
বিষয়টা কিছু মানুষের মজ্জাগত। ভয়াবহ আত্মকেন্দ্রিক এসব মানুষ, অন্যের কথা ভাবেন না। মনে করেন, নিজের উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। তাদের পদযুগল সামনে হাঁটে না। কিন্তু চিন্তার পদে হয়, উল্লম্ফন। যে কারণে, সেই মানুষ হরিণের মতো পাতার ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে বসে থাকেন। ভাবেন, কেউ তাকে দেখে না। অথচ চোখ অন্ধকারে রেখে, উদোম শরীর যে বাইরে রেখেছেন সেই খেয়াল নেই। শুধু তা-ই না। মনে করেন, তার অপকীর্তির কথা কেউ জানবে না। এদিকে, বিষয়টা যে শৃঙ্খলা, আইন ও নীতিবিরুদ্ধ সেটিও ভুলে যান। সাধারণ মানুষ যখন অর্বাচীনের মতো কাজ করে, মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন নীতিবিরুদ্ধ কাজে নিজেকে সচেতনভাবে সম্পৃক্ত করেন, তখন বিস্মিত হতে হয়। না হলে কি আর আইননীতির তোয়াক্কা না করে নিজের উন্নতিতে নিজে সম্পৃক্ত হন?
রবিবার দেশ রূপান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘নিজেরাই পদোন্নতি দিচ্ছেন নিজেদের’ শিরোনামের সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, শিক্ষক নিয়োগ-সংক্রান্ত বিধি ভেঙে দুই শিক্ষক নেতাকে সহযোগী অধ্যাপক (গ্রেড-৪) বানাতে নানা আয়োজন করছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) কর্র্তৃপক্ষ। শিক্ষকরা হলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের প্রচার, প্রকাশনা ও দপ্তর সম্পাদক সাব্বীর আহমেদ চৌধুরী এবং একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বেরোবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ। তারা দুজনই আবার নিয়োগ-সংক্রান্ত প্ল্যানিং কমিটির সদস্য। তারা নিজেরাই নিজেদের যোগ্য ঘোষণা করেছেন।
গতকাল রাতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ কথা বলতে রাজি হননি। জনসংযোগ উপপরিচালক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিধি ভেঙে প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ডাকা হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। প্ল্যানিং কমিটির সদস্যরা ভালো বলতে পারবেন।’ সংবাদে আরও জানা যায়, জানা গেছে, লোকপ্রশাসন বিভাগের দুটি সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে চারজন প্রার্থী আবেদন করেছেন। তাদের তিনজন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তারা হলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. জুবায়ের ইবনে তাহের, মো. আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ এবং সাব্বীর আহমেদ চৌধুরী। বেরোবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী তাদের কেউই সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে আবেদনের যোগ্য নন। তবে অভ্যন্তরীণ শিক্ষক পদ আপগ্রেডেশন নীতিমালা অনুযায়ী শুধু জুবায়ের ইবনে তাহের সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদের সর্বসাকল্যে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আট বছর এক মাস ৯ দিন এবং সাব্বীর আহমেদ চৌধুরীর চাকরিকাল আট বছর এক মাস আট দিন। তাদের কারোরই পিএইচডি বা এমফিল ডিগ্রি না থাকায় বর্তমান অভিজ্ঞতায় তারা সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদনের যোগ্য হননি। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, শূন্যপদে আবেদন করা অপর প্রার্থী ড. মো. রুহুল আমিন। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তার সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ১২ বছরের বেশি। ২০টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে তার। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখা থেকে জানা গেছে, প্রার্থীদের মধ্যে যে তিনজন বেরোবির তারা প্ল্যানিং কমিটিরও সদস্য। তারা আবেদনকারী চার প্রার্থীকেই সহযোগী অধ্যাপকের শূন্যপদে যোগ্য মনোনীত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, শর্ত শিথিল করে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের ব্যাপারটি জানেন ভিসি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ।
প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়েছে যোগ্যতা অর্জনের আগেই বিধি ভেঙে দুজন জুনিয়র শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক তাদের জ্যেষ্ঠতা হারাবেন। অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি শিথিল করে শিক্ষক নিয়োগের নজির বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এমন ঘটনা আগেও হয়েছে। সেই অসততা, দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির সঠিক বিচার হলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। পদোন্নতির বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ নেই। যোগ্য মানুষ যোগ্যতম স্থানে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় হয় তখনই, যখন যোগ্যতার তোয়াক্কা না করে জুনিয়র হয়ে যান সিনিয়র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দরকার।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ সমাবর্তন। বয়সের বিচারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার যৌবন পেরিয়ে পূর্ণবয়স্ক, যার বয়স বাংলাদেশের বয়সের সমান। অন্যদিকে, যশোর বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বয়সের দিক থেকে একেবারে নবীন। এ বছর চতুর্থ সমাবর্তনে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডিপর্যায়ে ১ হাজার ৮৩৪ জন গ্র্যাজুয়েটকে সনদ দিয়ে, যার মধ্য থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ৫৭ জন স্বর্ণপদক ও অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে ২২ জন গ্র্যাজুয়েট চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক, ২৬ জন ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড এবং ৯ জন ডিন অ্যাওয়ার্ড পান (তথ্যসূত্র :themailbd.com, ফেব্রুয়ারি, ১৮, ২০২৩)। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ষষ্ঠ সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করেন ১৫ হাজার ২১৯ জন শিক্ষার্থী, যার মধ্য থেকে ১৬ জনকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক দেওয়া হয় (তথ্যসূত্র : ঢাকা পোস্ট, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)।
দেখা যায় যে, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ বছরে চারবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সমান বয়সী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৫২ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ছয়বার। অন্যদিকে শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে ৫৩তম সমাবর্তনের আয়োজন করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে সমাবর্তন আয়োজনে ব্যর্থ। অথচ প্রতি বছরই ছাত্র ভর্তি করার সময় তাদের শিক্ষাজীবন শেষে সনদ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ছাত্র ভর্তি করার সময় হলগুলোতে কী সংখ্যক আসন শূন্য আছে, বিভাগগুলোর কী পরিমাণ ধারণক্ষমতা আছে ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্রকল্যাণ ফান্ড এবং বিভাগ ছাত্র সংসদে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাদান এবং পরীক্ষা শেষে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। আমি অনুমান করতে পারছি এটি প্রায় বাংলাদেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চিত্র। অথচ, সমাবর্তন তথা শিক্ষাজীবন শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সনদপ্রাপ্তির আনুষ্ঠানিকতা ছাত্র মাত্রেই অধিকার। যেকোনো ট্রেনিং প্রোগ্রাম শেষেও একটি আনুষ্ঠানিক সনদ প্রদান অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়। অথচ কোটি কোটি টাকার বাজেটের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে সময় লাগে কয়েক বছর। অনেকেই এ সময়ের মধ্যে কর্মজীবনেও কয়েক বছর পার করে দেন, ফলে সনদপ্রাপ্তির আনন্দটা সময়মতো উপভোগ করতে না পেরে সে যেন ক্রমেই ম্লান হতে থাকে।
অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে সমাবর্তন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। চার পাঁচ বছরের দীর্ঘ বিরতিতে সমাবর্তন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া বৈকি। আর এ ব্যয়ের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় ১০-১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েটের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন প্যান্ডেল তৈরি করতে। পত্রপত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ সমাবর্তনের প্যান্ডেল বাবদ খরচ হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্র্যাজুয়েট উভয়ের জন্যই এটা গলায় বিঁধা কাঁটার মতো। প্যান্ডেল ছাড়া সমাবর্তন আয়োজন সম্ভব নয়, আবার এত টাকার জোগান দেওয়াও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থ জোগানের চাপ গিয়ে পড়েছে রেজিস্ট্রেশন ফির ওপর।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব সহজেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রতি বছর প্রথম বর্ষে ছাত্র ভর্তি করার সময় বিভাগের ছাত্রকল্যাণ তহবিল, বিভাগের জন্য বরাদ্দ করা ফান্ডের মতো সমাবর্তন তথা শিক্ষাজীবন শেষে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের বিষয়টি মাথায় রেখে একটা অর্থ বরাদ্দ দিতে পারে। এটা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে কিংবা শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ফির মাধ্যমে, যেমনটি এখন করা হচ্ছে। একইভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন হতে পারে অডিটোরিয়াম বা কোনো হলরুমে। এতে করে প্রতি বছর অল্পসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটের জন্য আয়োজন করতে হবে বলে সমাবর্তন আয়োজন করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হবে না। আবার অন্যদিকে, একটা বিশাল অঙ্কের অর্থ অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
সমাবর্তন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশের এক মাইলফলক। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে গ্র্যাজুয়েটদের সামনে এমন একজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যার জীবন থেকে গ্র্যাজুয়েটরা একটি সুন্দর এবং বাস্তবধর্মী দিকনির্দেশনা পাবেন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে একবার সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন টেকনোলজির জগতের অন্যতম পুরোধা অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, যিনি তার বক্তব্যে তার জীবনের তিনটি ঘটনা বর্ণনা করে গ্র্যাজুয়েটদের ভবিষ্যতে কী করণীয় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা বিশ্বের কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারে। এতে সদ্য শিক্ষাজীবন সমাপ্তকারী গ্র্যাজুয়েটরা নিজেরা এ ধরনের সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত হবেন, কর্মজীবনে সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন, সমাজ এবং মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। কিংবা সমাবর্তন বক্তা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রচলিত কনভেনশনের বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে সমাবর্তন বক্তব্য গ্র্যাজুয়েটদের জন্য মূল আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে না।
সমাবর্তনের অন্যতম এক আকর্ষণ স্বর্ণপদক প্রদান। স্বর্ণপদক একদিকে যেমন একজন গ্র্যাজুয়েটের জন্য তার কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতি, অন্যদিকে তেমনি এটি বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের প্রেরণা। তাই স্বর্ণপদক প্রদানের ক্ষেত্র এবং পরিধি বাড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিসির একটা অংশ হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে স্বর্ণপদক প্রদান করা সম্ভব হয় না, কিংবা কয়েক বছরের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে হয়তো একজন বা দুজন গ্র্যাজুয়েটকে ফলাফলের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। যেমন : এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোফাসসিল উদ্দিন আহমেদ স্বর্ণপদক ১১ জন গ্র্যাজুয়েটের মধ্য থেকে ১ জনকে প্রদান করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ স্বর্ণপদকের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ আছে তাতে একজনকেই শুধু এই পদক দেওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সংবাদ পড়ার পর খুবই মর্মাহত হয়েছি। মোফাসসিল উদ্দিন আহমেদ স্বর্ণপদকপ্রাপ্তির যে শর্ত তাতে এই ১১ জনের ফলাফলই সেই শর্ত পূরণ করে। কিন্তু অর্থ সংকুলান করতে না পারার কারণে অনেকেই তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্র্যাজুয়েট উভয়ের জন্যই বিব্রতকর বটে।
এখন কথা হচ্ছে, স্বর্ণপদকের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে? আমরা যদি একটু উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকাই তাহলে সহজেই এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাব। একটি বিশ্ববিদ্যালয় একজন গ্র্যাজুয়েটের জন্য দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েটের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত তার প্রতিটি গ্র্যাজুয়েটের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য লিপিবদ্ধ রাখা। এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের কাছে স্বর্ণপদকের ফান্ড গঠনের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। আমি মাঝেমধ্যেই ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা থেকে ইমেইল পাই গ্র্যাজুয়েট দপাঠানো হয় যেখানে আমার পাঠানো ১০০ কিংবা ৫০ ডলার কী করে একজন মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি স্টুডেন্টের টিউশন ফি প্রদানে সহায়ক হতে পারে তার বর্ণনা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একজন অ্যালামনাইয়ের সম্পর্ক যেন বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কিংবা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আগমন, র্যালি, স্মৃতিচারণ ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তার বিশালসংখ্যক অ্যালামনাইকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনের জন্য কাজে লাগাতে পারে।
আমাদের দেশে সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় যেন ব্যস্ত থাকে এই আয়োজনকে ঘিরে। এই প্র্যাকটিস থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সমাবর্তন গ্র্যাজুয়েটদের অনুষ্ঠান, এটির আয়োজন যেন বর্তমান শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমে কোনো প্রভাব না ফেলে সে বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Email: [email protected]
১.
এই প্রজন্ম কতটা ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী সেটা বেশ ভালোভাবেই প্রতিনিয়ত টের পাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হিসেবে, যেমন শ্রেণিকক্ষে, তেমনি আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এর পাঠচক্রের আলোচনাতেও। আমাদের বাংলার আনাচে-কানাচে, আসা-যাওয়ার পথের ধারে মহান মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মৃতিক্ষেত্র রয়েছে, অথচ শিক্ষার্থীদের কাছে সেসব বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেকেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আমাদের ভাসানটেক সরকারি কলেজে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে স্থাপিত হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাসভিত্তিক ম্যুরাল ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’। কদিন আগে একাদশ শ্রেণির নবাগত শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের পাঠদানকালে আকস্মিক ভিজিলেন্সে উপস্থিত হন আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন। তিনি আমার পাঠদানের বিষয়ে জেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে কলেজের উল্লেখযোগ্য শিক্ষণীয় স্থাপনার বিষয়ে প্রশ্ন করলে হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া কেউই কিছু বলতে পারেনি। অথচ কলেজের প্রবেশ পথেই শহীদ মিনারের সঙ্গে ম্যুরালটি স্থাপিত। অনেকেই দৃষ্টিনন্দন ম্যুরালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়েননি কিংবা পড়লেও মনে রাখতে পারেননি বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিষয়বস্তু। যতদূর জানি, কলেজের মতন দেশের প্রতিটি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে জানি’ বিষয়ে বিশেষ পাঠ ও পরীক্ষা গ্রহণের নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মোবাইলসহ নানান তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি যে পরিমাণ আগ্রহ ও মনোযোগ দেখি, সেই বিবেচনায় আত্মানুসন্ধানে দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মহান শহীদদের বিষয়ে জানার আকুতি আশাব্যঞ্জক নয় বলেই বেদনাহত হই। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এবং অনেক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকই নিজেকে জানার গভীর প্রত্যয়ে স্বপ্নবান শিক্ষার্থীদের মনে স্বদেশপ্রেম, নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সচেষ্ট থাকেন কিন্তু সেই প্রয়াস কতটুকু ফলপ্রসূ হয় তা শ্রেণিকক্ষের পাঠ অভিজ্ঞতায় নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ২.
এত কথা বললাম একাত্তরের মহান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর নির্মিত ফাখরুল আরেফিন খানের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘অবিনশ্বর’-এর প্রিমিয়ার শো দেখতে দেখতে ভাবনার জালে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সত্য তথ্য নিয়ে তৈরি কাওসার চৌধুরীর ‘বধ্যভূমিতে এক দিন’, জাহিদুল ইসলাম বিপ্লবের ‘ওমর ফারুকের মা’ কিংবা ফাখরুল আরেফিন খানেরই আরেকটি চলচ্চিত্র ‘জেকে ৭১’Ñ দেখার স্মৃতি মনে পড়ায়। দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ডিজিটাল ক্লাসরুমের ব্যবস্থা আছে। সেই সুবিধা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক চেতনা জাগরণে নিয়মিত প্রদর্শনের নীতিমালা প্রণীত হলে এবং বাস্তবায়নে যথাযথ মনিটরিং হলে সবার মধ্যেই প্রকৃত চেতনার বিকাশ ঘটবে বলেই আমি মনে করি। ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে বিভ্রান্তির নানান সুযোগসমূহকে প্রতিহত করতে বিকল্প ইতিবাচক বাস্তবায়নযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না আমার।
৩.
ভাষার মাসে ভাষা আন্দোলনের রূপকার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের লড়াই ও সংগ্রামের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘অবিনশ্বর’-এর প্রিমিয়ার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনুদানে ফাখরুল আরেফিন খানের পরিচালনায় ও গড়াই ফিল্মসের প্রযোজনায় প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। আমরা জানি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একজন বাঙালি আইনজীবী, সমাজকর্মী ও ভাষাসৈনিক। যিনি দেশভাগের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত অংশে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতিবিদ হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায়ও রাখার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম বাংলা ভাষাকে আমাদের ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবি পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তকে ধরে নিয়ে যায় এবং ময়নামতী সেনানিবাসে নির্যাতন করে হত্যা করে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান চিরস্মরণীয়। এটি নির্মাণ প্রসঙ্গে পরিচালক ফাখরুল আরেফীন খান বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে কজন মানুষকে নিয়ে আমরা সর্বময় আলোচনার মধ্যে থাকি, সেখানে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অনুপস্থিত। তাকে আমরা কখনো আলোচনার মধ্যে আনি না। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল সূতিকাগার ভাষা আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। আর সে কারণেই শেষ পর্যন্ত তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিতব্য প্রামাণ্যচিত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলা ভাষার এই মহান সৈনিককে তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও চেতনাকে পৌঁছে দেওয়া।
৪.
‘অবিনশ্বর’ প্রামাণ্যচিত্রের যে মূল উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার যে মহান সৈনিককে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা, সেটি যথার্থভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে বলে একজন দর্শক হিসেবে মনে হয়েছে। তবে মনে করি, শুধু বাছাই করা কিছু নির্দিষ্ট দর্শকের জন্য নয়, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘অবিনশ্বর’-এর মতন আরও সমগোত্রীয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রের বাছাই করা তালিকা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরব্যাপী প্রদর্শনীর নির্দেশনা দিতে পারে। তাহলেই সঠিক ইতিহাস চেতনায় সমৃদ্ধ নাগরিক গড়ে তোলার সরকারের প্রত্যাশিত নানান শুভ উদ্যোগ বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ে উঠবে বলেই গভীরভাবে আশাবাদী।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা
যদি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, ধরা যাক দৈব কারণে উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, বিহার অথবা আসামের যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াবে? বাহ্যত তা যুদ্ধই। হতে পারে তা ছোট অথবা বড়। তাতে বিবিধ রঙ চড়তে পারে বা চড়ানো হতে পারে। কেউ বলবেন, এটা এক ধরনের গৃহযুদ্ধ। কারণ তা একটি দেশের মধ্যে ঘটছে ভারতে। ধরা যাক আবারও দৈব কারণে রাজ্যগুলোর যেকোনো একটির সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধ বেধে গেল। তখনো সংঘাতটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমিত থাকলেও সেটি আর গৃহযুদ্ধ থাকবে না। সেটি হয়ে যাবে বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের সংজ্ঞায় থাকা আর সম্ভব নয়। তবে যত যাই হোক নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমাতেই থাকতে হচ্ছে।
উল্লিখিত অঞ্চলগুলো মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী যথাক্রমে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সুম্ম। তারা বালী রাজার দত্তক অথবা স্বীকৃত পুত্র। পাঁচ ভাই। বালী রাজা নিঃসন্তান ছিলেন। তার স্ত্রীর গর্ভে এক ঋষি, যার নাম গৌতম দীর্ঘতম, তার ঔরসে তারা জাত। সেকালে এবং তার বহু যুগ পরেও ক্ষেত্রজ সন্তানের প্রথা চালু ছিল। ফলে প্রথা অনুযায়ী তারা বালী রাজার সন্তান। মোটকথা তারা বা তাদের অধ্যুষিত অঞ্চল পরস্পর সম্পর্কিত। বালী ছিলেন মগধের রাজা। মগধ নিয়ে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুম্মর প্রতিষ্ঠাতাদের ব্যাপারে এমন কথাই চালু আছে।
বাংলা (বঙ্গ), উড়িষ্যা (কলিঙ্গ), বিহার (অঙ্গ), ঝাড়খণ্ড (অঙ্গ বা মগধ), আসাম (প্রাগজ্যোতিষ) সবই একই সাংস্কৃতিক এবং মোটাদাগে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীভুক্ত। জরাসন্ধ যখন ভারতবর্ষের সম্রাট ছিলেন তখনো ছিল; মৌর্য্যরা যখন সম্রাট ছিল তখনো ছিল, গুপ্তরা যখন ছিল তখনো মগধ ছিল ভারতের (ভারতবর্ষের) ক্ষমতার কেন্দ্র। সুলতানি আমলেও বাংলা (বৃহৎ বঙ্গ) বা বাঙ্গালাহ (তথা মগধ/বৃহৎ বঙ্গ) প্রায় স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল। মুগল আমলে কেন্দ্র সরেছিল দিল্লিতে। আবার ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নামে বাংলা অঞ্চল (বৃহৎ বঙ্গ/সাবেক মগধ) একসঙ্গেই ছিল, ভারতবর্ষ তথা ইন্ডিয়া কাঠামোর মধ্যে। পৌরাণিক বা মিথলজিক্যাল দৃষ্টিতে উল্লিখিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে সশস্ত্র বিবাদকে যুদ্ধ বলা যাবে বটে কিন্তু তা যথার্থ হবে না। একে গৃহযুদ্ধ বললে তা হবে সংকীর্ণ সংজ্ঞা। একে বরং ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বলা যেতে পারে। বলা উচিতও।
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বলাই শ্রেয়। দুটি কারণে। এক, দুই দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল। দুই, ঐতিহাসিক বা প্রাগৈতিহাসিক সংযোগও আছে দুই দেশের মধ্যে। তারা জাতিগতভাবে সøাভ। পূর্বাঞ্চলীয় সøাভদের কেন্দ্র ছিল কিয়েভে বা কিয়িভে। এই স্ল্যাভদের বলা হতো কিয়েভান রাস বা কিয়িভের রুশ। কিয়েভ আসলে পূর্বী সøাভদের মক্কা। অতএব এটা যুদ্ধ হলেও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। এক সময় মগধের মৌর্য্যবংশীয় রাজা অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করে অনুরূপ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। অশোক অবশ্য শোকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভøাদিমির পুতিন বা ভলোদিমির জেলেনস্কি কী করবেন সেটা তাদের ব্যাপার। ইতিহাসে প্রায়শ এরকম ঘটনা ঘটে থাকে।
এটা যে কার্যত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সে কথা মনে রেখেছে রাশিয়া। যুদ্ধের শুরু থেকেই সে কথা ভেবে যত কম বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় তার চেষ্টা করেছে তারা। রাশিয়া চেষ্টা করেছে, এখনো করছে; তবে তেমন কোনো চেষ্টা করেনি ইউক্রেন। মার্কিন ও ন্যাটো-বটিকা গিলেছে তারা। অথবা গেলানো হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ইউক্রেনও নাৎসিবাদ এবং নাৎসিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এখন ইউক্রেনের নব্য নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে রাশিয়াকে। নব্য নাৎসিবাদের উত্থান হলো কী করে? যুক্তরাষ্ট্রের বদান্যতায় ময়দান অভ্যুত্থানের পর। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ইতিহাসটা তাহলে মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে! যুক্তরাষ্ট্র কোনোকালেই নাৎসিবাদবিরোধী ছিল না। হলোকাস্টের শিকার ইহুদি জনগোষ্ঠীর জায়নবাদীরাও যে নাৎসিবাদের বিরোধী ছিল না তা এখন স্পষ্ট। পোরোশেঙ্কো, জেলেনস্কিরাও যতটা না ইহুদি, ইউক্রেনযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণিত হয়েছে তারা অনেক বেশি জায়নবাদী। যুক্তরাষ্ট্র এবং জায়নবাদীরা কখনো মৌলবাদবিরোধীও ছিল না। থাকলে কন্ট্রা বিদ্রোহী, আল-কায়েদা, আইএস বা দায়েশ, তাহরির আল শাম, আল নুসরা প্রভৃতি জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীর জন্ম তারা দিতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্কের খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেন। ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনে নব্য নাৎসি তৎপরতা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সারকথা।
যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ২০২৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। যুদ্ধ ২০২২-এর মার্চেই শেষ হয়ে যেতে পারত। আলোচনা সেদিকেই যাচ্ছিল। তুরস্কের মধ্যস্থতায় চুক্তি প্রায় সম্পন্নের পর্যায়ে ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ওরফে বোজো অ্যাংলো-জায়নিস্ট ইমপেরিয়াল মন্ত্রণায় গত মার্চে কিয়েভে গিয়েছিলেন। আর তারপরই বুচাকাণ্ড ঘটল। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সমঝোতা-প্রয়াসও ভেস্তে গেল। ইউক্রেনের পিস ডেলিগেশনের প্রতিনিধি দানিস কিরেভকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থাই হাপিস করে দিল। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাপতালি বেনেতও ইউক্রেনের শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। বোজোর কারণে পারলেন না। ভেস্তে গিয়েছে বোজোর প্রধানমন্ত্রিত্বও। ন্যাটো-মার্কিন হুকুমে তিনি শান্তিপ্রক্রিয়া নস্যাৎ করেছিলেন। ব্রিটিশ অধিপতিমানস বলে কথা! মার্কিন সাম্রাজ্য মানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যই। এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশের রায়ত বই তো আর কিছু ছিল না। ইউক্রেনে যুদ্ধটা এখনো চলছে ন্যাটোর নামে মার্কিন হস্তক্ষেপে। মাস দেড়েকের মধ্যে থেমে যেতে থাকা একটা যুদ্ধ এক বছর ধরে চলছে। এ ব্যাপারে সব কৃতিত্বই যুক্তরাষ্ট্রের। এখন যুদ্ধে ইউক্রেন আসলে কোনো পক্ষ নয়। এখন এক পক্ষে রাশিয়া, আরেক পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। ইউক্রেন শিখণ্ডী মাত্র। জিতবে কে? যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো নাকি রাশিয়া? হারবে কে? রাশিয়া নাকি যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো? ইউক্রেন আলোচনায় নেই ইউক্রেন ‘গয়ং গছ’।
রসাতলে যেতে বসা ইউক্রেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যেতে হচ্ছে জেলেনস্কির সঙ্গে বোঝাপাড়া করে নয়, বরং প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। যেখানে যাবেন সেখানে যাতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা না হয় বাইডেন তার নিশ্চয়তা চেয়েছেন রাশিয়ার কাছে, ইউক্রেনের কাছে নয়। কারণ তিনি জানেন ইউক্রেনের যুদ্ধজয়ের সামর্থ্য নেই, ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা ঠেকানোর মুরোদও নেই। ইউক্রেন এখন ‘মুরাদ টাকলা’।
জেলেনস্কি এখন উপায় নেই গোলাম হোসেন দশায়। বাইডেনের এই সফরের আগে তিনি দুই মাস বাঙ্কারে ছিলেন বলে খবরে প্রকাশ। তিনি ইউক্রেনে প্রকাশ্যে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। যতটুকু সময় থাকেন হয় ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্তের লিববে নতুবা পোল্যান্ডে থাকেন। এ অঞ্চলটি স্তালিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউক্রেনের সঙ্গে জুড়েছিলেন। আগে ছিল জার্মানির দখলীকৃত অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ায়। যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ^ব্যবস্থার মোড়ল তার তো নিজের সক্ষমতাতেই ইউক্রেনে যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে কি তার জোর নেই? হবে হয়তো Biden dared not visit Kiev without asking Russia for security guarantees first-Foreign Ministry Spokeswoman Maria Zakharova noted that “the US leader’s visit was staged with drama, but, in reality, sembled a failed stage of in a provincial theater.” (https://tass.com)
২০ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। বাইডেন রাশিয়ার অনুমোদন সাপেক্ষে কিয়েভে গেলেন। সম্রাটের চালচলন যদিও ছাড়লেন না। নিজে টেবিলে বসে কী যেন লিখলেন। কিন্তু দেখা গেল ভলোদিমির জেলেনস্কি অধোবদনে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন হুকুম বরদার। বাইডেন সম্ভবত মস্কোর অনুমতি নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করবেন! পুতিন আবার পরমাণু অস্ত্র বিষয়ক তৃতীয় স্টার্ট চুক্তি স্থগিত করলেন। অবশ্য বাতিল করেননি। বাতিলের কালচার (ক্যানসেল কালচার) সাধারণত মার্কিনি এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। পারমাণবিক বলটা এখন মার্কিনি কোর্টে। জুনিয়র বুশ এক দফায় স্টার্ট চুক্তির দফারফা করেছিলেন। ট্রাম্প এক দফায় আইএনএফ চুক্তি বাতিল করেছিলেন। আরেক দফায় ট্রাম্প (ইসরায়েলি উসকানিতে) ইরানের পরমাণু চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। বলা যায় মার্কিনি পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ‘ঘ্যাচাং ফু’! ইমপেরিয়াল ম্যাডনেসে আক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র।
বাইডেন ইউক্রেনে যেতে পারলেন কিন্তু ওহাইও’র ট্রেইন ডিরেইলমেন্টের (ট্রেইন লাইনচ্যুত হওয়ার) জায়গায় যেতে পারলেন না। প্রায় ৪৪ হাজার প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে ওই ঘটনায় প্রায় ৫ মাইল এলাকাজুড়ে বিষাক্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ায়। ভয়ংকর বিপর্যয়। নিজ দেশের দুর্যোগের এলাকায় যাওয়ার সময় তার নেই। কিন্তু ইউক্রেন সফরের সময় আছে। সমালোচকরা বলছে, ২০২৪-এর নির্বাচনে জনসমর্থন বাড়ানোই ইউক্রেন সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল। ইউক্রেন রসাতলে না পাতালে গেল তা বিবেচনার বিষয় ছিল না। এ কথাও বলা হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে বড় একটি দুর্ঘটনাস্থল এড়িয়ে গিয়ে জনসমর্থনকে তিনি কার্যত ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। বাইডেনের সফরের সময়েই ওয়াশিংটনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সমাবেশ তেমন বড় ছিল না। হাজার তিনেক লোক ছিল। কিন্তু তাতে জড়ো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, পাবলিক ফিগার এবং সাংবাদিক। সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তুলসি গ্যাবার্ড, গ্রিন পার্টির সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জিল স্টাইন, সাবেক কংগ্রেসম্যান ডেনিস কুচিনিচ, পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক সিমুর হার্শ, বর্ষীয়ান কংগ্রেসম্যান এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রন পল। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ এবং ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বন্ধ করার দাবিই এ সমাবেশের মূল দাবি ছিল। ইউক্রেনে নয় বরং দেশের অভ্যন্তরে বেশি নজর দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।
যুদ্ধে রাশিয়া ‘যুদ্ধাচরণ’ করছে বটে, তবে পশ্চিমারা বলছে, বেসামরিক লোকদের এবং সামরিক লোকজনকেও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু সবাই, পাশ্চাত্যের প্রেস্টিটিউট ছাড়া, জানে যে, এ যুদ্ধ শুরুর আগে ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দনবাসের ১৪ হাজার লোককে হত্যা করেছে ইউক্রেন। চলমান যুদ্ধে কত লোককে হত্যা করেছে তা এখনো সঠিকভাবে নির্ণীত নয়। রাশিয়া ছাতু করছে বটে, তবে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে; হত্যা করছে বটে, তবে সামরিক ব্যক্তিবর্গকে। যুদ্ধের ফলে রাশিয়ায় এবং ইউরোপে লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। ১৯৯১ সালে পৃথগ্নতার পর (ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য হিসেবেই জাতিসংঘের সদস্য ছিল। তার নতুন করে স্বাধীন হওয়ার কিছু নেই।) জিডিপি বাড়েনি। ইউক্রেন আইএমএফের তৃতীয় বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা এবং ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়াকোভিচ বরং কড়া শর্তের কারণে আইএমএফের ঋণ নিতে অস্বীকার করেছিলেন। তার বিরুদ্ধেই ময়দান অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। রাশিয়াকে এসবের জন্য দায়ী করা চলে না। যুদ্ধকেও দায়ী করা যায় না। কারণ এর সবই ২০১৪ সালের আগের ইতিহাস।
ইউক্রেন ভয় পাচ্ছে মার্কিনিরা না আবার রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য চাপ দেয়! ২১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। তিনি ইউক্রেনযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের দায়ী করেছেন। বলেন, রাশিয়াকে ধ্বংস করতে বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে চায় তারা। বৈশ্বিক সমস্যা তাতে বরং আরেক দফা বাড়ল। এখন সিদ্ধান্তটা যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তবে ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই চীন ইউক্রেনে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে ১২ দফার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। ওয়াশিংটনকে হয় কোনো নতুন বোজোর সন্ধান করতে হবে অথবা শান্তি স্থাপনে সায় দিতে হবে। কী হবে!
লেখক: সাংবাদিক
নোবেলজয়ী রুশ চিকিৎসক ও শরীরতাত্ত্বিক ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাদে মৃত্যুবরণ করেন। শরীরের বস্তুবাদী গবেষণার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের আধুনিক রূপান্তরে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। ১৮৪৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার রয়াজানে জন্মগ্রহণ করেন পাভলভ। তার বাবা ছিলেন পাদ্রি। প্রথমে ধর্মীয় বিদ্যায় শিক্ষা শুরু করলেও ২০ বছর বয়সের আগেই চার্লস ডারউইনের লেখা পড়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন তরুণ পাভলভ। ১৮৭০ সালে রয়াজান থিওলজিক্যাল সেমিনারির পাঠ শেষ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট পিটার্সবুর্গের পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত অনুষদে প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে পড়েন। অধ্যাপনা করেন ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট পিটার্সবুগ, ইম্পেরিয়াল মেডিকেল অ্যাকাডেমি ও মিলিটারি মেডিকেল অ্যাকাডেমিতে। তার সবচেয়ে বড় অবদান ‘সাপেক্ষ প্রতিবর্ত’ ব্যাখ্যাকারী গবেষণা। গুরু মস্তিষ্কের অনেকগুলো প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং গবেষণার মাধ্যমে কুকুরের দেহে কীভাবে এসব প্রতিবর্ত তৈরি হয় ও কাজ করে তা প্রমাণ করেন তিনি। এভাবে মানুষ এবং পশুর মস্তিষ্কের সঙ্গে বাইরের উত্তেজকের সম্পর্কের বিধান আবিষ্কার ও ব্যাখ্যা করেন তিনি। তার সাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়ার তত্ত্বের ভিত্তিতে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে বস্তুবাদী ও আচরণবাদী গবেষণা এবং ব্যাখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯২২ সালে তার গবেষণা ফলাফলগুলো ভাষণ আকারে প্রকাশিত হয়। চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পান ১৯০৪ সালে। ১৯১৫ সালে তিনি ‘কপলে মেডাল’ জিতেন। তার উল্লেখযোগ্য দুটি বই হলোÑলেকচার্স অন দ্য ওয়ার্ক অব দ্য ডাইজেস্টিভ গ্ল্যান্ডস (১৮৯৭) এবং কন্ডিশনার্ড রিফ্লেক্সেস : অ্যান ইনভেস্টিগেশন অব দ্য ফিজিওলজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি অব দ্য সেরেব্রাল কর্টেক্স (১৯২২)।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ড. সাদিক আহমেদ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ে গবেষণাধর্মী একটা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। গুরুত্বপূর্ণভাবে, তিনি নির্বাচিত কিছু দেশের যারা মোটামুটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে বলা চলে, প্রচেষ্টার আলোকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, বাংলাদেশের মুদ্রানীতির সীমাবদ্ধতা নিয়েও তার প্রাজ্ঞ প্রতিক্রিয়া পেশ করেছেন। তার এই পর্যবেক্ষণ নীতিনির্ধারক এমনকি সাধারণ পাঠকের নজরে থাকা উচিত বলে মনে করি।
২০২২ সালে বিশ্বে চলমান ‘মারমুখী মূল্যস্ফীতির’ কথা আমরা সবাই জানি। সম্ভবত ২০০৮ সালের পর এমন ঝরোগতিতে বড় অভিঘাত সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নেই। চলমান মূল্যস্ফীতি কতটা মারমুখী, তা উপলব্ধি করার জন্য কিছু পরিসংখ্যান দিয়েছেন সাদিক আহমেদ যা উল্লেখ না করলেই নয়।
একমাত্র আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির হার ২০২১ সালের ১.৪ শতাংশ থেকে ২০২২ সালের জুনে ৯.১ শতাংশে পৌঁছায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নে সেই হার এক বছরের মধ্যে ১.৯ শতাংশ থেকে ১০.৬ শতাংশ লাফিয়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের প্রথম সাত মাসে ৩.২ থেকে ৭.৯ শতাংশ, ভারতে এক বছরে দ্বিগুণ, বাংলাদেশে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ৫.৯ শতাংশ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯.৫ শতাংশে অবস্থান নেয় মূল্যস্ফীতির হার।
বিশেষত দেশগুলোর বিদ্যমান পরিবেশ ও নীতি কাঠামোর ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন মাসে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে মূল্যস্ফীতি চূড়ায় ওঠা প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ সব জায়গায় ভোগান্তি মোটামুটি একইরকম। তবে জনগণের অসন্তুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতির মুখে নীতিগত প্রতিক্রিয়া অধিকতর দ্রুত এবং দৃঢ় ছিল ঐ সমস্ত দেশে যারা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়।
মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে ওঠার মূলে আছে দুটো কারণ : (ক) কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যৌথ প্রভাবের জন্য জোগানে ঘাটতি ঘটে এবং (খ) আমেরিকা ও ইউরোপে চাহিদা চাঙ্গা করার লক্ষ্যে প্রদত্ত কভিডবিরোধী প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন।
যদিও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী তীক্ষèতার উৎস ছিল জোগানের ঘাটতি এবং সেইহেতু পণ্যের দামের উল্লম্ফন। বিশেষত জ্বালানি দ্রব্য, তারপর নীতিনির্ধারকরা চটজলদি অনুভাবন করতে পেরেছিলেন যে, সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা দুষ্কর।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মুদ্রা কর্র্তৃপক্ষ খুব দ্রুত সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রেখে আগ্রাসী চাহিদা ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করলেন (কত আগ্রাসী তার প্রমাণ সুদের হার ত্বরান্বিত হওয়ার কারণে আমেরিকার দুটো ব্যাংকে ধস নামা)। এই পদক্ষেপ পদে পদে এবং চাহিদার প্রকৃতি সংক্রান্ত তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে করা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। থাইল্যান্ড, ভারত এবং ভিয়েতনামও মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদা সংকোচন নীতি আলিঙ্গন করেছে।
একমাত্র বাংলাদেশ ব্যতিক্রম যেখানে চাহিদা সংকোচন নীতি গ্রহণ করেইনি বরং চাহিদার চাপে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে ব্যক্তি খাতে ঋণ সম্প্রসারণ এবং রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি। যে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত দশ শতাংশেরও কম সেই দেশে ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়া ছাড়া অর্থায়নের উৎস কোথায়?
বাংলাদেশের মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বহু বিতর্কিত ‘ছয়/নয়’ সুদের নীতির অব্যাহত উপস্থিতি। যেখানে গেল সাত মাসের গড় ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে ল্যান্ডিং রেট ৯ শতাংশ। এই শূন্য অথবা ঋণাত্মক সুদের হার ব্যক্তি ঋণের প্রসার ঘটিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অপরদিকে, বর্ধিষ্ণু রাজস্ব ঘাটতি সরকারকে ব্যাংক থেকে গেল ১২ মাসে ২৮ শতাংশ হারে ঋণ নিতে বাধ্য করছে।
প্রশ্ন হলো, সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদা সংকোচন নীতি কতটা ফলদায়ক অন্তত বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে? দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে সবচেয়ে বেশি কমেছে থাইল্যান্ডে (৫১ শতাংশ) তারপর আমেরিকা ৩৫ শতাংশ, ইইউ-তে ২০ শতাংশ, ভারতে আট শতাংশ। ভিয়েতনামে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি নীতিগত গুরুত্ব পাওয়ার কারণে চাহিদা ব্যবস্থাপনায় সাফল্যস্বরূপ (যেমন সুদের হার বৃদ্ধি) বিশ্বে উঁচু মূল্যস্ফীতির মধ্যেও দেশটি ৫ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখতে পেরেছে।
মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনায় এই ভালো ফলাফলের বিপরীতে বাংলাদেশের কৃতিত্ব যে তেমন উজ্জ্বল নয়, তা বলা বোধ করি বাহুল্য নয়। আগস্ট ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
বস্তুত সরকারি পরিসংখ্যান তাই বলছে। তাও বৈশ্বিক স্তরে খাদ্যসহ পণ্যের দাম পড়ে যাওয়ার কারণে। মোটকথা, ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতি চূড়া থেকে মাত্র ৭ শতাংশ নেমেছে সংকল্পবদ্ধভাবে স্থিতিশীল রাখার প্রাণান্ত প্রয়াস হিসেবে।
মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা সহজেই অনুমেয় এবং কিছু দীক্ষা আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত। প্রথমত, এই ধারণাই ভুল যে যেহেতু মূল্যস্ফীতির উৎপত্তি বাইরে থেকে সুতরাং কিছুই করা যাবে না এবং তা কিছুটা আত্মপ্রবঞ্চনাপূর্ণ। মূল্যস্ফীতিকে শক্তিশালী চাহিদা ব্যবস্থাপনা নীতির আওতায় পোষ মানাতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সুদের হার বাড়িয়ে ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহ প্রয়োজন মাফিক রাখা এবং রাজস্ব ঘাটতি সংযত রাখা।
গত আট মাস ধরে চলমান মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ পৌঁছে কঠোর অভিঘাত হানছে দরিদ্র, নিম্ন আয় এবং মধ্যম আয়ের মানুষগুলোর ওপর এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা কী করছেন তাও জানা। পুষ্টির অভাব, শিক্ষা- স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হ্রাস, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি। অতএব, কালবিলম্ব না করে অচিরেই এর মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষত রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত উপদেশ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এটা করতেই হবে।
মূল্যস্ফীতি নিজে নিজে তো যাবে না। বরং তা অনমনীয় হয়ে উঠতে পারে যদি ঋণ বৃদ্ধি আর ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে ঘাটতি মেটাতে হয়। ঠিক এই মুহূর্তে সব দেশে মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব চেয়ে বড় অগ্রাধিকার। মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনাকে বি-রাজনীতিকরণের লক্ষ্যে অনেক উন্নত দেশে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রয়েছে যারা সুদের হার নীতির মাধ্যমে ঋণের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ তেমন স্বাধীনতা ভোগ করে বলে বেয়াকুফও বিশ্বাস করে না। তারপরও বলতে হয় যে- (ক) বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে জরুরি ভিত্তিতে ছয় /নয় সীমা তুলে দিয়ে নমনীয় সুদের হারে ঋণপ্রবাহ ঠিক রাখা, (খ) সুদের হারভিত্তিক মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করার জন্য টি-বিলস বাজার উন্নয়ন করা এবং (গ) সরকারের উচিত হবে রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি কৌশলকে সাহায্য করা, রাজস্ব ঘাটতি হ্রাসে কম সুদে বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং বড় বড় পুঁজি-নিবিড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা।
পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশে করোনার কারণে কৃত্রিম চাহিদা সংকোচন লক্ষ করা গেছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল পড়ন্ত। কিন্তু যেই করোনার করাল গ্রাস থেকে ভোক্তা এবং বিনিয়োগকারী অব্যাহতি পেল, অমনি বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আছড়ে পড়ল বাজারে। এমনিতে থাকা অপেক্ষাকৃত কম জোগান তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চাহিদা-জোগান ব্যবধান বাড়িয়ে দিয়ে মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢালছে।
সুতরাং, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি একদিকে ডিমান্ড পুল অন্যদিকে কস্ট পুস। অন্তত সুদের হার বৃদ্ধি করে চাহিদা সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে পারলে আপাতত বাঁচোয়া।
ব্যবসায়ী কিংবা বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য অন্যরকম। সুদের হার বাড়লে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমবে। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, সুদের হার জোর করে নিচে রাখার ফলে গেল ক’বছর বিনিয়োগ বৃদ্ধি কতটুকু হয়েছে, এর উত্তর নিশ্চয় উল্লসিত হওয়ার মতো হবে না। আসলে, ‘বিনিয়োগ’ অনেক উপাদানের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে সুদের হার অন্যতম, এমনকি প্রধান নিয়ামক।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানা-পুলিশের সদস্যরা ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বিক্রির অভিযোগ তুলে গণহারে চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ করেছেন চাক্তাই রাজাখালী এলাকার কিছু ব্যবসায়ী। তারা বলেছেন, বাকলিয়া থানায় কর্মরত পাঁচজন এসআই এক মাস ধরে ব্যবসায়ীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। গভীর রাতে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গুদামে হানা দিয়ে নিম্নমানের পণ্য বিক্রির অভিযোগ তুলে লাখ লাখ টাকা আদায় করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল সোমবার বেলা ১১টায়ও রাজাখালী এলাকায় কথিত অভিযানে যান বাকলিয়া থানার এসআই আসাদুল্লাহসহ আরও কিছু পুলিশ সদস্য।
এ সময় আপেল মার্কা ‘আরজে সেমাই’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে হানা দেন তারা। ময়দা নিম্নমানের, ট্রেড লাইসেন্স না থাকা এমন বিভিন্ন অভিযোগ তুলে প্রতিষ্ঠানের মালিক রাকিবকে ধরে থানায় নিয়ে যান এসআই আসাদুল্লাহ। বেলা ১১টা থেকে গতকাল এই প্রতিবেদন লেখার সময় (সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত) রাকিবকে থানায় ‘আটক’ করে রাখা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাকলিয়া থানায় ‘আটক’ অবস্থা থেকে রাকিব মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আজ বেলা ১১টার দিকে এসআই আসাদুল্লাহসহ কিছু পুলিশ কনস্টেবল আমার প্রতিষ্ঠানে আসেন। এ সময় এসআই আসাদুল্লাহ আমার প্রতিষ্ঠানের ময়দার মান খারাপ বলে অভিযোগ করে আমাকে থানায় এনে আটক করে রেখেছেন। আমি তাদের বলেছি, আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য পণ্য কেনার সব কাগজপত্র আমার কাছে আছে। আমার এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই। তবুও কেন আমাকে থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে।’
রাকিবকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে এসআই আসাদুল্লাহ বলেন, ‘আজ সকালে রাজাখালী এলাকায় গিয়েছিলাম জমিজমা-সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্ত করতে। এ সময় রাকিবের প্রতিষ্ঠানে যাই। থানার সেকেন্ড অফিসার তাকে (রাকিব) থানায় আনতে বলেছেন।’
রাকিবের এবং তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই। তা ছাড়া গতকাল সেখানে ভেজালবিরোধী কোনো অভিযানও হয়নি, তাহলে কেন রাকিবকে থানায় নিয়ে আটক করে রাখলেন? এমন প্রশ্ন করলে এসআই আসাদুল্লাহ বলেন, সেকেন্ড অফিসার বিস্তারিত জানাবেন।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে জানান, গত এক মাসের ব্যবধানে চাক্তাই-রাজাখালী এলাকার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রায় আট লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছেন আলোচ্য পুলিশ কর্মকর্তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গতকাল রাতে নিজেদের ব্যবসায়ী সংগঠন চাক্তাই শিল্প ও বণিক সমিতি কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন ভুক্তভোগীরা।
তাদের মধ্যে অন্যতম মেসার্স জননী পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিডের মালিক রিকু সেন অভিযোগ করে বলেন, ‘এক মাস ধরে বাকলিয়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর আমীর হোসেন, মোরশেদ, বেলাল, আসাদ উল্লাহ ও তাজুল ইসলাম বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গভীর রাতে অভিযান পরিচালনার নামে ব্যবসায়ীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রির অভিযোগ দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে এক মাসে ৮-১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত আট লাখ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন এই পাঁচ সাব-ইন্সপেক্টর।’
এক মাস ধরে চাঁদাবাজি চললেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ী রিকু সেন বলেন, ‘আমরা আজ রাতে সমিতির কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে বসব। এরপর সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করব।’
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশ চাঁদা আদায় করেছে সেগুলো হলো মেসার্স জননী পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, আবদুল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, চাল ব্যবসায়ী আহমদ হোসেন, মেসার্স দেলোয়ার সওদাগরের সেমাই ফ্যাক্টরি, রাজাখালী রোডের আক্কাস সওদাগর ও মেসার্স জয়নাল সওদাগরের ময়দার ফ্যাক্টরি।
ভুক্তভোগী আহাম্মদ নুর সওদাগর অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিম্নমানের চাল মজুদের অভিযোগ তুলে ১৬-১৭ দিন আগে এসআই আমীর আমার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে যান। এর ২০-২২ দিন আগে চাল গুদামজাত করার সময় একই অজুহাত তুলে আমার প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার শফির কাছ থেকে সাব-ইন্সপেক্টর মোরশেদ আড়াই লাখ টাকা নিয়েছেন।’
মেসার্স জননী পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রোপ্রাইটর রিকু সেন অভিযোগ করে বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য আনা ছোলা, মসুর ডাল ও সরিষা ট্রাক থেকে গুদামে নেওয়ার সময় নিম্নমানের অভিযোগ তুলে সাব-ইন্সপেক্টর আমীর হোসেন ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন।’
ভুক্তভোগী রাজাখালী এলাকার পেঁপে মার্কা সেমাই কারখানার মালিক দেলোয়ার সওদাগর বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে মজুদ থাকা ময়দার মান নিম্নমানের বলে অজুহাত তুলে ৬৫ হাজার টাকা নিয়েছেন বাকলিয়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর আমীর হোসেন।’
ব্যবসায়ীরা জানান, একইভাবে মেসার্স আবদুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের মালিক সোহাগের গুদামে ‘অভিযান’ চালিয়ে নিম্নমানের মৎস্য খাদ্য বিক্রির অভিযোগ তুলে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। সোহাগের গুদামে ‘অভিযানের’ নেতৃত্ব দেন এসআই বেলাল, এসআই আমীর হোসেন ও এসআই তাজুল। রাজাখালী রোডের জনতা বিল্ডিংয়ের সামনে মেসার্স জয়নাল সওদাগরের সেমাই ফ্যাক্টরির ময়দার মান খারাপ বলে আদায় করা হয় ১০ হাজার টাকা, মুসলিম বেকারি গলিতে মেসার্স আবুল কালাম ফিড মিলের পণ্য ট্রাক থেকে নামানোর সময় নেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা, রাজাখালী রোডের তেল ব্যবসায়ী আক্কাস সওদাগর থেকে নেওয়া হয় ৬৫ হাজার টাকা এবং চাক্তাই মুসলিম বেকারি গলির ভেতরে ঘি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কুইন কাউ নামক কারখানা থেকে এসআই আমীর নেন ৭০ হাজার টাকা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মনি বেগম, মোহাম্মদ কালু ও মো. আকাশ নামে তিনজন মাদক কারবারি চক্রের সদস্য। রাজাখালী ফায়ার সার্ভিস এলাকায় জুয়ার আসর চালায় কালু। স্থানীয় মুসলিম বেকারি গলি এলাকায় মাদক বিক্রি করে মনি বেগম। কিছু পুলিশের সঙ্গে তাদের সখ্য রয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সখ্যকে পুঁজি করে চাক্তাই এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের তারা নিয়মিত হয়রানি ও চাঁদাবাজি করছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠায় বাকলিয়া থানার এসআই আমীর হোসেনকে কিছুদিন আগে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।
তবে বাকলিয়া থানার ওসি আবদুর রহিমের দাবি, পদোন্নতি পাওয়ার পর এসআই আমীরকে কিছুদিন আগে সদরঘাট থানাধীন মাদারবাড়ী ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত রবিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে এসআই আমীর হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে নিজের থানায় কর্মরত পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এমন চাঁদাবাজির অভিযোগ শুনে বিস্মিত হয়েছেন ওসি আবদুর রহিম। তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশ একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী। এটা কি মগের মুল্লুক? ব্যবসায়ীরা কেন পুলিশকে বারবার টাকা দেবেন? তারা আমাকে জানাননি কেন? তবে অভিযোগের সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ওসি আবদুর রহিমের সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পর অভিযোগকারীদের নাম-ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর তাকে (ওসি) হোয়াটসঅ্যাপে দেন এই প্রতিবেদক। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলারও অনুরোধ করা হয়। এক ঘণ্টা পর গতকাল সন্ধ্যায় কল করলে ওসি আবদুর রহিম বলেন, ‘ভাই আমি অন্য কাজে ব্যস্ত আছি।’
পাকিস্তানে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনায় পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) এক নেতাসহ অন্তত দশজন নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্যা ডন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের হাভেলিয়ানের কাছে অজ্ঞাত হামলাকারীরা একটি গাড়িকে লক্ষ্য করে রকেট চালিত গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালায়। এতে পিটিআইয়ের স্থানীয় জেলা চেয়ারম্যান আতিফ জাদুন খানসহ অন্তত নয়জন নিহত হয়।
অ্যাবোটাবাদ জেলা পুলিশ কর্মকর্তা (ডিপিও) উমর তুফায়েল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, অ্যাবোটাবাদ জেলার ল্যাংড়া এলাকার এক গ্রামে দোয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর বাড়ি ফিরছিলেন আতিফসহ আরও কয়েকজন লোক। তখনই জাদুনের গাড়িতে দুর্বৃত্তরা অতর্কিত হামলা চালায় ফলে গাড়ির জ্বালানি ট্যাঙ্কটি বিস্ফোরিত হয়। উমর তুফায়েলের দাবি গাড়িটিতে রকেট হামলা হয়েছিলো।
তুফায়েল জানান, মরদেহগুলো অ্যাবোটাবাদ জেলা সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, ঘটনাটি পুরানো শত্রুতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে অবিলম্বে অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে তাদের শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে পিটিআই।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।