা বলছেন তা নিয়েই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে বেশি। সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে কোনো এক গোপন এজেন্ডা চাপিয়ে দিতেই বিজেপি এমন লুকোচুরি খেলছে। একটা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা চলে যাওয়া দেশের নাগরিকদের কাছে নিশ্চিত উদ্বেগের বিষয়।
পাশাপাশি খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে বিজেপি ও সংঘপরিবারের নেতাকর্মীরা যেভাবে, যে ভাষায় দেশেরই নাগরিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করছেন তা শুধু নিন্দের নয়, গর্হিত অপরাধও। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একটা সম্প্রদায়ের পোশাক নিয়ে বিশ্রি ইঙ্গিত করেছেন। যাবতীয় সন্ত্রাসের জন্য তাদের দিকে আঙুল তুলেছেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে নতুন আইনে হিন্দুরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমি জানি শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ ধরনের একটা প্রচার চলছে মোদি সরকার হিন্দু সংহতিতে নিবেদিতপ্রাণ। ফলে তারা যা কিছু করছেন বা করতে চাইছেন তা নিঃসন্দেহে হিন্দুদের স্বার্থে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বলব। এটা এক্কেবারে মিথ্যে প্রচার। এক বড় ধরনের ধাপ্পা। আসলে মোদি অমিত শাহ ব্রিটিশদের মতোই এক সম্প্রদায়কে অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছেন। এই চালাকিটা ভারতের বড়সংখ্যক মানুষ আজ বুঝতে পেরেছেন । ফলে দেশের সর্বত্র আওয়াজ উঠেছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে। এরকম ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন সত্যি বহুদিন ভারত দেখেনি। এই লড়াইয়ের নানান মাত্রা, নানা রং। সব মিলিয়ে নতুন এক জাতীয়তাবাদের পুনর্জন্ম হচ্ছে ভারতে। যা নিঃসন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষ।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন এ আন্দোলন কি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেহারা নিতে পারে? আমি বলব না। আপনি বলবেন, সরকার বদলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি কি তৈরি হয়েছে? তার উত্তরও হবে না। এই আন্দোলনের অভিমুখ, লক্ষ্য আপাতত একটাই। ভারতের সংবিধানে লিখিত ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে বাঁচিয়ে রাখা। দেশভাগ নিছক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হয়েছে এই সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়নেরও সময় এসেছে। দেশভাগের সঙ্গে জড়িত ছিল বিবিধ অন্যান্য প্রশ্নও অর্থনীতি, স্বাধিকার এবং সরকারের চরিত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় না অতি কেন্দ্রায়নের পথে হাঁটবে! কৃষিনীতি ভবিষ্যতে কী হবে! সামন্তবাদ থেকে রেহাই কোন পথে আসতে পারে এসব আপাত আড়ালে চলে যাওয়া প্রশ্নগুলোও নতুন করে সামনে না এনে শুধু হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় বিভাজনকেই প্রধান কারণ বলা সঠিক নয়। ধর্মের মধ্যেও থাকে শ্রেণিদ্বন্দ্ব। নোয়াখালী দাঙ্গা কিম্বা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখতে পাবেন জমির মালিকানা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পুঁজির ভাগবাটোয়ারা বহু বিষয় নিয়ে মতপার্থক্যও দেশবিভাজনের পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছিল। এবারের আন্দোলনে বিজেপির বা সাবেক জনসংঘের বহুদিনের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা ধাক্কা খেয়েছে।
এই গণসংগ্রামে সমাজের সব স্তরের লোকজন শামিল হলেও মূলত সামনের সারিতে আছেন ছাত্র, তরুণ ও মহিলারা। তাদের মধ্যে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুখ মুসলিম সম্প্রদায়ের। স্বাধীনতার আগে সম্ভবত একমাত্র খিলাফত আন্দোলনে এত বেশি সংখ্যক মুসলিম জনতাকে রাজপথে নামতে শেষবার ভারত দেখেছিল। এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এখন যে গণ-আন্দোলন চলছে তা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে তৃণমূল স্তরে। মহাত্মা গান্ধী বলতেন যে ভারতের গ্রাম বাদ দিয়ে স্বরাজ আসতে পারে না। স্বরাজ বা মানুষের স্বাধিকার কতটা ফিরবে এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তা এখনই বলা যাবে না। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর দেড়শো বছরের জন্ম সময় ভারত নতুন এক গণসংগ্রাম দেখছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : ভারতের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা