পৃথিবীকে যে শিক্ষা দিল ‘পেশেন্ট ৩১’
পরাগ মাঝি | ২৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০
করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে চীনের পর প্রথম দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক হারে সংক্রমণ শুরু হওয়ার জন্য দায়ী করা হয় এই ভাইরাসে আক্রান্ত দেশটির ৩১ নম্বর রোগীটিকে। নাম জানা না গেলেও ‘পেশেন্ট ৩১’ হিসেবেই তাকে আখ্যায়িত করছে গণমাধ্যম। মাত্র একজন সংক্রমিত রোগী কীভাবে একটি দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, ‘পেশেন্ট ৩১’ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। লিখেছেন পরাগ মাঝি
দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমণের শুরু যেভাবে
ইতালির মতো দক্ষিণ কোরিয়াতেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুটা হয়েছিল বেশ ধীরগতিতে। চীনে ভাইরাসটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় এতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ জন। আর আক্রান্তদের সবাই ছিলেন সেই সময়ের মধ্যে চীন থেকে যারা দেশে ফিরে এসেছিলেন তাদের অংশ। শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর ওই ৩০ জনকেই চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসে কর্র্তৃপক্ষ। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ায় রোগটির বিস্তারের সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতি বদলে যায় যখন সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৩১ নম্বর রোগীটিকে চিহ্নিত করা হয়। মহামারী আক্রান্ত পৃথিবীতে ওই রোগীকে ‘পেশেন্ট ৩১’ নামেই সবাই চেনে। কোরিয়ান কর্র্তৃপক্ষ নিরাপত্তার খাতিরে তার নাম এখন পর্যন্ত গোপন রেখেছে। তবে, এটুকু জানা গেছে যে- ‘পেশেন্ট ৩১’ একজন নারী। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার শিনচিওচি চার্চের একজন সভ্য। তার হাত ধরেই দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েগু শহরে অবস্থিত শিনচিওচি চার্চ হয়ে যায় করোনাভাইরাসের প্রাণকেন্দ্র। রাতারাতি বদলে যায় দেশটির মহামারী পরিস্থিতি।
যেভাবে চিহ্নিত হন পেশেন্ট ৩১
চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণ কোরিয়ার চতুর্থ বৃহৎ শহর দায়েগুতে ছোটখাটো এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন ৬১ বছর বয়সী এক নারী। সেদিনই আবার প্রচ- মাথাব্যথাও শুরু হলো তার। নারীটি ভাবলেন হয়তো দুর্ঘটনার কারণেই এমন মাথাব্যথা। তাই দায়েগু শহরেই চীনা মেডিসিন হাসপাতাল সায়েরোনান-এ একবার চেকআপও করিয়ে নিলেন এবং দু’একদিন হাসপাতালে থেকে একটু সুস্থ হওয়ার কথা চিন্তা করলেন তিনি। তাই আবারও বাড়ি ফিরে গেলেন প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য।
দুর্ঘটনার তিনদিন পর ৯ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে ক্ষণিকের জন্য বেরিয়ে দায়েগু শহরের বিখ্যাত শিনচিওচি চার্চেও একবার ঢুঁ মারলেন ওই নারী। যিশুর নামে উৎসর্গ করা ওই চার্চটিতে কয়েকশো মানুষের সঙ্গে এক প্রার্থনা সভায়ও যোগ দিলেন। পরে হাসপাতালে ফিরে এলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেন তার শরীরে কিছুটা জ্বরও আছে। আর সাধারণ ফ্লুয়ের মতো কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। ফলে তার শরীরে একটি ফ্লু টেস্টও করা হলো। পরীক্ষায় দেখা গেলো- নারীটির শরীরে কোনো ফ্লু-এর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু পরবর্তী কয়েকদিন ওই নারীর শরীরে থাকা ফ্লু-এর লক্ষণগুলো রয়েই গেল। শুধু তাই নয়, জ্বরের পরিমাণও ধীরে ধীরে বাড়ছিল।
১৫ ফেব্রুয়ারিতে চিকিৎসকরা ওই নারীকে একবার নভেল করোনাভাইরাস কভিড-১৯ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। যেহেতু তখন পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা মাত্র ৩০ জন। আর সংক্রমিত ওই ৩০ জনই ছিলেন চীন থেকে দেশে ফেরা কোরিয়ান নাগরিক। বিমানবন্দর থেকেই কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে তাদের আলাদা করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তাই বিগত কয়েকদিনে কেউ ধারণাই করেনি চিকিৎসাজনিত কারণে হাসপাতালে অবস্থান নেওয়া নারীটির শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকতে পারে। তার অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে একবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করে দেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা তো করলেনই না বরং কিছুটা মনঃক্ষুণœ হলেন সেই নারী। এর যথেষ্ট কারণও ছিল। যখন থেকে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, তারও অনেক আগে থেকেই কোরিয়ার বাইরে পা রাখেননি তিনি। এমনকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে গিয়েছেন বলেও মনে করেন না। ফলে পরীক্ষা না করিয়েই একটি ট্যাক্সি নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটলেন তিনি। পূর্ব দায়েগুর একটি হোটেলে সেই বন্ধুটির সঙ্গে লাঞ্চ করার নিমন্ত্রণ ছিল তার।
১৬ ফেব্রুয়ারি ওই নারী আরও একবার শিনচিওচি চার্চে গেলেন একটি প্রার্থনা সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য। পরের দিন চিকিৎসকরা আবারও তাকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা করতে বলেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের ভাষ্য মতে, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করতে বলায় একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক তর্কবিতর্ক করেন নারীটি। চিকিৎসকদের তিনি বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, কোনো অবস্থাতেই তার শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটার কোনো উপায় নেই। কারণ তিনি চীন থেকে দেশে আসেননি। আর চীন থেকে যারা দেশে এসেছে তাদের মধ্যে যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তাদের সবাইকে শনাক্ত করে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এর বাইরে দেশে আর কোনো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর অস্তিত্ব নেই। তাই তার সংক্রমিত হওয়ারও কোনো উপায় নেই।
এদিকে, অসুস্থতা না কমায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই অন্য আরেকটি হাসপাতালে করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় অংশ নিতে রাজি হলেন দায়েগু শহরের সেই নারী। পরীক্ষার ফলাফল তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরীক্ষায় পজেটিভ প্রমাণিত হওয়ার পর কোরিয়ার করোনাভাইরাস আক্রান্ত ৩১ নম্বর রোগী হিসেবে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। সারা বিশ্ব এখন তাকে ‘পেশেন্ট ৩১’ নামেই চেনে। কীভাবে তার শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশ করেছিল তা এখনো অজানা। তবে, তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাসের জন্মস্থান চীনের বাইরের কোনো দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত করা হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। ‘পেশেন্ট ৩১’কে চিহ্নিত করার পর মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই ৭ হাজারেরও বেশি কোরিয়ানের শরীরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের এমন বিস্ফোরণের জন্য ‘পেশেন্ট ৩১’কেই দায়ী করা হয়। কারণ শরীরে ভাইরাস নিয়েই তিনি বেশ কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকা-ে যুক্ত হয়েছিলেন। বিশেষ করে শিনচিওচি চার্চে গিয়েছিলেন। এই চার্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে সেখানে। নারীটির শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পরই কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র ওই চার্চে নির্ধারিত দিনগুলোতে প্রার্থনা সভায় যোগ দেওয়া ৯ হাজার ৩০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। এর মধ্যে ১২০০ জনের শরীরে ফ্লু-এর মতো উপসর্গ দেখা যায় এবং কয়েকশো মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। কোরিয়ান কর্র্তৃপক্ষ ‘পেশেন্ট ৩১’কে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ‘সুপার স্প্রেডার’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তার জন্যই মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রাণকেন্দ্র হয়ে যায় দায়েগু শহর।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তখন পর্যন্ত দেশটিতে যে পরিমাণ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তার ৬৩.৫ শতাংশই ছিলেন শিনচিওচি চার্চের সঙ্গে সম্পর্কিত।
পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নজির স্থাপন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। সর্বশেষ ২৩ মার্চে দেশটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৯৬১ জন। আর তখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ১১১ জন। অথচ ‘পেশেন্ট ৩১’-এর মাধ্যমে দেশটিতে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে ভাবা হচ্ছিল- শিগগিরই দেশটি এই মহামারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে এবং হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটবে। তবে, পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে কোরিয়ান কর্র্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে তারা যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা যে কোনো দেশের জন্যই অনুকরণীয়।
মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করার জন্য গত ১৬ মার্চ আক্রান্ত দেশগুলোকে উদ্দেশ্য করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানম গেব্রিয়াসেস এক ঘোষণায় বলেন, ‘পরীক্ষা করো, পরীক্ষা করো এবং পরীক্ষা করো।’ করোনাভাইরাসকে এক মাসের ব্যবধানে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ঠিক এই নীতিটিকেই অনুসরণ করছে।
এ সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘আপনি চোখ বেঁধে আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন না।’ অর্থাৎ অদৃশ্য এই ভাইরাসকে মোকাবিলা করার জন্য পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্ত সবাইকেই চিহ্নিত করতে হবে এবং যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সামর্থ্যকে কৃতিত্ব না দিয়ে উপায় নেই। ‘পেশেন্ট ৩১’-এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর একজন একজন করে আক্রান্তদের শনাক্ত করে তাদের সংস্পর্শে গেছে এমন মানুষদেরও পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসে কর্র্তৃপক্ষ। ১৯ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১ মাসের ব্যবধানে দেশটিতে প্রায় ৩ লাখ ৭ হাজার মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস আছে কি-না পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে উন্নত অনেক দেশই দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে পিছিয়ে আছে। এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্য মাত্র ৬৪ হাজার ৬২১ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি আছে কি-না পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ইতালি ছাড়া ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে এই সংখ্যাটা বেশি। এমনকি এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্য। আর ২৩ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ছয় শতাধিক মানুষের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া ৬৩৩টি কেন্দ্রের মাধ্যমে এক দিনে অন্তত ২০ হাজার মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে দেশটির একটি স্মার্টফোন অ্যাপও যথেষ্ট কাজে দিয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগী কোথায় কখন কতক্ষণ অবস্থান করেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র। বড় রাস্তাগুলোর পাশে সাদা রঙের তাঁবু দিয়ে অসংখ্য পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছে তারা। যেখানে দেশটির কোনো নাগরিক চাইলেই তার শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি-না তা পরীক্ষা করতে পারেন। আর এই পরীক্ষার ফলও মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তির মোবাইলে মেসেজ আকারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ব্যক্তিটি যদি করোনাভাইরাস পজেটিভ হয়- তবে রোগটি ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই কর্র্তৃপক্ষ তাকে আইসোলেশনে নিয়ে আসে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে কোরিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। তারা একটি স্মার্টফোনের সাহায্যেই দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। প্রত্যেক কোরিয়ানের কাছেই অন্তত একটি স্মার্টফোন রয়েছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশটির সরকার স্মার্টফোনের সাহায্যেই নাগরিকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো এলাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের জোর আশঙ্কা থাকে তবে ওই এলাকায় প্রবেশ করলেই স্মার্টফোনে তাকে সতর্ক করে মেসেজ প্রদান করে সরকারি কর্র্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালে মার্স ভাইরাস সংক্রমণ থেকে শিক্ষা নিয়ে যে কোনো মহামারী ঠেকানোর ক্ষেত্রে বেশি বেশি পরীক্ষা পদ্ধতিকেই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। তাই চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করার কিট নির্মাণ শুরু করে দেয় দক্ষিণ কোরিয়া। তারা যখন পরীক্ষা কিট তৈরি শুরু করে তখন পর্যন্ত দেশটিতে একজনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছিল না।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ মাইকেল মিনা বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সন্দেহভাজন রোগীকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা দেশটিতে করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ ও এর ক্ষয়ক্ষতি অনুধাবনের জন্য খুব কাজে দিয়েছে।’ অন্যদিকে, সব মানুষকে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করতে বাধ্য করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দারুণ ভূমিকা রেখেছে চীন সরকার।
মহামারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই উচিত সামাজিকতার ক্ষেত্রে একজন আরেকজনের কাছ থেকে ন্যূনতম দূরত্ব মেনে চলা। এটা শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্যই নয়, বরং অন্য সবাইকেই এই প্রক্রিয়ায় নিরাপদ রাখা সম্ভব। তাই মহামারীর ক্ষেত্রে ‘পেশেন্ট ৩১’ পুরো পৃথিবীর কাছেই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। যদি তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সময়মতো পরীক্ষা করাতেন তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের বিস্তার হয়তো আরও অনেক কম হতো। কিংবা দেশটিতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আর কোনো উপায়ই থাকত না।
শেয়ার করুন
পরাগ মাঝি | ২৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০

করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে চীনের পর প্রথম দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক হারে সংক্রমণ শুরু হওয়ার জন্য দায়ী করা হয় এই ভাইরাসে আক্রান্ত দেশটির ৩১ নম্বর রোগীটিকে। নাম জানা না গেলেও ‘পেশেন্ট ৩১’ হিসেবেই তাকে আখ্যায়িত করছে গণমাধ্যম। মাত্র একজন সংক্রমিত রোগী কীভাবে একটি দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, ‘পেশেন্ট ৩১’ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। লিখেছেন পরাগ মাঝি
দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমণের শুরু যেভাবে
ইতালির মতো দক্ষিণ কোরিয়াতেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুটা হয়েছিল বেশ ধীরগতিতে। চীনে ভাইরাসটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় এতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ জন। আর আক্রান্তদের সবাই ছিলেন সেই সময়ের মধ্যে চীন থেকে যারা দেশে ফিরে এসেছিলেন তাদের অংশ। শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর ওই ৩০ জনকেই চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসে কর্র্তৃপক্ষ। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ায় রোগটির বিস্তারের সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতি বদলে যায় যখন সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৩১ নম্বর রোগীটিকে চিহ্নিত করা হয়। মহামারী আক্রান্ত পৃথিবীতে ওই রোগীকে ‘পেশেন্ট ৩১’ নামেই সবাই চেনে। কোরিয়ান কর্র্তৃপক্ষ নিরাপত্তার খাতিরে তার নাম এখন পর্যন্ত গোপন রেখেছে। তবে, এটুকু জানা গেছে যে- ‘পেশেন্ট ৩১’ একজন নারী। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার শিনচিওচি চার্চের একজন সভ্য। তার হাত ধরেই দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েগু শহরে অবস্থিত শিনচিওচি চার্চ হয়ে যায় করোনাভাইরাসের প্রাণকেন্দ্র। রাতারাতি বদলে যায় দেশটির মহামারী পরিস্থিতি।
যেভাবে চিহ্নিত হন পেশেন্ট ৩১
চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণ কোরিয়ার চতুর্থ বৃহৎ শহর দায়েগুতে ছোটখাটো এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন ৬১ বছর বয়সী এক নারী। সেদিনই আবার প্রচ- মাথাব্যথাও শুরু হলো তার। নারীটি ভাবলেন হয়তো দুর্ঘটনার কারণেই এমন মাথাব্যথা। তাই দায়েগু শহরেই চীনা মেডিসিন হাসপাতাল সায়েরোনান-এ একবার চেকআপও করিয়ে নিলেন এবং দু’একদিন হাসপাতালে থেকে একটু সুস্থ হওয়ার কথা চিন্তা করলেন তিনি। তাই আবারও বাড়ি ফিরে গেলেন প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য।
দুর্ঘটনার তিনদিন পর ৯ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে ক্ষণিকের জন্য বেরিয়ে দায়েগু শহরের বিখ্যাত শিনচিওচি চার্চেও একবার ঢুঁ মারলেন ওই নারী। যিশুর নামে উৎসর্গ করা ওই চার্চটিতে কয়েকশো মানুষের সঙ্গে এক প্রার্থনা সভায়ও যোগ দিলেন। পরে হাসপাতালে ফিরে এলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেন তার শরীরে কিছুটা জ্বরও আছে। আর সাধারণ ফ্লুয়ের মতো কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। ফলে তার শরীরে একটি ফ্লু টেস্টও করা হলো। পরীক্ষায় দেখা গেলো- নারীটির শরীরে কোনো ফ্লু-এর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু পরবর্তী কয়েকদিন ওই নারীর শরীরে থাকা ফ্লু-এর লক্ষণগুলো রয়েই গেল। শুধু তাই নয়, জ্বরের পরিমাণও ধীরে ধীরে বাড়ছিল।
১৫ ফেব্রুয়ারিতে চিকিৎসকরা ওই নারীকে একবার নভেল করোনাভাইরাস কভিড-১৯ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। যেহেতু তখন পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা মাত্র ৩০ জন। আর সংক্রমিত ওই ৩০ জনই ছিলেন চীন থেকে দেশে ফেরা কোরিয়ান নাগরিক। বিমানবন্দর থেকেই কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে তাদের আলাদা করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তাই বিগত কয়েকদিনে কেউ ধারণাই করেনি চিকিৎসাজনিত কারণে হাসপাতালে অবস্থান নেওয়া নারীটির শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকতে পারে। তার অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে একবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করে দেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা তো করলেনই না বরং কিছুটা মনঃক্ষুণœ হলেন সেই নারী। এর যথেষ্ট কারণও ছিল। যখন থেকে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, তারও অনেক আগে থেকেই কোরিয়ার বাইরে পা রাখেননি তিনি। এমনকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে গিয়েছেন বলেও মনে করেন না। ফলে পরীক্ষা না করিয়েই একটি ট্যাক্সি নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটলেন তিনি। পূর্ব দায়েগুর একটি হোটেলে সেই বন্ধুটির সঙ্গে লাঞ্চ করার নিমন্ত্রণ ছিল তার।
১৬ ফেব্রুয়ারি ওই নারী আরও একবার শিনচিওচি চার্চে গেলেন একটি প্রার্থনা সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য। পরের দিন চিকিৎসকরা আবারও তাকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা করতে বলেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের ভাষ্য মতে, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করতে বলায় একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক তর্কবিতর্ক করেন নারীটি। চিকিৎসকদের তিনি বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, কোনো অবস্থাতেই তার শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটার কোনো উপায় নেই। কারণ তিনি চীন থেকে দেশে আসেননি। আর চীন থেকে যারা দেশে এসেছে তাদের মধ্যে যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তাদের সবাইকে শনাক্ত করে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এর বাইরে দেশে আর কোনো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর অস্তিত্ব নেই। তাই তার সংক্রমিত হওয়ারও কোনো উপায় নেই।
এদিকে, অসুস্থতা না কমায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই অন্য আরেকটি হাসপাতালে করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় অংশ নিতে রাজি হলেন দায়েগু শহরের সেই নারী। পরীক্ষার ফলাফল তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরীক্ষায় পজেটিভ প্রমাণিত হওয়ার পর কোরিয়ার করোনাভাইরাস আক্রান্ত ৩১ নম্বর রোগী হিসেবে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। সারা বিশ্ব এখন তাকে ‘পেশেন্ট ৩১’ নামেই চেনে। কীভাবে তার শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশ করেছিল তা এখনো অজানা। তবে, তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাসের জন্মস্থান চীনের বাইরের কোনো দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত করা হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। ‘পেশেন্ট ৩১’কে চিহ্নিত করার পর মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই ৭ হাজারেরও বেশি কোরিয়ানের শরীরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের এমন বিস্ফোরণের জন্য ‘পেশেন্ট ৩১’কেই দায়ী করা হয়। কারণ শরীরে ভাইরাস নিয়েই তিনি বেশ কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকা-ে যুক্ত হয়েছিলেন। বিশেষ করে শিনচিওচি চার্চে গিয়েছিলেন। এই চার্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে সেখানে। নারীটির শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পরই কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র ওই চার্চে নির্ধারিত দিনগুলোতে প্রার্থনা সভায় যোগ দেওয়া ৯ হাজার ৩০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। এর মধ্যে ১২০০ জনের শরীরে ফ্লু-এর মতো উপসর্গ দেখা যায় এবং কয়েকশো মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। কোরিয়ান কর্র্তৃপক্ষ ‘পেশেন্ট ৩১’কে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ‘সুপার স্প্রেডার’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তার জন্যই মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রাণকেন্দ্র হয়ে যায় দায়েগু শহর।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তখন পর্যন্ত দেশটিতে যে পরিমাণ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তার ৬৩.৫ শতাংশই ছিলেন শিনচিওচি চার্চের সঙ্গে সম্পর্কিত।
পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নজির স্থাপন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। সর্বশেষ ২৩ মার্চে দেশটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৯৬১ জন। আর তখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ১১১ জন। অথচ ‘পেশেন্ট ৩১’-এর মাধ্যমে দেশটিতে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে ভাবা হচ্ছিল- শিগগিরই দেশটি এই মহামারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে এবং হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটবে। তবে, পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে কোরিয়ান কর্র্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে তারা যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা যে কোনো দেশের জন্যই অনুকরণীয়।
মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করার জন্য গত ১৬ মার্চ আক্রান্ত দেশগুলোকে উদ্দেশ্য করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানম গেব্রিয়াসেস এক ঘোষণায় বলেন, ‘পরীক্ষা করো, পরীক্ষা করো এবং পরীক্ষা করো।’ করোনাভাইরাসকে এক মাসের ব্যবধানে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ঠিক এই নীতিটিকেই অনুসরণ করছে।
এ সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘আপনি চোখ বেঁধে আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন না।’ অর্থাৎ অদৃশ্য এই ভাইরাসকে মোকাবিলা করার জন্য পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্ত সবাইকেই চিহ্নিত করতে হবে এবং যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সামর্থ্যকে কৃতিত্ব না দিয়ে উপায় নেই। ‘পেশেন্ট ৩১’-এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর একজন একজন করে আক্রান্তদের শনাক্ত করে তাদের সংস্পর্শে গেছে এমন মানুষদেরও পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসে কর্র্তৃপক্ষ। ১৯ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১ মাসের ব্যবধানে দেশটিতে প্রায় ৩ লাখ ৭ হাজার মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস আছে কি-না পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে উন্নত অনেক দেশই দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে পিছিয়ে আছে। এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্য মাত্র ৬৪ হাজার ৬২১ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি আছে কি-না পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ইতালি ছাড়া ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে এই সংখ্যাটা বেশি। এমনকি এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্য। আর ২৩ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ছয় শতাধিক মানুষের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া ৬৩৩টি কেন্দ্রের মাধ্যমে এক দিনে অন্তত ২০ হাজার মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে দেশটির একটি স্মার্টফোন অ্যাপও যথেষ্ট কাজে দিয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগী কোথায় কখন কতক্ষণ অবস্থান করেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র। বড় রাস্তাগুলোর পাশে সাদা রঙের তাঁবু দিয়ে অসংখ্য পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছে তারা। যেখানে দেশটির কোনো নাগরিক চাইলেই তার শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি-না তা পরীক্ষা করতে পারেন। আর এই পরীক্ষার ফলও মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তির মোবাইলে মেসেজ আকারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ব্যক্তিটি যদি করোনাভাইরাস পজেটিভ হয়- তবে রোগটি ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই কর্র্তৃপক্ষ তাকে আইসোলেশনে নিয়ে আসে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে কোরিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। তারা একটি স্মার্টফোনের সাহায্যেই দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। প্রত্যেক কোরিয়ানের কাছেই অন্তত একটি স্মার্টফোন রয়েছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশটির সরকার স্মার্টফোনের সাহায্যেই নাগরিকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো এলাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের জোর আশঙ্কা থাকে তবে ওই এলাকায় প্রবেশ করলেই স্মার্টফোনে তাকে সতর্ক করে মেসেজ প্রদান করে সরকারি কর্র্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালে মার্স ভাইরাস সংক্রমণ থেকে শিক্ষা নিয়ে যে কোনো মহামারী ঠেকানোর ক্ষেত্রে বেশি বেশি পরীক্ষা পদ্ধতিকেই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। তাই চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করার কিট নির্মাণ শুরু করে দেয় দক্ষিণ কোরিয়া। তারা যখন পরীক্ষা কিট তৈরি শুরু করে তখন পর্যন্ত দেশটিতে একজনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছিল না।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ মাইকেল মিনা বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সন্দেহভাজন রোগীকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা দেশটিতে করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ ও এর ক্ষয়ক্ষতি অনুধাবনের জন্য খুব কাজে দিয়েছে।’ অন্যদিকে, সব মানুষকে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করতে বাধ্য করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দারুণ ভূমিকা রেখেছে চীন সরকার।
মহামারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই উচিত সামাজিকতার ক্ষেত্রে একজন আরেকজনের কাছ থেকে ন্যূনতম দূরত্ব মেনে চলা। এটা শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্যই নয়, বরং অন্য সবাইকেই এই প্রক্রিয়ায় নিরাপদ রাখা সম্ভব। তাই মহামারীর ক্ষেত্রে ‘পেশেন্ট ৩১’ পুরো পৃথিবীর কাছেই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। যদি তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সময়মতো পরীক্ষা করাতেন তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের বিস্তার হয়তো আরও অনেক কম হতো। কিংবা দেশটিতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আর কোনো উপায়ই থাকত না।