
সিনেমাতে ও বাংলাদেশের এনআইডিতে মায়ের চেয়ে ছেলে বড় অবশ্যই সম্ভব।
১০৬টি অ্যাপিসোডে সমাপ্ত আমেরিকার এনবিসি টেলিভিশনের ফ্যামিলি ড্রামা ‘দিস ইজ আস’। পিয়ারসন পরিবারের বড় বড় তিনটি সন্তান কেভিন, কেইট এবং র্যান্ডেল; তাদের বাবা জ্যাক পিয়ারসন এবং মা রেবেকা পিয়ারসন। রেবেকা আসলে অভিনয় এবং সংগীতে খ্যাত ম্যান্ডি মুর। তার জন্ম ১০ এপ্রিল ১৯৮৪। তার ব্যক্তি জীবনে দুটি ছেলে। ছোটটির জন্ম হয়েছে ২১ অক্টোবর ২০২২। আর সিনেমার ছেলে কেভিন আসলে জাস্টিন হার্টলে, তার জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৯৭৭, মায়ের চেয়ে সাত বছরের বড়। কেইট একটু মোটাসোটা। বাস্তব জীবনে অভিনেত্রী ও গায়ক ক্রিস্টিন মিশেলের জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮০, ক্রিস্টিনও মায়ের চেয়ে ৪ বছরের বড়। আর র্যান্ডেলের প্রকৃত নাম র্যান্ডেল হিল, কালো আমেরিকান, জন্ম ৩০ আগস্ট ১৯৮০; পিয়ার্সন পরিবার তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে। র্যান্ডেলও মায়ের চেয়ে ৪ বছরের বড়।
জন্ম-তারিখ ধরে হিসাব করে দেখুন সিনেমার কেভিন কেইট ও র্যান্ডেল, রেবেকার গর্ভজাত পুত্র, গর্ভজাত কন্যা এবং দত্তক গৃহীত পুত্র তিনজনই মায়ের চেয়ে বয়সে বড়। সোজা কথা সিনেমায়, নাটকে সন্তান মায়ের চেয়ে বেশি বয়স্ক হতেই পারে। সিনেমার মায়ের বা বাবার সঙ্গে সন্তানের বয়সের হাস্যকর ব্যবধান থাকতেই পারে। এজন্যই তো সিনেমা আর নাটক।
‘রাইডিং ইন কারস উইথ বয়স’ সিনেমার মা ড্রু ব্যারিমুরের বয়স ২৬ বছর আর ছেলে অ্যাডাম গার্সিয়ার ২৮। ‘ব্লো’ সিনেমায় অভিনয়ের সময় মা র্যাচেল গ্রিফিথ ৩২ বছর বয়সী ছিলেন আর তার ছেলে জনি ডেপ তখন ৩৭। যখন বিখ্যাত সিনেমা হ্যামলেট মুক্তি পায় তখন হ্যামলেটের ভূমিকায় অভিনয় করা লরেন্স অলিভিয়ার ছিলেন ৪১ আর তার মা ডেনমার্কের রানি এইলিন হার্লের বয়স তখন ৩০ বছর। মাকে ছেলের চেয়ে বড় হতেই হবে সিনেমাতে এই বাধ্যবাধকতা নেই। আর একটি উদাহরণ না দিলেই নয়। ডাক ফাটানো সিনেমা আলেকজান্ডারে মা অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ২৯ বছর। এখানে জীববিজ্ঞানের আইন মেনে তার পুত্র কলিন ফ্যারেন মাকে ডিঙাতে চেষ্টা করেননি। তার বয়স ২৮ বছর। মা ও ছেলের বয়সের ব্যবধান ১ বছর। সিনেমায় যতটুকু খোঁজ করেছি তাতে ছেলে মায়ের চেয়ে সর্বোচ্চ ১১ বছরের বড়। গঞ্জিকা সেবন করেই মাকে ছেলের চেয়ে কতটা বড় করা সম্ভব?
শিঙাড়া-সমুচা-চা-চপ সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় যেমন পৃথিবীকে হারিয়ে দিয়েছে, তেমনি হারিয়েছে বয়সের মহামারপ্যাঁচে। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে তৈরি করা জাতীয় পরিচয়পত্র ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডে (এনআইডি) ছেলে তার মায়ের চেয়ে ১৩ বছরের বড়। শৈশবে পাকামি করার কারণেই হোক কি অতি স্নেহপ্রবণ হয়ে হোক বাবা-মা ছেলের নাম রেখেছেন পাকু। প্রকৃত বয়স এবং বেশি আই কিউজনিত মানসিক বয়সের কিছু তারতম্য হয়েই থাকে। নিজের প্রকৃত বয়স ৫ বছর বুদ্ধিমত্তা তাকে ১০-এর সমকক্ষ করে দিতে পারে। কোনো বিশেষ গুণের কারণে পাকু নিজেকে ছাড়িয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইবোনদের ছাড়িয়ে এমনকি গর্ভদাত্রী মাকেও ছাড়িয়ে তার চেয়ে ১৩ বছর ৪ মাস এগিয়ে গেলেনতার জবাব দিতে পারে শুধু এনআইডি কর্তৃপক্ষ।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, পাকু দাসের মা রাধারানী দাশের জন্ম ৩ আগস্ট ১৯৬৮। আর তার গর্ভজাত পুত্র পাকু দাশের জন্ম ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড অনুযায়ী ২০ এপ্রিল ১৯৫৫, মায়ের জন্মেরও ১৩ বছর ৩ মাস ১৪ দিন আগে। শুধু যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি বলে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশের নাম ওঠার আর একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। পাকু দাশ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ২০২২-এর ৩০ অক্টোবর আরও কিছুসংখ্যক কর্মচারীর সঙ্গে তিনি চাকরি হারান। তার চাকরি হারানোর কারণ সরকার বিরোধিতা বা ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়া নয়, এমনকি অবৈধ অনুপস্থিতি বা ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিংসের সুপারিশের কারণেও নয়। চাকরি হারানোর কারণটি অত্যন্ত ন্যায়সংগত সুপার অ্যানুয়েশন। সময়মতো তার এনআইডি চেক করা হলে আরও আগেই তাকে বিদায় হতে হতো। চাকরি করার বিধিবদ্ধ যে চূড়ান্ত বয়স অর্থাৎ ৫৯ তিনি তা পেরিয়ে গেছেন। সুতরাং আর কত! এবার বিদায় নিন। কিন্তু ৫৯ হলোই বা, বিদায় নিতে হবে কেন? বাংলাদেশে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে চাকরিকাল তো ৬৭ বছর। পাকু দাশ যদি সে রকম পদে অধিষ্ঠিত থাকতেন তাহলেও তাকে আরও আগে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হতো। মায়ের আগে জন্ম নেওয়া পাকু দাশের বেলায় চাকরিচ্যুতি মানে শুধু বেতন হারানো নয়, চাকরির কারণে পাওয়া বাসাটিও হারানো। কিন্তু তাকে দেখলে কি ঊনষাট মানে ষাট ছুঁই ছুঁই মনে হয়। দেখে যা মনে হয় সেটা মেনে নিলেই ঝামেলা চুকে যেত। কিন্তু তা হওয়ার নয়।
এনআইডি পাওয়ার মতো মহাসম্মানজনক ঘটনা তখনো ভারতে ঘটেনি। ভারতে নিম্ন আদালতের একটি মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছায়। শ্যাম কিশোর ঘোষ ভারত কয়লা লিমিটেডের কর্মচারী। শ্যাম কিশোরের দাবি, তার সার্ভিস বইতে বয়স বেশি লেখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট অনেক বিচার বিবেচনার পর রায় দিয়েছে বানান ভুল সংশোধন করার সুযোগ আছে, কিন্তু চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সার্ভিস রেকর্ডে লিখিত বয়স এমনকি যদি ভুলও হয়ে থাকে সংশোধনের আর সুযোগ নেই। আবেদনকারীকে যত তরুণই মনে হোক না কেন সার্ভিস রেকর্ডের বয়সই তার স্বীকৃত বয়স। বাংলাদেশে অবশ্য কোনো সচিবও নির্ধারিত মেয়াদের চেয়ে বছর দু-এক বেশি চাকরি করার সময় ধরা পড়ে যান। পাকু দাশ ভাগ্যবান, তার ওপর মিডিয়ার আলো পড়েছিল বলে এনআইডি কর্তৃপক্ষ তার বয়স কমিয়ে সংশোধিত এনআইডি ইস্যু করে দিয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও পাকু দাশকে পূর্ব পদে বহাল করেছে। কিন্তু কোন অবস্থায় তাকে মায়ের চেয়ে বড় বানানো হলো, আবার কেমন করে মায়ের চেয়ে ছোট হয়ে গেলেন এ নিয়ে কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি, পেলে ভালো হতো। পাকু দাশের কর্মজীবনে প্রত্যাবর্তনকে অবশ্যই স্বাগত। এ ধরনের পাকু দাশ কেইস আরও থাকার কথা। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় সরকার সংস্থায় যারা চাকরি করছেন নিঃসন্দেহে সবাই এনআইডিধারী। এনআইডির ভুল সংশোধনেরও সুযোগ রয়েছে। যদি পাকু দাশের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে তো ১৯৫৫ সালের জন্ম-তারিখ নিয়ে তার চাকরিই পাওয়ার কথা নয়। তিনি কবে চাকরিতে ঢুকেছেন? ২০০০ সালেই তো তার বয়স ৪৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার কথা। এনআইডি এসেছে আরও অনেক পরে সন্দেহ নেই। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রুলিং অনুসরণ করলে চাকরিজীবীর বেলায় আদালতের আদেশ ছাড়া বয়স বাড়ানো কিংবা কমানো কিংবা সংশোধনের সুযোগ নেই। জন্মের প্রকৃত তারিখ যাই হোক বয়সটাকে কমিয়ে রাখার প্রবণতাই বেশি। আমি বাড়িয়ে নেওয়ার বেশ কটা ঘটনার সঙ্গেও পরিচিত। যেসব প্রতিষ্ঠানে পৌষ্যের চাকরি পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে, সেখানে পড়াশোনায় অনাগ্রহী ১৬ বছরের ছেলে বা মেয়েকে ১৮ দেখিয়ে বাবার অফিসে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য স্কুল রেজিস্টারে বয়সটা বেশিই লেখা হয়। আবার দুবছর কম লেখা হলে সরকারি চাকরিতে দুবছর বেশি চাকরি করার সুযোগটাও নেওয়া যায়। দুটোরই কিছু লাভজনক দিক রয়েছে। ভারতে বয়স নিয়ে বেশ কটা মামলার সুনির্দিষ্ট রুলিং রয়েছে। একটি মামলা সুনীল কুমার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া নামের বানান সংশোধন বিষয়ে, এতে সংশোধিত বানান গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বয়সের কারণে সুনির্দিষ্ট কোনো সুযোগ না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় বর্ণবাদের মতো বয়সবাদ (এজিজম)। ১৯৬৯ সালে রবাট নিল বাটলার বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি বৈষম্য বোঝাতে ‘এজিজম’ টার্মটি ব্যবহার করেন। বয়স্করা তরুণদের যে নিপীড়ন করে থাকে তাকেও এজিজম বলা হয়েছে। বয়সের কারণে পক্ষপাত বোঝাতে সর্বদাই যে তরুণ পছন্দনীয় তা নয়, বয়স্কের প্রাধিকার মেলে তবে তা তুলনামূলকভাবে কম। বয়স্করা এখন এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও ডিজিটাল এজিজমের শিকার। তরুণরা দক্ষতার সঙ্গে ডিজিটাল যুগে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে, বুড়োরা পারেনি। সুতরাং তারা মার খেয়ে যাচ্ছে। বয়স-বৈষম্যের কথা বেশি শোনা যায় হলিউডেসুন্দরী নায়িকা কিংবা স্মার্ট নায়কের বয়স বেড়ে গেছে, তাদের আর নায়িকা নায়ক ভূমিকায় রাখা যায় না। তিন ধরনের এজিজমের কথা বলা হয়; প্রাতিষ্ঠানিক বয়স-বৈষম্যবাদ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখা; আন্তব্যক্তিক বয়স-বৈষম্যবাদ : সমাজ জীবনে বয়স্করা প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হন; আত্মীকৃত বয়স-বৈষম্যবাদ : এতে ব্যক্তি নিজেই বয়স-বৈষম্যবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং নিজের ওপর তা প্রয়োগ করতে থাকেন।
একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের জন্য বিতর্কিত হেনরি কিসিঞ্জার ২৭ মে ২০২৩ শতবর্ষ পূর্ণ করবেন। ৯৯ বছর বয়সে প্রকাশ করেছেন একটি বহুলালোচিত গ্রন্থ : লিডারশিপ : সিক্স স্টাডিজ ইন ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ। বয়স-বৈষম্যবাদ তিনি অবলীলায় ডিঙিয়ে গেছেন। ৮৯ বছর বয়সে সোপোক্লেস রচনা করেছেন ইডিপাস অ্যাট কোলোনাস। ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুর দিনই ভোরে গ্যালিলিও নতুন বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। বেনিয়ামিন ফ্রাঙ্কলিন পাবলিক সার্ভিস থেকে অবসর নেন ৮২ বছর বয়সে। রোলান্ড রেগান ৭০ বছর বয়সে যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, পত্রিকা শিরোনাম করেছিল লাইফ বিগিনস অ্যাট সেভিন্টি। তিনি আরও ৮ বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্টদের একজন। হেনরিক ইবসেন ৭১ বছর বয়সে নাটক লিখেছেন : যখন আমরা মৃতেরা জেগে উঠব; অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস ৯২ বছর বয়সে গ্রিক ভাষা শিখে প্লেটোর রচনাবলি পড়তে শুরু করেন। হোয়াট শি শুড নট জর্জ বার্নার্ড শ লিখেছেন ৯৪ বছর বয়সে। বয়স যখন প্রায় পঁচাশি আইজ্যাক নিউটন রয়াল মিন্টের ওয়ার্ডেনের দায়িত্ব পালন করছেন।
তাদের সবাই নিজ গুণে বয়স-বৈষম্যবাদকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পেরেছেন। ব্রাজিলের ওয়াল্টার অর্থমান একই কোম্পানিতে ৮৪ বছর ৯ দিন চাকরি করে বিশ^রেকর্ড করেছেন, গিনেসের রেকর্ড বইতে তার নাম উঠেছে। তিনি শতবর্ষী। ১৫ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। বুড়ো বয়স নিয়ে অস্বস্তি বোধ করার কারণ নেই। সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫-এ পৃথিবীর ১৮ ভাগ মানুষ সিনিয়র সিটিজেন (৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব)। ২০৩০ নাগাদ এই সংখ্যা ৯৭৪ মিলিয়নে পৌঁছাবে। ওল্ড বয়স এবং ওল্ড গার্লস ক্লাবই হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাব।
গৌরবের ওল্ড বয়েস ক্লাব মায়ের চেয়ে বয়সে বড় একজন পাকু দাশকে ধরে রাখতে পারল না।
লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ আমাদের কর্মসংস্থান ও জীবনপ্রণালীতে ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ বৃদ্ধি, অভিবাসন ও জাতিগত সংঘাতের মতো বিষয় পৃথিবীর সমস্যাকে আরও ত্বরানিত করছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনমিতিক সম্ভাবনাকে সম্পদে রূপান্তর করতে প্রয়োজন জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও ইতিবাচক দৃষ্টিসম্পন্ন দূরদর্শী, সংবেদনশীল, অভিযোজনে সক্ষম, মানবিক, বৈশ্বিক এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক।
ওপরের এসব ভাবনা বিবেচনায় নিয়েই বহুল প্রতীক্ষিত নতুন শিক্ষাক্রম এ বছর থেকে দেশব্যাপী পরীক্ষামূলক সংস্করণ বাস্তবায়ন (প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে) শুরু হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে আগামীতে সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয় সর্বশেষ ২০১২ সালে। ফলে যুগোপযোগী নতুন শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রধানত তিনটি পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১. পাঠ্যবই পরিবর্তন ২. শিখন-শেখানো কৌশল পরিবর্তন ৩. মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন। নতুন শিক্ষাক্রমের দার্শনিক ভিত্তি হলো ডেভিড কোব-এর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন। মূলত শিক্ষার্থীরা চারটি ধাপের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবে। ডেভিড কোব-Learning is the process whereby knowledge is created through the transformation of experience (1984). ডেভিড কোব-এর শিখন-শেখানো কৌশলের চারটি ধাপ হলো যথাক্রমে: ১. প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা ২. প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ ৩. বিমূর্ত ধারণায়ন এবং ৪. সক্রিয় পরীক্ষণ। ডেভিড কোব-এর অভিজ্ঞতানির্ভর শিখন মূলত আরেক দার্শনিক পেঁয়াজের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ত্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ও বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এই নতুন শিক্ষাক্রম খুবই কার্যকর ও সময়োপযোগী। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে অভিনব পদ্ধতি সংযোজন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে তিনভাবে। যথা: ১. শিখনকালীন মূল্যায়ন (সারা বছর ধরে চলবে) ২. সামষ্টিক মূল্যায়ন (বছরে দুইবার) ৩. আচরণিক মূল্যায়ন। নতুন শিক্ষাক্রমের ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টি বিষয়ের (বাংলা, গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান) মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন ও সামষ্টিকভাবে। বাকি ৫টি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন (বিদ্যালয় পর্যায়ে)।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার কোনো দরকার নেই। অবশ্যই নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে বুঝে গেছে কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। গাইড বই বা অন্য কোনো সহায়ক বইয়েরও দরকার নেই। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও নতুন শিক্ষাক্রমের উপজেলা পর্যায়ের মাস্টার ট্রেনার (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান) হিসেবে বলতে পারি, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির পাঠ চলাকালীন শিক্ষার্থীদের এত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আনন্দঘন পরিবেশ আগে কখনো লক্ষ করা যায়নি।
নতুন শিক্ষাক্রমের পড়াশোনা পুরোপুরি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে বিভিন্ন শিখন কৌশল ও শিখন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যোগ্যতা অর্জন করবে। যোগ্যতাভিত্তিক এই শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই বিভিন্ন সেশন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সহায়িকা (ঞএ) রাখা হয়েছে। শিক্ষকমন্ডলী এই শিক্ষক সহায়িকা দেখে পড়াবেন। শিক্ষক সহায়িকার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আশা করা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এই নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে বিশ^নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে যে, শিক্ষকদের গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টি এখনো হয়তো সবার মনোযোগের কেন্দ্রে নেই। তাই হয়তো আমার এক সহকর্মী কৌতুক করে বলছিলেন ‘বুঝলাম, নতুন শিক্ষাক্রম বিশ^মানের। তবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কোন মানের?’
সে যাই হোক, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ভুলত্রুটি (বানান, তত্ত্ব ও লাইনের অসংগতি) চোখে পড়েছে। আমি ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির নতুন বইয়ে বেশ কিছু পৃষ্ঠায় বানান ভুল চোখে পড়েছে। যা গ্রহণযোগ্য ছিল না। কেননা মাধ্যমিক পর্যায়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই ভুল দেখছে ও পড়ছে (যদিও শিক্ষকরা নিজে থেকে ক্লাসে ভুল সংশোধন করে দিচ্ছেন)। এটা ঠিক, নতুন বই মূলত ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’।
পাঠ্যবইয়ের ভুলত্রুটি অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। নতুন পাঠ্যবইয়ের সামান্য ভুলত্রুটি বা অসংগতি নিয়ে যারা বা যেসব মহল তিলকে তাল করছে তারা সঠিক কাজ করছে না। গঠনমূলক সমালোচনা সব পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য। নতুন শিক্ষাক্রম মূলত পুরো জাতির জন্য। সামান্য ভুলত্রুটি থাকলে সেটা গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। কেননা শিক্ষাক্রমের নতুন প্রতিটি বইয়ের শুরুতে ‘প্রসঙ্গ কথা’য় লেখা রয়েছে পরীক্ষামূলক এই সংস্করণের কোনো ভুল বা অসংগতি কারও চোখে পড়লে এবং এর মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো পরামর্শ থাকলে তা জানানোর জন্য সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ রইল।
আশা করি, নতুন শিক্ষাক্রমের ভুলত্রুটি নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কর্তৃপক্ষ থেকে সংশোধনী আসবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় জীবন-জীবিকার যেমন সংকট থাকবে না তেমনি অভিযোজনের মাধ্যমে টেকসই ও নিরাপদ পৃথিবী গড়া সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী
‘দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ করব না’অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে গত বছরের শুরুতে দায়িত্বে অভিষেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর। এক বছরের মাথায় এসে ঘোষণা : ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকরা ক্যানসারের মতো, ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ যেমন কেটে ফেলা হয়, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের ছেঁটে ফেলা হবে’।
অভিষেকের সময় প্রধান বিচারপতির করা আশাজাগানিয়া ওই অঙ্গীকারের কোনো খেলাপ এখনো হয়নি। অথবা চেষ্টায় কমতি ঘটেছে বা হাল ছেড়ে দিয়েছেন এমনও নয়। অবিরাম তার নানা নির্দেশনা-আহ্বানের কিছু কিছু গণমাধ্যমেও আসছে। কোনো অনুষ্ঠানে রাখা বক্তব্যের খবরগুলোই সচরাচর প্রকাশ পায়। এ ছাড়া ইনডোরেও সুষ্ঠু বিচারের তাগিদ দিচ্ছেন নিয়মিত। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় বলা কথাবার্তার মধ্যে স্বল্প খরচ ও সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, আইনজীবীদের সপ্তাহে অন্তত এক দিন বিনাপয়সায় মামলায় লড়ার আহ্বান মানুষকে আশাবাদী করেছে। বিবেকবানদের দৃষ্টি কেড়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির শত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের কয়েকটি বক্তব্য আরও তাৎপর্যপূর্ণ।
দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতের তাগিদ দিতে গিয়ে তিনি কিছু উষ্মার কথা বলেছেন। বছরের পর বছর মাসের পর মাস মানুষ আদালতে ঘুরতে থাকলে আদালতের প্রতি অনাস্থার জন্য দায়ী হবে কে? প্রশ্নটি ছুড়ে জবাবে বলেছেন, দায়ী হবে সিস্টেম, দায়ী হবেন আইনজীবী, দায়ী থাকবেন বিচারক। কিছুদিন আগেও এক বক্তৃতায় তার প্রশ্ন ছিলএকটি কেইস ৩০ বছর ধরে চললে মানুষের কেন আস্থা থাকবে? চাঁপাইনবাবগঞ্জের বক্তৃতায় কোনো বিচারকের প্রতি অভিযোগ থাকলে সরাসরি তার কাছে অভিযোগ জানাতে বলেছেন। একপর্যায়ে বলেছেন সবচেয়ে কঠিন কথাটি‘দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকরা ক্যানসারের মতো, ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ যেমন কেটে ফেলা হয়, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের ছেঁটে ফেলা হবে।... যেকোনো দুর্নীতি ক্যানসারের মতো। যদি কোনো আঙুলে ক্যানসার হয় উচিত হবে চট করে সেই আঙুল কেটে ফেলা।’ একেবারে মেদহীন কথা। যদি-কিন্তু-তবের ফাঁক নেই। বিচার বিভাগকে মহান সংবিধানের ‘শেষ রক্ষাকবচ’ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আইনজীবীরা সেই বিচার বিভাগেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বার ও বেঞ্চ পরস্পরের পরিপূরক। একটি পাখির দুটি ডানা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা দুই পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো বিচার বিভাগ।’
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কথাগুলোকে বলার জন্য বলা বা কথার কথা মনে করার জো নেই। কথা আর অবশিষ্ট রাখেননি তিনি। দায় নয়, প্রকারান্তরে দায়িত্ব নিয়েছেন। শুরু থেকেই চলমান অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং, ঘুষসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ-কষ্টের কথা জানিয়ে আসছিলেন তিনি। যেগুলোর দায় এবং দায়িত্ব সরকারি মহলের। কিন্তু, এবার নিজস্ব আঙিনার দুর্নীতির দিকে আঙুল তুলে প্রধান বিচারপতি অতিরিক্ত দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়েছেন। কোনো তথ্য বা অভিযোগ ছাড়া তিনি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারক ও ক্যানসার’ প্রসঙ্গটি আনেননি। এ ছাড়া এমন একসময় তিনি তীরটি ছুড়লেন যখন আমাদের সামনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিন্ড্রোম। তাও তার আদালতে বিচারাধীন। সচরাচর সাধারণ মানুষ বিচার, বিচারালয়, বিচারপতি নিয়ে কথা বলতে ভয়ে থাকে। বিষয়গুলো স্পর্শকাতর। আড়ালে-আবডালে কিছু বললেও এদিক-ওদিক তাকায়। কারও কাছে আইন-আদালত ভীষণ ভয়ের। কারও কাছে শ্রদ্ধার। আর লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মধ্যে কাজ করে সর্বোচ্চ সতর্কতা। একটু এদিক-সেদিক হয়ে গেলেই আদালত অবমাননার মতো মহাবিপদের শঙ্কা তাড়া করে। আবার তথ্যসহ প্রযুক্তিগত নানা কল্যাণে কেউ না বললেও সব কথাই বলা হয়ে যায়। জানাজানির বাকি থাকে না। সোশ্যাল মিডিয়া মাড়িয়ে মূলধারার গণমাধ্যমেও চলে আসে। তার ওপর আইন-বিচারাঙ্গনে কর্মরতদের কাণ্ডকীর্তির খবর হালে মাত্রাগতভাবে বেশি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতের ঘটনার ফুটেজ প্রথমে ঘুরছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরে মেইন স্ট্রিমের মিডিয়ায়। একপর্যায়ে উচ্চ আদালতের বিচার্য বিষয়ে। আইন-আদালত-বিচার নিয়ে সাধারণ মানুষ ভয়ে বা শ্রদ্ধায় সংযত থাকলেও সংশ্লিষ্টরা দেখিয়েছেন উল্টোটা। হাইকোর্টের বিচারপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালত কক্ষের ওই ভিডিও ফুটেজ দেখে বলেই বসেছেন, কমলাপুরের কুলিরাও এ ভাষায় কথা বলে?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ ও আইনজীবীদের কর্মবিরতির কারণে আদালতপাড়ায় টানা কয়েক দিন যে অচলাবস্থা চলেছে একে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বিচ্ছিন্ন বা আঞ্চলিক ঘটনা বলার অবস্থা নেই। সেখানকার জেলা জজসহ দুই বিচারকের অপসারণ ও নাজিরের শাস্তির দাবিতে আইনজীবীরা কর্মবিরতিসহ কি না করেছেন? কীসব ভাষা ও আচরণ না করেছেন? এজলাস চলাকালে বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে আইনজীবীদের আচরণ ও ভাষার কয়েক মিনিট সারা দেশের মানুষের দেখা হয়েছে।
এ রকম সময় প্রধান বিচারপতি ‘চাঁপাই’তে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় যে মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা উপলব্ধির মূল দায়িত্ব আইনজীবী-বিচারপতি দুপক্ষেরই। তার ‘একটি পাখির দুটি ডানা’ মন্তব্যের মধ্যে রয়েছে মোটা দাগের একটি সতর্কবার্তা। অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবী আর বিচারকসহ আইনাঙ্গন সংশ্লিষ্টদের কদাকার ঘটনাকে জাস্ট ভাই-বোনের বিরোধের মতো বিষয় বলে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আচানক কাণ্ডের পর উচ্চাদালতেও কম যাননি আইনজীবীরা। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীকে আদালত অবমাননার রুল দেওয়ার পর ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজিরা ছিল তাদের। দিনটিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বাংলাদেশের বিচারালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে। আদালত বলেছে, ওই বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীরা যে আচরণ করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না। সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগুন না থামালে আমাদের সবাইকে জ্বলতে হবে।
বিচারপতির উপরোক্ত তিনটি বাক্যের মধ্যে লুকানো বেদনা ও শঙ্কার মধ্যে বিবেকমান যে কারও জন্য ভাবনার অনেক উপাদান। ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। সেখানকার এমপি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি আবার একজন আইনজীবীও। তার বাবা প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকও ছিলেন বাংলাদেশের আইন ও বিচার অঙ্গনের তারকা ব্যক্তিত্ব। মহল্লার মেলদরবারের মতো দুই কথার বাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এজলাসে হট্টগোল, বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের ‘গালাগাল ও অশালীন আচরণকে ‘ভাইবোনের ঝগড়ার মতো’ বলে উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী। বিচারক-আইনজীবী-আদালত-বিচার তথা আইন ভাইবোনের কাইজ্জার বিষয় নয়? স্বামী-স্ত্রী বা ভাই-বোন মিলে দল চালানো যায়। জোট গঠন করা যায়। বড় বড় কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা যায়। দেশও চালানো যায়। তা আইন, বিচার বা বিচারালয়ে কি খাটে? সাফাই বা এ ধরনের আশকারা দেশের বিচারব্যবস্থাকে কোন তলানিতে নিয়ে যেতে পারেসেই শঙ্কার বার্তা রয়েছে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ ফারুক আহমেদের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশও দিয়েছে হাইকোর্ট। যেই লাখো-কোটি মানুষ ওই ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন, গালমন্দগুলো শুনেছেন তাদের মনের হার্ডডিস্কে কিন্তু গেঁথে আছে। শুনানিতে হাইকোর্ট কেন শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীদের তলব করল, বিচারকদের প্রতি কেন আদালত অবমাননার রুল জারি করল নাএ ক্ষোভ ছোড়া হয়েছে। বিচারকদের আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ বলতেও ছাড়েননি আইনজীবীরা। এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা উচ্চৈঃস্বরে ‘ঠিক-ঠিক’ বলে ওঠেন। এত ঠিকের মধ্যে আইন-বিচার ও আদালতের ভবিষ্যৎ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারক বিচার চেয়েছেন। আগে অসদাচরণের শিকার বিচারকরাও বিচার চেয়েছিলেন। আদালতে তলব করে দুর্বিনীত আইনজীবীকে সমঝে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আদালতে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে তারা হাসিমুখে বের হয়ে বেপরোয়া আচরণের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বিখ্যাত’ হয়েছেন। ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর বা খুলনার ঘটনা অনেকের মনে আছে, যা আইন পেশার মানের নিম্নগামিতার সঙ্গে আরও নানান কিছু নির্দেশ করে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআইবি একবার তাদের খানা জরিপ প্রতিবেদন দিয়ে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগ ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সার্ভিস সেক্টর’। সুপ্রিম কোর্ট ক্ষুব্ধ এতে হয়। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব মিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি বলেছিল, এই জরিপ উপকারী নয়। টিআইবি বলেছিল, এটা দৃষ্টিভঙ্গিগত একটি বিষয়। তবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের মনোভাব কী, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক সময় অল্পসংখ্যক বিচারকদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ বিভিন্ন সেক্টরে অল্পরাই বেশি ক্ষমতাধর। এরাই উদাহরণ। প্রধান বিচারপতিও নিশ্চয়ই অনেক সংখ্যকের কথা বলেননি। অন্তত টোকেন বা প্রতীকী হলেও অল্পেরও অল্প কিছু দৃষ্টান্ত রাখার দায়িত্ব এখন প্রধান বিচারপতির। ক্যানসার মেডিসিনে না সারলে সার্জিক্যালে যেতে হয়, ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ কেটে ফেলার সেই আভাস তিনি দিয়েছেন প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে। কথা বলেছেন অ্যাকটিভ ভয়েসে। এর মধ্য দিয়ে সার্জনের থিয়েটারে তিনি নিজেই। শনিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে এটি গুরুত্ব পেয়েছে দিনের টপ নিউজ হিসেবে। আরেক টপ নিউজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারকের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনায় আদালত অবমাননার ব্যাখ্যার পরবর্তী তারিখ সামনের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। ওইদিন তিন আইনজীবীর সশরীরে লিখিত ব্যাখ্যার তারিখ। এর আগে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যটি রুলিংয়ের চেয়ে কম নয়। যদি বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা তা উপলব্ধি করেন। এটি অন্য কারও বুঝিয়ে-শুনিয়ে আরোপের বিষয় নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবিড় পাঠ ও গবেষণার পরিবেশের সঙ্গে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যাবৃদ্ধি এবং দেশের নানাপ্রান্তে সেগুলোর অবস্থানগত বিস্তারের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবাসনের সুবিধা না পেলে শিক্ষার্থীদের পাঠ ও গবেষণায় তা বিরূপ প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটকে কেন্দ্র করে চলছে ছাত্ররাজনীতির নামে নির্মম দখলদারিত্ব আর ক্ষমতার সন্ত্রাস। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো যেমন এ বিষয়ে পরিকল্পনাহীন তেমনি উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয় নিশ্চুপ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট কতটা প্রবল তা জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে। এতে জানা গেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আবাসিক হল না থাকায় ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসিক সুবিধা পান না। প্রতিবেদনে উল্লিখিত বাস্তবতার এক নির্মম চিত্র দেখা যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘আন্দোলন করে হলে উঠে ছাত্রীরা পেল চৌকি’ শিরোনামের প্রতিবেদন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ‘চৌকি নিবাস’-এর তথ্য উঠে এসেছে। জানা গেছে, তারিখ দিয়েও দফায় দফায় পেছানোর পর অবশেষে আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ছাত্রীদের জন্য তৈরি হলে শিক্ষার্থী ওঠানো শুরু হয়েছে। আসন বরাদ্দসহ চার দফা দাবিতে গত শুক্রবার রাতভর বিক্ষোভ করার পর গতকাল শনিবার নতুন ওই আবাসিক হলটিতে আসন পেয়েছেন জরাজীর্ণ ফজিলাতুন্নেছা হলের ছাত্রীরা। এ ছাড়া কয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্রদের আরেকটি হল চালু করা হবে বলে জানা গেছে। তবে এসব হলে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। শুধুমাত্র মাথাপিছু একটি করে চৌকি এবং পানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থী ওঠানো হচ্ছে। অথচ ২০১৮ সালে এই হলগুলোর নির্মাণকাজ উদ্বোধনের সময় বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের ডিসেম্বরেই কাজ শেষ হবে। দীর্ঘ আশ্বাসের পরেও আবাসিক হল দুটিতে পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। হলের মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা নেই। প্রত্যেককে একটি চৌকি দেওয়া হয়েছে। পানি এবং বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। তবে নেই গ্যাস সংযোগ। প্রত্যেক তলায় গ্যাসের চুলা থাকার কথা থাকলেও নেই। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে উন্নতমানের চেয়ার, শেলফসহ টেবিল ও লকার থাকার কথা। পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও দেওয়া হয়নি। কমনরুম, ব্যায়ামাগার এবং গ্রন্থাগারও প্রস্তুত হয়নি। পুরোদমে চালু হয়নি লিফট। নবীন শিক্ষার্থীদের নবনির্মিত হলে আসন দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম বিলুপ্ত হবে বলেও আশ্বাস এসেছিল। আর সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গত বছরের ৯ মার্চ ৫০তম ব্যাচের ক্লাস অনলাইনে শুরু করা হয়েছিল। তবে হলের কাজ শেষ না হওয়ায় ওই বছরের ২৩ মে গণরুমে তুলেই তাদের সশরীরে ক্লাস শুরু করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন গেল বছরের জুনের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করার কথা বলেছিলেন। পরে জুন মাসে এসে সে বছরের অক্টোবরে ৬টি হল উদ্বোধন করা যাবে বলে সাংবাদিকদের তিনি জানান। তবে কাজ শেষ করতে না পারায় ছয়টির মধ্যে দুটি হল নভেম্বরের মধ্যে উদ্বোধন করতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম। কিন্তু হল উদ্বোধন করতে না পারায় ইতিমধ্যে কয়েক দফায় নতুন শিক্ষাবর্ষের (৫১তম ব্যাচ) ক্লাস শুরুর সময়সূচি পিছিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ৩১ জানুয়ারি শুরু হতে যাওয়া ৫১তম ব্যাচের ক্লাস শুরুর আগেই ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য একটি করে হল চালুর ঘোষণা বাস্তবায়ন করছে প্রশাসন। তারই অংশ হিসেবে ছাত্রীদের নতুন হলটিতে শিক্ষার্থী ওঠানো হয়েছে।
শিক্ষাবিদ ও উচ্চশিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া আসন সংখ্যা বাড়ানোয় এই সংকট তৈরি হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিকল্পিত নীতিই দায়ী। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচ্য ঘটনায় প্রশাসনের অদক্ষতা এবং দায়িত্বহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট। যে কারণে দফায় দফায় সময় বেঁধে দিয়েও শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে তোলা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত বেশি সংখ্যক সম্ভব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসন সুবিধা সৃষ্টি করা এবং মানসম্মত পাঠ ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, শিক্ষায় বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হওয়া উচিত গবেষণায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আবাসন সুবিধার মতো মৌলিক অবকাঠামো গড়ে তোলাতেই আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সংকট নিরসনের একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।
চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনীর অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। খাপছাড়া পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। পরে তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। ১৯৫৭ সালে তিনি চলচ্চিত্রে যুক্ত হন ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ সিনেমার সহকারী পরিচালক হিসেবে। ১৯৬৪ সালে তিনি নির্মাণ করেন উর্দুতে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’। ‘বরফ গলা নদী’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আর কত দিন’, ‘তৃষ্ণা, ‘হাজার বছর ধরে’ প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তার পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘স্টপ জেনোসাইড’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। জহির রায়হান ছিলেন যুগপৎ শিল্পী ও যোদ্ধা। একাত্তরের যুদ্ধকালে তার নির্মিত বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। এরপর অনেক কাজের পরিকল্পনা থাকলেও করতে পারেননি। বড় ভাই সাহিত্যিক, সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগ মুহূর্তে আলবদর বাহিনী অপহরণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান মিরপুরে বিহারি-রাজাকার অধ্যুষিত এলাকায় যাওয়ার পর আর তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় সেদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
বছরে ৪০ কোটি ডলার পারিশ্রমিকের প্রস্তাব নিয়ে লিওনেল মেসির সংগে যোগাযোগ করছে আলো হিলাল। তারা মংগলবার চুক্তির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে বলে জানিয়ে রেখেছে। কিন্তু মেসি তাদেরকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রস্তাবটা পিছিয়ে দিতে বলেছেন বলে খবর দিয়েছে ফুটবল বিষয়ক ওয়েব পোর্টাল গোল ডটকম।
তবে সৌদি ক্লাব এ-ই প্রস্তাব এখনই গ্রহন না করলে আগামী বছর তা একই রকম থাকবে না বলে জানিয়েছে।
মেসি আসলে তার শৈশবের ক্লাবে আরো অন্তত এক বছর খেলতে চান। তাতে তার পারিশ্রমিক সৌদি ক্লাবের প্রস্তাবের ধারে কাছে না হলেও ক্ষতি নেই। জানা গেছে, বার্সা তাকে এক বছরে ১৩ মিলিয়েন ডলার পারিশ্রমিক প্রস্তাব করতে যাচ্ছে।
লা লিগা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ায় মেসিকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে বার্সা। ধারনা করা হচ্ছে বুধ-বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ ব্যাপারে একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।