বর্বর, অমানবিক, নৃশংস কিংবা নারকীয় কোনো শব্দ বা শব্দবন্ধ দিয়ে আর প্রকাশ করা যায় না গাজায় চলমান ইসরায়েলি অভিযানের। গত জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারিতে প্রথম দফার যুদ্ধবিরতির পর দ্বিতীয় দফার আলোচনা চলছিল। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার নতুন করে গাজায় হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এরপর থেকে গতকাল শুক্রবার অবধি প্রায় ৬০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে তারা। এর মধ্যে দুই শতাধিকই শিশু।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের নতুন এ অভিযান আসলে গাজার ভূরাজনীতি বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা। পাশাপাশি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। কেউ কেউ বলছে, এ দফার অভিযান আসলে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি বিতারিত করে ‘দ্বিতীয় নাকবা’ বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের একটি সেনাঘাঁটিতে রকেট হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা দাবি করা সংগঠন হামাস। বিশ্লেষকদের ভাষ্য, এবারের এ হামলা-পাল্টা হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে একটি দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার মুখে ঠেলে দেবে।
গাজায় ইসরায়েলের সর্বশেষ নৃশংস হামলা নিয়ে মিডল ইস্ট আইয়ে লিখেছেন ইসরায়েলি সাংবাদিক ও লেখক মেরন র্যাপোপোর্ট। সেই লেখায় বলা হয়েছে, গাজায় সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে এটা ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে ভয়ানক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সামরিক পদক্ষেপ।
হামলার পাশাপাশি গাজাবাসীর ঘরবাড়ি ছাড়ার নির্দেশও নতুন করে জারি করেছে ইসরায়েল। ফলে গাজা জুড়ে হাজার হাজার মানুষ নতুন করে জোরপূর্বক স্থানচ্যুত ও বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম ‘হারেৎজ’র মধ্যপন্থি সামরিক ভাষ্যকার আমোস হারেলও গত মঙ্গলবার থেকে গাজাবাসীর ওপর শুরু করা হামলাকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকারের স্বার্থে শুরু করা যুদ্ধ বলে মনে করেন।
এ হামলা ও হামলার ধরনের সঙ্গে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সম্পর্ক আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হামলার সঙ্গে তিনটি বিষয়ের সম্পর্কে আছে বলে মনে হচ্ছে। এক. রাজনৈতিকভাবে নেতানিয়াহুর টিকে থাকা। দুই. সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তার আধিপত্য বিস্তার। তিন. জনগণকে উত্তেজিত না করে মিত্রদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা।
চলতি মাসের শেষের দিকে নেতানিয়াহুকে বাজেট পাস করতে হবে। এটা করতে না পারলে তার সরকারের পতন হবে এবং নতুন নির্বাচন দিতে হবে। বাজেট যদি পাস করা যায়, তাহলে ২০২৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নেতানিয়াহুর সরকার টিকে যাবে। তাই বাজেট পাস করতে পারাটা তার সরকারের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
গত মঙ্গলবার গাজায় হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টা পর বেন-গভির ঘোষণা দেন, তার দল আসলেই সরকারে ফিরতে যাচ্ছে। কারণ যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার তাদের যে দাবি ছিল, তা পূর্ণ হয়েছে। এর অর্থ হলো এখন জুদায়িজম পার্টি বিপক্ষে ভোট দিলেও বাজেট পাস হবে। এটা নেতানিয়াহুর জন্য নগদ লাভ।
গাজায় নতুন করে হত্যাযজ্ঞ শুরুর পেছনে ট্রাম্পেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছিলেন নেতানিয়াহু। সেখান থেকে ফেরার পর থেকে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি জোরেশোরে অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে, যেখানে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি বা আইন তোয়াক্কা করার কোনো গরজ নেই। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর থেকে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টিটিউট থেকে বিরোধীদের ব্যাপক হারে ছাঁটাই করা শুরু করেছেন। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘শিন বেত’-এর শীর্ষ পদে রদবদল করা হয়েছে। হারজি হালেভিকে বাদ দিয়ে ইয়াল জমিরকে নতুন সেনাপ্রধান করা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি মেনে না চলার বিষয়েও নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্টের মনোভাব অনুসরণ করেছেন। ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে গত জানুয়ারিতে হওয়া চুক্তিতে বলা হয়েছিল, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ কার্যকর হওয়ার ১৬ দিন পর দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছানো সম্ভব না হলেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। কিন্তু ট্রাম্পের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে নেতানিয়াহু মনে করলেন, তিনি লিখিত চুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারেন এবং সবচেয়ে নির্মম উপায়ে গাজায় হামলা চালাতে পারেন।
গত মঙ্গলবার পুরো হামলা যুদ্ধবিমান দিয়ে চালানো হয়েছে। এতে স্থলবাহিনী অংশ নেয়নি। শুধু যুদ্ধবিমান থেকে বোমা হামলা চালানোর মধ্যেও ইসরায়েলের ঘরোয়া রাজনীতির চিত্র ফুটে উঠেছে। যদিও নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার অনিচ্ছা এবং যুদ্ধ পুনরায় শুরুর বাসনা গোপন করেননি। পাশাপাশি তার অতি ডানপন্থি মিত্র বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ গাজা উপত্যকা দখলে নেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে বিতাড়নের দাবি জানিয়েছেন।
অবশ্য গাজা বা অন্তত উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চল দখল করতে গেলেও হাজার হাজার সেনা সমাবেশের প্রয়োজন হবে। কিন্তু এটা করতে গেলে নেতানিয়াহু সরাসরি বা অনানুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রত্যাখ্যানের মুখে পড়তে পারেন। সেনাসদস্য নিয়োগ দিতে গিয়ে গণপ্রত্যাখ্যানের মুখে পড়তে হলে তা সেনাবাহিনীর জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে গণ্য হবে। অথচ এ সেনাবাহিনীই এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সমাজের অস্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা বিল্ডিং ব্লক। সেনাবাহিনী ধাক্কা খেলে তা ইসরায়েলের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করবে।
তাই এসব কিছু আমলে নিয়ে অন্তত এখন পর্যন্ত শুধু বিমান হামলার ওপর নির্ভর করাকে নিরাপদ মনে করছেন নেতানিয়াহু। আপাতত বোমা ফেলাটাই নেতানিয়াহুর জন্য রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সুবিধাজনক। কারণ, এতে সংরক্ষিত সেনা বা রিজার্ভিস্টদের যুদ্ধের মাঠে পাঠাতে হচ্ছে না বা সেনাসদস্যদের ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে না।
দ্যা গার্ডিয়ান বলছে, সরকারকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহু উল্লিখিত সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। কারণ, এসব হামলার সামরিক উদ্দেশ্য প্রায় অস্তিত্বহীন। এসব হামলার নেতানিয়াহুর একমাত্র সম্ভাব্য সামরিক লক্ষ্য হলো হামাসকে আরও চাপে রাখা, যাতে গোষ্ঠীটিকে এক ধাপের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করা যায়। এতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই সব জিম্মিকে উদ্ধার করা যাবে।
এবারের বোমা হামলার পর দ্বিতীয় ধাপের চুক্তির কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই যদি হামাস কিছু জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়, তা নেতানিয়াহুর পক্ষে যাবে। তখন তিনি বলতে শুরু করবেন, সামরিক চাপ দিয়েই তাদের মুক্ত করা গেছে। নির্বাচনেও তিনি এর সুবিধা নিতে পারেন। এরই মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহে তিনি এমনটি করেছেন। কিন্তু সেটা তো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পরিষ্কার কোনো লক্ষ্যবস্তু নয়। খোদ ইসরায়েলই বলছে, এবারের হামলায় হামাসের যেসব কর্মকর্তা মারা গেছেন, তারা গোষ্ঠীটির গাজার বেসামরিক প্রশাসনের। এবারের হামলায় হামাসের সামরিক সক্ষমতার ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
এসব কিছুর কারণে বলা যায়, গাজায় এবার ইসরায়েলে নতুন করে যে অভিযান শুরু করেছে, তার উদ্দেশ্য ঘরোয়া রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধি। অবশ্য মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়নকেন্দ্রের সহযোগী অধ্যাপক সেরহান আফাকান বলেছেন, ইসরায়েলের এবারের অভিযান আসলে গাজাকে আমূল বদলে দেওয়ার পদক্ষেপ। নেতানিয়াহুর রক্তপিপাসাই শুধু গাজার এ পরিণতির কারণ নয়। এটা ওই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বের ফসল।