
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় শিরিন ম্যানশন নামের একটি বাণিজ্যিক ভবনের তিনতলায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়েছেন। তারা ওই তলায় অবস্থিত নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মী। ভবনের একটি অংশ ধসে ছিটকে পড়ে দুপাশের সড়কে।
বিস্ফোরণে পথচারীসহ আহত হয়েছেন অর্ধশত ব্যক্তি। এর মধ্যে অন্তত পঁচাজন দগ্ধ হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ১৬ জনকে। তাদের মধ্যে দুজন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। গতকাল রবিবার সকাল ১০টা ৫২ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয় বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। বিস্ফোরণের পরই আগুন ধরে যায় ভবনটিতে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ঘটনার পর তাৎক্ষণিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল ছুটে যান। জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণটি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল। বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা নয় বলে দাবি করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার।
আগের দিনই চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন বেশ কয়েকজন।
গতকাল সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর ভবনটির চারদিকে ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। ভবনের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে দুপাশের সড়কে। ধসে পড়ে ভবনের তিনতলার দেয়ালের ইট-বালু ও আসবাবপত্র। কিছু সময় পর দেখা যায় কয়েকজন ভবনের সামনের সড়কের ওপর অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। ভবনটির দুই পাশ দিয়ে থাকা সড়কের অনেক পথচারীও আহত হন।
ঘটনার সময় ভবনটির নিচে ছিলেন রিকশাচালক জিয়া রহমান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি রিকশা নিয়ে দাঁড়ায় ছিলাম। হঠাৎ এমন একটা বেকট (বিকট) শব্দ হলো, এরপর চারিদিক ধুলায় ভরে গেল। আমি রিকশা ফেলায় দিছি দৌড়। বাইচা গেছি।’
ধানমন্ডি থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিস্ফোরণে আহতদের তাৎক্ষণিক ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। নিহত তিনজন হলেন নিউ জেনারেশন কোম্পানির কম্পিউটার অপারেটর শফিকুজ্জামান শফিক (৪৫) ও তুষার, অফিস সহকারী আবদুল মান্নান (৬৫)।
আহতদের অনেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও ধানম-ির পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গুরুতর আহত ১৬ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আয়েশা আক্তার আশা, হাফিজুর রহমান, জহুর আলী, সৈয়দ আকবর আলী ও সৈয়দ আশরাফুজ্জামান।
বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, পাঁচজনকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই থেকে তিনজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। সবাইকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন নুরনবী, তাজুদ্দিন, মেহেদী হাসান, জাকির হোসেন জুয়েল, কামাল, কবীর হোসেন, রাবেয়া খাতুন, তামান্না ও অজ্ঞাতনামা একজন।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের পাশেই শিরিন ম্যানশন নামের তিনতলা বাণিজ্যিক ভবন। ভবনটি পুরাতন ও জরাজীর্ণ। বিস্ফোরণ হওয়া তৃতীয়তলায় ফিনিক্স ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এবং নিউ জেনারেশন কোম্পানি অফিস। দোতলায় রয়েছে সেলুন, লন্ড্রি আর নিচতলায় খাবারের হোটেল, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাকের দোকান, হস্তশিল্প ও তাঁতজাত পণ্যের বিপণিবিতান। ভবনটির তিনতলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেয়ালের ইট ও জানালার কাচ উড়ে গিয়ে রাস্তা ও আশপাশের এলাকায় পড়েছে। আশপাশের দোকানিরা জানান, ভবনটির নিচে বেশ কয়েকজন হকার ছিল। তারাও আহত হয়েছে।
পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পর আহতদের উদ্ধার করে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। তাদের মধ্যে তিনজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তারা সবাই দগ্ধ ছিলেন বলে জানান জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। এ ছাড়া তিনজন এখনো চিকিৎসাধীন। তারা হলেন মো. হান্নান, মাহাবুবুন্নবী ও স্বপ্না রানী সাহা।
হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মো. কামরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ৩৫ থেকে ৪০ জনকে চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের মধ্যে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় দুজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে এবং একজনকে এইচডিওতে রাখা হয়েছে। তাদের শরীর ও মাথা আঘাতে থেঁতলে গেছে।’
হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি : গতকাল দুপুরে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকতেই দেখা যায় স্বজনদের আহাজারি। মৃত্যুর সংবাদ শুনে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন তারা। নিহত শফিকুজ্জামান শফিকের স্বজনরা জানান, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন সাভারের গেন্ডারিয়ায়। তার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী সদর থানার ধুলদি লক্ষ্মীপুরে। মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন স্ত্রী পপি জামান। তার কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতাল এলাকা।
নিহত আবদুল মান্নান গত ২২ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছিলেন বলে স্বজনরা জানান। তার ছেলে মোসাদ্দেক হোসেন আশিক জানান, পুরান ঢাকার চকবাজার থানা এলাকার ইয়াসিন ব্যাপারীর গলিতে তাদের বাসা। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন মান্নান। পরে মৃত্যুর খবর পান তারা। তিনি বলেন, টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ দিন আগে তার বোন মনিরা মারা গেছেন। সেই শোক না কাটতেই বাবার মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। নিহত আরেকজন তুষারের বাড়ি নরসিংদী।
বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে সিটিটিসির বক্তব্য : ঘটনার পর সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট এবং সিবিআরএন ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সেখানে গ্যাস ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। সাধারণত কোনো ঘরে বা আবদ্ধ স্থানে যদি কোনোভাবে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ঘনত্বে গ্যাসের অবস্থান থাকে, সে ক্ষেত্রে যেকোনো ইগনিশন সোর্সের (বৈদ্যুতিক সুইচ, শর্টসার্কিট, দেশলাই, লাইটার) মাধ্যমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ঘটনাস্থল বিশ্লেষণে প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরণের সূত্রপাত ভবনের তিনতলার ফিনিক্স ইনসিওরেন্স লিমিটেডের অফিস থেকে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিটিটিসির বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থলে কোনোরূপ বিস্ফোরকের উপস্থিতি ছিল না বলে নিশ্চিত হয়েছে। বিস্ফোরণের তীব্রতা ও ব্যাপকতা পর্যালোচনায় গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ বলে সিটিটিসির বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে মতামত দিয়েছেন।
ঘটনাস্থলে আসা সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের নেতৃত্বে থাকা অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রহমতউল্লাহ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার ভবনগুলো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ, সেখানে যেকোনো কারণে গ্যাস তৈরি হতে পারে। আমরা ধারণা করছি জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে, কারণ এত বড় বিস্ফোরণ গ্যাস থেকেই সম্ভব। তবে এসির গ্যাস থেকে এমন বিস্ফোরণ হয় না। স্যুয়ারেজের লাইন বা অন্য কোনো কারণে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে।’ নাশকতার কোনো আলামত এখনো মেলেনি বলে জানান তিনি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর একই দাবি করে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনাটি নাশকতা নয়, এটি একটি দুর্ঘটনা। বিস্ফোরণের ঘটনাটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে আমরা একটা কমিটি করব। তদন্ত কমিটি ফায়ার সার্ভিস এবং ঘটনাস্থলে কাজ করা এক্সপার্টদের মতামত নেবে। পরে তারা একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।’
নিউ জেনারেশন কোম্পানির এরিয়া সেলস ম্যানেজার শাহিনুর রহমান দেশ রূপান্তরকে জানান, লিরা ব্র্যান্ডের পেনসিল, রাবার, ইরেজার, জ্যামিতি বক্স, ফাইল, স্ট্যাপলারসহ এ জাতীয় বিভিন্ন পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে বিক্রি করেন তারা। বিস্ফোরণ হওয়া অফিসটাতে কোনো মালামাল ছিল না।
ফিনিক্স ইনসিওরেন্স কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট (পাবলিক রিলেশনস) মো. মাহাবুব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমাদের ছয়জন কর্মী অফিসে ছিল বলে জানতে পেরেছি। তারা সবাই আহত হয়েছেন। অফিসে দুই টন করে চার টনের দুটি এসি ছাড়া আর কিছুই নেই। কোনো গ্যাস সিলিন্ডার বা দাহ্য পদার্থ ছিল বলে আমার জানা নেই।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে সরকার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে না পারলে সংস্থাটি ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করবে না। প্রথম কিস্তির ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদনের আগে এ শর্ত দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। সরকার রাজি হওয়ায় ঋণ অনুমোদন এবং প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় করেছে সংস্থাটি।
আগামী ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের কথা রয়েছে। এখন দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন নির্দেশনা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে দফায় দফায় বৈঠক।
সূত্র জানায়, আইএমএফের শর্ত মানতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে আরেক দফা। রাজস্ব খাতের সংস্কারে এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একের পর এক হিসাব কষছে। আইএমএফের কথামতো অতিরিক্ত রাজস্ব কোন খাত থেকে আদায় করা সম্ভব তার যোগ-বিয়োগ করছে। আসছে বাজেটে কোন কোন খাতে ভ্যাট অব্যহতি কমানো যায় তা নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে।
রাজস্ব খাতে আইএমএফের শর্তপূরণ করতে হলে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে হবে। এর মধ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ করতে হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত দিয়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এ অর্থবছরে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে বলেছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত আরও ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে।
আইএমএফের এসব হিসাব সামনে রেখে চলতি অর্থবছরের গত ৯ মাসের ১৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি সামনে রেখেও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরার চিন্তা চলছে। এতে আসছে অর্থবছরেই লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে কি না তা নিয়ে চলছে বৈঠক। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে এবং ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপাস্তকে বলেন, ‘বাস্তব অবস্থার ওপর নির্ভর করে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কাউকে খুশি করতে গিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলে তা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না।’
আইএমএফের কথামতো নিয়মিত আদায়ের সঙ্গে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে এরই মধ্যে আয়কর আইন সংশোধন করে চূড়ান্ত করার কাজটি দ্রুত শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। সংস্থাটি কাস্টমস বা শুল্ক আইনের কাজটিও দ্রুত শেষ করতে বলেছেন। ঋণদানকারী সংস্থার সন্তুষ্টিতে এরই মধ্যে রাজস্ব জালের বিস্তার করতে ২০২৩ সালেই আরও ২০ লাখ করদাতা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। দাতা সংস্থার শর্ত মানতে বড়মাপের কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। রাজস্ব ফাঁকিবাজ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এনবিআরে তলব করে পাওনা পরিশোধে বলা হয়েছে।
এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইসি), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং ভ্যাট গোয়েন্দা শাখার কাজে গতি বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দাতা সংস্থার প্রস্তাব অনুসারে সম্ভাবনাময় বৃহৎ ও মাঝারি করদাতা চিহ্নিত করার কাজে জোর বাড়ানো হয়েছে। রাজস্ব আদায় কার্যক্রম মনিটরিং, আমদানি পর্যায়ে মিথ্যা ঘোষণা ও অবমূল্যায়ন সম্পর্কিত কার্যক্রম কঠোর নজরদারিতে, করদাতাদের সেবা বৃদ্ধি ও করদাতাদের সঙ্গে (খাতভিত্তিক) বেশি বেশি আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে রাজস্ব জালের বাইরে থাকা অনিবন্ধিত নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো জরিপে চিহ্নিত করে নিবন্ধিত কর শুরু করা হয়েছে।
ঋণ প্রদানের আগেই আইএমএফের শর্ত দেওয়া হয়েছে, নতুন করে কোনো খাতেই আর শুল্ক-ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। বর্তমানে যেসব খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে, তা কমাতে হবে বা তুলে নিতে হবে। আইএমএফের এ প্রস্তাবে কোন কোন খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে তা যাচাই-বাছাই করে এনবিআরের তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নেই। উৎপাদন খাতে পোশাকশিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, লিফট, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতাভুক্ত থাকায় ভ্যাট জিডিপি তথা কর জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না বলেও প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআর থেকে হিসাব করা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ওপর বড় ধরনের চাপ না তৈরি করেও আইএমএফের শর্ত কতটা মানা সম্ভব।
অর্থ পাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে জোরালো চাপ দিয়েছে আইএমএফ। ঋণদানকারী সংস্থাকে সন্তুষ্ট করতে এরই মধ্যে অর্থ পাচারে কে বা কারা জড়িত তার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে ৩৩টি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাজে গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। অর্থ পাচারকারীর এসব ব্যক্তির সন্ধানে তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অতীতে পানামা, প্যারাডাইসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ পাচার সম্পর্কিত কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের যেসব নাগরিকের নাম উঠে এসেছিল তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়াও শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংক খাতে সংস্কার, সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া, টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, প্রকল্পের কেনাকাটায় জবাবদিহি, স্বচ্ছতা আনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভিযোজন ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাংক খাতের কী সংস্কার করা সম্ভব এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন কতটা সংশোধন করা সম্ভব তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কাজ করছে।
আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে এ বছরের ডিসেম্বরে আর শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। এসব কিস্তির পরিমাণ ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে পাশে থাকবে কাতার। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি ৫ : সম্ভাবনা থেকে সমৃদ্ধি) পঞ্চম জাতিসংঘ সম্মেলনের পাশাপাশি গতকাল রবিবার কাতার ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে (কিউএনসিসি) কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল সানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে এ আশ্বাস দেওয়া হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি কাতারের আমিরকে উদ্ধৃত করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাতারের আমির বলেছেন, আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। কাতার সব সময় বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
মোমেন বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কাতারের কাছ থেকে আরও বেশি জ্বালানি, বিশেষ করে বার্ষিক আরও এক মিলিয়ন মেট্রিক টন (এমটিএ) তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বলেছেন, আমরা কাতারের সাহায্য চাই। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ জ্বালানি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আমি চুক্তি নবায়ন করতে চাই। আমি আরও এলএনজি চাই। জবাবে কাতারের আমির জানতে চান বাংলাদেশ কতটা জ্বালানি চায়। তাকে বলা হয়, বাংলাদেশ আরেকটি এমটিএ অর্থাৎ ১৬-১৭ কনটেইনার জ্বালানি চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে আমির বলেন, আপনার কাতার ছাড়ার আগে জ্বালানিমন্ত্রী এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করবেন।
অনুদান নয় স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের প্রাপ্য চায় : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনুদান নয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রকৃত কাঠামোগত রূপান্তরের জন্য তাদের প্রাপ্য চায়। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোও দর-কষাকষিতে তাদের পক্ষ রাখবে। আমাদের দেশগুলো দান চায় না; আমরা যা চাই তা হলো আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির অধীনে আমাদের পাওনা।’
প্রধানমন্ত্রী গতকাল কিউএনসিসিতে এলডিসি ৫ : সম্ভাবনা থেকে সমৃদ্ধি পঞ্চম জাতিসংঘ সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণে এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দোহা কর্মসূচি বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য আশার আরেকটি আশ্বাস। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই এলডিসিতে বাস্তব কাঠামোগত রূপান্তরের জন্য তার প্রতিশ্রুতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এলডিসিতে উত্তরণে তাদের পারফরম্যান্সের জন্য কিছু প্রণোদনা থাকা উচিত। তাদের একটি বর্ধিত সময়ের জন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সহায়তা ভোগ করা উচিত। তাদের উন্নত বিনিয়োগ এবং উৎপাদনশীল সক্ষমতা কীভাবে তৈরি করা যায় তা জানতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য কিছু উদ্ভাবনী ও ক্রান্তিকালীন অর্থায়ন ব্যবস্থা থাকতে পারে। তবে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বৈশ্বিক বাণিজ্যে তাদের অংশ দ্বিগুণ করার জন্য টেকসই সহায়তা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর এলডিসির জন্য ওডিএ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে হবে। খবর বাসসের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঋণ টেকসই করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যম রয়েছে। এলডিসিগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নকে নমনীয় এবং অনুমানযোগ্য করা উচিত। এলডিসিগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তর বাস্তব এবং অর্থপূর্ণ হওয়া দরকার। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের তাদের অধিকার এবং মঙ্গলের জন্য সুরক্ষা প্রয়োজন। আমরা এলডিসিতে ২২৬ মিলিয়ন যুবকদের ব্যর্থ করতে পারি না।’
বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারী এবং তারপর ইউক্রেনের যুদ্ধ এলডিসি অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু সংকট এবং কিছু স্বল্পোন্নত দেশে দীর্ঘকাল ধরে টানা সংঘাত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের গল্পের বেশির ভাগ অংশই আমরা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য আলোচনা করেছিলাম এবং সহযোগিতার জন্য আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরেছি। বেশির ভাগ উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতি থেকে আমরা যে শুল্ক এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছি, তা আমাদের বেসরকারি খাতকে একটি দৃঢ় উৎপাদন ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ট্রিপস চুক্তির অধীনে প্রদত্ত পেটেন্ট মওকুফ সুবিধা স্থানীয়ভাবে আমাদের ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করার সুযোগ করে দিয়েছে। অপর ডব্লিউটিও চুক্তির অধীনে রেয়াতগুলো আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিগত সহায়তা পেয়েছি, তা আমাদের সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১ দশমিক ২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই মহতী সমাবেশে আপনার সঙ্গে থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমি কাতার সরকার ও জনগণকে তাদের উদার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘লিঙ্গবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে রয়েছি। আমাদের সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ। আমাদের জনগণের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছরের বেশি। কভিড-১৯ মহামারীকালে তার সরকার বাংলাদেশের জিডিপির ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ সমান অর্থব্যয়ে ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের পরবর্তী ভিশন-২০৪১ সালের মধ্যে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা। সম্মেলনের সভাপতি ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল সানি উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস, ইউএনজিএর সভাপতি সাবা করোসি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সভাপতি লাচেজারা স্টোয়েভা এবং মালাবির প্রেসিডেন্ট ও এলডিসি গ্রুপের চেয়ারপারসন লাজারাস ম্যাকার্থি চাকাওয়েরা বক্তৃতা করেন।
অবহেলাতেই প্রাণ গেল ছয়জনের। আহত ২২ জনের মধ্যে চোখ হারাল তিনজন। অক্সিজেন সেপারেশন কলামে যখন অক্সিজেন এসে জমা হচ্ছিল, সেই অক্সিজেন বের হওয়ার জন্য যে পাইপগুলো ছিল একপর্যায়ে তা বের হতে না পেরেই প্রবল শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে কলামটি। আর ১০০ ফুট উচ্চতার এ কলামটি ছিল লোহার শিটের তৈরি। এই শিটগুলো যখন প্রবল বেগে ছোটে, তখন শেডের লোহার পাতগুলো কারখানার রডের ছাউনিগুলোকে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর লোহার আঘাতে চারপাশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গতকাল রবিবার উদ্ধার কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর ঘটনাস্থলে কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, এ কলামটি (অক্সিজেন সেপারেশন কলাম) বিস্ফোরিত হয়েছিল। এটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু ছিল। প্রায় ১৪ বর্গফুট আয়তনের এ কলামটিতে অক্সিজেন এসে জমা হতো। একই সঙ্গে দুটি পাইপ দিয়ে আসত বাতাস। আর দুটি পাইপ দিয়ে উৎপাদিত অক্সিজেন দুটি ডেলিভারি পয়েন্টে চলে যেত। সেই ডেলিভারি পয়েন্টে প্রায় ২৪টি সিলিন্ডারে একসঙ্গে অক্সিজেন রিফিল করা যায়। এই প্ল্যান্টে দুটি ডেলিভারি পয়েন্ট ছিল; অর্থাৎ ৪৮টি সিলিন্ডারে একসঙ্গে অক্সিজেন রিফিল করা হচ্ছিল। অক্সিজেন রিফিল হয়ে গেলে পাশেই ট্রাক দাঁড়ানো থাকত সেই ট্রাকে উঠিয়ে দেওয়া হতো বলে জানান মিজানুর রহমান নামের এক শ্রমিক।
বিস্ফোরণ কেন হলো : বিস্ফোরণের কারণ জানতে চাইলে কারখানার শ্রমিক আহমদ মিয়া কলামটিকে দেখিয়ে বলেন, এই কলামে এসে অক্সিজেন জমা হচ্ছিল। সেই অক্সিজেন কোনো না কোনো কারণে ডেলিভারি পয়েন্টে যাচ্ছিল না। কোথাও ব্লকেজ হয়েছিল। ব্লকেজ হয়ে যাওয়ায় কলামের ভেতরে অক্সিজেনের চাপ বেড়ে যায় এবং বিস্ফোরণ হয়। কিন্তু চাপ বেড়ে গেলে তো পাশের অপারেটর বসা ছিলেন। তিনি কলামের পাশের জায়গায় আঙুল প্রদর্শন করে বলেন, এখানে বসত অপারেটর। তাহলে আমার প্রশ্ন, ডেলিভারি পয়েন্টে যে সিলিন্ডার রিফিল হচ্ছিল না, তা অপারেটর খেয়াল করেনি কেন? এই প্রশ্নের জবাবে পাশে থাকা ফোরকান নামের আরেক শ্রমিক বলেন, ডেলিভারি পয়েন্টে যে শ্রমিক কাজ করছিল, সে সুইচ অন করে বসেছিল, সে হয়তো খেয়াল করেনি। একইভাবে অপারেটরও বিষয়টি জানত না। আর এতেই দুর্ঘটনা ঘটে।
কিন্তু হঠাৎ করে ব্লকেজ কেন হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে মিজানুর রহমান নামের আরেক শ্রমিক জানান, গত পাঁচ বছরে এই সেপারেশন কলাম চেক করা হয়নি বলে জানেন। হয়তো দীর্ঘদিন মেইনটেন্যান্স না করার কারণে তা ব্লকেজ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অক্সিজেন সেপারেশন কলামেই বিস্ফোরণ হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে গ্যাস জ্যাম হয়ে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। তারপরও আমরা আরও কিছু বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে এর আগে কোনো অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। তাই এখানে কেন ঘটল, আমরা তা শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।’
কারখানা ব্যবস্থাপকের ভাষ্য : দুর্ঘটনার পর থেকে সীতাকুন্ডের কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না কিংবা পরিচয় দিয়ে কেউ সামনে আসছিল না। গতকাল সকালে কারখানার ব্যবস্থাপক আবদুল আলিম সংবাদকর্মীদের সামনে শনাক্ত হওয়ার পর বলেন, ‘আমাদের কারখানার সরকারের সব দপ্তরের (বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস) ছাড়পত্র রয়েছে। সাধারণত অক্সিজেন প্ল্যান্টে দুর্ঘটনা ঘটে না। তারপরও কেন ঘটল তা আমরা বুঝতে পারছি না।’
তদন্ত কমিটির ভাষ্য : সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল রবিবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে কী পেয়েছেন, সে বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ সময় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান বলেন, ‘পুরো তদন্ত শেষ না করা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এই প্ল্যান্টের পাশাপাশি আগামীতে যাতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে এবং কীভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেই সুপারিশ থাকবে আমাদের রিপোর্টে।’
এদিকে গতকাল সকালেই উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করা হয়েছে। তবে ধ্বংসস্তূপ থেকে আর কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি। এমনকি কেউ আহত অবস্থায়ও ছিল না। ফলে গত শনিবারের বিস্ফোরণে ছয়জনের মৃত্যু ও ২২ জন আহত হয়েছে। এই প্ল্যান্ট থেকে শিল্পকারখানায় অক্সিজেন সরবরাহ করা হতো। এ ছাড়া শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার জন্যও এই অক্সিজেন ব্যবহৃত হতো। চট্টগ্রামে বেসরকারিভাবে আবুল খায়ের, লিন্ডে, স্পেকট্রা, মোস্তফা হাকিম, আল রাজিসহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন উৎপাদন করে। এর আগে গত বছরের ৪ জুন পাশর্^বর্তী বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল।
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জামাত (কাদিয়ানি) আয়োজিত সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের পর গত শনিবার দিনভর পরিস্থিতি ছিল অনেকটা স্বাভাবিক। তবে রাত ৯টার দিকে একটি গুজবকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ দুজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে রাতে এমন গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই গুজব ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই বিক্ষুব্ধ জনতা সড়ক অবরোধ করে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় জেলা শহরের দোকানপাট। এ সময় একদল দুর্বৃত্ত শহরের কদমতলায় ওয়াকার শোরুমসহ আহমদিয়াদের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে মালামাল লুটপাট করে। এ ছাড়া ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। জেলা শহরের প্রেস ক্লাব সড়কে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বিক্ষোভকারীদের। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের অ্যাকশনে পিছু হটে বিক্ষোভকারীরা। এমন পরিস্থিতিতে গত শনিবার মধ্যরাত থেকে পঞ্চগড়ে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল।
তবে গতকাল রবিবার সকাল থেকে শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সাপ্তাহিক দুদিন ছুটির পর গতকাল সরকারি-বেসরকারি দপ্তর খোলা থাকায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরে ভিড় বাড়তে থাকে। অবশ্য শহরে মানুষজনের উপস্থিতি তুলনামূলক অন্যান্য দিনের চেয়ে ছিল কিছুটা কম।
এদিকে হত্যা, বাড়িঘর ভাঙচুর করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ট্রাফিক পুলিশ অফিস ভাঙচুর করে আগুন দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে পঞ্চগড় সদর থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে আহমদিয়াদের পক্ষ থেকে একটি এবং পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছে। তিনটি মামলায় নামপরিচয় উল্লেখসহ এবং অজ্ঞাতপরিচয় মিলে আসামির সংখ্যা প্রায় সাত হাজার বলে পুলিশ জানিয়েছে। আহমদিয়াদের মামলার বাদী হয়েছেন ওসমান গনী নামে এক ব্যক্তি। এই মামলায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের যুবক প্রকৌশলী জাহিদ হাসানকে হত্যার ঘটনায় আটক করা হয়েছে দুজনকে। তারা হত্যার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনায় আরও কয়েকজন জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে পুলিশ গ্রেপ্তারদের পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানায়নি।
অন্যদিকে গুজব রটনার অভিযোগে পৌর যুবদল নেতা ফজলে রাব্বীকে (৩০) এবং তেঁতুলিয়া থেকে আরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় আরও ১৯ জনকে আটক করা হয়েছে।
পঞ্চগড় সদর থানার ওসি আবদুল লতিফ মিঞা বলেন, ‘যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের সঙ্গে বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে সতর্ক আছেন। এখন পর্যন্ত থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন। মামলার আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘গুজব ঠেকাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’ ইন্টারনেটসেবা বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অপারেটররা নিজে থেকে ইন্টারনেটসেবা বন্ধ করেছে। আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই।’
বিএনপি-জামায়াত গুজব ছড়িয়েছে দাবি রেলপথমন্ত্রীর : আহমদিয়াদের সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা গুজব ছড়িয়ে তৌহিদি জনতার নামে বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি করেছেন রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। গতকাল বিকেলে পঞ্চগড় জেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত শান্তি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই দাবি জানান রেলপথমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত ধর্মের নামে, ইসলামের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি এবং আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস করে নিজেদের ফায়দা লুটতে চায়। তারা সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের এই অপচেষ্টা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে।’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। গতকাল রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় দিনের উদ্ধার অভিযানে হতাহত কাউকে উদ্ধারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদিকে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ১৮ জনের মধ্যে ৭ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল ইসলাম। সাতজনের মধ্যে মো. মাসুদ ও প্রভাষ নামে দুই শ্রমিককে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। গুরুতর আহত অন্য পাঁচজন হলেন মো. আরাফাত আলম, জাহিদ হাসান, মো. ওসমান, মো. মজিবুর রহমান ও ফ্যান্সি।
আগ্রাবাদ কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে, বিস্ফোরণের ঘটনায় আগুন নির্বাপণের পরও আগ্রাবাদ ও কুমিরা স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছিল। এখন আর দুর্ঘটনার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও কারণ তদন্তসাপেক্ষে পরে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন ফায়ার স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা।
হাসপাতালের চিত্র: গতকাল রবিবার দুপুরে চমেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আহতরা বিভিন্ন ওয়ার্ডের বেডে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। বিস্ফোরণে কারও থেঁতলে গেছে পা, কারও উড়ে গেছে হাত, কেউ পেয়েছেন মাথায় আঘাত। আবার কেউ অগ্নিদগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন বার্ন ইউনিটের বিছানায়। তাদের সুস্থ করে তুলতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান দেশ রূপান্তরকে জানান, বিস্ফোরণে আহত ২১ জনকে গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে তিনজন গতকালই মারা গেছেন। বাকি ১৮ জন বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
আহতদের কাতরাতে দেখে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড। ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে কথা হয় আহত শ্রমিক মো. ফোরকানের সঙ্গে। তার হাত ও আঙুলে ব্যান্ডেজ। তিনি জানান, শনিবার বিকেলে কারখানায় কাজ করছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণের পর তার আর কিছু মনে নেই। চমেক হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফেরার পর দেখেন তার বাম হাতের দুই আঙুল উড়ে গেছে। পাশের বেডে কাতরাচ্ছেন মাসুদ। তার ডান পা উড়ে গেছে। কথা বলতে পারছিলেন না তিনি।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন মো. জাহেদ। তার চিকিৎসা চলছিল চমেকের ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে। জাহেদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শনিবার বিকেলে কারখানায় কাজ করছিলেন তিনি। হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণের পর আর কিছু মনে নেই তার। গতকাল রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে তার জ্ঞান ফেরে। তার পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ। চিকিৎসকরা জানান, জাহেদের অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে।
২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অপারেটর রিপন। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। বুক, কোমর ও হাঁটুতেও আঘাত পেয়েছি।’
চমেক হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, আহত ১৮ জনের মধ্যে ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে ৭ জন, অর্থোপেডিক্স বিভাগে ২ জন, নিউরো সার্জারি বিভাগে ৬ জন ও চক্ষু বিভাগে ৩ জন। আহত অন্য শ্রমিকরা হলেন মো. নূর হোসেন (৩০), মোতালেব (৫২), জসিম উদ্দিন (৪৫), নারায়ণ (৬০), মো. ফোরকান (৩৫) ও শাহরিয়ার (২৬)।
গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে গেলে এমন বীভৎসতার চিত্র দেখা মেলে। বিস্ফোরণে মুখম-ল থেঁতলে গেছে আকতারের। তার সারা শরীরে ঢুকেছে কাচ ও লোহার টুকরা। ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে চিরতরে। দুই চোখ ও থুতনি ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মুখমন্ডলে রক্তের দাগ। বাম চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে গতকাল বিকেলে। চিকিৎসকরা বলেছেনÑডান চোখ দিয়ে পৃথিবীর আলো আর দেখবেন না আকতার। এমন খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তার ছোটভাই আজাদ হোসেন। চোখের যন্ত্রণায় হাসপাতালের বিছানায় ভাইকে কাতরাতে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারছেন না আজাদ। তার দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। স্বামীর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আকতারের স্ত্রীও শাড়ির আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মুছছেন।
চমেকের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তনুজা তানজিন জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে আজাদসহ তিনজনের একটি করে চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাদের চোখে কাচ ঢুকে নার্ভ কেটে গেছে। তবে তিনজনের চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাকি দুজন হলেন নাহিন শাহরিয়ার ও সোলায়মান। এর মধ্যে নাহিন ও আকতার সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের শ্রমিক। সোলোয়মান ট্রাক শ্রমিক।
ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ৪০০ ঘরবাড়ি: গতকালের বিস্ফোরণে কারও ঘরের চাল উড়ে গেছে, কারও ভেঙেছে জানালার কাচ। আবার কারও বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ফেটে গেছে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাচ, ছোট ছোট লোহার টুকরো। দেখে মনে হবে, এ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো এলাকা। বিস্ফোরণের পর আশপাশে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এমন ক্ষয়ক্ষতিই যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
বিএম ডিপোর ঘটনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই ৯ মাসের মাথায় সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড নামের একটি প্ল্যান্টে ঘটে গেল আরেকটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ।
সোনাইছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বেলাল হোসেন বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকা জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমরা আজ (গতকাল) সকাল থেকে ঘটনাস্থলসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখেছি। সবমিলিয়ে প্রায় চারশ ঘর ও অর্ধকোটি টাকার মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তখন ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আপনারা আরও সুস্পষ্টভাবে জানতে পারবেন। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি।’
সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবদুল আলীম বলেন, আমি অসুস্থ তাই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারিনি। আমাদের কাছে ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ সব সংস্থার ছাড়পত্র আছে। তবে কীভাব এ ঘটনা ঘটেছে তা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। বিস্ফোরণে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেব। আর যেসব ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা সংস্কার করে দেওয়া হবে।
শনিবার বিকেল ৪টার দিকে সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিটের সঙ্গে নৌবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়। প্রথম দিনের উদ্ধার অভিযান শেষে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে ৩০ জনের কথা জানা যায়। এর মধ্যে আহত ২৪ জন এবং নিহত ৬ জন।
এদিকে, বিস্ফোরণের কারণ জানতে জেলা প্রশাসনের সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
নিহত শ্রমিকদের দুই মন্ত্রণালয় থেকে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
বুধবার (২৯ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
হেফাজতে সুলতানার মৃত্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘হঠাৎ করে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আপনি প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে পাবেন।’
‘এই সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণগুলিতে শিশু নিহত হয়েছে। কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে? আমি মনে করি না এই ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করবে।’
এর আগে, নওগাঁ পৌরসভা-চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানাকে (৩৮) র্যাব-৫ এর একটি টহল দল ২২ মার্চ সকালে কাজে যাওয়ার সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ধরে নিয়ে যায়। হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং তারপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
মোমেন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার নেই।
‘বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। অন্য দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কোনো পাঠের প্রয়োজন নেই।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন খুবই শক্তিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সমস্যা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের গণতন্ত্র খুবই দুর্বল। তাই তারা দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে ওকালতি করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। আমরা এটি সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায় আছি। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত এক দশকে ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা ভুয়া ভোটারদের মোকাবিলা করার জন্য ছবিসহ ভোটার আইডি তৈরি করেছি। বিগত ১৪ বছরে নির্বাচন কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তাদের প্রায় সবগুলোই ছিল স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য। এবং ভবিষ্যতেও আমাদের নির্বাচন হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।’
মোমেন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ‘জাদুকরী’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্বব্যাপী আমাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এবং ক্রমাগত উন্নয়নের কারণে, বিশ্বের অনেক দেশ এখন আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন,‘এই স্বাধীনতা দিবসে এবং রমজানের শুরুতে, আমরা অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকে অভিনন্দনমূলক চিঠি পেয়েছি।’
মেয়েদের বয়সভিত্তিক দল নিয়ে বাফুফে যতটা তৎপর, সিনিয়র জাতীয় দল নিয়ে ততটাই উদাসীন। আরো একবার দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থার সিদ্ধান্ত সেটাই প্রমাণ করল। অর্থাভাবের অজুহাত দিয়ে সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাফুফে বলেছে, ‘মায়ানমার যাতায়াতের বিমান ভাড়া, ইনস্যুরেন্স ফি, সেখানে থাকা-খাওয়া ও ট্রান্সপোর্টশনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের সংকুলান না হওয়ায় উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
অলিম্পিক বাছাইয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা আছে ‘বি’ গ্রুপে। স্বাগতিক মায়ানমারের সঙ্গে গ্রুপে আরও আছে ইরান ও মালদ্বীপ। গ্রুপের খেলাগুলো হবে আগামী ৫ থেকে ১১ এপ্রিল।
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে চেয়েছিলাম এই বাছাই পর্বের স্বাগতিক হতে। কিন্তু স্বাগতিক মর্যাদা মায়ানমারকে দেওয়া হয়। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী এখানে অংশ নিতে হলে সব খরচ নিজেদের বহন করতে হবে, যা বহন করার মতো অবস্থায় নেই বাফুফের।’
আবু নাঈম সোহাগ আরও বলেন, ‘আমরা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। সেই সাহায্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরই আমরা দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
গত সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি সাবিনারা। এই সফর বাতিল হওয়ায় মাঠে নামার অপেক্ষাটা তাদের আরো বাড়ল।
মেয়েদের জাতীয় দল নিয়ে বাফুফের উদাসীনতার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালের এসএ গেমসে মেয়েদের দল পাঠায়নি বাফুফে।
সেবার যুক্তিটা ছিল অদ্ভুত। যেহেতু তখন মেয়েদের জাতীয় দলটি মূলত বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ছিল, তাই শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খারাপ করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। এই কারণের কথা বলে সেবার এসএ গেমসে দল পাঠায়নি বাফুফে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও 'সময়োচিত সংস্কার পদক্ষেপ' গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন সরকার চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সংবাদ সংস্থাটি এক নিবন্ধে লিখেছে, 'তিনি (শেখ হাসিনা) টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।' একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পুরো তহবিল পেতে আরও সংস্কার করতে হবে বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে সম্ভাব্য জয়ী হওয়ার কারণ এটা নয় যে তার অনেক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছেন বা আইনি ফাঁদে পড়েছেন।
নিবন্ধে বলা হয়, শেখ হাসিনার বিজয়ের কারণ 'কেবলমাত্র তার অনেক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছে বা আইনি ফাঁদে পড়েছেন- এটা নয় বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সাফল্যের কারণেই এটা ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত।'
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সময়োপযোগী সংস্কারের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণপ্রাপ্তির পটভূমিতে ব্লুমবার্গ দুটি উপশিরোনামসহ 'বাংলাদেশ লিডার বেটস আইএমএফ-ম্যান্ডেটেড রিগর উইল পে অফ ইন পোলস' শিরোনামের এই নিবন্ধটি প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, 'পুরো তহবিল পেতে শেখ হাসিনাকে আরও সংস্কার করতে হবে' এবং 'নির্বাচনে তিনি টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে'।
ব্যালট বাক্সে পরাজিত হওয়ার ভয়ে বিশ্বজুড়ে সরকারি দলের নেতারা প্রায়শই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে সম্মত সংস্কার বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের মতো নন।
তার দ্রুত আইএমএফ ম্যান্ডেটের বাস্তবায়ন দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে যেখানে পাকিস্তান এখনও জ্বালানি ভর্তুকি নিয়ে দুরাবস্থার মধ্যে রয়েছে। শ্রীলঙ্কা স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচন বিলম্বিত করেছে, কারণ, তারা গত সপ্তাহে আইএমএফ তহবিল পেতে কর এবং সুদের হার বাড়িয়েছে।
গত জুলাই মাসে আইএমএফের সহায়তা চাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মধ্যে সর্বশেষ ছিল বাংলাদেশ। দেশটি দ্রুত জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির পর প্রথম ঋণ অনুমোদন পেয়েছে। ৭৫ বছর বয়সী শেখ হাসিনা এই পদক্ষেপ নিতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করেননি।
যদি কোনো নারী কমপক্ষে দুটি মুরগি পালন করেন অথবা কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করেন তাকে শ্রমশক্তির আওতায় এনেছে সরকার। অথচ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কর্মের আওতায় এসেছেন এমন পরিসংখ্যানের হিসাবই দেওয়া হয়নি। গতকাল বুধবার শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশের কথা থাকলে শ্রমশক্তি জরিপটি ছয় বছর পর প্রকাশ করল বিবিএস। এতে বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার বলে উল্লেখ করা হযেছে। যা ২০১৭ সালের জরিপে ছিল ২৭ লাখ। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার কমেছে ৭০ হাজার। শ্রমশক্তি জরিপ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।
সরকারের বেকারত্বের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ৩০ দিনে বেতন বা নিজস্ব পণ্য উৎপাদনের নিমিত্তে কোনো না কোনো কাজ খুঁজে থাকেন এবং গত সাত দিনে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন তবে তাকে বেকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিবিএস বলছে, করোনার সময় দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়েনি বরং কমেছে। কারণ ওই সময় সরকার বিশেষ অনেক পদক্ষেপ নেওয়ায় এসব বেকারের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তাছাড়া কৃষি খাতে অংশগ্রহণ বাড়ায় বেকারের সংখ্যা কমেছে।
জরিপে বলা হয়েছে, দেশে এখন ২৬ লাখ ৩০ হাজার বেকার আছে। এর আগে ২০১৭ সালের জরিপে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। ছয় বছরের ব্যবধানে বেকার কমেছে ৭০ হাজার।
জরিপে দেখা গেছে, ছয় বছর আগের তুলনায় বেকারত্বের হারও কমেছে। ২০১৭ সালে বেকারত্ব ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। সর্বশেষ জরিপ বলছে, এখন বেকারত্ব কমে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পেলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, এখন দেশে শ্রমশক্তিতে ৭ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ আছে। এর মধ্যে কাজে নিয়োজিত ৭ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। এ শ্রমশক্তির মধ্যে থাকা ৪ কোটি ৭৪ লাখ পুরুষ আর ২ কোটি ৫৯ লাখ নারী। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯৯ লাখ ১০ হাজার মানুষ শ্রমশক্তির আওতায় এসেছে অর্থাৎ এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
জরিপে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের বিবেচনা করা হয়েছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের প্রায় সোয়া লাখ পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহ করা হয় দ্বৈবচয়ন অর্থাৎ লটারি পদ্ধতিতে বাছাইয়ের মাধ্যমে। এর আগে ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ করেছে বিবিএস। প্রতি চার থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধান এ জরিপ করা হয়ে থাকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেকারদের মধ্যে পুরুষ ১৬ লাখ ৯০ হাজার। আর নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার। পাঁচ বছর আগের চেয়ে নারীর বেকারত্ব কমেছে। বেড়েছে পুরুষের বেকারত্ব। ২০১৭ সালের জরিপে ১৪ লাখ পুরুষ বেকার ছিল। ওই সময় ১৩ লাখ নারী বেকার ছিল।
জরিপ বলছে, মোট সাত কোটি কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তির মধ্যে কৃষি খাতে নিয়োজিত রয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ, শিল্প খাতে ১ কোটি ২০ লাখ এবং সেবা খাতে ২ কোটি ৬৬ লাখ।
জরিপের হিসাবে আরও দেখা যায়, দেশে শ্রমশক্তির বাইরে আছেন ৪ কোটি ৬৯ লাখ মানুষ। এর মধ্যে নারী ৩ কোটি ৪৮ লাখ, পুরুষের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। বেকারত্ব কমে আসার পাশাপাশি কর্মে নিয়োজিত জনবলও বেড়েছে দেশে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুবকদের কর্মসংস্থান হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, এ জরিপের মাধ্যমে অর্থনীতির মূল গতিবিধি আমরা বুঝতে পারব। আমরা কোনো তথ্যই লুকিয়ে রাখব না। তিনি বলেন, আমাদের দেশের গৃহিণীরা প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কাজ করেন। তাদের শ্রম হিসাব করা হয় না। তাদের শ্রম হিসাবে এলে জিডিপির আকার ৬০০ থেকে ৭০০ বিলিয়ন হতো। নারীদের শ্রমের প্রকৃত বিচার হয় না। আমরা আশা করছি এখন থেকে এ তথ্য প্রতি তিন মাসেই পাব।
আইএলওর আইন মানা হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আইএলওর মানদ- অনুযায়ী এ জরিপ করা হয়েছে। কডিডের সময় আমাদের দেশে বেকারত্ব কমেছে কারণ সে সময় আমরা শিল্প খোলা রেখেছিলাম। লকডাউনে সড়কে বাস চলাচল করতে দিয়েছি। ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে সে সময়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, এটি প্রভিশনাল রিপোর্ট। এ তথ্য মূল প্রতিবেদনে পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থনীতির হাল বোঝার জন্য এ তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশে বেকার বাড়ছে নাকি কমছে সে তথ্য সরকারের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যেসব প্রশ্ন আসছে, এগুলো সবসময়ই এসে থাকে। এসব প্রশ্ন আসবেই। শহরের মহিলা শ্রমিক কমে গেছে, তার মানে হলো তারা গ্রামে গিয়ে কৃষিতে যুক্ত হচ্ছে।
বিবিএস বলছে, সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা ও নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ঘরে ঘরে চাকরি প্রদানের বিষয়ে বিশেষ সুযোগ তৈরির প্রচেষ্টায় বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে।
এ সময় শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এহসান-ই-এলাহী বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম দেশে শ্রমিক ছয় কোটি, এখন দেখি সাত কোটির বেশি। এটি বড় সুসংবাদ। আমরা আগামী বছরের মধ্যে তিন লাখ শ্রমিকের ডেটাবেজ করব। কারণ আমাদের কাছে সঠিক কোনো ডেটাবেজ নেই।
মেট্রোরেলের উত্তরা দক্ষিণ ও শেওড়াপাড়া স্টেশন আগামীকাল ৩১ মার্চ যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ইতিমধ্যে এ দুটি স্টেশন খোলার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। মেট্রোরেল সেবা পরিচালনাকারী ডিএমটিসিএল সূত্র এ তথ্য জানায়।
উত্তরা দক্ষিণ ও শেওড়াপাড়া স্টেশন চালু হলে যাত্রীরা উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন ব্যবহার করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন।
ডিএমটিসিএল-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা দুটি দল গঠন করেছি যারা অপারেশনের জন্য উত্তরা দক্ষিণ এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের অপারেশন টিমের সাথে সমন্বয় করবে।'
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন। রাজধানীর দিয়াবাড়িতে দিয়াবাড়ি-আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ এর ১১.৭৩ কিলোমিটার অংশের ফলক উন্মোচন করেন তিনি। বর্তমানে মেট্রোরেল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত যাত্রীসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।