ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির উর্বর ক্ষেত্র বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে ‘বিজলি’, ‘মোরা’, ‘রোয়ানু’, ‘মিধিলি’, ‘মোখা’, ‘আম্ফান’, ‘ফনি’, ‘সিত্রাং’ ও ‘বুলবুল’ এর মতো অনেক ঘূর্ণিঝড়ের পর সর্বশেষ গত রবিবার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’। গত ৩৪ বছরে ২৭টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলেও এখনো মানুষের মনে দাগ কাটে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন ‘সিডর’ কিংবা ২০০৯ সালের ‘আইলা’র তাণ্ডব। তবে দেশের দক্ষিণে যতো ঘূর্ণিঝড় হয় বুক পেতে রক্ষা করে সুন্দরবন। এবারো রিমালের আঘাত থেকে উপকূলবাসী রক্ষা করল প্রাকৃতিক দেয়াল খ্যাত এই সুন্দরবন। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো— ২০০৯ সালের ২৬ মে আঘাত করেছিল আইলা, পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২৬ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এবং সর্বশেষ গত রবিবার (২৬ মে) আঘাত করে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’।
বঙ্গোপসাগরে গড়ে প্রতি বছর চারটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলেও এর এক বা দুটি হয়ে থাকে আমাদের অংশে এবং বাকিগুলো আরব সাগর অংশে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. মো. ছাদেকুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন,‘বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে বঙ্গোপসাগর এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে। কোনো বছর ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ না পেলে নিম্নচাপের মাধ্যমে ঋতু প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে।’
উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আকাশ’, ২০০৮ সালের ৩ মে আঘাত ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’, ২০১০ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘লায়লা’, ২০১৩ সালের ১৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’, ২০১৬ সালের ২২ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানা’, ২০১৭ সালের ৩১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’,২০১৯ সালের ৫ মে ‘ফনি’ এবং ২০২০ সালের ২১ মে ‘আম্ফান’ উপকূলের আঘাত করেছিল। এদিকে গত রবিবারে আঘাত করা ‘রিমাল’ পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি প্রবেশের কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা একটু উত্তর দিকে বেঁকে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে উপকূলে প্রবেশ করে। আর এই বাম দিকে বেঁকে যাওয়াতে ঝড়ের প্রধান অংশের আঘাত গিয়ে পড়েছে সুন্দরবনের উপর। যেকোনো ঝড়ের ক্ষেত্রে ডান দিকে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকে এবং সেই এলাকায় ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হয়ে থাকে। আর এই ঝড়ের ডান দিকে ছিল সুন্দরবন। ফলে পটুয়াখালী ও খেপুপাড়ায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ১১১ কিলোমিটার রেকর্ড হয়েছে রাত দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে।
তবে ১৯৯০ থেকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্ষার আগে (এপ্রিল-মে) ও বর্ষার পরে (অক্টোবর-নভেম্বর) এ পর্যন্ত ২৭টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়ে উপকূলে আঘাত করেছে। এরমধ্যে ১৫টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার) এলাকায় এবং বাকি ১২টি আঘাত করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে (সাতক্ষীরা থেকে ভোলা)। আবার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আঘাত করা ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশিরভাগই কিন্তু এপ্রিল-মে মাসে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত করা ঝড়গুলো অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আঘাত করা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা এখনও মানুষ ভুলতে পারেনি। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এলেই উপকূলের মানুষ তাদের প্রিয়জনদের স্মরণ করে। অপরদিকে দক্ষিণ বঙ্গে ২০০৭ সালের ‘সিডর’ ও ২০০৯ সালের ‘আইলা’ও এমন তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল উপকূলে।
তবে এখন এমন শক্তিশালী ঝড় তুলনামূলকভাবে কমেছে বলে মনে করেন সাউথ এশিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. মোহন কুমার দাশ। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক সিডর কিংবা আইলার মতো ঝড়ের সংখ্যা কম হচ্ছে। তবে সাগরে ঝড় সৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই হয়তো বাতাসের গতিবেগ কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের মুভমেন্ট সব মিলিয়ে তা আমাদের উপকূলকে রক্ষা করে ভারত বা মিয়ানমারের (২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল নার্গিস) দিকে যাচ্ছে।’
ভারতের উড়িষ্যা, তামিলনাড়– কিংবা পশ্চিমবঙ্গ অথবা মিয়ানমারের দিকে ঘূর্ণিঝড়ের বাঁক কেন হয়? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. মো. ছাদেকুল আলমের সাথে। তিনি বলেন, একেকটি ঘূর্ণিঝড়ের পরিধি কয়েকশ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী হয়ে থাকে। এখন ঝড়টি ফানেল আকৃতির বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের পর ঘুরতে থাকে। আর ঘুরতে গিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় চাপে তা বেশিরভাগ সময় বামে বা ডানে যায়। ২ ডিগ্রি পরিমাণও যদি বাঁক নেয় তাহলে আঘাতের স্থান কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত পার্থক্য হয়ে যায়। আর এতে আমাদের উপকূলে তুলনামূলভাবে কম হয়ে থাকে।’
একই মন্তব্য করেন আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘সাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড়গুলো ঘূর্ণন গতিতে থাকে। আর এসব ঘূর্ণিঝড় উপকূলের কাছাকাছি আসার পর বেশিরভাগ সময়ে গতি ও দিক পরিবর্তন করে।’
উল্লেখ্য, বছরের এপ্রিল-মে মাসে এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মৌসুমি বায়ু প্রবেশের আগে সাগরে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার পর দেশে বর্ষার শুরু হয়। আর বর্ষার পরে শীতের আগে সাগরে ঝড় সৃষ্টির পর শীতের আগমন ঘটে।