ইভিএম : আলোচনা আশঙ্কা আর অভিজ্ঞতা
রাজেকুজ্জামান রতন | ২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০
নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না সে কথা আরও বেশি সঠিক। দেশ-বিদেশের কথা বাদ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোর দিকে লক্ষ রাখলে এ কথা প্রমাণ করতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে বিগত এগারোটি নির্বাচনকে যদি পর্যালোচনা করা হয় তাহলে ১৯৯১, ১৯৯৬-এর জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ এই চারটি নির্বাচন ছাড়া বাকি সবগুলোই বিতর্কিত নির্বাচন বলা যায়। যে চারটি নির্বাচন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় তারাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় বরং সঠিকভাবে বলা যায় কম বিতর্কিত বা তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল এই নির্বাচনগুলো। এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই নির্বাচনগুলোর কোনোটিই দলীয় সরকারের অধীনে হয়নি।
নির্বাচন সামনে রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) কারিগরি ও ভোটদান বিষয়ে মতবিনিময় করার জন্য ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ইভিএম-সংক্রান্ত অবিশ্বাস, অনাস্থা দূর করা এবং এর কারিগরি দিক অবহিত করার প্রচেষ্টা ছিল এই মতবিনিময় সভার উদ্দেশ্য। তিন দফায় অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভায় ৪টি দল ইভিএমের পক্ষে মতামত দিয়েছে, ২৪টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে তাদের সংশয় ব্যক্ত করে একে অগ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছে আর ১১টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মতবিনিময় সভার শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা ইভিএম মন থেকে চান, চেতনা থেকে চান। কিন্তু তার এ কথা বাকিদের মনের সংশয় আর অভিজ্ঞতাজনিত ভয় দূর করতে পারেনি। বরং ক্ষমতাসীনদের জোরের সঙ্গে ইভিএম দাবি করায় অনেকের সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দল দীর্ঘদিন ধরেই অবশ্য ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে বলে আসছে। এ বছরের ৭ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তার পরদিনই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু ১০ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষমতা এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বর্তমানে ১০০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষমতা রাখেন। তিনি আরও বলেছিলেন, রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার পর ইভিএম ব্যবহার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। বর্তমান মতবিনিময় সভা তারই অংশ বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
এ সময়কালে আরও অনেক কথা নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যেমন ২১ মে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আমাদের ইভিএমের মতো সেরা মেশিন বিশ্বের কোথাও নেই। ইভিএমের ভুলত্রুটি যদি কেউ ধরতে পারেন তার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। এ কথা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে ২৪ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণাকে উদ্ভট বলে আখ্যা দেন। সাংবাদিকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে নাকি তিনি এমন কথা ভুলে বলে ফেলেছেন বলে তিনি নির্বাচন কমিশনারকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিন আবার এই নিশ্চয়তা দেন যে ভোট তার নিয়মানুযায়ী হবে, দিনের ভোট দিনেই হবে, রাতে হবে না। এ কথা শুনে সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি দিনের ভোট রাতে হয়েছিল? জবাবে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ আমি ডিনাই করি না আবার বিশ্বাসও করি না। কিন্তু অভিযোগগুলো ব্যাপকভাবে হয়েছে, এতে জনমনে নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।’ এরপর ৩০ মে আর একজন নির্বাচন কমিশনার আর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ একটাই, আর কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে একটা ডাকাত, সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে। আপনার ভোট হয়ে গেছে, চলে যান। দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।’ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এসব মন্তব্যকে কি হালকাভাবে দেখা উচিত? নিশ্চয়ই নয়।
বহুল কথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের আকাক্সক্ষা বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেমন জরুরি, নির্বাচন-সংক্রান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। ভোট প্রদান পদ্ধতি, ভোট প্রদানের আয়োজন, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে ভোট প্রদানের পরিবেশ, নির্বাচনকালীন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার সঙ্গে ভোট প্রদানের মেশিন বা মাধ্যমের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতীতে ব্যালটে ভোট প্রদানে যেমন আপাত সুষ্ঠু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আছে, তেমনি তিক্ত ও লজ্জাজনক অভিজ্ঞতাও দেশের জনগণের আছে। কখনো স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স আর কখনো আধুনিক ইভিএম ব্যবহার করেও নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনা যায়নি।
ইভিএম ব্যবহার নিয়ে যখন বিতর্ক হচ্ছে তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশ কটি দেশে ইভিএমের মতো মেশিন ব্যবহারের নেতিবাচক দৃষ্টান্তও আছে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩১ দেশ ইভিএম ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ৪ দেশ জাতীয়ভাবে, ১১ দেশ স্থানীয় নির্বাচনে এবং ১১টি দেশ পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। আর ৩ দেশ ইভিএম বাদ দিয়েছে, ১১ দেশ পাইলট প্রোগ্রামের পর ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তে অটল আছে। ভারতে ইভিএম ব্যবহার হয় বলে যে বহুল প্রচার আছে সে ক্ষেত্রে উল্লেখ করা উচিত যে, ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভোটে স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিশ্চিত করার স্বার্থে ইভিএমের সঙ্গে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছিল এবং সেটা মেনে চলা হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র পেপার ট্রেইল ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেছে। ফলে নির্বাচনে আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে মেশিনের কারিগরি দিকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচনকালীন পরিবেশ। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে এর কোনোটাই কমিশনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার কিছুটা লক্ষণ দৃশ্যমান হয়েছে।
যন্ত্র যতই আধুনিক হোক না কেন, যন্ত্রের কারিগরি সুবিধা যেমন থাকে, অসুবিধাও তেমনি থাকে কিন্তু আস্থার অভাব থাকলে শুধু যন্ত্র ব্যবহার করে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যাবে না। ইভিএমের কারিগরি ব্যবহার করে নির্বাচনী কারসাজি যে করা যায় সে কথা অনেকেই বলছেন। ফলে শুধু ১০-১৫ মিনিট পর্যবেক্ষণ করেই অনাস্থা দূর করা যাবে না। ফলে শুধু নির্বাচন কমিশনের কথা শোনা, আশ্বাস পাওয়া এবং ব্যবহারিক প্রদর্শন (ডেমনেস্ট্রশন) দেখে কারও পক্ষে কার্যকর কোনো মতামত দেওয়া সম্ভব হবে না। বরং একটি নিরপেক্ষ কারিগরি কমিটি করে ইভিএম সম্পর্কিত সব প্রশ্নের যৌক্তিক সমাধান করে তা সব রাজনৈতিক দলের কাছে উপস্থাপন করলে অনেক বেশি কার্যকর হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাটাও মনে রাখতে হবে যে যন্ত্রের চেয়ে যন্ত্রের পরিচালনাকারী এবং যন্ত্রের পেছনের মানুষ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা না থাকলে যন্ত্র ব্যবহারের পরও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব আর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তো সুদূরপরাহত।
নির্বাচনকে কালোটাকা, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সম্ভব নয়। সাধারণত বলা হয়ে থাকে তিনটা ‘এম’ নির্বাচন কলুষিত করে। এগুলো হচ্ছে মানি, মাসল আর মিডিয়া ম্যানিপুলেশন। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে তিন ‘প’, অর্থাৎ পুলিশ, প্রশাসন আর প্রভাব-প্রতিপত্তি। সবার ভোট সমান এ কথা এখন অকার্যকর হয়ে গেছে কারণ সবার ভোটে দাঁড়ানো, ভোটকেন্দ্রে যাওয়া আর ভোট দেওয়ার অধিকার তো সমান নেই এখন। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে নির্বাচন যে কতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার দৃষ্টান্ত আছে অসংখ্য। ফলে নির্বাচনকালীন সরকার কী ধরনের হবে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আর একটি প্রশ্নের জবাব পাওয়াও দরকার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী পরিচালিত একটি ব্যবস্থা। তাহলে কুমিল্লার উদাহরণ থেকে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, কুমিল্লায় কি বিজয়ী প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পেয়েছেন? বর্তমানে প্রচলিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ সিস্টেমে পাঁচ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে যিনি এক ভোটেও এগিয়ে থাকবেন, তিনিই আইনত জয়ী। এ নিয়মে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে জয় পেয়েছেন। ৫০ হাজার ৩১০ (৩৭.২৪%) ভোটে তার জয় নিশ্চিত হয়েছে। ভোট গণনা নিয়ে বিতর্কের কথা না তুলেও তো এ কথা বলা যায়, সম্মিলিতভাবে অন্য চার প্রার্থী মিলে বিজয়ী প্রার্থীর বিপরীতে ৮৪ হাজার ৪৩৫ অর্থাৎ ৬২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তাহলে তো সংখ্যাগরিষ্ঠের হার হয়েছে নির্বাচন পদ্ধতির কাছে। এ পদ্ধতি কি মানুষের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটায়, নাকি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে।
যন্ত্র, যন্ত্রের পেছনের মানুষ, নির্বাচনী পরিবেশ, নির্বাচনকালীন সরকার এসবের পাশাপাশি নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি তো তিক্ততা কমাবে না বরং সন্দেহ ও অবিশ্বাসের পাল্লা ভারী করবে ক্রমাগত। ইভিএম যেন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক্যালি ভোট ম্যানিপুলেশন নামে অভিহিত না নয়, তা দেখার দায়িত্ব তো নির্বাচন কমিশন একাই নিতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু যন্ত্র নয়, সুস্থ রাজনীতি যেমন নিয়ামক, তেমনি পদ্ধতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
শেয়ার করুন
রাজেকুজ্জামান রতন | ২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০

নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না সে কথা আরও বেশি সঠিক। দেশ-বিদেশের কথা বাদ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোর দিকে লক্ষ রাখলে এ কথা প্রমাণ করতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে বিগত এগারোটি নির্বাচনকে যদি পর্যালোচনা করা হয় তাহলে ১৯৯১, ১৯৯৬-এর জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ এই চারটি নির্বাচন ছাড়া বাকি সবগুলোই বিতর্কিত নির্বাচন বলা যায়। যে চারটি নির্বাচন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় তারাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় বরং সঠিকভাবে বলা যায় কম বিতর্কিত বা তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল এই নির্বাচনগুলো। এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই নির্বাচনগুলোর কোনোটিই দলীয় সরকারের অধীনে হয়নি।
নির্বাচন সামনে রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) কারিগরি ও ভোটদান বিষয়ে মতবিনিময় করার জন্য ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ইভিএম-সংক্রান্ত অবিশ্বাস, অনাস্থা দূর করা এবং এর কারিগরি দিক অবহিত করার প্রচেষ্টা ছিল এই মতবিনিময় সভার উদ্দেশ্য। তিন দফায় অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভায় ৪টি দল ইভিএমের পক্ষে মতামত দিয়েছে, ২৪টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে তাদের সংশয় ব্যক্ত করে একে অগ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছে আর ১১টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মতবিনিময় সভার শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা ইভিএম মন থেকে চান, চেতনা থেকে চান। কিন্তু তার এ কথা বাকিদের মনের সংশয় আর অভিজ্ঞতাজনিত ভয় দূর করতে পারেনি। বরং ক্ষমতাসীনদের জোরের সঙ্গে ইভিএম দাবি করায় অনেকের সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দল দীর্ঘদিন ধরেই অবশ্য ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে বলে আসছে। এ বছরের ৭ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তার পরদিনই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু ১০ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষমতা এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বর্তমানে ১০০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষমতা রাখেন। তিনি আরও বলেছিলেন, রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার পর ইভিএম ব্যবহার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। বর্তমান মতবিনিময় সভা তারই অংশ বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
এ সময়কালে আরও অনেক কথা নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যেমন ২১ মে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আমাদের ইভিএমের মতো সেরা মেশিন বিশ্বের কোথাও নেই। ইভিএমের ভুলত্রুটি যদি কেউ ধরতে পারেন তার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। এ কথা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে ২৪ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণাকে উদ্ভট বলে আখ্যা দেন। সাংবাদিকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে নাকি তিনি এমন কথা ভুলে বলে ফেলেছেন বলে তিনি নির্বাচন কমিশনারকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিন আবার এই নিশ্চয়তা দেন যে ভোট তার নিয়মানুযায়ী হবে, দিনের ভোট দিনেই হবে, রাতে হবে না। এ কথা শুনে সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি দিনের ভোট রাতে হয়েছিল? জবাবে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ আমি ডিনাই করি না আবার বিশ্বাসও করি না। কিন্তু অভিযোগগুলো ব্যাপকভাবে হয়েছে, এতে জনমনে নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।’ এরপর ৩০ মে আর একজন নির্বাচন কমিশনার আর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ একটাই, আর কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে একটা ডাকাত, সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে। আপনার ভোট হয়ে গেছে, চলে যান। দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।’ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এসব মন্তব্যকে কি হালকাভাবে দেখা উচিত? নিশ্চয়ই নয়।
বহুল কথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের আকাক্সক্ষা বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেমন জরুরি, নির্বাচন-সংক্রান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। ভোট প্রদান পদ্ধতি, ভোট প্রদানের আয়োজন, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে ভোট প্রদানের পরিবেশ, নির্বাচনকালীন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার সঙ্গে ভোট প্রদানের মেশিন বা মাধ্যমের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতীতে ব্যালটে ভোট প্রদানে যেমন আপাত সুষ্ঠু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আছে, তেমনি তিক্ত ও লজ্জাজনক অভিজ্ঞতাও দেশের জনগণের আছে। কখনো স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স আর কখনো আধুনিক ইভিএম ব্যবহার করেও নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনা যায়নি।
ইভিএম ব্যবহার নিয়ে যখন বিতর্ক হচ্ছে তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশ কটি দেশে ইভিএমের মতো মেশিন ব্যবহারের নেতিবাচক দৃষ্টান্তও আছে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩১ দেশ ইভিএম ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ৪ দেশ জাতীয়ভাবে, ১১ দেশ স্থানীয় নির্বাচনে এবং ১১টি দেশ পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। আর ৩ দেশ ইভিএম বাদ দিয়েছে, ১১ দেশ পাইলট প্রোগ্রামের পর ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তে অটল আছে। ভারতে ইভিএম ব্যবহার হয় বলে যে বহুল প্রচার আছে সে ক্ষেত্রে উল্লেখ করা উচিত যে, ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভোটে স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিশ্চিত করার স্বার্থে ইভিএমের সঙ্গে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছিল এবং সেটা মেনে চলা হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র পেপার ট্রেইল ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেছে। ফলে নির্বাচনে আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে মেশিনের কারিগরি দিকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচনকালীন পরিবেশ। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে এর কোনোটাই কমিশনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার কিছুটা লক্ষণ দৃশ্যমান হয়েছে।
যন্ত্র যতই আধুনিক হোক না কেন, যন্ত্রের কারিগরি সুবিধা যেমন থাকে, অসুবিধাও তেমনি থাকে কিন্তু আস্থার অভাব থাকলে শুধু যন্ত্র ব্যবহার করে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যাবে না। ইভিএমের কারিগরি ব্যবহার করে নির্বাচনী কারসাজি যে করা যায় সে কথা অনেকেই বলছেন। ফলে শুধু ১০-১৫ মিনিট পর্যবেক্ষণ করেই অনাস্থা দূর করা যাবে না। ফলে শুধু নির্বাচন কমিশনের কথা শোনা, আশ্বাস পাওয়া এবং ব্যবহারিক প্রদর্শন (ডেমনেস্ট্রশন) দেখে কারও পক্ষে কার্যকর কোনো মতামত দেওয়া সম্ভব হবে না। বরং একটি নিরপেক্ষ কারিগরি কমিটি করে ইভিএম সম্পর্কিত সব প্রশ্নের যৌক্তিক সমাধান করে তা সব রাজনৈতিক দলের কাছে উপস্থাপন করলে অনেক বেশি কার্যকর হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাটাও মনে রাখতে হবে যে যন্ত্রের চেয়ে যন্ত্রের পরিচালনাকারী এবং যন্ত্রের পেছনের মানুষ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা না থাকলে যন্ত্র ব্যবহারের পরও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব আর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তো সুদূরপরাহত।
নির্বাচনকে কালোটাকা, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সম্ভব নয়। সাধারণত বলা হয়ে থাকে তিনটা ‘এম’ নির্বাচন কলুষিত করে। এগুলো হচ্ছে মানি, মাসল আর মিডিয়া ম্যানিপুলেশন। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে তিন ‘প’, অর্থাৎ পুলিশ, প্রশাসন আর প্রভাব-প্রতিপত্তি। সবার ভোট সমান এ কথা এখন অকার্যকর হয়ে গেছে কারণ সবার ভোটে দাঁড়ানো, ভোটকেন্দ্রে যাওয়া আর ভোট দেওয়ার অধিকার তো সমান নেই এখন। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে নির্বাচন যে কতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার দৃষ্টান্ত আছে অসংখ্য। ফলে নির্বাচনকালীন সরকার কী ধরনের হবে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আর একটি প্রশ্নের জবাব পাওয়াও দরকার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী পরিচালিত একটি ব্যবস্থা। তাহলে কুমিল্লার উদাহরণ থেকে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, কুমিল্লায় কি বিজয়ী প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পেয়েছেন? বর্তমানে প্রচলিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ সিস্টেমে পাঁচ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে যিনি এক ভোটেও এগিয়ে থাকবেন, তিনিই আইনত জয়ী। এ নিয়মে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে জয় পেয়েছেন। ৫০ হাজার ৩১০ (৩৭.২৪%) ভোটে তার জয় নিশ্চিত হয়েছে। ভোট গণনা নিয়ে বিতর্কের কথা না তুলেও তো এ কথা বলা যায়, সম্মিলিতভাবে অন্য চার প্রার্থী মিলে বিজয়ী প্রার্থীর বিপরীতে ৮৪ হাজার ৪৩৫ অর্থাৎ ৬২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তাহলে তো সংখ্যাগরিষ্ঠের হার হয়েছে নির্বাচন পদ্ধতির কাছে। এ পদ্ধতি কি মানুষের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটায়, নাকি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে।
যন্ত্র, যন্ত্রের পেছনের মানুষ, নির্বাচনী পরিবেশ, নির্বাচনকালীন সরকার এসবের পাশাপাশি নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি তো তিক্ততা কমাবে না বরং সন্দেহ ও অবিশ্বাসের পাল্লা ভারী করবে ক্রমাগত। ইভিএম যেন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক্যালি ভোট ম্যানিপুলেশন নামে অভিহিত না নয়, তা দেখার দায়িত্ব তো নির্বাচন কমিশন একাই নিতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু যন্ত্র নয়, সুস্থ রাজনীতি যেমন নিয়ামক, তেমনি পদ্ধতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট