রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সব সম্পদই ‘অর্থ’ নয়

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৩ এএম

কথিত আছে যে, দুই অর্থনীতিবিদ (একজন অভিজ্ঞ ও অন্যজন অনভিজ্ঞ) কোনো এক বিকেলে পথ ধরে হাঁটছিলেন। দেখতে দেখতে তাদের সামনে পড়ল, একটা গোবরের স্তূপ। অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বললেন, ‘তুমি যদি স্তূপে থাকা গোবর খেতে পার, তা হলে তোমাকে আমি বিশ হাজার ডলার দেব।’ অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ চিন্তা করে দেখলেন, গোবর খেয়ে যদি বিশ হাজার ডলার পাওয়া যায় তো এই দুর্মূল্যের বাজারে তাই বা কম কীসের। অনেক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে শেষমেশ তিনি গোবর খেয়ে প্রতিশ্রুত অর্থ আদায় করে নিলেন। কিছু দূর যেতেই আরেকটা গোবরের স্তূপ তাদের সামনে পড়ল। এবার অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বললেন, ‘তুমি যদি স্তূপে থাকা গোবর খেতে পার তা হলে তোমাকেও আমি বিশ হাজার ডলার দেব।’ এই কথা শুনে অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ভাবলেন, কোনো দিন তো বাজিতে হারিনি; কিছুক্ষণ আগে হেরে গিয়ে বিশ হাজার ডলার খোয়ালাম। বেইজ্জতের ব্যাপার! নাহ্, আমাকে ওই অর্থ ফেরত আনতেই হবে। অনেক হিসাব করে সেও স্তূপে থাকা গোবর খেয়ে বিশ হাজার ডলার ফিরে পেলেন। চলার পথে অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ আক্ষেপের সুরে বলছেন, ‘খামোখাই কিন্তু আমরা গোবর খেলাম। আমাদের দুজনের অর্থের অবস্থা আগের মতোই; কোনো উন্নতিই হয়নি, একদম পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়।’ অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ একটা বিজ্ঞের হাসি দিয়ে জানান দিলেন, ‘উন্নতি হয়নি মানে? এরই মধ্যে ৪০ হাজার ডলারের মতো অর্থের লেনদেন হয়েছে সেটা কি কম কথা?’ এই কথা শুনে অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ গোবর গণেশের মতো অর্থবিষয়ক গ্যাঁড়াকলে পড়ে যায়। তবে এই গ্যাঁড়াকল বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার আগে অর্থ সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

দুই. ইংরেজিতে যাকে বলে মানি, বাংলায় তাই টাকা। বর্তমান আলোচনার স্বার্থে আমরা আপাতত মুদ্রা, অর্থ ও টাকা সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। মানি বা অর্থ বলা হয়ে থাকে এমন সম্পদকে, সাধারণভাবে যা স্বীকৃত বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। খুব ভালো জীবনমানের আশায় বছরের পর বছর আপনি পরীক্ষায় পাস দিয়ে প্রতি মাসে টাকা নামে কিছু কাগজ হাতে পান কিন্তু খেয়াল করেননি বোধহয় যে,  এদের অন্তর্নিহিত কোনো দাম নেই। আপাতদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কাগজের নৌকা আর কাগুজে নোট বুঝি একই রকম, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। কাগুজে নৌকার ওপর কিছু লেখা থাকে না (এবং থাকলেও তা বহনকারীর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ নয়) কিন্তু কাগুজে মুদ্রার পিঠে ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ কথাটা লেখা থাকে। মজার কথা, যতক্ষণ পর্যন্ত না অর্থ হাতছাড়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থ কেবলই অর্থহীন।

তিন. যদি কোনো সমাজ স্বীকার করে নেয় বা গ্রহণ করতে রাজি থাকে, তা হলে রাবার ব্যান্ড বা চটি জুতাও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। ইতিহাসের পাতায় আছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সমাজে ক্যান্ডিবার, গরু, বিয়ার বা ওয়াইন, কপার, লৌহ, তামা, স্বর্ণ, ডায়মন্ড এমনকি সিগারেটও বিনিময়ের মাধ্যম এবং অর্থ হিসাবে সেবা দিয়েছে। এগুলোকে বলে দ্রব্যজাত অর্থ বা কমোডিটি মানি। বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে অন্য সব দ্রব্য বিদায় নিলেও সিলভার ও স্বর্ণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মাঠে থেকে যায়। দ্রব্যজাত অর্র্থের প্রধান সুবিধা বা গুণ এই যে, এদের অন্তর্নিহিত দাম থাকে (ইনট্রিনসিক ভেল্যু)। যেমন নারিকেল বা চাল কেউ না নিলেও নিজে খাওয়া যায়; গরু কেউ গ্রহণ না করলেও নিজের প্রয়োজন মেটানো যায়। অন্য অর্থে, নারিকেল, চাল কিংবা গরুর বিক্রয়মূল্য থাকে। যাই হোক, সময়ের বিবর্তনে ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি বেড়েছে বিনিময় এবং স্বভাবতই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে উত্তরোত্তর স্বর্ণ-রুপার চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু মুশকিল হলো, ধাতব দ্রব্যের জোগান খুব সীমিত, কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যয়বহুল খনি খনন করে বের করতে হয় এবং তার পরিমাণ কখনো খুব বেশি, কখনো খুব কম। অর্থাৎ স্বর্ণ-রুপার অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা ও অনিশ্চিত জোগান বিনিময় ব্যবস্থাকে অসংযত করে রাখে, যা আস্তে আস্তে মুদ্রার ওপর আস্থা হ্রাস করে। একটা অর্থনীতিতে অর্থ চলে আস্থার ওপর ভিত্তি করে। সমাজ বা সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে যে, চলমান সম্পদটি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে। একবার এক নাটকে দেখা গেল, হাড় কিপটে লোকটি বস্তায় বস্তায় টাকা জমিয়েছে কিন্তু হঠাৎ খবর পেল যে, সরকার এই টাকা বাতিল ঘোষণা করেছে (ডিমোনিটাইজড)। বাতিল করা মানে যেকোনো কারণেই হোক প্রচলিত মুদ্রার ওপর থেকে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আস্থা উঠে যাওয়া এবং সেই কারণে এই টাকা আর বিনিময়ে ব্যবহার করা যায় না। এই অবস্থায় বস্তার ওপর মাথা রেখে কৃপণের কান্না কে দেখে, ‘তুই আমারে মাফ কইরা দেরে ট্যাহা, আমি তোর লাইগ্যা কিছুই করতে পারলাম না .....’। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, নানান কারণেই প্রচলিত মুদ্রা বাতিল হওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বিশেষ মানের নোট বাতিল করেছিল এবং স্বাধীনতাউত্তর কালে, খুব সম্ভবত ১৯৭৪ সালে, এরূপ আরেকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ আস্থা হচ্ছে মুদ্রার অস্তিত্বের প্রধান সোপান।

চার. বিনিময় প্রথা মানবসভ্যতার ইতিহাসে আদি ঘটনা। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে মানুষ বিনিময় করত পণ্যের বিপরীতে পণ্য দিয়ে। যে প্রক্রিয়ায় বিনিময় সংঘটিত হতো তার নাম ছিল বার্টার পদ্ধতি। প্রয়োজনের তাগিদে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য হাজির করা হতো। যেমন চালের বিপরীতে কাপড় বা দুধের বিপরীতে কলা। অর্থ নিয়ে লেখা বহু পূর্বে রচিত একটা বইতে দেখা যায়, ৫টি গান গেয়ে একজন গায়ক পেয়েছিলেন তিনটি শুকরের ছানা, ২৩টি মোরগ বিশেষ (টার্কিজ), ৪৪টি মুরগির বাচ্চা, ৫০০০ নারিকেল ও বিপুল পরিমাণে লেবু, কলা ও কমলা। যদি ফ্রান্সের মুদ্রায় হিসাব করা হয় তা হলে দেখা যায়, সেই গায়ক পেয়েছিল ৫০০০ ফ্রাঙ্ক। তবে এখন আর সেই দিন নেই। আজকাল একজন সুগায়ক  ৫টি গান গাইলে ট্রাকভর্তি জিনিস নয়, ব্যাগভর্তি টাকা পাবেন আর এই টাকা দিয়ে অবশ্য তারা কিনবেন গায়কের গিটার কিংবা গায়িকার গয়না। যাই হোক, গহিন কোনো গ্রাম ছাড়া আজকাল বার্টার পদ্ধতির উপস্থিতি খুব একটা নেই এবং এর বিলুপ্তির পেছনের কারণ বুঝতে কষ্ট হওয়ারও কথা নয়। যেমন এই পদ্ধতি কার্যকর থাকতে হলে দুই চাহিদার ‘শুভ বিবাহ’ সম্পন্ন হতে হয়। একজনের দুধের প্রয়োজন ও অন্যজনের চালের চাহিদা একই সময় ঘটতে হবে। ক্ষুধার্ত দর্জি যদি বস্ত্রহীন কৃষক না পায় যার কাছে খাবার আছে কিন্তু শার্ট নেই, সেক্ষেত্রে দুজনকেই চাতক পাখির মতো পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে, এমনকি না খেয়েও থাকতে হতে পারে। একে বলে একই সময়ে অভাব মেটানোর অভাব। আর একটা উপমা দেওয়া যেতে পারে। একজনের একটা গরু আছে কিন্তু তার প্রয়োজন, ধরা যাক, তিন কেজি চাল। প্রতিদিন টানাহেঁচড়া করে বাজারে গরু নিয়ে যাওয়ার কষ্ট ছাড়াও তিন কেজি চালের জন্য নিশ্চয়ই পুরো গরুটা বিনিময় করা যায় না; ওদিকে আবার তিন কেজি চালের পরিমাণ দ্রব্য গরুর শরীর থেকে কেটে দেওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে গরু ও চালের মালিকের সম্পদ থাকা সত্ত্বেও না খেয়ে থাকার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এমনি উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং বিনিময় ব্যবস্থা সহজতর, দ্রুত এবং বিস্তৃত করার স্বার্থে, মুদ্রা সমেত আধুনিক অর্থের উদ্ভব ঘটেছে।

পাঁচ. এই ফাঁকে মুদ্রা নিয়ে দুয়েকটা কথা বলতেই হচ্ছে। বাজারে শুধু নতুন মুদ্রা নয়, পুরনো মুদ্রার চাহিদাও কিন্তু কম নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পুরনো মুদ্রা কেনাবেচার বিশাল বাজার রয়েছে। পুরনো মদের মতোই, যত পুরনো মুদ্রা তত তার দাম। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টাঁকশাল রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। এই টাঁকশালে প্রতি বছর এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ধাতব মুদ্রা তৈরি হয়। মানুষের শখের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে মুদ্রা সংগ্রহ। রোমান সম্র্রাট জুলিয়াস সিজারকে প্রথম মুদ্রা সংগ্রাহক হিসেবে ধরা হয়। পাকিস্তানি মুদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসাবে টাকার প্রচলন হয় ৪ মার্চ ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর প্রচুর টাকা খরচ করতে হয় মুদ্রা তৈরি করতে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই মুদ্রা বা অর্থ কথাটা আবার নানান অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। যে জন্য বেশ সতর্কতার সঙ্গে এর আক্ষরিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। যেমন- একজন অর্থনীতিবিদ কনসালট্যান্সির মাধ্যমে অনেক অর্থ উপার্জন করেন কথাটার মানে দাঁড়ায়, তিনি অনেক আয় করে থাকেন। বিল গেটসের অনেক অর্থ আছে বললে ধরে নিতে হবে যে, বিল গেটসের অনেক সম্পদ আছে। ‘শুনেছি আজকাল সহজে অর্থ পাওয়া যায় তাই চলুন না একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলি’ এই কথাটার অর্থ সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তি। আবার, ব্যাংক থেকে অর্থ তোলা মানে প্রচলিত মুদ্রা হাতে নেওয়া। প্রকৃতপক্ষে, অর্থ বলতে ওই সম্পদকে নির্দেশ করবে যা পণ্য ও সেবার বিনিময় কাজে ব্যবহৃত হবে। মোট কথা, অর্থ একটা সম্পদ কিন্তু সব সম্পদই অর্থ নয়।

লেখক: অর্থনীতিক বিশ্লেষক সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত