ইমরানের মন্ত্রী-আম্বানি-শচীনরা সম্পদ গোপন করেছেন!
রূপান্তর ডেস্ক | ৫ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০
বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান ৩৫ রাষ্ট্রপ্রধান, ৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের তিন শতাধিক রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রায় ১০০ ধনকুবেরের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস। এটি ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক দলিলপত্র ফাঁসের ঘটনা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিকদের অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে গোপনে বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য হাজির করা হয়েছে ১৮ মাসের অনুসন্ধানে। প্যান্ডোরা পেপারস ফাঁসের ঘটনায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নথি উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ্বের ১১৭টি দেশের ৬০০ জনের বেশি সাংবাদিক ওয়াশিংটনভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) পক্ষে বিশ্বের ১৪টি কোম্পানির ১ কোটি ২০ লাখ গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্র বিশ্লেষণ করে গত রবিবার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে।
আইসিআইজের এই নথিতে আছে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইন, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী চেরি, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য, চেক রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিচ ও আরও অনেক নাম। প্যান্ডোরা পেপারস দেখিয়েছে কীভাবে বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশ ও ভূখণ্ডের ৩০০ রাজনীতিক অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে গোপনে দেশের বাইরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
রাষ্ট্রপ্রধান : জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইন, ডোমিনিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট লুইস আবিনাদের, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, মন্টেনিগ্রোর প্রেসিডেন্ট মিলো শুকানোভিস, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট গিলার্মো লাসো, কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ডেনিস সাসো এনগুয়েসো, গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলি বনগো অনডিম্বা, চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা, কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনোস্কি।
সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান : প্যারাগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোরাসিও কার্টেস, কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সিজার গাভিরিয়া, পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্ট পেদ্রো পাবলো কুকজিনস্কি, হন্ডুরাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট পোরফিরিও লোবো সোসা, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো মার্টিনেলি, কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস পাস্ত্রানা, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট আর্নেস্তো পেরেজ বাল্লাডারেস, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস ভেরেলা।
বর্তমান সরকারপ্রধান : আইভরি কোস্টের প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিক আচি, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিচ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি।
সাবেক সরকারপ্রধান : যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি, হংকংয়ের সাবেক প্রধান নির্বাহী তুং চি-ওয়া, হংকংয়ের সাবেক প্রধান নির্বাহী লিউং চুন-ইং।
রাজনীতিক : হন্ডুরাসের রাজধানী টেগুসিগাল্পার বর্তমান মেয়র নাসরি আসফুরা, জেরুজালেমের সাবেক মেয়র ও নেসেটের বর্তমান সদস্য নীর বরকত, ব্রাজিলের সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্তো ক্যাম্পোস নেটো, মেক্সিকোর যোগাযোগ ও পরিবহনমন্ত্রী জর্জ আর্গানিস দিয়াজ লিয়াল, আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট মরিসিও ম্যাক্রির পরামর্শক জাইম ডুরান বারবা, ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী পাওলো গুয়েডেস, নেদারল্যান্ডসের অর্থমন্ত্রী ও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক আপিলের নেতা ওপকে হোয়েকস্ত্রা, বেলগ্রেডের সাবেক মেয়র ও অর্থমন্ত্রী সিনিসা মালি, আর্জেন্টিনার সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেমের মেয়ে জুলেমা মারিয়া ইভা মেনেম, আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেস্টর কিরচনার সচিব ড্যানিয়েল মুনোজ, ইসরায়েলের সাবেক ভাইস প্রধানমন্ত্রী ও নেসেটের সাবেক সদস্য হাইম রামন, মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল লোপেল ওব্রাডোরের সাবেক উপদেষ্টা জুলিও স্কেরারা ইবারা, পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন, মালয়েশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী দাইম জয়নুদ্দিন, ফিলিপাইনের পরিবহনমন্ত্রী আর্থার তুগাদে, ফিলিপাইনের নির্বাচন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সুশাসন সংক্রান্ত প্রেসিডেন্ট কমিশনের চেয়ারম্যান আন্দ্রেস ডি বাতিস্তা, কাজাখস্তানে নিযুক্ত ফিলিপাইনের কনসাল ও ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের সহযোগী ব্যবসায়ী ডেনিস উ, শ্রীলঙ্কার পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনবিষয়ক সাবেক উপমন্ত্রী নিরুপমা রাজাপাকসে।
প্যান্ডোরা পেপারসের মধ্য দিয়ে ৬৪ লাখ নথি, ৩০ লাখ ছবি, ১০ লাখের বেশি ই-মেইল এবং প্রায় ৫ লাখ হিসাবের নথি (স্প্রেডশিট) উন্মোচিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এর আওতায় যেসব গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মালিকানা গোপন করে কোম্পানি স্থাপন করেছেন জর্ডানের বাদশাহ। সেখানে ৭ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করেছেন তিনি। আজারবাইজানের শীর্ষস্থানীয় পরিবারের যুক্তরাজ্যে লুকানো সম্পদের পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ডের বেশি। ১ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড ব্যয়ে ফ্রান্সে দুটি বাড়ি কিনতে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর অফশোর বিনিয়োগ কোম্পানি খোলার কথা গোপন রাখা। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তার পরিবার কীভাবে দশকের পর দশক ধরে গোপনে অফশোর কোম্পানিগুলোর মালিকানা ধরে রেখেছে।
প্যান্ডোরা পেপারসে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ধনী ও প্রভাবশালীদের গোপন অর্থ লেনদেনের তথ্য ফাঁস করা হয়েছে। এ তালিকায় নাম রয়েছে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রীর। প্যান্ডোরা পেপারস বলছে, ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়ে লন্ডনে ভবনের মালিকানা নিয়েছিলেন ব্লেয়ার দম্পতি। তথ্য বলছে, টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী চেরি ব্লেয়ার ২০১৭ সালে লন্ডনের একটি ভবনের মালিকানা নেন। ভবনটির সে সময় মূল্য ছিল ৬৫ লাখ পাউন্ড। ভবনটির মালিকানা ছিল বাহরাইনের শিল্প, বাণিজ্য ও পর্যটনমন্ত্রী জায়েদ বিন রশিদ আলজায়ানির। লন্ডনের ভবনটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনেন ব্লেয়ার দম্পতি। এতে তাদের ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর দিতে হয়নি। এ ধরনের লেনদেনে যুক্তরাজ্যে আইনি বৈধতা রয়েছে। আর কর না দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই দম্পতি এমনটি করেছিলেন এমন প্রমাণও মেলেনি।
পেপারসে এসেছে ভারতের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজনের নামও। তাদের মধ্যে রয়েছেন রিলায়েন্স কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান ও ধনকুবের অনিল আম্বানি, পলাতক হীরা ব্যবসায়ী নিরব মোদির বোন, জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা শচিন টেন্ডুলকার। এমনকি রাজনীতিবিদ, আইনবিষয়ক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন এ তালিকায়। যুক্তরাজ্যের একটি আদালতে ভারতীয় ধনকুবের অনিল আম্বানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। তার সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে প্যান্ডোরা। বলা হচ্ছে তার ১৮টি অফশোর কোম্পানির মালিকানা রয়েছে।
ভারত থেকে পালানোর মাত্র এক মাস আগে হীরা ব্যবসায়ী নিরব মোদির বোন একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্যান্ডোরার তালিকায় আছেন ভারতের কোটিপতি উদ্যোক্তা কিরণ মজুমদার সাওয়ের স্বামী জন সাও। তিনি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান বিওকন লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত। জানা গেছে, তিনিও একটি ট্রাস্ট গড়ে তুলেছেন সেখানে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়; প্যান্ডোরা বলছে, তাদের তালিকায় তিন শতাধিক ভারতীয়র নাম রয়েছে। ৬০ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অফশোর হোল্ডিং রয়েছে। তদন্তের পর তাদের নাম প্রকাশ করবে প্যান্ডোরা। ভারতীয় ব্যাংকের কয়েক কোটি রুপির ঋণখেলাপির নামও প্যান্ডোরা পেপারসে রয়েছে। এমনকি কারাবন্দিদের অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে একটি বোম্বারডিয়ার চ্যালেঞ্জার উড়োজাহাজ কেনার তথ্যও রয়েছে। অনেক প্রোমোটর যাতে ঋণখেলাপি না হন, সে জন্য তাদের সম্পদ অফশোর ট্রাস্টে বিনিয়োগ করেছেন। প্যান্ডোরা পেপারসের তালিকায় রয়েছেন ভারতের কয়েকজন রাজনীতিবিদও। তাদের মধ্যে অনেকে পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য। তারা ভারতীয় তদন্ত সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন। প্যান্ডোরার তালিকায় আছেন রাজস্ব বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা, সাবেক কর কমিশনার, ঊর্ধ্বতন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আইনবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তাও।
নেপালের শীর্ষ ধনী বিনোদ চৌধুরীর নাম এসেছে প্যান্ডোরা পেপারসে। তার সঙ্গে কয়েকজন বিদেশির নামও প্রকাশিত হয়েছে। এর একজন বাংলাদেশের। তার নাম আবদুল আউয়াল মিন্টু। তার পরিচয় বলা হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। নেপালি টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য দাবি করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে বিনোদের কিছু কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার তথ্যও প্রকাশ করেছে প্যান্ডোরা পেপারস। সেখানে অংশীদার হিসাবে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তাতে আবদুল আউয়াল মিন্টুর নামও আছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন অর্থ পাচারের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুই প্যান্ডোরা পেপারসের নেপালি ব্যবসায়ীর অংশীদার।
প্যান্ডোরা পেপারসে পাকিস্তানের প্রভাবশালীদের মধ্যে নাম রয়েছে অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন, পানিসম্পদমন্ত্রী মুনিস এলাহি, সিনেটর ফয়সাল ভাওদা, মুসলিম লিগ (এন) নেতা ইশহাক দারের ছেলে আলি দার, পিপিপি নেতা শারজিল মেমন, শিল্পমন্ত্রী খুসরো বখতিয়ারের পরিবার, পিটিআই নেতা আবদুল আলিম খান প্রমুখের। এদের মধ্যে অনেকেই ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। পেপারসে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার নাম আসার জেরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে বিরোধী দল মুসলিম লিগ (নওয়াজ)। গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব আহসান ইকবাল বলেছেন, প্যান্ডোরা পেপারসে ইমরান খানের নাম ছড়ানোয় আর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই।
শেয়ার করুন
রূপান্তর ডেস্ক | ৫ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০

বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান ৩৫ রাষ্ট্রপ্রধান, ৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের তিন শতাধিক রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রায় ১০০ ধনকুবেরের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস। এটি ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক দলিলপত্র ফাঁসের ঘটনা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিকদের অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে গোপনে বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য হাজির করা হয়েছে ১৮ মাসের অনুসন্ধানে। প্যান্ডোরা পেপারস ফাঁসের ঘটনায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নথি উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ্বের ১১৭টি দেশের ৬০০ জনের বেশি সাংবাদিক ওয়াশিংটনভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) পক্ষে বিশ্বের ১৪টি কোম্পানির ১ কোটি ২০ লাখ গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্র বিশ্লেষণ করে গত রবিবার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে।
আইসিআইজের এই নথিতে আছে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইন, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী চেরি, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য, চেক রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিচ ও আরও অনেক নাম। প্যান্ডোরা পেপারস দেখিয়েছে কীভাবে বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশ ও ভূখণ্ডের ৩০০ রাজনীতিক অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে গোপনে দেশের বাইরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
রাষ্ট্রপ্রধান : জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইন, ডোমিনিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট লুইস আবিনাদের, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, মন্টেনিগ্রোর প্রেসিডেন্ট মিলো শুকানোভিস, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট গিলার্মো লাসো, কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ডেনিস সাসো এনগুয়েসো, গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলি বনগো অনডিম্বা, চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা, কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনোস্কি।
সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান : প্যারাগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোরাসিও কার্টেস, কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সিজার গাভিরিয়া, পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্ট পেদ্রো পাবলো কুকজিনস্কি, হন্ডুরাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট পোরফিরিও লোবো সোসা, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো মার্টিনেলি, কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস পাস্ত্রানা, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট আর্নেস্তো পেরেজ বাল্লাডারেস, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস ভেরেলা।
বর্তমান সরকারপ্রধান : আইভরি কোস্টের প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিক আচি, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিচ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি।
সাবেক সরকারপ্রধান : যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি, হংকংয়ের সাবেক প্রধান নির্বাহী তুং চি-ওয়া, হংকংয়ের সাবেক প্রধান নির্বাহী লিউং চুন-ইং।
রাজনীতিক : হন্ডুরাসের রাজধানী টেগুসিগাল্পার বর্তমান মেয়র নাসরি আসফুরা, জেরুজালেমের সাবেক মেয়র ও নেসেটের বর্তমান সদস্য নীর বরকত, ব্রাজিলের সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্তো ক্যাম্পোস নেটো, মেক্সিকোর যোগাযোগ ও পরিবহনমন্ত্রী জর্জ আর্গানিস দিয়াজ লিয়াল, আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট মরিসিও ম্যাক্রির পরামর্শক জাইম ডুরান বারবা, ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী পাওলো গুয়েডেস, নেদারল্যান্ডসের অর্থমন্ত্রী ও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক আপিলের নেতা ওপকে হোয়েকস্ত্রা, বেলগ্রেডের সাবেক মেয়র ও অর্থমন্ত্রী সিনিসা মালি, আর্জেন্টিনার সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেমের মেয়ে জুলেমা মারিয়া ইভা মেনেম, আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেস্টর কিরচনার সচিব ড্যানিয়েল মুনোজ, ইসরায়েলের সাবেক ভাইস প্রধানমন্ত্রী ও নেসেটের সাবেক সদস্য হাইম রামন, মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল লোপেল ওব্রাডোরের সাবেক উপদেষ্টা জুলিও স্কেরারা ইবারা, পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন, মালয়েশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী দাইম জয়নুদ্দিন, ফিলিপাইনের পরিবহনমন্ত্রী আর্থার তুগাদে, ফিলিপাইনের নির্বাচন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সুশাসন সংক্রান্ত প্রেসিডেন্ট কমিশনের চেয়ারম্যান আন্দ্রেস ডি বাতিস্তা, কাজাখস্তানে নিযুক্ত ফিলিপাইনের কনসাল ও ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের সহযোগী ব্যবসায়ী ডেনিস উ, শ্রীলঙ্কার পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনবিষয়ক সাবেক উপমন্ত্রী নিরুপমা রাজাপাকসে।
প্যান্ডোরা পেপারসের মধ্য দিয়ে ৬৪ লাখ নথি, ৩০ লাখ ছবি, ১০ লাখের বেশি ই-মেইল এবং প্রায় ৫ লাখ হিসাবের নথি (স্প্রেডশিট) উন্মোচিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এর আওতায় যেসব গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মালিকানা গোপন করে কোম্পানি স্থাপন করেছেন জর্ডানের বাদশাহ। সেখানে ৭ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করেছেন তিনি। আজারবাইজানের শীর্ষস্থানীয় পরিবারের যুক্তরাজ্যে লুকানো সম্পদের পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ডের বেশি। ১ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড ব্যয়ে ফ্রান্সে দুটি বাড়ি কিনতে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর অফশোর বিনিয়োগ কোম্পানি খোলার কথা গোপন রাখা। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তার পরিবার কীভাবে দশকের পর দশক ধরে গোপনে অফশোর কোম্পানিগুলোর মালিকানা ধরে রেখেছে।
প্যান্ডোরা পেপারসে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ধনী ও প্রভাবশালীদের গোপন অর্থ লেনদেনের তথ্য ফাঁস করা হয়েছে। এ তালিকায় নাম রয়েছে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রীর। প্যান্ডোরা পেপারস বলছে, ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়ে লন্ডনে ভবনের মালিকানা নিয়েছিলেন ব্লেয়ার দম্পতি। তথ্য বলছে, টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী চেরি ব্লেয়ার ২০১৭ সালে লন্ডনের একটি ভবনের মালিকানা নেন। ভবনটির সে সময় মূল্য ছিল ৬৫ লাখ পাউন্ড। ভবনটির মালিকানা ছিল বাহরাইনের শিল্প, বাণিজ্য ও পর্যটনমন্ত্রী জায়েদ বিন রশিদ আলজায়ানির। লন্ডনের ভবনটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনেন ব্লেয়ার দম্পতি। এতে তাদের ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর দিতে হয়নি। এ ধরনের লেনদেনে যুক্তরাজ্যে আইনি বৈধতা রয়েছে। আর কর না দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই দম্পতি এমনটি করেছিলেন এমন প্রমাণও মেলেনি।
পেপারসে এসেছে ভারতের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজনের নামও। তাদের মধ্যে রয়েছেন রিলায়েন্স কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান ও ধনকুবের অনিল আম্বানি, পলাতক হীরা ব্যবসায়ী নিরব মোদির বোন, জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা শচিন টেন্ডুলকার। এমনকি রাজনীতিবিদ, আইনবিষয়ক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন এ তালিকায়। যুক্তরাজ্যের একটি আদালতে ভারতীয় ধনকুবের অনিল আম্বানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। তার সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে প্যান্ডোরা। বলা হচ্ছে তার ১৮টি অফশোর কোম্পানির মালিকানা রয়েছে।
ভারত থেকে পালানোর মাত্র এক মাস আগে হীরা ব্যবসায়ী নিরব মোদির বোন একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্যান্ডোরার তালিকায় আছেন ভারতের কোটিপতি উদ্যোক্তা কিরণ মজুমদার সাওয়ের স্বামী জন সাও। তিনি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান বিওকন লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত। জানা গেছে, তিনিও একটি ট্রাস্ট গড়ে তুলেছেন সেখানে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়; প্যান্ডোরা বলছে, তাদের তালিকায় তিন শতাধিক ভারতীয়র নাম রয়েছে। ৬০ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অফশোর হোল্ডিং রয়েছে। তদন্তের পর তাদের নাম প্রকাশ করবে প্যান্ডোরা। ভারতীয় ব্যাংকের কয়েক কোটি রুপির ঋণখেলাপির নামও প্যান্ডোরা পেপারসে রয়েছে। এমনকি কারাবন্দিদের অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে একটি বোম্বারডিয়ার চ্যালেঞ্জার উড়োজাহাজ কেনার তথ্যও রয়েছে। অনেক প্রোমোটর যাতে ঋণখেলাপি না হন, সে জন্য তাদের সম্পদ অফশোর ট্রাস্টে বিনিয়োগ করেছেন। প্যান্ডোরা পেপারসের তালিকায় রয়েছেন ভারতের কয়েকজন রাজনীতিবিদও। তাদের মধ্যে অনেকে পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য। তারা ভারতীয় তদন্ত সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন। প্যান্ডোরার তালিকায় আছেন রাজস্ব বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা, সাবেক কর কমিশনার, ঊর্ধ্বতন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আইনবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তাও।
নেপালের শীর্ষ ধনী বিনোদ চৌধুরীর নাম এসেছে প্যান্ডোরা পেপারসে। তার সঙ্গে কয়েকজন বিদেশির নামও প্রকাশিত হয়েছে। এর একজন বাংলাদেশের। তার নাম আবদুল আউয়াল মিন্টু। তার পরিচয় বলা হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। নেপালি টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য দাবি করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে বিনোদের কিছু কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার তথ্যও প্রকাশ করেছে প্যান্ডোরা পেপারস। সেখানে অংশীদার হিসাবে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তাতে আবদুল আউয়াল মিন্টুর নামও আছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন অর্থ পাচারের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুই প্যান্ডোরা পেপারসের নেপালি ব্যবসায়ীর অংশীদার।
প্যান্ডোরা পেপারসে পাকিস্তানের প্রভাবশালীদের মধ্যে নাম রয়েছে অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন, পানিসম্পদমন্ত্রী মুনিস এলাহি, সিনেটর ফয়সাল ভাওদা, মুসলিম লিগ (এন) নেতা ইশহাক দারের ছেলে আলি দার, পিপিপি নেতা শারজিল মেমন, শিল্পমন্ত্রী খুসরো বখতিয়ারের পরিবার, পিটিআই নেতা আবদুল আলিম খান প্রমুখের। এদের মধ্যে অনেকেই ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। পেপারসে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার নাম আসার জেরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে বিরোধী দল মুসলিম লিগ (নওয়াজ)। গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব আহসান ইকবাল বলেছেন, প্যান্ডোরা পেপারসে ইমরান খানের নাম ছড়ানোয় আর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই।