
পবিত্র শবেমেরাজ আজ। আজ শনিবার রাতে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত কামনায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে মসজিদে, নিজ গৃহে কিংবা ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোরআনখানি, জিকির-আজকার এবং ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে পবিত্র শবেমেরাজ উদযাপন করবেন।
ইসলাম ধর্মে শবেমেরাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এই মেরাজের মধ্য দিয়েই সালাত বা নামাজ মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয় এবং এ রাতেই প্রতিদিন পাঁচবার নামাজ আদায় করার বিধান নিয়ে আসেন প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)। গতকাল শুক্রবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পবিত্র শবেমেরাজ উদযাপন উপলক্ষে আগামীকাল (আজ) দুপুর দেড়টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ‘পবিত্র শবেমেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মহা. বশিরুল আলম। আলোচক হিসেবে থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল কাদির।
সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার নতুন দুয়ার নগর পরিবহনে মেট্রোরেল উন্মোচন করেছে। বৈদ্যুতিক ট্রেনের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এত কিছুর পরও রাজধানীরজুড়ে সড়কে এখনো দাপিয়ে বেড়ায় ফিটনেসবিহীন বাস। এই নিম্নমানের বাসগুলোর দিকে তাকালে দেশের এবং দেশের বাইরে থেকে আসা অনেকেই ভাবতে পারেন বাংলাদেশে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হলেও সেকালের গরিবি বাসে সয়লাব শহরজুড়ে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে নানা সময় বাসগুলো বন্ধের নির্দেশনা দিলেও সেভাবে মনিটরিং না করায় বছরের পর বছর বাসগুলো সড়কে চলছে। তবে বাস মালিক সমিতি থেকে এই মাসে বাসগুলো বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন সমিতির নেতারা।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেইট, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, সড়কে এখনো ফিটনেসবিহীন বাস প্রকাশ্যে চলছে। মাঝপথে অনেক বাস বন্ধ হতে দেখা যায়। বেশিরভাগ বাসের সিট ভাঙা, নেই ভালো বসার স্থান। আর বাসগুলো থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়ে পরিবেশের মারাত্মক হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে খারাপ বাস চলতে দেখা যায় পুরান ঢাকার বাবুবাজার বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে গাবতলী পর্যন্ত রোডে। এই রোডে শতভাগ বাসের ফিটনেস নেই বললেই চলে।
ভোলার বাসিন্দা মো. যুবায়ের দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার জেলা-উপজেলায় ঢাকার চেয়ে উন্নত মানের বাসগুলো চলে। সিটিতে চলা বেশিরভাগ বাসে ভালোভাবে বসা যায় না। সিটগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। আর কিছু বাস দেখতে সুন্দর হলেও ভেতরে দেখা যায় নানা সমস্যা। এই রকম অবস্থা দেখে আসছি বছরের পর বছর। কোনো উন্নতি নেই এই বাসগুলোর।
ঢাকায় নিয়মিত বাসে চলাচল করা মো. ইমন নামের এক যাত্রী জানান, বাসগুলোর দিকে তাকালে বুঝা যায় সড়কে এত দুর্ঘটনা কেন ঘটে। এই ফিটনেসবিহীন বাসগুলো দিনের পর দিন সড়কে চলছে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। তবে কিছু হলে তেলের অজুহাতে ভাড়া বাড়ান বাস মালিকরা।
সদরঘাট থেকে মিরপুর রোডে চলাচল করা তানজীল পরিবহনের এক বাসচালক মো. তানভির বলেন, ‘মালিক যে বাস দেন সেটি চালাই। এখন পুরনো হোক বা নতুন হোক আমাদের তো আর কিছু বলার নেই। আমি না চালালে অন্য কেউ তো আর বসে থাকবে না।’
পুরান ঢাকার বাবুবাজার থেকে বেড়িবাঁধ দিয়ে গাবতলী পর্যন্ত চলা একটি ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় ‘প্রত্যয় পরিবহন’র একটি বাসের চালক মো. সিফাত দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যাত্রীরা যখন বাসে ওঠেন আমাদের সঙ্গে বাগ্বিত-া লেগেই থাকে বাসের এই অবস্থার জন্য। শুনলাম সামনে নতুন বাস নামাবেন মালিক। এর থেকে বেশি আর বলতে পারছি না।’
বাবুবাজার রোডে চলাচল করা একটি পরিবহনের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ গাড়ি চলে এই রোডে। এই এলাকায় বাস নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। তাদের জন্য নতুন বাস নামানো যায় না। আর এই ফিটনেসবিহীন বাসগুলোর জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয় প্রতিটি জায়গায়।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে শুনে আসছি এসব ফিটনেসবিহীন বাসের বিরুদ্ধে অভিযানের কথা। কিন্তু এই বাসগুলো বন্ধে সেভাবে পদক্ষেপ আজও নিতে দেখিনি। ফলে এই বাসগুলো রাস্তায় চলাচল করায় সড়কে দিনের পর দিন মৃত্যুর মিছিল বেড়েই যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সাইফুন নেওয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মেট্রোরেলের মতো এত অত্যাধুনিক পরিবহন শহরের যোগাযোগে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো সড়কে দেখা যায় সেই পুরনো ফিটনেসবিহীন বাস। এসব বাস বন্ধের জন্য বাস মালিক সমিতি ও বিআরটিএ একসঙ্গে বসে ফিটনেসবিহীন বাসের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করা উচিত। খুব দ্রুত এই বাসগুলোর বিষয়ে মনিটরিং বাড়িয়ে যেগুলো চলাচলের অনুপযোগী, সেগুলোকে অপসারণ করা দরকার।’
চলতি মাসেই ফিটনেসবিহীন বাসের বিরুদ্ধে মনিটরিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এই মাস থেকেই আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। ফিটনেসবিহীন বাস কোনোভাবেই সড়কে চলাচল করতে দেওয়া যাবে না। আর বাবুবাজার রোডে যেসব ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল করে সেগুলো আমাদের সমিতির আওতায় নেই বলে জানান তিনি।
ডলার সংকট এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। প্রায় সব খাতেই খরচ বেড়েছে। নীরবে মূল্যবৃদ্ধির এ ধাক্কা সামলাতে গিয়ে বেসামাল স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত।
আর্থিক সংকটে অনেকে বাধ্য হয়েই পরিবারের নিয়মিত অনেক খরচ কাটছাঁট করেছে। ডিম, বড় মাছ, মাংস, দুধসহ অনেক কিছু নিয়মিত খাবারের তালিকা থেকে হয় বাদ দিয়ে, না হয় কমিয়ে দিয়েছে। সে তালিকায় যোগ হয়েছে কম দামি খাবার।
খরচ বেড়ে যাওয়ায় অন্য খাতে কাটছাঁট করতে গিয়ে অনেকে পাারিবারিক অনুষ্ঠান ও মেহমান দাওয়াত দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে আপতত এসব আয়োজন বন্ধ রেখেছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, খরচ বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না আয়। আর ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বেশি দামে কিনে সামান্য লাভে বিক্রি করলেও দাম বেড়ে যাচ্ছে। তবে অসাধু ব্যববায়ীদের কারসাজিতে অনেক খাতে দাম যতটা বাড়ার, বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি এমন কথাও বলেছেন তারা।
সরকারের নীতি-নির্ধারকদের মতে, এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গত এক বছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছয় মাস ধরে কম-বেশি প্রায় সব খাতে খরচ বেড়েই চলেছে। অথচ ব্যবসায় সুবাতাস নেই। চাকরিতেও বেতন বাড়ার সুখবর তেমন শোনা যায় না। খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না আয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ কষ্টে পড়েছেন বেশি। প্রতি দিনের সংসার খরচ চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে অনেক পণ্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। যা কিনছি তা-ও বেশি দামে। ন্যূনতম লাভে বিক্রি করলেও আগের চেয়ে দাম বেশি পড়ছে। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করে দাম বেশি রাখছেন না। তবে এটা সত্য অনেক সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিয়ে দাম যতটা বাড়ার, তার চেয়ে বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।’
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোটা চালের দাম খানিকটা স্থিতিশীল। কিন্তু গত ছয় মাসে অনেকটাই বেড়েছে। অন্যদিকে শুল্ক কমিয়ে আমদানির সুযোগ বাড়ানোর পরও চালের দাম কমেনি। মিনিকেট নাম দিয়ে বিক্রি করা প্রতি কেজি ভালো মানের চাল দুই মাস আগে ৭২ টাকায় কিনতে পারলেও এখন ৭৮ টাকা। ৭০ টাকা কেজির নাজির শাইল এখন ৭৫-৮০ টাকা।
এক বছরের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। এক কেজি প্যাকেটজাত আটার দাম ৭০ টাকা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর দেওয়া বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বেশি দামে আটা কিনতে না পারায় দেশের মানুষের বড় অংশ রুটি, বিস্কুট ও আটা-ময়দা থেকে তৈরি খাদ্য কম খাচ্ছে। দাম বেশি থাকায় আটার তৈরি খাবারের বদলে মানুষ ভাত খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে।
ছয় মাসে প্রায় সব ধরনের বিস্কুটের দাম বেড়েছে গড়ে ২০-৩০ টাকা। চানাচুরের দাম প্রতি কেজিতে ৪০-৫০ টাকা এবং মুড়ির দাম প্রতি কেজিতে ২৫-৩০ টাকা বেড়েছে।
এক বছরে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ ভাগ। সর্বশেষ ৭ টাকা বেড়ে বোতলজাত এক লিটারের দাম এখন ১৮৭ ১৯০ টাকা। আর খোলাটা লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৮০ টাকা।
শীতকাল শেষ। কিন্তু শীতে ভরা মৌসুমেও অনেকের সাধ্যের বাইরে ছিল শাকসবজি। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রতিবেদন বলছে, দেশে খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে ৬৮ শতাংশ মানুষ। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং আয় না বাড়ায় নানাভাবে সাশ্রয়ের চেষ্টা করছে। যেমন সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, এক মাস আগে ঢাকার বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৬০-৭০০ টাকা। আর খাসির মাংসের দাম ছিল ৯০০-১০০০ টাকা। এখন খাসির মাংসের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০০-২০০ টাকা। আর এক মাসের ব্যবধানে বাজারে গরুর মাসের দাম বেড়ে হয়েছে কেজি ৭০০-৭৫০ টাকা।
ফার্মের মুরগি, ডিম, দুধ ও মাছের মতো সব ধরনের প্রোটিনজাতীয় খাবারের দাম চড়া। তেলাপিয়া, পাঙাশের মতো মাছ কিংবা অ্যাংকর ডালও সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বড় আকারের তেলাপিয়া মাছের দাম কেজিপ্রতি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। বাদামি রঙের ডিমের ডজন ১৪৫-১৫০ টাকা। এক মাস আগেও প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১১০-১১৫ টাকা। সাধারণ মানুষের প্রোটিনের বড় আরেকটি উৎস ব্রয়লার মুরগি। কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৪০ টাকা। টিসিবি বলছে, মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৬০ টাকার মধ্যে। কম নেই সোনালি মুরগির দামও। গত মাসে ২৬০ কেজি দরে বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগির দাম এখন ৩৫০ টাকায় ঠেকেছে। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা।
তরল দুধের দাম এক বছরে লিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) এক লিটার দুধের দাম এখন ৯০ টাকা। টিসিবির হিসাবে, এক বছরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে ২৭-৩৫ টাকা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, আট ধরনের প্রাণিজ আমিষে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে দেশের মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার।
সব ধরনের প্যাকেটজাত মসলার দাম বেড়েছে। প্যাকেটজাত মসলার দাম গড়ে প্রতি কেজি বেড়েছে ১৩০ টাকা। মসুরের ডাল রকমভেদে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ২৮ টাকা। চিনির দাম দফায় দফায় বেড়ে এখন খোলা ১১০ ও প্যাকেটজাত ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা, রসুন ও আদার দাম কেজিতে ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে। ৩৫০ টাকার প্রতি কেজি জিরা এখন ৫৫০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লবণের দাম বেড়েছে কেজিতে ৬ টাকা।
এক বছরে খাদ্যপণ্যের সঙ্গে খাদ্যবহির্ভূত সব ধরনের খরচও বেড়েছে। সাবান, শ্যাম্পু, দাঁতের মাজন, শাড়ি, গয়না, স্যান্ডেল, জুতাসহ প্রায় সব ধরনের পোশাকের দাম বেড়েছে।
গায়ে মাখা সাবানের দাম গড়ে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। গুঁড়া সাবানের দাম বেড়েছে ৬০-৭০ টাকা। ৭০০ গ্রাম শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ১৫০ টাকা।
নতুন বছরের শুরুতে কমবেশি বাসাভাড়া ও বেশির ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন বাড়ানো হয়েছে। খাতা, কলম, পেনসিলসহ প্রায় সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম আগের চেয়ে বেশি। খাতার দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। বল পয়েন্ট কলমের দাম বেড়েছে ১ থেকে ২ টাকা। গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা।
চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছে অনেকে। প্রাথমিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধ এখন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্যারাসিটামলের মতো অধিক ব্যবহৃত ওষুধের দামও বেড়েছে। ৫০০ এমজির প্যারাসিটামল প্রতিটি ট্যাবলেট ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ২০ পয়সা হয়েছে। মেট্রোনিডাজল ৫০০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড-আগে ছিল ১ টাকা ৬৬ পয়সা, এখন ২ টাকা। কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশেরও বেশি; অর্থাৎ আগে যে দামে ওষুধ কেনা যেত, এখন তার চেয়ে দ্বিগুণ টাকা গুনতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা থাকে সরকারের হাতে। ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, এক্সিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময়মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণে ওষুধের খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যই বলছে, গত বছর মে মাসের পর থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা যখন দিশাহারা, এ অবস্থায় জ¦ালানি ও বিদ্যুতের মতো কৌশলগত পণ্যের ভর্তুকি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে বাড়ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, তার চারজনের পরিবারের খাবার খরচ আগের চেয়ে অন্তত ৭ হাজার টাকা বেড়েছে। কিন্তু আয় তো আর এত টাকা বাড়েনি।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এনইসি সম্মেলন কক্ষে ডেভেলপমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ডিজেএফবি) আয়োজিত উন্নয়ন সংলাপে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম মূল্যস্ফীতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত বছরের (২০২২ সালের) জানুয়ারি মাসে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন উপকরণের দাম বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছিল।
কেউ কেউ সবসময় খুঁজে ফেরে পাদপ্রদীপের আলো, কেউ থাকতে ভালোবাসেন নিভৃতচারী হয়ে। সৈয়দ আশরাফুল হক দ্বিতীয় দলের মানুষ। ক্রিকেট খেলেছেন, ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে, এখনো ক্রিকেট প্রশাসনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন। কিন্তু কখনোই এই নিয়ে তাকে আত্মম্ভরী কথাবার্তা বলতে শোনা যায়নি। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদাপ্রাপ্তির পেছনেও সৈয়দ আশরাফুল হকের ক্রিকেট কূটনীতির অবদান অনেক। অথচ নিভৃতচারী এই মানুষ বলতে গেলে হারিয়েই গেছেন দেশের ক্রিকেট অঙ্গন থেকে, যেখানে এখন শুধুই মৌসুমি ক্রিকেটপ্রেমীদের দাপট।
আসলে সৈয়দ আশরাফুল হক মানুষটাই এমন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে বন্ধু আব্দুল হালিম জুয়েলদের সঙ্গে তিনিও যেতে চেয়েছিলেন রণাঙ্গনে। কিন্তু মাত্র ফেব্রুয়ারি মাসেই বিয়ে করা আশরাফুলকে রণাঙ্গনে যেতে দেননি জুয়েল। আশরাফুলের ভাষায়, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি বিয়ে করি। জুয়েল ছিল আমার বিয়ের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু জুয়েল বলেছিল, ‘নতুন বিয়ে করেছিস। যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নেই। তুই ঢাকায় থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে পারিস।’ তাই সরাসরি রণাঙ্গনে না গিয়েও ঢাকায় থেকেই ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধাদের অনেক রকম সহায়তা করেছেন আশরাফুল, নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছেন অপারেশনে। সেনা টহলের মুখে পড়লে কাজে দিত ক্রিকেটার পরিচয়টা, জানান আশরাফুল। তিনি বলেন, ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক গেরিলাই আমার বন্ধুবান্ধব ছিল। ওদের নানাভাবে সাহায্য করেছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে শহীদ রুমি ছিলেন আমার খুব পরিচিত। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে অনেক সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। কতবার যে নিজে গাড়ি চালিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের রসদ নানা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি! একবার তো প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিলাম। মোহাম্মদপুর থেকে কিছু স্টেনগান আর গ্রেনেড তুলেছি গাড়িতে। ওগুলো ছিল বাজারের চটের ব্যাগে। পথে একটা সেনা চেকপোস্টে গাড়ি দাঁড় করাতে হলো। আমি ভেতরে-ভেতরে শেষ। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে সৈনিককে বললাম, ‘আমি ক্রিকেটার। পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলি।’
যুদ্ধ শেষ হলো, স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেট দলের প্রথম বিদেশ সফরের দলে নিজ যোগ্যতাতেই জায়গা করে নিলেন আশরাফুল। ‘আসলে আমার মনে হয় ১৯৭৯ সালের আইসিসি ট্রফির দলে আমিই ছিলাম একমাত্র ক্রিকেটার যার ইংল্যান্ডে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। আমি ইংল্যান্ডে পড়ার সময় মিডলসেক্স কাউন্টির লিগে স্থানীয় একটা দলের হয়ে খেলেছি। আমরা ফিজিকে হারাই আর মালয়েশিয়াকে হারাই। আমি মনে করি ডেনমার্ক ও কানাডার বিপক্ষেও আমাদের জেতা উচিত ছিল’, এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন আশরাফুল হক। ফিজির বিপক্ষে অফস্পিনে আশরাফুল নিয়েছিলেন ২৩ রানে ৭ উইকেট যা দীর্ঘদিন বাংলাদেশের সেরা বোলিং নৈপুণ্যের রেকর্ড হিসেবে টিকেছিল। সেসময়ের ক্রিকেটে এখনকার মতো টাকা-পয়সার ঝনঝনানি ছিল না। নৌবাহিনীর ব্যারাকে অনুশীলন, অনেকটা সৈনিক জীবনের মতো শারীরিক প্রশিক্ষণেই হতো দিনের শুরু। সাতসকালে ঠান্ডা পানিতে গোসল করার সেই দিনগুলোই আইসিসি ট্রফির আগে দলটাকে শারীরিকভাবে প্রস্তুত করেছিল বলেই বিশ্বাস আশরাফুলের, যদিও আক্ষেপ আছে সেই সফরে দলের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো না করার।
ক্রিকেটার জীবনের ইতি টানেন ৮০’র দশকে। এরপরই আশরাফুল হকের সঙ্গে দেখা হয় এমন একজনের, যার সংস্পর্শে এসে ক্রিকেট কূটনীতি আর অর্থনীতির অন্দরমহলে অবাধ প্রবেশাধিকার পেয়ে যান। সেই মানুষটির নাম জগমোহন ডালমিয়া, ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি। যার হাত ধরে ক্রিকেটে লেগেছে বিশ্বায়নের ছোঁয়া। আশরাফুল হকের সঙ্গে ডালমিয়ার পরিচয় ৮০’র দশকেই। ‘আমি তখন আজাদ বয়েজ স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। ক্রিকেট বোর্ডের আমন্ত্রণে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিএবি) একটি দল আসে ঢাকায়, তখন ডালমিয়া ঢাকায় আসেন। সেই থেকে পরিচয়, এরপর তো বলা যায় আমরা এক পরিবারের মতোই হয়ে গেলাম’, বললেন আশরাফুল।
ডালমিয়ার হাত ধরেই ক্রিকেট কূটনীতির অন্দরমহলে নিত্য যাতায়াত শুরু হয় সৈয়দ আশরাফুল হকের। ডালমিয়াই বুঝেছিলেন, ক্রিকেট খেলাটাকে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মুঠো থেকে বের করে আনতে হবে, বুঝতে পেরেছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেটের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। ১৯৯৬ সালে উপমহাদেশের তিন দেশÑ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা মিলে আয়োজন করল ক্রিকেট বিশ্বকাপ। জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ইডেন গার্ডেনসে। চোখ ধাঁধানো লেজার শো আর মিস ইউনিভার্স সুস্মিতা সেনের হাতে অংশগ্রহণকারী সব দলের অধিনায়কের পতাকা। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পুরো আয়োজন একা সামলেছেন ‘অ্যাশ’ নামে পরিচিতি পাওয়া আশরাফুল। তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সব দায়িত্ব উনি (ডালমিয়া) দিলেন আমার হাতে। অথচ কে আমি? বাংলাদেশ তো খেলছেই না! সবটাই হয়েছে ডালমিয়ার জন্য, উনি আমাকে রেখেছেন তাই কেউ কিছু বলেনি। কারণ উনিই ছিলেন বিশ্বকাপের প্রধান আয়োজক, স্থানীয় আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক।’
সফল সেই বিশ্বকাপ আয়োজনের পর ১৯৯৮ সালে ঢাকায় হলো প্রথম মিনি বিশ্বকাপ বা আইসিসি নকআউট ট্রফি, যা এখন চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নামে পরিচিত। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর খুলে গেল ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে খেলার দরজা, সেখানে পাকিস্তানকে হারানোর পর দাবি উঠল টেস্ট মর্যাদার। কেনিয়া এবং নেদারল্যান্ডসও টেস্ট মর্যাদার জোরালো দাবিদার, সেখানে কীভাবে বাংলাদেশ তাদের আগে টেস্ট মর্যাদা পেয়ে যায় সেই লম্বা গল্পটাও শুনিয়েছেন আশরাফুল হক। ‘১৯৭৬ সালে আইসিসির বার্ষিক সভাতেই বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা নিয়ে আলোচনা হয়। যেহেতু বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল এবং পরে স্বাধীন হয়েছে, আর পাকিস্তান টেস্ট মর্যাদাপ্রাপ্ত দেশ তাই বাংলাদেশও টেস্ট মর্যাদা পাবে। এই ছিল আলোচনা, কিন্তু অনেকগুলো দেশ এতে রাজি হয়নি এবং বলা হয় আগে বাংলাদেশকে আইসিসির সহযোগী সদস্য হতে। তারপর যখন ১৯৯৭ সালে আমরা আইসিসি ট্রফি জিতলাম তখন আবার এই প্রসঙ্গটা আসল। আমি সাবেরকে (সাবের হোসেন চৌধুরী) বললাম যে, আমাদের একজনকে আইসিসির ডেভেলপমেন্ট কমিটিতে থাকতে হবে কারণ এই কমিটিই সহযোগী সদস্যদেশগুলো থেকে পরের ধাপে যেতে মনোনয়ন দেবে। একজন কমিটিতে থাকলে ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের জন্য কাজ করা সহজ হবে। সাবের বলল, ‘আমার তো এখানে প্রথমবার, এখানেই কেউ আমাকে চেনে না। তুমিই নির্বাচন কর।’ নির্বাচনে আমি সবচেয়ে বেশি ভোট পেলাম। এরপর কমিটি থেকে যখন কেনিয়া ও নেদারল্যান্ডসের নাম উত্থাপন করার প্রস্তাব হয় তখন আমি বাধা দিয়ে বললাম, না, বাংলাদেশের নাম প্রস্তাব করা হোক। বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতেছে,’ স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন আশরাফুল। এভাবে নানান কৌশলে ও কূটনীতিতে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের প্রধানদের সম্মতি আদায় করে, আইসিসির প্রণীত কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করে অবশেষে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদার দ্বার খুলতে পারেন সাবের-আশরাফুল জুটি। ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা না পেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট যে অনেকখানি পিছিয়ে পড়ত তার প্রমাণ তো হাতের কাছেই আছে। কেনিয়া যে হারিয়েই গেছে ক্রিকেট থেকে আর বাংলাদেশের পর আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে ২০১৭ সালে। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর ক্রিকেটের যে জোয়ার এসেছিল, টেস্ট মর্যাদা না পেলে তাতে নিশ্চিতভাবেই ধরত ভাটার টান।
১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের যুবদলের বিপক্ষে খেলতে বাংলাদেশে এসেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উদীয়মান ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া একটি দল। সেই দলে খেলেছিলেন ইমরান খান। ইমরানকে আশরাফুল বলেছিলেন, ‘এরপর ঢাকায় আসতে ভিসা লাগবে।’ ইমরান হেসে উড়িয়ে দিলেও পরে লন্ডনে ঠিকই আশরাফুলকে বলেছিলেন যে, সেনাবাহিনীর এসব কাজকর্মের ব্যাপার তিনি জানতেন না। এই প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে ইমরানের আত্মজীবনীতেও।
খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিকেট মাঠে এবং সংগঠক হিসেবে ক্রিকেট কূটনীতিতে সুদক্ষ ও কৌশলী আশরাফুল হক কর্মসূত্রে বেশিরভাগ সময়ই থাকেন মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের বাঁকবদলের নেপথ্যের নায়ক এখন কাজ করছেন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেইসহ নানান দেশে ক্রিকেট ছড়িয়ে দিতে। অথচ তার মাপের সংগঠকের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল বাংলাদেশের, কেন পেলেন না সেই প্রশ্ন না হয় তোলাই থাক।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নিরপেক্ষ সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপিসহ বর্তমান সরকারবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। আজ শনিবার ঢাকার বাইরে সারা দেশের সব মহানগরে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর গোপীবাগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি আয়োজিত পদযাত্রা কর্মসূচি-পূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘দেশে কীভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। যাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছে, তিনি নিজেও তা জানতেন না বলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। এ থেকে প্রমাণ হয় বর্তমান সংবিধানে দেশ চলবে না। সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের উত্থাপিত ২৭ দফার আলোকে সংবিধান পরিবর্তন করে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে।’
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আজ ক্ষমতাসীনদের চুরির কারণে ব্যাংক খালি, ডলার নেই। ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না। দেশে আজ গণলুট চলছে। এরা যখনই ক্ষমতায় আসে, তখনই দেশের সম্পদ লুট করে। একদিকে দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলছে, মানুষ গরিব হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। তারা বলে উন্নয়ন উন্নয়ন, এমন উন্নয়ন হয়েছে যে মানুষ আজ বিদ্যুৎ পায় না, পানি পায় না, গ্যাস পায় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।’ বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে ১৫ বছরে অনেক অত্যাচার হয়েছে দাবি করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জনগণকে বাসা থেকে বের হতে হবে, জেগে উঠতে হবে। কারণ সরকার দেশকে ফতুর বানিয়ে ফেলেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা প্রশাসনকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং পুলিশকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, আমরা এটি চাইনি, এটি জাতির জন্য লজ্জাকর, তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে র্যাব ও পুলিশকে দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। এবারও আমেরিকায় অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ দাওয়াত পাইনি, এতে বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়। যে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ হয়েছে, সেই গণতন্ত্র হরণের অভিযোগেই গণতন্ত্র সম্মেলনে দাওয়াত পায়নি বাংলাদেশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ সারা দেশেই অত্যাচার হচ্ছে, চলছে নৈরাজ্য। আওয়ামী লীগ মূলত সন্ত্রাসী দল। এরা কখনোই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি। এরা সব সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। গত কয়েক মাসে তারা আমাদের ১০ জন নেতাকে হত্যা করেছে। বেআইনি ও গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারপরও আন্দোলন থামানো যাচ্ছে না। কারণ এই আন্দোলন শুধু বিএনপির নয়, গণতন্ত্রকামী সব জনতার।’
‘আমার অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশের মানুষ হাসে। আমাদের পরিষ্কার কথা এই সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না। দেশের অনেক ক্ষতি করেছেন। শুধু নিজ পরিবার ও নেতাদের লুটের কারণে দেশ আজ ফোকলা হয়ে গেছে। দেশের মানুষের কোনো উন্নয়ন হয়নি, আপনাদের উন্নয়ন হয়েছে।’
‘বিএনপি আন্দোলন করতে পারে না’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি আন্দোলন করতে না পারলে আপনারা কেন পাহারার নামে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামেন। তাহলে কেন পাহারা দেন? এখনো সময় আছে, দেয়ালের লিখন পড়েন। সারা দেশের মানুষ নেমে পড়েছে। সময় থাকতে পদত্যাগ করুন, নতুবা রেহাই পাবেন না।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করেছেন, তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশান্তরি করে রেখেছেন। তাতে কি আন্দোলন বন্ধ করতে পেরেছেন? বিএনপি কি ভেঙে গেছে; বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে।’
সমাবেশ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু হয়। এতে অংশ নেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না প্রমুখ।
গোপীবাগ ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব মাঠ থেকে টিকাটুলি-রাজধানী মার্কেট (র্যাব-৩ অফিসের সামনে দিয়ে) স্বামীবাগ-দয়াগঞ্জ-বানিয়ানগর-মোড় সাদেক হোসেন খোকা মাঠের পাশ দিয়ে ধোলাইখাল-রায়সাহেব বাজার চৌরাস্তা-তাঁতীবাজার মোড় হয়ে নয়াবাজার গিয়ে পদযাত্রা শেষ হয়। এর আগে বেলা ১টার পর থেকেই নেতাকর্মীরা এসে জড়ো হতে থাকেন মতিঝিল এলাকায়। এ সময় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি মোশাররফের : গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির উদ্যোগে উত্তরায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পদযাত্রা কর্মসূচি করেন দলটির নেতাকর্মীরা। পদযাত্রার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। দাবি মানা না হলে আন্দোলনের মাধ্যমে রাজপথেই ফয়সালা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনার অধীনে এ দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। বিএনপি কর্মসূচি দিলেই আওয়ামী লীগ শান্তির নামে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে উসকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। যারা ভোট ডাকাত, তারা কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে না।’
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব আমিনুল হকের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত পদযাত্রা-পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ।
সভা শেষে পদযাত্রা শুরু হয়ে ১১ নম্বর সেক্টর জমজম টাওয়ারের সামনে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন জ্যেষ্ঠ নেতারা।
সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর পদযাত্রা : গতকাল বিকেলে রাজধানীর পূর্বপান্থপথে এফডিসিসংলগ্ন এলডিপির কার্যালয়ের সামনে থেকে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) পদযাত্রা শুরু হয়। এরপর মগবাজার হয়ে মালিবাগ মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন দলটির সভাপতি ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। এতে নেতৃত্ব দেন এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। মোস্তফা মোহসিন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম রাজধানীর মতিঝিলে আরামবাগের নিজস্ব দলীয় কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে।
১২-দলীয় জোটের পদযাত্রা আজ : একই দাবিতে আজ শনিবার বেলা ১১টায় রাজধানীতে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করবে ১২-দলীয় জোট। বিজয়নগর পানির ট্যাংকিসংলগ্ন রাস্তা থেকে পদযাত্রা শুরু হয়ে পুরানা পল্টন মোড়, আজাদ প্রোডাক্টসের গলি ঘুরে কালভার্ট রোড হয়ে ফের পানির ট্যাংকির সামনে গিয়ে শেষ হবে।
সরকার পতনের দাবিতে রাজপথে থাকা বিএনপিকে নষ্ট রাজনীতির হোতা আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এদের কাছে গণতন্ত্র, জনগণ কেউই নিরাপদ নয়।’ তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড লু (যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী) বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। আমেরিকার এ দূতের সঙ্গে কথা বলতে বিএনপি অনেক চেষ্টা করেছিল, সফল হয়নি। বিএনপি ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিং এলাকায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘শান্তি সমাবেশে’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। দলের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা এ সমাবেশের আয়োজন করে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, বর্তমান সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকা-ে দেশের মানুষ খুশি, শুধু মন খারাপ বিএনপির। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী চলা সংকটেও দেশের মানুষ শেখ হাসিনার ওপর খুশি। শেখ হাসিনার সততায় খুশি। শেখ হাসিনার উন্নয়নে খুশি। মন খারাপ শুধু বিএনপির। তাদের মন খারাপ। উন্নয়ন দেখলে তাদের ভালো লাগে না, অন্তজ্বালায় ভোগে।’
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প তুলে ধরে সেতুমন্ত্রী বলেন, ১৪ বছর আগের ও পরের মোহাম্মদপুর, দিনরাতের পার্থক্য। মোহাম্মদপুর এখন আলোয় আলোকিত। এটা এখন ডিজিটাল নগরী। এ নগরী এখন উন্নয়নের ঝলকে আলোকোজ্জ্বল। মোহাম্মদপুর, আদাবরের যেদিকেই তাকাবেন উন্নয়ন, শুধু উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন বলেই এত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি বাংলাদেশেকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। মেয়েদের দমিয়ে রাখতে চায়। অথচ শেখ হাসিনা নারীদের অধিকার নিশ্চিত করেছেন।’ তিনি বলেন, শেখ হাসিনা মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছেন। তার মাধ্যমে আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন বিদেশি চ্যানেলে দেখতে পায়। তিনি মাতারবাড়ীতে, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানিয়েছেন, শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিতের লক্ষ্যে রূপপুর, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়েছেন। শেখ হাসিনাই একদিনে ১০০ সেতু, ১০০ রাস্তা উদ্বোধন করেছেন। সংকটের সময়েও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে জ¦ালানি, খাদ্যশস্য কিনছেন। কিন্তু দিচ্ছেন কম দামে।
তিনি বলেন, ‘তারেক জিয়া হচ্ছে খাম্বা ব্যাপারী। তাদের কাজ ছিল লুটপাট করা। হাওয়া ভবনের আরেক নাম খাওয়া ভবন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর ছেলেমেয়েরা চাকরি করে খায়, তারা ব্যবসা করে না, সাধারণ জীবনযাপন করেন।’ সেতুমন্ত্রী বলেন, এখন বিএনপির মুখে আবার খই ফুটেছে। তাদের আন্দোলনের নদীতে এখন আর জোয়ার নেই। এ বছর না আগামী বছর, কোন বছর আন্দোলন হবে জানা নেই। তাদের সবকিছুই ভুয়া। শেখ হাসিনা গণতন্ত্র নিশ্চিত করেন, অন্য কিছু নয়।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য সাদেক খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
জনগণের জানার অধিকার রয়েছে কাকে কোনো প্রকল্পের কাজ দেওয়া হচ্ছে, কার সঙ্গে কী চুক্তি হচ্ছে এবং তা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির কোনো কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছে না। অদক্ষভাবে বিদ্যুৎ চুক্তির কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে আয়োজিত ‘নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ (খসড়া) : এটি কি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কোনো একটি পক্ষকে সুবিধা দিয়ে কাজ দেওয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বিদ্যুতের বড় ঘাটতি মেটাতে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের প্রয়োজন ছিল। তবে বর্তমানে আইনটি অদক্ষতার জায়গা তৈরি করছে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটির মতে, জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। কোনো কোনো পক্ষ পাচ্ছে বাড়তি সুবিধাও। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করার দাবি জানিয়ে সিপিডি বলছে, নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- এমন চুক্তিতে গেলে বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরকার সরে আসতে পারবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৯ সালে জরুরি বিদ্যুৎ আইনের প্রয়োজন ছিল। ওই সময় বড় রকমের বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, সেটা মেটানোর জন্য চুক্তির দরকার ছিল। এরপর চারবার নবায়ন হয়েছে ওই আইন। আমরা মনে করি, এখন যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এরকম চুক্তির আর প্রয়োজন নেই।
দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আইন থেকে সরকারের সরে আসা দরকার। এই আইন বিভিন্নভাবে সমস্যা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর আগেও যেগুলো হয়েছে- সেগুলো এখন সরকারের জন্য বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ। এর মূল কারণ এই দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন।
সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক বলেন, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কাজ করছে সরকার। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির সমন্বয় করা হচ্ছে ভোক্তার ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে। ভুল পলিসির কারণে এমনটি হচ্ছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে ব্যাপক হারে। সেটির দায় ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনটি যদি অবলোপন করে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- চুক্তির দিকে যদি যাওয়া যায়, তাহলে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে। ফসিল ফুয়েল থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে গেলে বড় রকমের ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা শুনে এসেছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্য সবচেয়ে কম। অথচ নতুন চুক্তির অধীনে আমরা যে ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আনা শুরু করলাম, সেটার মূল্য তো ১৫ টাকা। এটা তো বোধগম্য না কী করে এরকম মূল্য, এরকম জায়গায় আমরা চুক্তি করতে পারি।
জ্বালানি চুক্তি খোলামেলা হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো চুক্তির ডকুমেন্টস আমরা পাই না। কী রেটে চুক্তিগুলো করা হচ্ছে- জনগণের সেটা জানার অধিকার রয়েছে।
নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ এর খুঁটিনাটি তুলে ধরে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এতে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো কতটা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে করা হচ্ছে, তা আলোচনা হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণ, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ২০০৮ সালে গৃহীত পলিসির আওতায় সামগ্রিক উৎপাদনের ৮ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এটা পলিসির ব্যর্থতা।
তিনি আরও বলেন, নতুন নীতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের কথা বলা হয়েছে। শুধু সোলার বলেই ছেড়ে দেওয়া হয়নি। রুফটফ সোলার, নেট মিটারিং, মিনি গ্রিড, ন্যানো গ্রিড, সোলার ইরিগেশন, চার্জিং স্টেশন, স্ট্রিট লাইটে রিনিউয়েবল এনার্জি, ফ্লোটিং সোলার সিস্টেম- এরকমভাবে ডিটেইল বলা আছে। একইভাবে উইন্ড এনার্জি, বায়োমাস এনার্জি, বায়ো ফুয়েলের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির কিছু নতুন উৎসের কথাও এখানে বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে আগামীতে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথা বলা হয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। এতে কিছু টার্গেটের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির ক্ষেত্রে কিছু টার্গেট দেওয়া হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কথা এতে উল্লেখ রয়েছে জানিয়ে এই গবেষণা পরিচালক বলেন, স্রেডাকে এখানে নোডাল এজেন্সি বলা হয়েছে। আমরাও তাই মনে করি। কিন্তু স্রেডাকে সব ধরনের ক্যাপাসিটি দিতে হবে। বড় পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রস্তাবনা দেখভাল করার ও অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা স্রেডাকে দেওয়া উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার দরকার আছে। তবে এই সংস্কার আবার খসড়া প্রস্তাবে অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, নুতন নীতিতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের আবার নীতি সংস্কার হয়েছে। মন্ত্রণালয় তার হাতে কর্তৃত্ব নিয়ে ফেলছে। এর ফলে রেগুলেটরি কমিশনের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানি নীতিতে যে গাইডলাইন দেওয়া আছে, আর সরকার এখন যেভাবে দাম নির্ধারণ করেছে, তাতে এটা এখন উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করছে।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসি-২০২২ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান বিদ্যুৎ খাতে যে সংকট রয়েছে তা অনেকটাই কমে যাবে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তে এখনো পিছিয়ে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে ২২৭ জন। সে হিসাবে দেশে যক্ষ্মা শনাক্তের হার ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ বা ৩৭ হাজার ৫০০ শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৪ শতাংশ বা দেড় হাজারের বেশি নয়। অর্থাৎ এখনো ৬ শতাংশ বা ২২ হাজার ৫০০ শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের বাইরে রয়েছে। এর অর্থ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও শনাক্ত না হওয়ায় এসব শিশু চিকিৎসা পাচ্ছে না।
অবশ্য দেশে শিশু রোগীর সংখ্যার সঠিক কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। গত এক বছরে কত শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, সে তথ্যও নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশে শিশু যক্ষ্মার এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তে লক্ষ্যমাত্রা থেকে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মাহফুজার রহমান সরকার। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা মোট যক্ষ্মা রোগীর ৮ শতাংশ বা তার বেশি যেন শিশুদের যক্ষ্মা নির্ণয় করতে পারি। কিন্তু বাচ্চাদের শনাক্ত কম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আছি।
এ কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশে ৪ শতাংশ বা তার কিছু বেশি শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করতে পারছি। মোট যে শনাক্তের হার, তার ৮ শতাংশ (বেসরকারি হিসেবে ১০ শতাংশ) শিশু হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে ৪ শতাংশের মতো। বাকি ৪ শতাংশ শনাক্ত হচ্ছে না।
শনাক্ত কম হওয়ার কারণ হিসেবে এই কর্মকর্তা বলেন, শিশুরা বলতে পারে না বা উপসর্গ বোঝে না, আবার অভিভাবকরাও সচেতন না। ফলে বেশিরভাগ শিশু শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। অথচ সার্বিক ক্ষেত্রে আমাদের যক্ষ্মা শনাক্ত হার অনেক বেশি। অনেক দেশের চেয়ে ভালো আছি। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী আমাদের মোট শনাক্তের হার ৮২ শতাংশ।
অবশ্য শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তের হার বাড়ানোর জন্য নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে জানান সরকারের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, শিশুদেরও যে যক্ষ্মা হতে পারে, সে তথ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচার করা হচ্ছে। আগে শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তের হার আরও কম ছিল। কিন্তু এখন আমরা যেভাবে কাজ করছি তাতে সামনের দুই-এক বছরের মধ্যে শনাক্তের হার আরও বাড়বে।
এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। ১৮৮২ সালে ২৪ মার্চ ডা. রবার্ট কক যক্ষ্মা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করেন। এর ১০০ বছর পর ১৯৮২ সাল থেকে এই দিনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়Ñ ‘হ্যাঁ! আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।
১ বছরে ১ লাখ রোগী কমেছে : জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে। কর্মসূচির হিসেবে, গত বছর বাংলাদেশে নতুন ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩১ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে । এ সময় যক্ষ্মার উপসর্গ আছে এমন ২৯ লাখের বেশি লোকের নমুনা পরীক্ষা করে এ রোগী শনাক্ত হয়েছে। সে হিসাবে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশ।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির হিসেবে, এর আগের বছর ২০২১ সালে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৩ লাখ ৭৫ হাজার। সে হিসাবে গত এক বছরে দেশে যক্ষ্মা রোগী কমেছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৬৯ জন। চিকিৎসা নিরাময়ের হার গত ১০ বছর ধরে ৯৫ শতাংশের বেশি আছে। সর্বশেষ গত বছর তা আরও বেড়ে ৯৭ শতাংশ হয়েছে।
গত বছর সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে ঢাকা বিভাগে, ৭৪ হাজার ৯৪৫ জন ও সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগে, ১৬ হাজার ৪৯১ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ৪৮ হাজার ৯৩৮, রাজশাহীতে ২৭ হাজার ৫৪৫, খুলনায় ২৭ হাজার ১১৭, রংপুরে ২৬ হাজার ৮২৮, সিলেটে ২২ হাজার ২০৭ ও ময়মনসিংহে ১৮ হাজার ৩৬০ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এখনো শনাক্তের বাইরে ২০% রোগী : এখন পর্যন্ত দেশে মোট রোগীর ৮০ শতাংশকে শনাক্ত করতে পারছে সরকার ও বাকি ২০ শতাংশ শনাক্তের বাইরে রয়েছে। ফলে এই ২০ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসা পাচ্ছে না। এমনকি তাদের মধ্যে ঠিক কী পরিমাণ রোগী মারা যাচ্ছে, সে তথ্যও পাচ্ছে না সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে যক্ষ্মা নির্মূলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে সার্বিক শনাক্ত শতভাগ পূরণ করতে হবে। সব রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনতে না পারলে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে মোট শনাক্ত যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী ২২৭ জন। সে হিসাবে মোট রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ জন। কিন্তু সে বছর শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার। সে হিসাবে এখনো শনাক্তের বাইরে ৯৩ হাজার ৭৫০ জন। অর্থাৎ এই ২০ শতাংশ রোগী এখনো সরকারের শনাক্ত ও চিকিৎসার নেটওয়ার্কের মধ্যে আসেনি।
প্রতি ১২ মিনিটে যক্ষ্মায় মরছে ১ জন : গত ১০ বছরে দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু কমলেও এখনো এ সংখ্যা উদ্বেগজনক। গত ২০২১ সালে যক্ষ্মায় মারা গেছেন ৪২ হাজার মানুষ। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির হিসেবে, চিকিৎসার মাধ্যমে ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রায় ২৩ লাখ যক্ষ্মা রোগীকে বাঁচানো গেছে। ২০১৫ সালে যেখানে প্রতি ১ লাখে ৪৫ জন লোকের মৃত্যু হতো, সেখানে ২০২১ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু প্রতি লাখে ২৫ জনে নেমে এসেছে। কিন্তু এখনো দেশে প্রতি মিনিটে একজন ব্যক্তি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি ১২ মিনিটে যক্ষ্মার কারণে একজন মারা যাচ্ছে।
যক্ষ্মা নির্ণয় ও চিকিৎসা বিনামূল্যে : যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, দেশে সরকারিভাবে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এ ব্যয় সরকার বহন করে। মানুষ এ সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু অনেক সময় মানুষ এ তথ্য জানে না। সে জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যক্ষ্মা পরীক্ষার ব্যবস্থা জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও আছে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকর্তারা জানান, যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে বাংলাদেশে ৫১৮টি জিনএক্সপার্ট মেশিন, ১ হাজার ১১৯টি মাইক্রোস্কোপ, ২০৫টি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন ও ৩৮টি ট্রুনেট মেশিন রয়েছে। এসব পদ্ধতিতে যক্ষ্মার প্রায় ৮২ শতাংশ রোগী শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও একটি ন্যাশনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি ও পাঁচটি রিজিওনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরির মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, সরকারি চারটি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, সাতটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এবং সরকারি সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও এনজিও ক্লিনিকে বিনামূল্যে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা দিচ্ছে সরকার।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফজালুর রহমান জানান, যক্ষ্মা শনাক্ত হওয়ার পর প্রতিটি রোগীকে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি নিয়মিত ওষধু সেবন করার জন্য প্রতিটি রোগীর সঙ্গে একজন ডটস প্রোভাইডার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে রোগী শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে যক্ষ্মায় মৃত্যুহার কমে এসেছে এবং চিকিৎসার সাফল্যের হার বেড়েছে। এ উদ্যোগ বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এ সাফল্যের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার (এমডিআর টিবি) হারও কমে এসেছে।
কেন শিশুরা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে : এ ব্যাপারে রাজধানীর শ্যামলী ২৫০ শয্যার টিবি ও অ্যাজমা হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যক্ষ্মা বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি। রোগটা সাধারণত মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে। এই জীবাণু যেকোনো অঙ্গেই সংক্রমিত হতে পারে। তবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত শিশুরা তাদের লক্ষণগুলো বুঝিয়ে বলতে পারে না, তাই প্রায়ই তাদের ক্ষেত্রে এ রোগটি নির্ণয় করতে দেরি হয় এবং উপেক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। বিশ্বব্যাপী মোট যক্ষ্মা রোগীর ১২ শতাংশ শিশু। কিন্তু বাংলাদেশে সঠিকভাবে শনাক্ত না হওয়ার কারণে এ হার চার শতাংশের মতো। শিশুদের হার আরও বেশি হবে বলে মনে করা হয়।
এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, শিশুর শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু প্রবেশ করে বড়দের কাছ থেকে। ফুসফুসে আক্রান্ত একজন যক্ষ্মা রোগীর সংস্পর্শে এলে শিশুর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তবে বড় শিশুদের তুলনায় এক মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এরকম শিশুরা তাদের সময়ের একটা বড় অংশ পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় ও খেলার সাথীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সময় কাটায়। এ ছাড়া এমন বয়সী শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বড় শিশুদের তুলনায় কম থাকে। অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদের যক্ষ্মার ঝুঁকি বেশি। কারণ অপুষ্টি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক