
প্রবল চাপের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি। অর্থনৈতিক মন্দা গ্রাস করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা নাজুক। আর অনুন্নত এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্বল দেশগুলোর অর্থনৈতিক চিত্র কেমন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ডলার’ যখন বিশ্ববাজারের নিয়ন্ত্রক, তখন এর পতন সরাসরি আঘাত হানে- অর্থনীতিতে। কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে, ‘আমদানি-রপ্তানি’ নিয়ন্ত্রিত হয় ডলারের মাধ্যমে। সেই ডলারের যখন ঘাটতি দেখা দেয়, স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তৈরি করে অর্থনৈতিক কৌশল। জাতীয় অর্থনীতিকে সচল রাখতে এই কৌশলের বিকল্প নেই। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কৌশলেই আর কাজ হয় না। বাধ্য হয়ে সরকারকে অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে ডলারের চাপ যখন একটি দেশের জনগণের চিকিৎসাব্যবস্থায় সরাসরি আঘাত করে, তখন বিষয়টি দুশ্চিন্তার হয় বৈকি!
গতকাল দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘ডলারের চাপ চিকিৎসা সরঞ্জামেও’ শিরোনামের সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় হার্টের রিং, ভালভ ও শিশু হার্ট রোগীদের ডিভাইস ক্লোজার, অস্ত্রোপচারের জায়গা সেলাইয়ের সুতা, এক্স-রে, এমআরআই ও সিটিস্ক্যানের ফিল্ম, ইসিজি রোলসহ বেশ কিছু চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন না চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিকারকরা। ফলে গত চার মাসে এসব পণ্যের আমদানি ৪০-৫০ শতাংশ কমেছে। এদিকে আমদানিকারকদের কাছে থাকা মজুদও শেষ হয়ে আসছে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
সংবাদে আরও জানা যায়, সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে হার্টের রিং, ভালভ ও শিশু হার্ট রোগীদের ডিভাইস ক্লোজার, অস্ত্রোপচারের জায়গা সেলাইয়ের সুতা, এক্স-রে, এমআরআই ও সিটিস্ক্যানের ফিল্ম, ইসিজি রোল, আল্ট্রাসনো পেপার, ডায়াবেটিস মাপার স্ট্রিপস, ব্লাড ও ইউরিন ব্যাগ, ডায়ালাইজার, হ্যান্ড গ্লাভস, অক্সিজেনেটর মেশিন, স্পাইনাল কর্ড নিডল, ডায়াগনোসিস কেমিক্যাল ও মেডিকেল-বর্জ্য পরিশোধনের ডিসপোজিবল সরঞ্জামাদির। এর মধ্যে আবার কিছু কিছু পণ্য আমদানি একেবারেই বন্ধ রয়েছে।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সিঙ্গাপুর ও জাপানের মানসম্পন্ন জেএমএস ও ট্রেমো ব্লাড ব্যাগ পাচ্ছি না। প্রতি মাসে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ ব্যাগ লাগে। ট্রিপল ব্যাগ লাগে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার। সরবরাহকারীরা আগে যে পরিমাণ ব্যাগ দিত এখন দিতে পারছে না। এখন যে ব্যাগ আছে তা দিয়ে এক থেকে দেড় মাস চলবে।’ বাংলাদেশ মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, ‘এলসির অভাবে গড়ে বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামাদির আমদানি ৪০ শতাংশ কমেছে। আমরা যে ব্যাংকে এলসি করি, সেই ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, এত টাকার এলসি করার অনুমতি নেই। আরও কম আনেন। যেখানে আমরা ১ লাখ ডলারের এলসি করতাম, এখন করছি ২০-২৫ ডলারের এলসি। ফলে আমদানিও কম করতে হচ্ছে।’ বাংলাদেশ সার্জিক্যাল মেডিকেল ডিভাইস অ্যাসোসিয়েশনের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আতিকুর রহমান বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে কিছু কিছু এলসি খোলা যাচ্ছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এ ছাড়া আমদানিকারকদের চাহিদা অনুপাতে যেন ঔষধ প্রশাসন পণ্য আমদানিতে অনুমতি দেয়, সরকারকে সেটাও দেখতে হবে।’
মানুষ রোগাক্রান্ত হবেন। তারা চিকিৎসকের কাছে ও হাসপাতালে যাবেন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে উঠবেন। মধ্যবর্তী সময়ে চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার কোনো আতঙ্কের কারণ ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে, সাধারণ রোগীর দুশ্চিন্তা আরও বাড়ছে। ডলার সংকটের কারণে, এভাবে এলসি কমতে থাকলে চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি আরও বাড়বে। তখন ভবিষ্যৎ কী হবে, তা ভাবলেও শরীর হিম হয়ে আসে! দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করছি, কেটে যাবে ডলার সংকট। চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে, এলসি করতে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। সাধারণ মানুষ যেন চিকিৎসাসেবা পেতে দুর্যোগের মুখোমুখি না হন।
পুঁজিবাদী বিজ্ঞান সভ্যতার ঔদ্ধত্যের বুকে প্রচণ্ড পদাঘাত হানল করোনাভাইরাস বা কভিড। একুশ শতকের মানবসভ্যতা ভুলেও কল্পনা করেনি, থরথর বুক কাঁপানো নিকষ অন্ধকার মৃত্যুর হুংকারের সামনে সে পতিত হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসমান-ছোঁয়া সম্পদের পাহাড় নির্মাতা এবং ক্ষমতার মদেমত্ত ৫৬ ইঞ্চি বুকের পাটাওলাদের দুয়ার ঠেলে অন্দরমহলে ঢুকে যাবে কভিড, কে কবে ভেবেছে? লন্ডভন্ড করে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি। কভিড থামছে না। থামানো যাচ্ছে না। এ যেন অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া। ছুটছে তো ছুটছে পর্বত-সমুদ্র পেরিয়ে গোলার্ধেও, যেখানে রয়েছে মানব প্রজাতি নামক প্রাণী। পৃথিবীর হাজার-লাখো হেক্টর ভূমি দখল করছে আগুনতি গণকবর। গণদাহের অনির্বাণ আগুন ছুঁয়েছে নন-সেমেটিক ধর্মের দেশ, চীন-ভারতের মতো অপরাপর ভূখণ্ডে। সেমেটিক ধর্মানুসারীদের লাখ লাখ কঙ্কাল বাংলাদেশ-আমেরিকা-ব্রিটেন-আর্জেন্টিয়ার মাটির কবরে তৈরি করছে কঙ্কালের রাজ্য।
কী সংবাদ, মানবসভ্যতার ভাবলোক তথা মনোলোক আর সমাজ সম্পর্কের? সে এক অবিশ্বাস্য ভয়াবহ অবয়ব। বাঙালি আমজনতা শিখল নতুন কিছু ইংরেজি শব্দ। লকডাউন, স্যানিটাইজার, মাস্ক, সোশ্যাল ডিসটেনস ইত্যাদি। নতুন এক অচেনা জীবন। মুখে মাস্ক লাগিয়ে ছদ্মবেশ। ঘরে আটকা পড়ে গৃহবন্দি। মানুষের এমন শারীরিক পলায়ন আর আত্মপলায়ন কবে দেখেছেন মানুষ? রোগভয়, মৃত্যুভয় গণ-আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। যেন কিয়ামতকাল।
এমন অসম্মানের মৃত্যু কিংবা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা এবং আতঙ্ক, সে এক অভূতপূর্ব-অবিশ্বাস্য বিষয়। আদিম যুগেও মৃতদেহের প্রতি ভালোবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, সম্মান ছিল। ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে, মৃতব্যক্তির প্রতি কিংবা লাশ বা মরদেহ বিধিবিধানের ভেতর দিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রচলন শুরু হয়। ধর্মে অবিশ্বাসী কমিউনিস্টদের ক্ষেত্রেও জাতীয় পতাকা এবং পার্টির পতাকায় শবাধার আচ্ছাদিত করে গার্ড অব অনার সহকারে সৎকার করা হয়। আর করোনার মৃতদেহ? কুকুর-বেড়াল বা জন্তুর মতো টেনে-হিঁচড়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়। কার লাশ যে কোথায় গেল, প্রিয়জনরা জানতেও পারে না। করোনায় মৃত মানুষ তো সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম নয় যে, তার কবর ঘিরে জগতের বিস্ময়কর স্থাপত্য ‘তাজমহল’ তৈরি হবে। একটি মৃত্যু প্রিয়জনদের কাছে ভালোবাসা আর করুণা কিংবা শোকের বদলে ঘৃণাভরা মহা-আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জীবনের এমন অস্বীকৃতি, রোগ আর মৃত্যুর প্রতি এই প্রতিহিংসার ঘৃণা বড় বিস্ময় জাগায়।
বিশ্বের নগরগুলো কভিড রোগের স্বর্গরাজ্য। নগরসভ্যতার আবাসনগৃহ দখল করেছে ভাইরাসেরা। সমাজের বোঝা হয়ে অহেতুক বেঁচে থাকে বৃদ্ধরা, যাদের বুর্জোয়া সমাজ শখ করে ‘প্রবীণ নাগরিক’ বলে ডাকে, করোনার আক্রোশ তাদের প্রতিই অধিক। এই ঘাতক বাইরাস যাদের মোটেই সহ্য করে না তারা হচ্ছেন গরিব-দরিদ্র পুষ্টিহীন, রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার ক্ষমতাশূন্য আমজনতা। জীবন যেমনি তাদের পদে পদে অসম্মান করেছে, মৃত্যুও তাই।
বেঁচে থাকলে নির্জনতার কবি, বিষন্নতার কবি জীবনানন্দ দাশ ও তার কবিতার খাতা বন্ধ করে রাখতেন। মহাযুদ্ধের নগর কলকাতার কারফিউ পড়া রাত দেখেছেন তিনি, দেখেননি করোনাভাইরাসের লকডাউনের কলকাতার রাত। সেকালে এত বিদ্যুতের আলোর দাপট ছিল না, ছিল না ট্রামলাইনের সিগন্যালের লাল-হলুদ-সবুজের আলোর চোখ। লকডাউনে পড়া বিশ্বের প্রতিটি দেশের রাজপথের নির্জনতা, স্তব্ধতা খানখান ভেঙে পড়ে দুঃসময়ের বুকে। আতঙ্ক বর্ষার জলের মতো থই থই করে মানুষের বুকের ভেতর, চোখের কর্র্নিয়ায়। যানবাহন আর মানুষশূন্য রাজপথের নির্জনতায় সিগন্যালের লাল-সবুজ-নানা বর্ণের আলো আচমকা জ¦লে আর নেভে। অতি প্রাকৃত-ভৌতিক এক দুনিয়া নেমে আসে শহরে অজানা মহাশূন্য থেকে।
এই যে সভ্যতার বাস্তবতাএর অভিঘাত, মানবজাতির মনোলোক এবং ভাবনার বিকাশের ভেতর দিয়ে আধুনিক সভ্যতায় পা রাখা সামাজিক চলমান জীবন পাল্টে কোথায় দাঁড়াবে? ভাবনায় পড়েছেন বিশে^র তাবড়-তাবড় মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানী। সমাজে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন অভিঘাত। মানুষের মনোলোকে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন জটিল উপসর্গ। সমাজবিজ্ঞানীরা আর মনোচিকিৎসা বিজ্ঞানীরা খেই পাচ্ছেন না।
চীনের যে গবেষণাগার থেকে ভাইরাসটির উদ্ভব বলে জনশ্রুতি (প্রমাণ হয়নি), তা বি স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থানুকূল্যে পরিচালিত। শুধু চীনা গবেষকই নন, মার্কিনি গবেষকরাও সেখানে কাজ করেন। তা ছাড়া ওষুধ-বাণিজ্য চালায় বিশে^র যেসব দেশ, তাদের বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন সেখানে। ঠিক যেমনি রয়েছে বাংলাদেশ ঢাকার মহাখালীর আইসিডিডিআরবি বা কলেরা-উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস বলছে, বিশ্বে প্রথম ‘কলেরা’ নামে রোগের উদ্ভব বাংলাদেশের বরিশাল। মনে হয়, সেই স্মৃতিবাহী ঢাকার আন্তর্জাতিক কলেরা গবেষণা কেন্দ্রটি। কিংবদন্তি এই সুলতান মো. বিন তুঘলকের মৃত্যু ঘটেছিল আরব সাগরের ‘ইলিশ’ মাছ খেয়ে পেটের পীড়ায়।
করোনার অভিঘাতমানবজাতির সংস্কার, বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা এবং চিরকালের বিশ্বাসের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে চলেছে। মনের জগৎকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজনের ওপর একটার পর একটা ঢেউয়ের আঘাত হানছে। ধনীর জন্য যেমন ভ্যাকসিন নেই, দরিদ্রের জন্যও তাই। মহাপণ্ডিত কিংবা মহামূর্খ, সমান দাস করোনার কাছে।
লকডাউনের ফলে গৃহবন্দি মানুষ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। প্রথম দিকে তো দরজা-জানালা পর্যন্ত বন্ধ, এই বুঝি করোনা ঢুকে গেল ঘরে। এমনি করেই প্রতিদিনের কর্মময় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন মানুষ। ধীরে ধীরে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে শারীরিক বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি মানসিক বিচ্ছিন্নতাও ঘটতে থাকে। কর্মহীন মানুষ যেন জড়পদার্থে পরিণত হচ্ছেন। হাজার হাজার বছরের কর্মময় সাংস্কৃতিক অভ্যাসের যে ঐতিহ্য মানুষের মনোজগতে গড়ে উঠেছে, হঠাৎ তার থেমে যাওয়া যেন জীবনের বিপর্যয়। অবিরাম চোখের সামনে ঘরের আপনজনরা, বড় একঘেয়ে ঠেকে। টিভির পর্দা বা মোবাইল তো এর বিকল্প নয়। তাই বৃদ্ধি পাচ্ছে ডোমেস্টিক ভায়লেন্সি। সান্নিধ্যের নৈকট্যের ঘনঘটা আর ভালো লাগে না। পরস্পরের কাছে পারিবারিক সম্পর্কগুলো বড় বাসি মনে হয়। মনের অজান্তেই সম্পর্কের ভেতর অদৃশ্য চিড় ধরতে থাকে।
সোশ্যাল ডিসডেন্সস এমনটা মানতে গিয়ে পড়শি বা সহনাগরিক পরস্পর থেকে হচ্ছে বিচ্ছিন্ন। কি জানি কার ভেতর রয়েছে ভাইরাস। মুখের মাস্ক বেয়ে হয়তো চলে আসবে আপন শরীরে। এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে পরস্পর অবিশ্বাস। জীবনের প্রয়োজনে ওই যে রাস্তায় বের হওয়া, বাজার-ব্যাংকে যাওয়া, ওষুধের দোকানে পা ফেলা, সবখানেই ভয় আর সন্দেহ। শুধু কি তাই? পরমাত্মীয়ের দুয়ার পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন। নিষিদ্ধ দুয়ার। আমরা কী দেখলাম? উন্নত বিশ্ব তথা ইউরোপ-আমেরিকার স্টাইল দ্রুতগতিতে ছড়িয়েছে করোনা। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, পরস্পর অভিব্যক্তি প্রকাশের যে ঐতিহ্য (যৌনতা ও চুম্বন) করোনা বিস্তারের অন্যতম কারণ। রক্ষণশীলতা এখানে জয়ী হলেও নারীমুক্তি বা নারী স্বাধীনতাকে তো অস্বীকার করা যায় না। মানুষের অধিকারকেও না।
দুঃখ, শোক, মৃত্যু মানুষকে ধর্মের দিকে ঠেলে দেয়। প্রাচীন মিথ বা গ্রিক পুরাণ এবং ভারতীয় পুরাণে দেব-দেবীদের উদ্ভবের আখ্যান পাই। জন্ম-মৃত্যু, শস্য, সমুদ্র, বৃষ্টি, আগুন, আকাশ, পাতাল এবং প্রতিটি রোগের এক-একজন দেবতা বা দেবীকে দেখতে পাই। প্রাচীন অসহায় মানুষের এভাবে ঈশ্বর কল্পনা ছাড়া অন্য গতি ছিল না। ভয় এবং দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য দেব-দেবীর কল্পনা করেছেন মানুষ। বসন্ত রোগের দেবী, কলেরার দেবী, চর্মরোগ বা খোস-পাঁচড়ার দেবতাও রয়েছে। এই একুশ শতকে করোনাভাইরাস এসে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া, শিক্ষাবঞ্চিত আদিবাসী কুসংস্কারাচ্ছন্ন কোনো কোনো জনগোষ্ঠী কিংবা নিম্নবর্গের হিন্দুদের মধ্যে নতুন এক দেবতার জন্ম দিয়েছে। তার নাম ‘করোনা দেবতা বা দেবী’। বেশ কয়েক জায়গায় এর কাল্পনিক মূর্তি বানিয়ে পূজাও হয়েছে। যারা এই করোনাভাইরাস দেবীর পূজা করেছেন তাদের বিশ্বাস প্রচলিত কোনো শক্তিমান দেব-দেবীর পক্ষেই ‘করোনা’ নামক ‘অসুর’কে হত্যা অসম্ভব। তাই করোনা দেবী এ যেন দেবীদুর্গা কর্তৃক তাসুর নিধনেরই বিকল্প রূপ কল্পনা।
প্রশ্ন হলোএমন ঘটনা কেন ঘটল? মানুষের কোন অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস আর অসহায়তা এর জন্য দায়ী? সে যা হোক, করোনাভাইরাস মানুষের আত্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনেছে। মানুষকে ভেঙে চূর্ণ করেছে, নিঃসহায় করেছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আশায় মানুষ দম বন্ধ করে আছে। আমাদের বিশ্বাস বিপুল প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে খুব তাড়াতাড়িই করোনাভাইরাসকে মানুষ প্রতিহত করবে। কিন্তু এর মহা-অভিঘাতের ফলে মানবসমাজ আর মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটবে। পাল্টে যাবে স্টাইল, জীবন ও জগৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখবেন মানুষ। ভাঙবে পুরনো জীবন দর্শন, নতুন করে জীবনের নতুন ব্যাখ্যা খুঁজে নিতে হবে সভ্যতাকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক
নতুন শিক্ষাক্রমে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে শিখনকালীন মূল্যায়ন, যেটি প্র্যাকটিক্যাল টিচিং লার্নিংয়ের কথাই বলে। একটি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা ভারতের হিন্দি ফিল্ম আর সিরিয়াল দেখে হিন্দি কথা বলতে পারেন এবং হিন্দি বোঝেন। যদিও তারা হিন্দি অক্ষরের সঙ্গেও পরিচিত নন, হিন্দি বিদ্যালয়ে পড়েননি, শিক্ষকদের সহায়তা নেননি, কোনো পরীক্ষাও দেননি। শুধু ভারতীয় ছবি দেখেই হিন্দি শিখে ফেলেছেন। ইংরেজির ক্ষেত্রে হয়েছে পুরোপুরি উল্টো। আমরা দীর্ঘ বারো বছর বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াচ্ছি। শুধু কি পড়াচ্ছি? তারা কোচিং করছে, ক্লাস করছে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, বোর্ড থেকে ইংরেজিতে একটি গ্রেড নিয়ে পাস করছে কিন্তু ইংরেজি না পারছে বলতে, না পারছে বুঝতে, না পারছে নিজ থেকে দু-চার লাইন লিখতে (ব্যতিক্রম দু-চারজন ছাড়া)। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বেশির ভাগ মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। অর্থাৎ বিষয় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সারা বছর ধরে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা, খেলাধুলা, গ্রুপ ওয়ার্ক, কুইজ, পোস্টার প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাবেন এবং তাদের কাজের মূল্যায়ন করবেন। মূল্যায়ন মানে বর্তমানকালের মতো প্রচলিত পরীক্ষা নয়, নম্বর নয়, গ্রেডিং নয়। নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে সে সম্পর্কে শিক্ষক মন্তব্য করবেন। মন্তব্যগুলো হবে’ খুব ভালো, ভালো, সন্তোষজনক এবং আরও শেখা প্রয়োজন, এ ধরনের। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শ্রেণিতে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া বা নম্বর ও গ্রেডিংয়ের পেছনে ছোটার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সেটি থাকবে না। এখানে শিক্ষকের ভূমিকাই হবে মুখ্য। তাদের বহুমাত্রিক সৃজনশীল, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ ও মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ শিক্ষক হতে হবে। সহপাঠীরাও তাদের সতীর্থদের মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবে। যেমনপ্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চায়’ একজন শিক্ষক তার শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে প্রকল্পভিত্তিক শেখার কাজ দেবেন। কাজটি করার পর শিক্ষার্থীরা তা শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। তার ভিত্তিতে শিক্ষক মূল্যায়ন করবেন। আবার দলের ভেতরে থেকেও শিক্ষার্থীরা একে অপরের কাজ মূল্যায়ন করতে পারবে। এগুলো সবই চমৎকার কথা! কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া কারিকুলামের বই তিন বছরেরও অধিক সময় ধরে বের হলো, কিন্তু প্রতিটি বইয়ে ভূরি ভূরি ভুল বের হচ্ছে। ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। যেকোনো কাজ করতে গেলে ভুল কিছুটা হবেই। গত বছর বইগুলোর ওপর পাইলটিং হয়েছে, বহুবার পত্রিকায় লিখেছি, পাইলটিংয়ের ফলাফল জাতির সামনে পেশ করতে যাতে সংশ্লিষ্টদের ফিডব্যাক নিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে কম ভুলসহ বইগুলো তুলে দেওয়া যায়। কিন্তু তা ঘটেনি। এখন সব শিক্ষার্থীর কাছে বই পৌঁছায়নি, সব বিষয়ের বইও পৌঁছায়নি অথচ ভুলে ভুলে একাকার। একজন রিডার এরই মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে ৪৮টি ভুল বের করেছেন। তবে, আমার আজকের লেখা ভুল নিয়ে নয়। আমার লেখা ইংরেজি বই কতটা আনন্দময় আর ইংরেজি ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে কতটা উপযোগী হয়েছে সেই বিষয়ে সামান্য একটু আলোকপাত করতে চাই।
মাতৃভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষা শেখাতে হলে সেই ভাষাতেই শেখানোর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়। তা না হলে শিক্ষার্থী বারবার তার মাতৃভাষায় ফিরে আসবে, বাধাগ্রস্ত হবে তার দ্বিতীয় ভাষাশিক্ষা। নতুন বইয়ে যেটি করা হয়েছে পুরো ইন্ট্রাকশন বাংলায় করা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক ইংরেজি প্র্যাকটিস করবেন না। এটি ন্যাচারাল। তারা ইংরেজির দিকে তাকাবেনই না, তাহলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি কোথা থেকে শিখবে? ইন্ট্রাকশনগুলো সব সময়ই ইংরেজিতে ছিল। এখন পাঠককে আনন্দময় করতে গিয়ে সব বাংলায় করা হলো, এ কেমন ভাষাশিক্ষার পদ্ধতি? আমরা তো আবারও গ্রামার ট্রানস্লেশন মেথডে ফিরে গেলাম। ইংরেজিতে যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বাংলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা শিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু ভাষা শেখার জায়গাটি কোথায়? এমনিতেই ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি প্র্যাকটিসের সুযোগ নেই বললেই চলে, ক্লাসরুম আর বই থেকে কিছুটা শিখবে। সেখানেও ইংরেজি শেখার সুযোগ সংকুচিত করা হলো।
আমাদের শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে, সিচুয়েশন সব জানা থাকলেও নিজ থেকে ইংরেজিতে কিছু লিখতে পারে না, একইভাবে বলে প্রকাশ করতে পারে না যদিও তাদের পটেনশিয়াল আছে। অন্যের ইংরেজি শুনে, বিদেশিদের ইংরেজি শুনে বুঝতে পারে না, ইংরেজিতে লেখা কোনো বিষয় পড়ে বুঝতে পারে না শুধু নিজ টেক্সট বইয়ের নির্দিষ্ট কিছু চ্যাপ্টার ছাড়া। ঘুরেফিরে তারা ওই কয়েকটি চ্যাপ্টার এবং প্যাসেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ফলে, পাসের হার বাড়ছে প্রচুর কিন্তু ইংরেজি শেখার ধারে-কাছেও নেই দু-চারজন অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া। ইংরেজির এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা চিৎকার করছি, আবেদন করছি, লিখছি, টিচার সংগঠন করছি কারণ টিচারদের আগে এই প্র্যাকটিসগুলো করতে হবে, তা না হলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখায় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
কেউ কেউ বলছেন, নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ব্যাপকভাবে Task based language teaching theory প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা সিএলটি মেথড, সঙ্গে জিটিম পদ্ধতিতে ইংরেজি শিখবে। গ্রামার ট্রান্সলেশন পদ্ধতি তো পুরনো, সেটি বাদ দিয়ে তো কমিউনিকেটিভ মেথড (সিএলটি) আমদানি করা হলো। দুই পদ্ধতির বেস্ট প্র্যাকটিসগুলো একসঙ্গে ব্যবহৃত হলে সেটিকে বলা হয় একলেকটিস অ্যাপ্রোচ। এটি কিন্তু কোনোটিই হয়নি। তাহলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখার কী হবে? তারা আরও বলছেন, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ভাষার চারটি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবে। সেটি কীভাবে? বলা হয়েছে, প্রথমবারের মতো ইংরেজি বই দুটোতে বাংলা যোগ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের বাংলার মাধ্যমে ইংরেজি শিখতে উৎসাহিত করার জন্য।
ইংরেজিতে সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট ও কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট দুটো পদ্ধতিতেই অ্যাসেসমেন্ট হবে। বলা হচ্ছে, সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে রিডিং ও রাইটিং স্কিল আর কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে স্পিকিং ও লিসেনিং স্কিলসহ অন্যান্য স্কিল মূল্যায়ন করা হবে। এতে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন করা হলো বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এখন ক্রিটিক্যাল থিংকিং ডেভেলপ করতে পারবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভাষায় বিশেষভাবে পিছিয়ে আছে, ইংরেজিতে কীভাবে তারা ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল উন্নত করবে? নতুন নতুন ভোকাব্যুলারি সব লেসনের প্রথমে আছে আর সবগুলোর অর্থ বাংলায় বইয়ের শেষে দেওয়া আছে। আসলে কোনো শব্দের অর্থ জানলেই ভোকাব্যুলারি উন্নত হয় না, শিক্ষার্থীরা যদি সেসব নতুন শব্দ ব্যবহার করে নিজেরা বাক্য তৈরি করতে না পারে।
সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ‘এ ড্রিম স্কুল’ নামক প্রথম চ্যাপ্টারটিতে দেখলাম আঠারোটি প্রশ্ন করা হয়েছে, সবগুলোই ‘ডু’ দিয়ে শুরু? এ কেমন ভাষাশিক্ষার ক্লাস, আর আনন্দই বা কোথায়? বিভিন্ন ধরনের সাহায্যকারী ক্রিয়া দিয়ে বাক্যগুলো গঠন করা যেত। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘প্লেলিং উইথ ওয়ার্ডস’-এ ‘সাফিক্স’ আর ‘প্রেফিক্স’ বোঝানোর জন্য পুরোপুরি ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতে জটিলভাবে গ্রামারের নিয়মকানুন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে আনন্দের তো কিছুই দেখছি না।
বইয়ের পক্ষে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ‘প্যারাগ্রাফ’ আর ‘রচনা’ মুখস্থ করতে হবে না। গাইডবই ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। বিভিন্ন সিচুয়েশনে শিক্ষার্থীরা ডেমোক্রেটিক ওয়েতে নাকি সমস্যা ডিল করতে করতে এগিয়ে যাবে। ইংরেজির স্কিলগুলো ধারালো করা না হলে কীভাবে তারা লিখবে আর কীভাবে ডেমোক্রেটিক ওয়েতে এগোবে। এগোবে যেমন তাদের ইংরেজির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে পুরোটাই বাংলায় এবং এ কথাগুলোই বেশি বেশি আলোচিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ল্যাংগুয়েজ ডেভেলপ করতে গিয়ে শিক্ষকদের যে, ডেভেলপ করতে হবে তার তেমন কোনো আলোচনা বা প্রশিক্ষণ অনুপস্থিত। আরও বলা হয়েছে, ইংরেজিতে ফেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। ইংরেজিতে এখন কত শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করে?
কৃষিবিজ্ঞান, ইতিহাস কিংবা ইসলামিয়াতে ফেল করতে পারে, কিন্তু ইংরেজিতে তো ফেল করা কঠিন। বোর্ড পরীক্ষার ফল তো তাই বলে। এখন ৬০ শতাংশ নম্বর শিক্ষকের হাতে, অতএব ফেলের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইংরেজি না শিখে পাস, এখন না শিখে না পড়ে, পাস হবে। এটিকেও আনন্দের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কি না জানি না। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, একজন দক্ষ শিক্ষক কিন্তু পত্রিকার কিংবা বইয়ের একটি পাতা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের হাসাতে পারেন, নাচাতে পারেন, গান গাওয়াতে পারেন, গ্রামার শেখাতে পারেন, ভাষার চারটি স্কিল প্র্যাকটিস করাতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে শেখাতে পারেন মানবিকতা, সহানুভূতি, দেশপ্রেম। অর্থাৎ জাদু কিন্তু শিক্ষকের হাতে। শিক্ষকদের সেভাবে প্রস্তুত করতে পারলে এত ঢাকঢোল পেটানো দরকার হয় না। শিক্ষকরা নিজেরাই আনন্দের মাধ্যমে পড়াতে পারবেন, বিষয় শেখাতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষকদের সেই উন্নয়নের ব্যবস্থাটি কোথায়? এটি নিয়ে ভেবে দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
কয়েক বছর ধরেই আশরাফুল হোসেন আলম যিনি হিরো আলম নামে সর্বাধিক পরিচিত ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্নভাবে আলোচনায় আসছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবকিছুকে ছড়িয়ে গেছে তার সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মধ্য দিয়ে। যদিও অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে গেছেন কিন্তু তার পরও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন এবং সেটাই যেন এখন চর্চার বিষয়। অনেকেই আছেন যারা এর মধ্যে ইতিবাচকতা খুঁজে পান, তবে শেষ পর্যন্ত সংসদ সদস্য না হতে পারায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন এমন মানুষের সংখ্যা কম না। না, যোগ্য কী যোগ্য না সেই মাপকাঠিই না বরং এজন্য যে তিনি পদের জন্য ‘মানানসই’ না। যদিও অনেকের কাছেই তিনি এমন একটা চরিত্র, যার মধ্যে আছে সাহস, নতুন কিছু করার উদ্যম এবং বিদ্রুপ ও নিন্দায় ভেঙে না পাড়া একজন শক্তমনের মানুষ। প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোর অংশ হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা থেকে হিরো আলম তার রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন বগুড়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে, তার অতীত নিয়ে যথেষ্ট চর্চা করা হয়েছে, এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নিজেও নানা ধরনের ঝড়ঝঞ্ঝার মোকাবিলা করছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আকাক্সক্ষা তার আগেও ছিল, যেটা অনেকেরই থাকে কিন্তু সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাটি অনেক বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং একই সঙ্গে এমন কিছু প্রশ্নেরও উদ্রেক করেছে, যার উত্তর খোঁজা খুব জরুরি।
হিরো আলম বিনোদন জগতের মানুষ, আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ তাকে অনুসরণ করে এবং সেই সংখ্যাটা নিতান্তই ছোট না। ফেইসবুক ভেরিফাইড পেজে তার অনুসারী প্রায় দুই মিলিয়ন। বোঝাই যায় এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করা এত সহজ কিছু না সেটা যে কারণেই হোক না কেন। অনুমান এদের কেউ পেতে চান শুধুই বিনোদন আবার কেউবা তাকে অনুকরণীয় হিসেবে ভাবেন। তবে আমাদের মতো শ্রেণিবিভক্ত সমাজে হিরো আলম বা হিরো আলমদের মতো মানুষের উঠে আসা মোটেও সহজ বিষয় না। ছোটবেলা থেকেই আশরাফুল হোসেন আলম ‘হিরো’ হতে চেয়েছিলেন কোনো একটি বাসনা থেকে। এভাবে হিরো হওয়ার চেষ্টা কতটুকু বাস্তবসম্মত তা নিয়ে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি আছে। তবে আমাদের সমাজে ‘হিরো’ শব্দের প্রতীকী অর্থ আছে, আছে চাকচিক্যময় সামাজিক অবস্থান। সে ক্ষেত্রে হিরো হওয়ার জন্য যে সামাজিক ভিত্তি, সৌন্দর্য ও যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা আছে হিরো আলম তাতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। এই প্রতিবাদে তিনি কতটা সফল তা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও এরই মধ্যে অনেক আলোচনার জন্ম দিতে পেরেছেন, সেখানে কিছু সার্থকতা অবশ্যই আছে। তার লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রতিবাদটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
সেই বিবেচনায় তিনি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা, বিশেষ করে তার ভক্তকুলের কাছে। কীভাবে এতশ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজেকে প্রান্তিক পর্যায় থেকে একে একে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটা পর্যায় পর্যন্ত আসা যায় তার একটা দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন। কিন্তু এই সমাজে প্রতিবন্ধকতা ভাঙা তো সহজসাধ্য না, এখানে এখনো প্রবলভাবে শ্রেণিবিভাজন, জাত-পাতের অস্তিত্ব যেমন আছে, তেমনভাবে আছে সাদা-কালো বিবেচনার বর্ণবাদ। অন্যদিকে পুরুষতন্ত্রের পুরুষই সব নয় সুপুরুষের ধারণাও আমাদের ক্ষমতা কাঠামোতে পোক্তভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং সেভাবেই সমাজ পরিচালিত হয়।
তাই স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায় হিরো আলমের মতো মানুষ, যিনি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের কাছে বিনোদন আইকন কিন্তু যথেষ্ট ‘সুপুরুষ’ নন, তথাকথিত মূলধারার নন, যখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে চান তখন অবচেতন মন কোনোভাবেই মেনে নিতে চায় না। তাকে কোনোভাবেই যোগ্য মনে হয় না। হিরো আলমের নিজেদের কথায়ও বারবার এই আক্ষেপের কথাই উঠে আসছে। অন্যেরা যদি শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন থেকে এসে জনপ্রতিনিধি হতে পারেন তাহলে তিনি কেন পারবেন না। হিরো আলমের প্রশ্ন যৌক্তিক কিন্তু মূলসংকটটা হচ্ছে হিরো আলম ও তার অনুসারীরা প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত না, তারা এই কাঠামোকে প্রভাবিত করতে পারেন না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এবারের নির্বাচনেও অংশগ্রহণের জন্য হিরো আলমকে সর্বশেষ হাইকোর্টের রায় নিয়ে তারপর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে হয়েছে।
সমাজ কাঠামোর এই প্রতিফলন আমাদের দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের মধ্যেও হরহামেশাই দেখতে পাই তাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে। হিরো আলমের মতো ‘নিম্নবর্গের’ মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তারাও সহজেই মেনে নিতে পারেন না। যে কারণে প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা তাকে নিয়ে ট্রল করেন, একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য হিরো আলমকে ছোট করেন। এই ছোট করার মধ্য দিয়ে কতটুকু ব্যক্তি হিরো আলমকে ছোট করলেন তা যেমন বিবেচ্য এবং সঙ্গে সঙ্গে কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে কাজ করছে তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় হিরো আলম একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সমাজ কাঠামোর যে রূপান্তর তা আশরাফুল আলমকে তথাকথিত হিরো হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ক্ষমতাহীন ও প্রান্তিক গোষ্ঠী যে হিরো হতে পারে তার বাসনা প্রকাশ পেয়েছে। হিরো আলম হয়তো আমাদের সমাজের পরিবর্তনের লক্ষ্য না কিন্তু নিঃসন্দেহে একটি প্রক্রিয়া যাকে শুদ্ধতার মাপকাঠিতে দেখার সুযোগ কম। এই অবস্থাকে অস্বীকার করার জো নেই। যে কারণে হিরো আলম নিজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হলেও তিনি এখন ক্ষমতার অংশীদার হতে চান এবং কখনো কখনো আধিপত্যবাদী ক্ষমতার প্রকাশ করতে চান। এর জন্য তা নিজের দায় যেমন আছে একইভাবে দায় আছে প্রচলিত সমাজ কাঠামোর। হিরো আলমের জীবনাচরণ হয়তো প্রথাগত ‘ভদ্রসমাজের’ অন্তর্গত না। কিন্তু হিরো আলমতো আর একা না, তার মতো হাজারো ও লাখো জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আছে যাদের আকাক্সক্ষা আছে ও উদ্যম আছে হয়তো তথাকথিত ভদ্রসমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি এবং এই সমাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাটুকু পায়নি। তাই যেনতেন প্রকারে হিরো হওয়ার মধ্য দিয়েই যেমন তাদের মুক্তি ও প্রতিবাদের প্রকাশ।
হিরো আলম, যা করছেন তার সবকিছুর সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই। অনেক সময়ই তার কর্মকাণ্ড বাড়াবাড়ি মনে হয় যার সঙ্গে আমরা অনেকেই একমত না। একমত হওয়ার কথাও না এবং তার এসব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার অধিকার সবারই আছে কিন্তু সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত জাত-পাতনির্ভর হলে তা বন্ড বেশি সেকেলের। লালন সাঁই সেই কবে গেয়েছিলেন ‘জাত গেলো জাত গেলো বলে একি আজব কারখানা, লালন বলে জাত কারে কয় এই ভ্রম তো গেল না’। জাত-পাতকেন্দ্রিক এই বিভাজন সমাজের মধ্যে কোনো আশার সঞ্চার করে না বরং বৈষম্যমূলক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নকে পিছিয়ে রাখে এবং তাদের হতোদ্যম ও আকাক্সক্ষাকে ধ্বংস করে দেয়। আর আকাক্সক্ষা ও উদ্যমহীন একটি জনগোষ্ঠী যেকোনো সমাজের জন্য একটি বোঝা। লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
৫
১৯৬৯ সালের এই দিনে শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। অবিভক্ত বাংলার বাঁকুরা জেলায় ১ মে ১৯৩৪ সালে তার জন্ম। তিনি বাঁকুরা জিলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫০ সালে বাঁকুরা ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নশাস্ত্রে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে বিএসসি (সম্মান), ১৯৫৪ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, পরে রসায়ন বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে তিনি শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক ও ১৯৬৬ সালে প্রাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালের ১ মে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে এসে আইয়ুব শাহীর সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন তুঙ্গে উঠতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে ড. জোহা সেখানে ছুটে যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালাতে চাইলে সেনাবাহিনীর সদস্যদের তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ সেনাবাহিনীর গুলিতে ড. জোহা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেদিনই তিনি মারা যান। তার সম্মানে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ শামসুজ্জোহা হল। ২০০৮ সালে শহীদ শামসুজ্জোহাকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়া হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।