সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

শিল্পে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ

  • শিল্পায়ন নিরুৎসাহিত হওয়ার শঙ্কা
  • ২৭ ডিসেম্বর নতুন সংযোগের নীতিগত অনুমোদন
আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৪২ এএম

শিল্প ও ক্যাপটিভ (কারখানায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র) শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ নিতে গ্রাহককে উচ্চমূল্যের আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দামে গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হবে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত বিষয় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে, যেটি বাস্তবায়ন হলে শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর চুরির নামে যে বিপুল সিস্টেম লস দেখানো হয়, তা বন্ধের পাশাপাশি গ্যাস অনুসন্ধান এবং পুরনো কূপ সংস্কারে জোর দিলে এগুলো করার দরকার ছিল না।

আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বিদ্যমান গ্রাহকের তুলনায় নতুন গ্রাহককে কিংবা লোড বৃদ্ধি করলে গ্যাস বিল অনেক বেশি দিতে হবে। গ্যাস বিলের এই বৈষম্যের কারণে নতুনদের উৎপাদনব্যয় বাড়বে। এতে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। সব মিলে শিল্পের সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হবে দেশে।

শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে বিদ্যমান, প্রতিশ্রুত ও সম্ভাব্য গ্রাহকের গ্যাস ব্যবহার/লোড বৃদ্ধি অথবা নতুন গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে ট্যারিফ (গ্যাসের দাম) পুনর্নির্ধারণের ওই প্রস্তাবটি গত ২৭ ডিসেম্বর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

অনুমোদিত প্রস্তাব অনুযায়ী, শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে সম্ভাব্য নতুন গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকরা এলএনজি আমদানির মোট ব্যয়মূল্যে পরিশোধ করবেন। তবে গ্যাস সংযোগের জন্য আগের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাদের প্রাথমিক সম্মতিপত্র বা চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়েছে, সেসব গ্রাহক তার ব্যবহারের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যমান শিল্প/ক্যাপটিভ পাওয়ার শ্রেণির দামে বিল পরিশোধ করবেন। এর অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয়মূল্যে দাম পরিশোধ করতে হবে তাকে। 

এ ছাড়া শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহককে অনুমোদিত লোড অপেক্ষা অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাকে এলএনজি আমদানির মূল্যে গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হবে।
জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছে, এলএনজি আমদানি মূল্য বলতে দাখিল করা বিলের পূর্ববর্তী তিন মাসের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ও স্পট এলএনজি ক্রয় বাবদ ব্যয় (এলএনজি ক্রয়মূল্য, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, ভ্যাট, ট্যাক্স বিভিন্ন মার্জিনসহ সার্বিক মূল্য) গড়মূল্য বোঝাবে।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ১২ থেকে ৩০ টাকা করেছিল। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এরপরও গ্যাস পাচ্ছি না। বরং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পর সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখন আবার নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে যদি গ্রাহককে এলএনজির দামে গ্যাস বিল দিতে হয়, তাহলে তা ৬০ টাকা বা তারও বেশি হবে।’

তিনি বলেন, এর ফলে নতুন এবং পুরাতন গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। উৎপাদনব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা যাবে না। ফলে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে নতুন শিল্পায়ন থেমে যাবে।

অভিযোগ উঠেছে, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন অযাচিত ব্যয়, লোকসান আর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে জ্বালানি খাতের সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে গেছে। এই ব্যয় সামাল দিতে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা আর ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৩০ টাকা। এক বছরের মাথায় গত ফেব্রুয়ারিতে আবারও নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪.৭৫ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০.৭৫ টাকা করে সরকার। 

বর্তমানে প্রতিদিন দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হয় গড়ে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় ক‚প থেকে ১ হাজার ৯০০ মিলিয়ন এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে ৮০০ থেকে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়। 

পেট্রোবাংলা দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন দামে যে গ্যাস কেনে, তাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের গড় দর ৬ টাকা ৭ পয়সা। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির দাম পড়ে ৬৫ থেকে ৭১ টাকা পর্যন্ত। দেশীয় এবং আমদানি করা এলএনজি মিলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড়মূল্য ছিল ২৪.৩৮ টাকা, যা পাইকারি দরে বিক্রি করা হয় ২২.৮৭ টাকায়। এতে ইউনিটপ্রতি ১.৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো বিশেষ করে তিতাস সিস্টেম লসের নামে যে গ্যাস ডাকাতি করছে, সেটা বন্ধ করা গেলে ১২৫ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপচয় বন্ধ করা সম্ভব। এর সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে পুরনো গ্যাসকূপ সংস্কারের মাধ্যমেও কিছু গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এগুলো করতে পারলে তো ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এই সোজা কাজ না করে সরকার কঠিন কাজ করতে যাচ্ছে, যা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, গ্যাস ডাকাতি বন্ধ আর কিছু পুরনো কূপ সংস্কারের মাধ্যমে যে গ্যাস পাওয়া যাবে, তাতে অনেক শিল্পে সংযোগ দেওয়া যাবে। এলএনজি আমদানির চাপও কমবে।
গ্যাসের সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে সাগরে ও স্থলভাগে ব্যাপকহারে অনুসন্ধানের তাগিদ দেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। 

এর আগে গণশুনানির মাধ্যমে সর্বশেষ ২০২২ সালে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল বিইআরসি। তখন সরকার চাইলেই খেয়াল-খুশিমতো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে পারত না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ইচ্ছামতো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে আইন সংশোধন করে নির্বাহী আদেশে মূল্য বৃদ্ধি করছিল কমিশনকে পাশ কাটিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেই নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণসংক্রান্ত আইন বাতিল করে দিয়েছে। ফলে নতুন করে গ্যাসের দর নির্ধারণের একক এখতিয়ার এখন কমিশনের। 

জ্বালানি বিভাগ ওই প্রস্তাবটি অনুমোদনের পর গত ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির বিদ্যমান গ্রাহক অনুমোদিত লোডের অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করছেন, সে-সংক্রান্ত তথ্যসহ অন্যান্য তথ্য চাওয়া হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য পাওয়ার পর গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব পাঠানো হবে কমিশনে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিইআরসি যদি ওই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে, তাহলে বর্তমান এলএনজির দর বিবেচনায় নতুন গ্রাহককে প্রতি ইউনিট গ্যাসের বিল দিতে হবে প্রায় ৬০ টাকা। আর প্রতিশ্রুত গ্রাহককে তার ব্যবহৃত অর্ধেক গ্যাসের জন্য ইউনিটপ্রতি প্রায় ৬০ টাকার মতো পড়তে পারে। অর্ধেকের জন্য বিদ্যমান দর ৩০ টাকা হারে দিতে হবে। একই হারে গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হবে, যেসব গ্রাহক তাদের অনুমোদিত লোডের অতিরিক্ত লোড বৃদ্ধি করতে চান তাদেরও। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে দাম বাড়বে আর কমে গেলে কমবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত