বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ। সংস্থাটি জানিয়েছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ৫০টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল রবিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স এ তথ্য জানান।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, মাগুরার আট বছরের শিশুটির মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। বাংলাদেশে শিশুরা, বিশেষ করে কন্যাশিশুরা, কীভাবে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো ও নিরাপত্তার গুরুতর লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, সেটা ওই শিশুর মৃত্যু আমাদের ভয়ংকরভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ইউনিসেফের প্রতিনিধি বলেন, দুঃখজনকভাবে, এ ছোট শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি শিশুদের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক যেসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে সেগুলোর মধ্যকার একটি ঘটনা হলেও ইউনিসেফের নিরীক্ষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া শিশুদের সংখ্যা বেদনাদায়ক, উদ্বেগজনক। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত সময়ে সংবাদমাধ্যম ও স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো শিশু ধর্ষণের প্রায় ৫০টি ঘটনা রেকর্ড করেছে। আর এ প্রবণতা যেন দিন দিন আরও ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে শুধু ১০ মার্চ (সোমবার) এক দিনে সাতটি শিশু নিহত হয়েছে এবং ছয়টি শিশুর সঙ্গে সহিংসতার ঘটনা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব পরিসংখ্যান কেবল নিছক কোনো সংখ্যা নয়; এরা বিপন্ন জীবনের কথা বলে, নির্যাতনের শিকার হয়ে বেঁচে যাওয়া শিশুরা যে বিরাট মানসিক অভিঘাতের শিকার হয়, তার কথা বলে। ভুক্তভোগী পরিবার ও কমিউনিটিগুলোর বয়ে বেড়ানো অকল্পনীয় কষ্টের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে তুলে ধরে।
এসব ঘটনায় দেশ জুড়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে ঘরে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাদের কাছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা সুরক্ষিত থাকে বলে সবাই আস্থা রাখে, সেসব মানুষের হাতে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা লঙ্ঘন হওয়ার ঘটনা সবার মনে গভীর দাগ কেটেছে, নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
বিবৃতিতে রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ইউনিসেফের হিসাবে বিশ্বে বর্তমানে বেঁচে আছে এমন প্রতি আট নারী ও শিশুর মধ্যে একজন ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। আর বাংলাদেশে সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব অপরাধী প্রায়ই ভুক্তভোগীদের পরিচিত হয়ে থাকে। এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অপরাধীদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার যে নির্দেশ দিয়েছে, সেটাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধকে এর যথাযথ নাম ‘ধর্ষণ’ বলে সম্বোধন করার ওপর জোর দিচ্ছি।
তিনি বলেন, নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর সহিংসতার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতার’ (জিরো টলারেন্স) নীতির প্রতি অঙ্গীকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছে ইউনিসেফ। পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে ক্ষতিকর আধেয় (কনটেন্ট) অপসারণে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রচেষ্টারও প্রশংসা করছি আমরা।
বিবৃতিতে বলা হয়, যেহেতু এসব পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি, এগুলোকে শিশুদের ওপর সহিংসতার মূল কারণগুলো মোকাবিলায় একটি বৃহত্তর ও স্থায়ী প্রচেষ্টার অংশ করে নিতে হবে। এমন একটি সমাজ নির্মাণ করতে হবে, যেখানে প্রতিটি শিশু ভয় ও সহিংসতা থেকে মুক্ত হয়ে বেড়ে উঠতে পারবে, তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ও সব অংশীদারের শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোতে বিনিয়োগ এবং সেগুলো জোরদারে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে জোরালো তদন্ত, প্রসিকিউশন ও বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুর ওপর সহিংসতার সব ঘটনার বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে একটি বিশেষায়িত শিশু সুরক্ষা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। এই ইউনিটের সদস্যদের মানসিক আঘাতপ্রাপ্তদের বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনার প্রশিক্ষণ এবং ভুক্তভোগীর প্রতি সংবেদনশীল মনোভাব নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। তাছাড়া সমাজসেবায় নিয়োজিত জনবল বৃদ্ধি এবং তাদের পেশাগত উৎকর্ষ আনা গেলে, তা ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারগুলোকে জেন্ডার-সংবেদনশীল ও শিশুকেন্দ্রিক সহায়তা প্রদানে কাজে দেবে। ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই স্বাধীন ও জেন্ডার-সংবেদনশীল প্রসিকিউটর নিয়োগ দিতে হবে, যাতে সময়মতো বিচার নিশ্চিত হয়। পাশাপাশি ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ করা সরকারের যে লক্ষ্য, তা অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
রানা ফ্লাওয়ার্স শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গঠনে সংবাদমাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, কর্র্তৃপক্ষগুলোকে নৈতিকতাসম্পন্ন (ইথিকাল) মিডিয়া ও শিশু সুরক্ষার নীতিগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া চলাকালে শিশুর মর্যাদা ও কল্যাণ রক্ষিত হয়। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমগুলোকে নির্যাতনের শিকার শিশু ও ভুক্তভোগীদের পরিচয়, গোপনীয়তা এবং মর্যাদা সুরক্ষিত রেখে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরকে চটকদার করে অহেতুক উত্তেজনা তৈরি পরিহার করার এবং ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার ও কমিউনিটির আরও ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, শিশুদের নিরাপত্তায় ঘাটতি, বাল্যবিবাহ এবং শিশুর ওপর অন্যান্য ধরনের সহিংসতা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। প্রতিটি শিশুর একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার রয়েছে এবং তা ঘরে ও জনসমাগমস্থল উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিশেষ করে তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া চলাকালে সহিংসতার শিকার শিশু কোনোভাবেই যেন আর মানসিক আঘাতের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতার শিকার শিশুসহ প্রতিটি মানুষই মর্যাদা, ক্ষত সারিয়ে ওঠা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। কর্র্তৃপক্ষ, সংবাদমাধ্যম, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও জনসাধারণ সবাইকে এটা মেনে চলতে হবে। এটা তাদের সেরে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। শিশু ভুক্তভোগীদের জন্য দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং এখানে কোনো আপস চলবে না। যারা দায়ী তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
