
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির দেশব্যাপী সমন্বিত কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার (ইঈউঐ) কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি নবদিগন্তের সূচনা হতে চলেছে। মূলত এবং মুখ্যত আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার এটি একটি সৃজনশীল উদ্যোগ। এই প্রকল্পের আওতায় গৃহীত কর্মসূচি একটি দক্ষ, কার্যকর, সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য চিকিৎসাসেবা প্রক্রিয়া। দেশ-বিদেশে মানুষ এখন স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছে। প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পদ্ধতিতেও কার্যকর পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যসেবাকে দেশব্যাপীকরণে কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার কর্মসূচির বাস্তবায়ন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির এই অভিনব উদ্যোগ সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা ইউনিয়ন বা থানা হেলথ কমপ্লেক্সে আধুনিক চিকিৎসাসেবা দানের অবকাঠামো ও প্রক্রিয়াগত অপ্রতুলতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনায় যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে তাকে পূর্ণতা প্রদানে সহায়ক ভূমিকায় (স্বশাসিত ও স্বেচ্ছাসেবী) থাকবে। সমিতির এই ভূমিকা দেশের স্বাস্থ্য খাতকে অধিকতর সেবামুখী করবে। সরকারি খাতের পরই বেসরকারি খাতে বৃহত্তর পরিসরে ৬৮ বছর বয়সী বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক রয়েছে দেশব্যাপী। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১১-১৯৮৯) প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু ডায়াবেটিক চিকিৎসায় সীমিত নয়। যেসব শারীরিক সমস্যা বা রোগের আহ্বায়ক ডায়াবেটিস, সেসব শারীরিক রোগ যথা হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, কিডনি, চোখ, কান, গলা, দাঁত, বক্ষব্যাধি, লিভার, নিউরো ও ইউরোলজি, গ্যাস্ট্রিওলজি ইত্যাদি চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণ চিকিৎসালয় (জেনারেল হাসপাতাল) বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। সেই সেবা ব্যবস্থাপনায় ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি টেস্টিং, মেডিকেল ইমেজিং, রোগী-চিকিৎসকের পরামর্শ, এমনকি ছোটখাটো অস্ত্রোপচার পদ্ধতিও ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করা হয় এই উদ্যোগের মাধ্যমে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যদিবসকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ‘সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করে।
প্রসঙ্গত, মোবাইল প্রযুক্তির বিবর্তনের ফলে রোগী-চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো ইত্যাদির মতো সামাজিক অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে। রক্ত এবং মূত্র পরীক্ষা এখন সঠিক এবং দ্রুত ফলাফল প্রদানের জন্য কমভোগ্য সামগ্রীসহ ছোট সরঞ্জাম ব্যবহার করে পরিচালিত হচ্ছে। পোর্টেবল হ্যান্ড-হোল্ড ডিভাইসগুলো আলট্রাসাউন্ড, রক্তনালিতে তরল প্রবাহ এবং ইসিজির মতো ইলেকট্রনিক রেকর্ডিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। টেলিমেডিসিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যে মুখোমুখি পরামর্শের অভিজ্ঞতার প্রতিস্থাপন করতে না পারা। এখন, পোর্টেবল হ্যান্ড-হোল্ড ডিভাইসের সংমিশ্রণ, দ্রুত-পরীক্ষা ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম এবং সামাজিক অ্যাপগুলোর সঙ্গে অডিও-ভিজ্যুয়াল যোগাযোগের ব্যবহার রোগী এবং ডাক্তার উভয়ের জন্য টেলিমেডিসিন কার্যক্ষমতা ও অভিজ্ঞতাকে ব্যাপকভাবে উন্নত করতে পারে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে ৬৪টি জেলা এবং ১৯টি উপজেলায় হাসপাতাল এবং বহির্বিভাগের রোগীদের কেন্দ্রগুলোর বিশাল নেটওয়ার্কে প্রযুক্তিগত বিপ্লব থেকে উপকৃত হতে ডিজিটাল সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হচ্ছে। কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার সেন্টারে যেসব সেবা মিলবে : সরাসরি প্রাথমিক চিকিৎসা ও ভিডিও কনসালটেশনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা প্রদান, ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে, মাইনর ইন্টারভেনশন, ওষুধ বিক্রয় এবং সরকারি ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রেফার করা।
কেন্দ্রগুলো সারাদেশে একটি বৃহৎ রেফারেল নেটওয়ার্ক গঠনের জন্য জেলা এবং শহর পর্যায়ের চিকিৎসা সুবিধাগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করবে। ডায়াবেটিক সমিতির চিকিৎসা সুবিধার দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক এবং বিশেষায়িত হাসপাতালে এখন একাধিক চিকিৎসা শাখায় বিশেষজ্ঞ এবং পরামর্শদাতাদের একটি বিশাল পরিসর রয়েছে। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অনলাইনে ভিডিও পরামর্শ প্রদান করবেন। কেন্দ্রের মাধ্যমে রোগীদের অনলাইন ভিডিও পরামর্শ প্রদানের জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে অনুষদের একটি প্যানেল থাকবে। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ বা লভ্যতার সুযোগ বৃদ্ধি করবে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি সবসময় স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা সরবরাহের উন্নতির জন্য যে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও লালন করেছে। সমিতি ডাক্তারদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সার্টিফিকেট কোর্স চালু করেছে। এমনকি গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা পাইলট প্রকল্পে টেলিমেডিসিন সেবা, ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে ইব্রাহিম হেলথলাইন, বিএনডিআরের রোল আউট ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতিসংক্রাস্ত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী প্রতি ১০,০০০ জন মানুষের জন্য মাত্র ২.৪১ জন চিকিৎসক, ১.৩৬ জন নিবন্ধিত নার্স রয়েছে; এবং প্রতি মিলিয়ন মানুষের জন্য মাত্র ১০টি হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে প্রতি ৪০০০ জন মানুষের জন্য হাসপাতালের শয্যা রয়েছে মাত্র ১টি। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের অনুমান বাংলাদেশে এখনো শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষের ডায়াবেটিস আছে কিনা তা পরীক্ষা করা বাকি।
অন্যদিকে এখন এটি উপলব্ধিতে আসছে যে, দেশের প্রত্যন্ত কোণে প্রযুক্তির ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা সাশ্রয়ীভাবে প্রসারিত করতে পারলে অপ্রয়োজনীয় ও অদক্ষ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা এমন বাস্তবতা যেখানে প্রযুক্তির সহায়তায় রোগীর যতেœর উন্নতি ও সেবা বৃদ্ধি করা সম্ভব। পোর্টেবল ডিভাইস দিয়ে দ্রুত-পরীক্ষা, ক্লিনিকাল ল্যাবরেটরি বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হার্টের কিংবা জটিল রোগীকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ পরামর্শক্রমে রোগীকে দ্রুত যথা চিকিৎসালয়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে। হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে চিকিৎসার পরিধিতে আনতে পারলে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।
পাইলট হিসেবে তিনটি সেন্টার উদ্বোধন করা হয়েছে, সেগুলো হলোÑ ক. উখিয়া, কক্সবাজার খ. খোকসা, কুষ্টিয়া এবং গ. বাবুগঞ্জ, বরিশাল। ওই সেন্টারগুলোর প্রত্যেকটিতে পাঁচজন করে লোকবল নিয়োগ দিয়ে প্রান্তিক এলাকার জনসাধারণকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। এই পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন একজন ডাক্তার (এমবিবিএস), একজন নার্স, একজন সেন্টার/মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট, একজন ল্যাব টেকনোলজিস্ট এবং একজন ক্লিনার। সেন্টারগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন (ডায়াবেটিস, রক্ত, মূত্র, হরমোন ইত্যাদি মোট ৩৬টি পরীক্ষা), ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম এবং ভিডিও কনসালটেশনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসাসেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। খুব শিগগির আরও ২টি সেন্টার চালু করার প্রস্তুতি চলছে, হবিগঞ্জের গ্রাম পঞ্চাশ, শায়েস্তাগঞ্জ এবং অপরটি শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। এ পর্যন্ত ৪টি অধিভুক্ত সমিতি যথা : দিনাজপুর ডায়াবেটিক সমিতি (সেতাবগঞ্জ), বগুড়া ডায়াবেটিক সমিতি (তালোড়া), পাবনা ডায়াবেটিক সমিতি (কাশিনাথপুর), ঠাকুরগাঁও ডায়াবেটিক সমিতি (রানীশংকৈল) তাদের সাব-সেন্টারগুলোকে বাডাস কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে।
তিনটি সেন্টার পাইলটিং করে দেখা যায় যে, প্রতিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠায় জমির মূল্য বাদে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে এ ধরনের ৩০টি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেতে বাডাস কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার প্রজেক্টের (বিসিডিএইচপি) আওতায় ৩০টি সেন্টার স্থাপনের জন্য একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হচ্ছে। টেলিমেডিসিন যোগাযোগ ব্যবস্থা (অনলাইন ভিডিও পরামর্শের জন্য উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ এবং সরঞ্জাম) গড়ে তোলার জন্য সরকারের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ সহায়তা চলমান রয়েছে ।
কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) এবং সিটি হেলথ লিমিটেডের মধ্যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করা হয়েছে। কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার প্রকল্প, ইব্রাহিম হেলথলাইনের একটি সম্প্রসারিত প্রকল্প। ইব্রাহিম হেলথলাইন স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
প্রসঙ্গত যে, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা একজন ডাক্তার। ভুটানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভুটানের রাজ পরিবারের চিকিৎসক প্রত্যেকেই বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ারসেবা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান-এর কাছে তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। ভুটানে যদি বাডাস কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার প্রকল্প চালু করা যায়, তবে নেপালেও স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করার লক্ষ্যে কম্প্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য
কুলিদের দৌরাত্ম্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সদরঘাট লঞ্চঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশন, বিভিন্ন বাস টার্মিনালে তারা সংঘবদ্ধভাবে ইচ্ছা চরিত্রের প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন। এ যেন এক চিহ্নিত নৈরাজ্যভূমি। এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই, উদ্ধত কুলিদের পেছনে কোনো রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক শক্তি নেই! অনুমান করা যায়, সমস্ত জায়গায় আটঘাট বেঁধেই তারা হয়রানি চালাচ্ছেন যাত্রীদের ওপর।
প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল দিয়ে। কোনো যাত্রী বহনযোগ্য পণ্য নিজেই বহন করতে চাইলে কুলিরা তাতে বাধা দেন এবং অতিরিক্ত চাঁদা দাবি করেন। এক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ’র নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে বলা রয়েছেÑ হাতে বহনযোগ্য পণ্য যাত্রীরা কোনো ধরনের টাকা বা মাসুল ছাড়াই নিতে পারবেন। আর ব্যবসায়িক পণ্য যে সমস্ত কুলি বহন করবে তাদের পোশাক হবে ‘হলুদ রঙের’ এবং যারা যাত্রীর মালামাল বহন করবে তাদের পোশাক হবে ‘আকাশি রঙের’। এই নিয়মের বাস্তবায়ন যেন নির্দেশনা পর্যন্তই। খুব কমসংখ্যক কুলিকেই নির্দিষ্ট পোশাকে দেখা যায়। এ বিষয়ে দেশ রূপান্তরে বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘মাল বহন না করলেও টাকা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লঞ্চঘাটে কুলিদের দৌরাত্ম্য বিষয়ে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
বছরের পর বছর ধরে লঞ্চে রাজধানীতে আসা-যাওয়া করেন দক্ষিণাঞ্চলের লাখো যাত্রী। তারা ঘাটশ্রমিকদের দৌরাত্ম্যে নাজেহাল হচ্ছেন। মাল বহন করার জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে নেওয়া হচ্ছে নির্ধারিত হারের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মজুরি। বাড়তি টাকা না দিলে মারধর বা হেনস্তার শিকার হতে হয় যাত্রীদের। আর এসব ঘটনা ঘটছে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের সামনেই। যাত্রীদের অভিযোগ, সদরঘাটের ইজারাদারের লোকেরা ইচ্ছামতো টাকা আদায় করেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয় না। প্রশাসনের লোকজন দেখেও না দেখার ভান করছেন। বহনযোগ্য কোনো মালামাল কুলিরা ধরতে পারবেন না। এমনকি যাত্রীদের বহনযোগ্য কোনো মালামালের জন্য ফি বা শুল্ক দিতে হবে না, সরকার তো এমন নিয়মই করেছে। তারপরও কেন টাকা চাইছেন? একজন কুলি বলেন, ‘এসব আমরা জানি না। আপনেরা সরকাররে গিয়া জিগান।’
বলার অপেক্ষা রাখে না সদরঘাটে যাত্রী ভোগান্তির সবচেয়ে বড় কারণ কুলিদের দৌরাত্ম্য। ঘাটে মালামাল বহনে কুলিদের মজুরি তালিকা অনধিক ১০ কেজি ওজনের মালের জন্য ১০ টাকা, ২০ কেজির জন্য ২০ টাকা ও ৩০ কেজির জন্য ৩০ টাকা, ৪০ কেজির ৪০ টাকা, ৬০ কেজির জন্য ৫০ টাকা, স্টিলের অথবা কাঠের আলমারি প্রতিটি ১০০ টাকা, কাপড়ের গাঁইট ৫০ টাকা, ফ্রিজ ৫০ টাকা, হার্ডওয়্যার ৪০ টাকা, মোটরসাইকেল ২৫ টাকা, বাইসাইকেল ২০ টাকা, সিলিংফ্যান বা অন্যান্য ২০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা রয়েছে। কিন্তু ঘাটে মালামাল আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানছেন না কুলিরা।
শুধু যাত্রী নয়, সদরঘাটে চাঁদাবাজি চলে নৌকার মাঝি, ঘাটের ফলের দোকান এবং হকার থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি পর্যায়ে। ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই মূলত ঘাটের ইজারা নেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপই তেমন একটা কার্যকর হয় না। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে একবার সদরঘাটের টার্মিনালকে কুলিদের অবৈধ তৎপরতামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। শুধু সদরঘাট নয়, কুলিদের দৌরাত্ম্য চলছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন বাস টার্মিনালেও। সেখানে নিয়মিতভাবে এই অর্থের ভাগ পাচ্ছেন টার্মিনাল কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা এবং এলাকার মাস্তান। তাদের হাতে রেখেই কুলিদের এমন ঔদ্ধত্য।
যাত্রীরাও অযথা হয়রানি হবেন না আবার কুলিরাও বেকার হয়ে না যান, সেই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। টার্মিনালের ঝুলন্ত নোটিসের যেন বাস্তবায়িত রূপ যাত্রীরা দেখতে পান, সেটাই মুখ্য। প্রত্যাশা থাকবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে কঠোর আইন চালু করবেন। সেই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমেই যেন সমস্যার সমাধান হয়। সাধারণ যাত্রী যেন কুলিদের হাতে আর নাজেহাল না হন।
জীবন ঘোষালের জন্ম চট্টগ্রামের সদরঘাটে ২৬ জুন ১৯১২ সালে। তার প্রকৃত নাম মাখনলাল। তার বাবার নাম যশোদা ঘোষাল। তিনি ছিলেন ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। ছাত্রাবস্থায় ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংঘটিত বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি। তাদের এই বিদ্রোহ শোষণ-বঞ্চনার আঁধারে ঢাকা ভারতবাসীকে সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ভারতের মুক্তিকামী মানুষের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে কিছুদিনের জন্য হলেও চট্টগ্রামকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করতে এক অসম দুঃসাহসী লড়াইয়ের পরিকল্পনা করে চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা। চট্টগ্রামের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে ১৮ এপ্রিল বিদ্রোহ শুরু হয়। রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে রেখে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনস এবং কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগারে হামলা চালায় বিপ্লবীরা। তিনি পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের জন্য গঠিত দলে ছিলেন। তার দল সফলভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে সমর্থ হয়। এ সময় অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংসের জন্য আগুন লাগাতে গেলে হিমাংশু সেন আহত হন। তাকে নিরাপদে রেখে আসতে তিনি ও তার সঙ্গীরা শহরে গেলে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে চন্দননগরে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে তিনি আহত হন এবং ১৯৩০ সালের ১ সেপ্টেম্বর মারা যান।
তাহাজ্জুদ নামাজ ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে তা নিয়মিত আদায় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। ফরজ নামাজের পর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নামাজ হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাজ। পুরো পৃথিবী যখন নীরবতার কোলে হারিয়ে যায়, মহান আল্লাহ তখন নেমে আসেন নিকটবর্তী আসমানে, বান্দার খুব কাছাকাছি। কার কী প্রয়োজন, কী আকাক্সক্ষা, কী ফরিয়াদ, বারবার জানতে চান তিনি। রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহ বান্দাদের প্রতি তাদের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান। বান্দাদের প্রয়োজন পূরণের কথা শোনেন। তাহাজ্জুদের মাধ্যমে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়, বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নৈকট্য লাভ করেন। এতে মুমিনের আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
তাহাজ্জুদ ইসলামের প্রথম দিকে ফরজ ছিল। অনেক দিন পর্যন্ত তা ফরজই ছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী! রাতের বেলা নামাজে রত থাকো। অর্ধেক রাত, কিংবা তার চেয়ে কিছু কম করো। তবে কিছু সময় ছাড়া অথবা তার ওপর কিছু বাড়িয়ে নাও। আর কোরআন থেমে থেমে পাঠ করো। আমি অতি শিগগির তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাজিল করব। নিশ্চয়ই রাতের বেলা জেগে ওঠা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশি কার্যকর এবং যথাযথভাবে কোরআন পড়ার জন্য উপযুক্ত সময়।’-সুরা মুজজাম্মিল : ১-৬
পরে তাহাজ্জুদ নামাজ নফল হিসেবে সাব্যস্ত হলে মহান আল্লাহ তার প্রিয় রাসুল (সা.)-কে বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করবে। এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত। নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে ওঠাবেন।’ -সুরা ইসরা : ৭৯
হাদিসে এসেছে, হজরত সাদ ইবনে হিশাম (রহ.) বলেন, আমি বললাম! হে উম্মুল মুমিনিন! আপনি আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র বিষয়ে কিছু বলুন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, তুমি কি কোরআন পড়ো না? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র কোরআনে যা আছে তাই। তারপর সাদ বলেন, আপনি আমাকে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাতের নামাজের ব্যাপারে বলুন। তখন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, তুমি কি ইয়া আইয়্যুহাল মুজজাম্মিল পড়ো না? সাদ বলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ আমি পড়ি তো। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এ সুরার যখন প্রথমাংশ নাজিল হয়, (যাতে তাহাজ্জুদ ফরজ হয়) তখন সাহাবায়ে কেরাম এত দীর্ঘ তাহাজ্জুদ পড়তেন যে, তাদের পা ফুলে যেত। আর এ সুরার শেষাংশ বারো মাস পর্যন্ত আসমানে আটকে থাকে। বারো মাস পর যখন এর শেষাংশ নাজিল হয়, তখন যে তাহাজ্জুদ ফরজ ছিল তা নফল হয়ে যায়।’-সুনানে আবু দাউদ : ১৩৪৪
তাহাজ্জুদ আদায়কারী বান্দাদের জন্য আল্লাহ জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন। হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই জান্নাতের মধ্যে এমন কতিপয় সুন্দর প্রাসাদ রয়েছে, যার বাইরের দৃশ্যগুলো ভেতর থেকে দেখা যায় এবং ভেতরের দৃশ্যগুলো বাহির থেকে দেখা যায়। এক বেদুইন দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এ প্রাসাদগুলো কার জন্য?’ তিনি বললেন, যার কথা নরম। ক্ষুধার্তকে খাদ্য প্রদান করে। নিয়মিত নফল রোজা পালন করে এবং রাতের বেলা মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সে নামাজ আদায় করে।’ -জামে তিরমিজি : ১৯৮৪
নবী কারিম (সা.)-এর পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তার পরও তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। দীর্ঘ নামাজের কারণে নবীজির পা ফুলে যেত। সহিহ সনদে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (নবী কারিম) রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত বেশি নামাজ আদায় করতেন যে, তার পা মোবারক ফুলে যেত। এটা দেখে তিনি (হজরত আয়েশা রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এত কষ্ট করছেন, অথচ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে! হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমার কি উচিত নয় যে, (এ মহা অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে) আমি একজন পূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায়কারী বান্দা হব?’ -সহিহ বোখারি : ১০৭৮
গভীর রাতে সবাই যখন আরামের নিদ্রায় মশগুল, মুমিন তখন আরামের নিদ্রা ত্যাগ করে রবের সান্নিধ্য লাভের জন্য নামাজে দন্ডায়মান হয় তখন স্বয়ং আল্লাহ তার বান্দার নিকটবর্তী হন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রাতের শেষভাগে রব তার বান্দার খুব নিকটবর্তী হন। যদি পারো, ওই সময় আল্লাহর জিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও!’ -জামে তিরমিজি : ৩৫৭৯
যেহেতু তাহাজ্জুদের নামাজ রাতে ঘুম থেকে উঠে আদায় করতে হয়, অনেকের জন্য তা কষ্টকর। কিন্তু কেউ যদি রাতে ঘুমানোর সময় নিয়ত করে ঘুমায় এবং কোনো কারণে তার তাহাজ্জুদের নামাজ ছুটে যায়, তাহলেও সে সওয়াব পাবে। এ জন্য তার প্রথম কাজ হলো, পাকাপোক্ত নিয়ত করা। অন্তর থেকে নিয়ত করতে পারলে আমল সহজ হয়ে যায়। বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমলসমূহেরই যে শুদ্ধাশুদ্ধির বিচার হয়, কেবল তা নয় অনেক সময় ওজরবশত উক্ত আমল করতে না পারলেও আমলের সওয়াব পেয়ে যায় মুমিন। বিষয়টি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে এভাবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে আদায় করার নিয়ত করে বিছানায় গেল, কিন্তু ঘুম তাকে পরাস্ত করল, সে উঠতে পারল না, এমনকি সকাল হয়ে গেল, তাহলে নিয়তের কারণে তার আমলনামায় আমলের সওয়াব লেখা হবে। আর এই ঘুম রবের পক্ষ থেকে তার জন্য সদাকা বলে বিবেচিত হবে।’-সুনানে নাসাঈ : ১৭৮৭
প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিই কামনা করেন, আল্লাহ যেন তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন, ইবাদত-বন্দেগি কবুল করেন এবং ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেন। এসব চাওয়া-পাওয়ার প্রধান অবলম্বন হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। তাহাজ্জুদ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একান্ত কথোপকথনের মহান অবলম্বন। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। তাহাজ্জুদের বদৌলতে মানুষ মহান মর্যাদার অধিকারী হয়। মুমিনদের উচিত, তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল নামাজের আমল অব্যাহত রাখা। সেই সঙ্গে আল্লাহর দরবারে কাতর কণ্ঠে দোয়া করা নিজ ও পারিবারিক যাবতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য, আপনজনের মধ্যে যারা ইন্তেকাল করেছেন- তাদের মাগফিরাতের জন্য।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
গত ২৩ আগস্ট ২০২৩ বুধবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায় রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধাদল ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার পথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই ঘটনার ঠিক দুই মাস আগে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওয়াগনার বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন। বিদ্রোহের দুই মাস ছুঁই ছুঁই হলেও প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অনেকেই অবাক হচ্ছিলেন এবং কোনো কোনো পর্যবেক্ষক তাকে ‘ডেডম্যান ওয়াকিং’ বা চলমান মৃত ব্যক্তি হিসেবেই অভিহিত করছিলেন। বিদ্রোহের পর থেকে প্রিগোজিন রাশিয়াতে প্রকাশ্যেই ছিলেন। রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রিগোজিনের মৃত্যুকে স্রেফ একটি দুর্ঘটনা হিসেবে বলা হলেও পশ্চিমা বিশ্লেষকরা একে তার বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে দেখছেন এবং রাশিয়ার ইতিহাসও তাই বলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার গোয়েন্দার সংস্থা এফএসএস (ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস)-এর হত্যা পরিকল্পনা একটি নিয়মিত ঘটনা। এর আগের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেগুলো হয় বিষপ্রয়োগ, গুলি করে হত্যা করা, বিস্ফোরক প্রয়োগে হত্যা করা বা ভবনের জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়া এসব ঘটনা ও রটনার কথা শোনা যায়। বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যদি সত্যিই প্রিগোজিনকে হত্যা করা হয় তাহলে রাশিয়ার ইতিহাসে এটাই প্রথম।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে যে ঘটনাগুলো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে রয়েছে, রাশিয়ান ধনকুবের ও আইনসভার সদস্য পাভেল আন্তোভ গত ২০২২-এর ডিসেম্বর মাসে ভারতের ওড়িশা ভ্রমণের সময় একটি হোটেলের জানালা থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। বলা হয় তিনি ইউক্রেন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচক ছিলেন। ভারতের পক্ষ থেকে একে আত্মহত্যা হিসেবে বলা হলেও পুতিন সমালোচকরা সন্দেহমুক্ত হতে পারছেন না। প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে রাশিয়ার বেসরকারি তেল জায়ান্ট লুকঅয়েলের চেয়ারম্যান রাভিল মাগানভের ক্ষেত্রে। তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মস্কোর একটি হাসপাতালের জানালা দিয়ে পড়ে মারা যান। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পরপরই লুকঅয়েল-এর চেয়ারম্যান যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আক্রমণের সমালোচক ব্যবসায়ী ডান রাপোপর্টের মৃতদেহ ওয়াশিংটনের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে উদ্ধার করা হয় ২০২২ সালের আগস্ট। ২০১৯ সালে চেচনিয়ান বংশোদ্ভূত জর্জিয়ান জালিমখান খানগোসভিলিকে জার্মানির বার্লিনের একটি উদ্যানে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ২০০০-এর শুরুর দিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে চেচনিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বলা হয় এফএসবি তাকে হত্যার জন্য এজেন্ট নিয়োগ করেছিল।
এর আগে ২০১৫ সালে নভেম্বর মাসে রাশিয়ার সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও পুতিন ঘনিষ্ঠ মিখাইল লেসিনের মৃতদেহ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির একটি হোটেল রুমে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। লেসিন রাশিয়া টুডে নামে একটি ইংরেজি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধারণা করা হয় লেসিন আমেরিকায় অর্থ পাচার ও দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি মামলা থেকে বাঁচার জন্য মার্কিন এফবিআইয়ের সঙ্গে সমঝোতার দিকে আগাচ্ছিলেন। বরিস নেমটসভ সাবেক প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়ালৎসিনের সময় রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন পুতিনের কট্টর সমালোচক। ২০১৫ সালে ক্রেমলিনের কয়েক গজের মধ্যেই তাকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুতিনের বিরাগভাজন হয়ে বরিস ব্রেজভস্কি যুক্তরাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। নির্বাসনে থাকার সময় তিনি পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দিয়েছিলেন। তাকে ২০১৩ সালের মার্চে বার্কশায়ার নিজ বাড়ির ভেতর থেকে বন্ধ বাথরুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার এই মৃত্যু সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা না গেলেও অনেকে তার মৃত্যুতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের সন্দেহ প্রকাশ করেন। সাংবাদিক নাটালিয়া এস্তেমিভোরা চেচনিয়ায় রাশিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘন উন্মোচনে কাজ করতেন। ২০০৯ সালে তাকে তার বাড়ির সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ ও মৃত অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়।
রাশিয়ান মানবাধিকার আইনজীবী স্টানিসলভ মারকেলভ পুতিনের সমালোচক সাংবাদিক আনা পলিটকভস্কায়া ও অন্য সাংবাদিকদের সহায়তা করতেন। ২০০৯ সালে তিনি মুখোশধারী বন্দুকধারীদের হাতে ক্রেমলিনের কাছাকাছি গুলিতে নিহত হন। ২০০৬ সালে রাশিয়ান সাংবাদিক ও পুতিন সমালোচক আনা পলিটকভস্কায়াকে হত্যা করা হয়। তিনি তার ‘পুতিনের রাশিয়া’ বইয়ে রাশিয়াকে একটি পুলিশি রাষ্ট্র বানানোর জন্য পুতিনের সমালোচনা করেন। বন্দুকধারীরা পলিটকভস্কায়াকে তার ফ্ল্যাটের লিফটের সামনে গুলি করে হত্যা করে। পরে প্রমাণিত হয় তার এই হত্যাকাণ্ড ছিল ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’। পল ক্লেবনিকভ, ‘ফোর্বস’ রাশিয়ার সম্পাদক ছিলেন, তিনি রাশিয়ার শাসক গোষ্ঠীর দুর্নীতি নিয়ে লিখতেন ও অনুসন্ধান করতেন। সাংবাদিকদের সুরক্ষা সম্পর্কিত একটি কমিটির মতে ২০০৪ সালে তাকেও কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের শিকার হতে হয়।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভিন্ন মতাবলম্বী, পক্ষত্যাগী গোয়েন্দা ও তার শত্রুদের প্রায়ই বিষপ্রয়োগের অভিযোগ আছে। ২০০২ সালে আরব চেচেন বিদ্রোহী নেতা খাত্তাব একটি চিঠি খুললেন এবং এটাই ছিল তার শেষ চিঠি। ধারণা করা হয় এই চিঠির মাধ্যমে তার ওপর সারিন নামক এক ধরনের মারাত্মক স্নায়ু অকার্যকর রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছিল। পরে এফএসবির পক্ষ থেকে জানানো হয় এক বিশেষ অভিযানে খাত্তাব নিহত হন। ইউক্রেনের ২০০৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় ভিক্টর ইউসেঙ্ক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি নির্বাচনী দৌড় থেকে ছিটকে পড়েন। ইউসেঙ্ক পশ্চিমাপন্থি নেতা ছিলেন। তিনি যখন আবার জনসম্মুখে আসলেন তখন মুখমণ্ডল অনেকটাই বিকৃত হয়ে যায়। সন্দেহ করা হয় ইউসেঙ্কের ওপর ডাইওস্কিন নামক বিষপ্রয়োগের শিকার হয়েছিলেন। আলেকজান্ডার লিটভিনেস্কো ছিলেন রাশিয়ান এফএসবি ও কেজিবির প্রাক্তন কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে তিনি রাশিয়ায় থেকে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় তিনি পুতিনবিরোধী একজন কট্টর সমালোচক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবিকে নিয়ে বই লিখেন। লিটভিনেঙ্কো ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যের এক হোটেল চা পানের পর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দুই বছর আগে নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেনÑ রাশিয়ার ক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে বিষপ্রয়োগ কেবল একটি সাধারণ অস্ত্র। যুক্তরাজ্যের তদন্ত অনুযায়ী লিটভিনেস্কোর চায়ে পোলোনিয়াম-২০ নামে এক ধরনের তেজস্ক্রিয় মেশানো হয়েছিল।
২০১৮ সালে এমনই একজন রাশিয়ান পক্ষত্যাগী সাবেক গোয়েন্দা সের্গেই স্ক্রিপালকে স্নায়ু অকেজো করে দেয় এমন রাসায়নিক প্রয়োগে হত্যা চেষ্টা করা হয়। সের্গেই স্ক্রিপাল যুক্তরাজ্যের হয়ে রাশিয়ায় গোয়েন্দাগিরি করার জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং এক বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। এমনিভাবে রাশিয়ার বিরোধী রাজনীতিবিদ ভøাদিমির কারা-মুর্জা বিষপ্রয়োগে হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তাও একবার না পরপর দুইবার। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৫ সালে কোনো এক জনসভায় ভাষণ দানকালে এবং দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালে বলে তিনি জানান। শুধু বর্তমান রাশিয়ায় নয়, সাবেক সোভিয়েত আমলেও ভিন্নমতাবলম্বী কবি-সাহিত্যিকরা বিভিন্ন সময়ে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ১৯৭৮ সালে বুলগেরিয়ান লেখক জর্জি মার্কোভ যখন লন্ডনে তার কর্মস্থল বিবিসিতে যাওয়ার জন্য বাসের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তখন তিনি রাসায়নিক আক্রমণের শিকার হন এবং পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২০ সালের আগস্টে রাশিয়ার বিরোধী দলের নেতা, অ্যালেক্সেই নাভালনি, এখন রাশিয়ার জেলে অন্তরীণ আছেন, সার্বিয়া থেকে মস্কো ফেরার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তিনি চিকিৎসার জন্য জার্মানি যান। সেখানে ডাক্তাররা জানানÑ তিনি নভিচক নামক এক ধরনের রাসায়নিকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
রাশিয়ার রাজনৈতিক ও গুপ্তহত্যার ইতিহাস পুরনো। জোসেফ স্টালিনের বিরুদ্ধেও একের পর এক হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ আছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ লিওন ট্রটস্কি। তবে রাজনৈতিক ও গুপ্তহত্যায় রাশিয়াই একমাত্র দেশ না এবং ওপরে যে হত্যাকাণ্ড বা হত্যাচেষ্টার কথা বলা হয়েছে তার সবগুলো সর্বাংশে সত্য নাও হতে পারে। পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বৈরথ সেই পুরনো, অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমা মিডিয়া তারই প্রতিনিধিত্ব করে। রাশিয়া মানেই খারাপ আর পশ্চিমা সবকিছুই ভালো বিষয়গুলো এমনও নয়। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে শাস্তি দেওয়া হয়। তা কখনো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, কখনো ধর্ম-বর্ণ ও আদর্শের নামে, বা অন্যের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে, যার সঙ্গে যুক্ত থাকে মূলত প্রভাবশালী শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থ। পুতিন এখানে একজন ব্যক্তি না, তিনি রাশিয়ার অভিজাত শাসক শ্রেণিরই প্রতিনিধি, এই শাসক শ্রেণিই তাকে টিকিয়ে রেখেছে। শুধু রাশিয়ায় না অভিজাত শাসক শ্রেণি দেশে দেশে নিজেদের ক্ষমতা ও স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। আর কূটকৌশলেরই একটা উপায়ই হচ্ছে রাজনৈতিক ও গুপ্তহত্যা। লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।