সরকারি চাকুরিজীবীরা আইনে, বিধিবিধানে সবাই কর্মচারী। কর্মকর্তারা এর মাঝেও নিজেদের আলাদা ভাবতে ভালবাসেন, নিজেদের একটু আলাদা রাখেন। সুযোগ-সুবিধার পাল্লাও তাদের দিকেই হেলে থাকে। কর্মচারীরা উপেক্ষিত থাকেন। আবার অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীদের সুবিধার তুলনায় সচিবালয়ের কর্মচারীরা পিছিয়ে আছেন। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর বৈষম্য কমার আশা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তা তো কমেইনি বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে।
গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ সরকারকে বলেছে, তাদের সঙ্গে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বৈষম্য দূর করার জন্য তারা রেশনসুবিধা চেয়েছে। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের কাছে লেখা আবেদনে বলা হয়েছে, ‘সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দক্ষতার সঙ্গে সুচারুভাবে কাজ করেন। এসব করতে ছুটির দিনে বা নির্দিষ্ট সময়ের পরও অফিস করতে হয় তাদের। এজন্য তাদের অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা বা রেশন বা সচিবালয়ভাতা দেওয়া হয় না। কিন্তু অন্যান্য দপ্তর, অধিদপ্তর বা সংস্থার প্রায় ৮ লাখ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রেশনের পাশাপাশি ঝুঁকিভাতাও পায়।’
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘১৭টি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন পায়। কিন্তু সচিবালয়ের কর্মচারীরা পায় না। এর বাইরেও অনেক বৈষম্য রয়েছে। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে ভুগছি।’
এর আগে বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি অর্থ সচিবকে জানিয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন ও ৩০ শতাংশ হারে ঝুঁকিভাতা পায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন পায়। এসএসএফের বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন ও ৫০% বিশেষ ভাতা, বিজিবি’র পোষাকধারী ও পোশাকবিহীন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন ও ৩০ শতাংশ হারে সীমান্তভাতা, ফায়ার সার্ভিসের বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন ও ৩০ শতাংশ ঝুঁকিপাতা পায়। রেশন ও ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা পায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এছাড়া কারা অধিদপ্তরের বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, পুলিশের নির্দিষ্ট পোশাকবিহীন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঝুঁকিভাতা পায়। লেজিসলেটিভ বিভাগের কর্মকর্তারা ৩০ শতাংশ ভাতা পায়। র্যাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রেশন ও ঝুঁকিভাতা পায়। প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের অসামরিক কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ ক্ষতিপূরণভাতা পায়।
জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ পে কমিশনসহ আগের সব পে কমিশন বেতন-ভাতা ও মর্যাদায় বৈষম্য দূর করার সুপারিশ করেছে। কিন্তু সুপারিশ আমলে না নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৈষম্য আরো বেড়েছে। ২০১৫ সালের পে স্কেল কার্যকরের পর নির্বাহী আদেশে গাড়ি-প্রাধিকার উপসচিব পর্যায়ে নামিয়ো আনা হয়। প্রতিমাসে রক্ষণাবেক্ষণ খরচের নামে যে টাকা দেওয়া হয় তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৈষম্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। টেলিফোন বিল বাড়িয়ে নগদ অর্থগ্রহণের নীতির ফলে কর্মকর্তাদের মোট ভাতার পরিমাণ বেড়েছে। ইন্টারনেট ভাতা, প্রশিক্ষণ ভাতা বাড়ানো এবং বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির বৈঠকে অংশগ্রহণের সম্মানী নির্ধারণ ও বৃদ্ধির ফলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কর্মচারীদের বৈষম্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁচেছে।
সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের উচিত বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করা। বৈষম্য ভয়ংকর সংকট সৃষ্টি করে।’
উপসচিব ও তার নিচের ধাপের কর্মকর্তারা সিলেকশন গ্রেডের সুবিধা পেতেন। এর সঙ্গে টাইম স্কেলের সুবিধা ক্যাডারবিহীন কর্মকর্তা ও সব শ্রেণীর কর্মচারীর জন্য ছিল। চাকরি জীবনে ন্যূনতম দুটি পদোন্নতির সুযোগ দিয়ে সর্বশেষ পে কমিশন টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করার সুপারিশ করে। কিন্তু সরকার টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করলেও পদোন্নতির শর্ত পূরণ করেনি। ফলে কর্মচারীরা আরো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট জারি হয় ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর। অথচ বেতন স্কেল কার্যকর করা হয়েছে ২০১৫ সালের ১ জুলাই। আগের বেতন স্কেল অর্থাৎ ২০০৯ সালের বেতন স্কেলের সুবিধা নতুন স্কেল কার্যকারের আগের দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ ছিল। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সমান হারে বেতন বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ যাদের টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড কেটে নেওয়া হয়েছে তাদের বেতন যে হারে বেড়েছে আর যাদের টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল না তাদেরও একই হারে বেতন বাড়ানো হয়েছে। এতে কর্মচারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা শুধু পদোন্নতি নয়, উচ্চতর বেতন থেকেও বঞ্চিত। এ অবস্থার অবসানে বিকল্প সিদ্ধান্ত নেন রাজনীতিকরা। কিন্তু আমলাদের বিরোধিতায় তা কার্যকর করা যায়নি। সিদ্ধান্তটি ছিল: যেকোনো কর্মচারী ১০ বছর চাকরির পর উন্নত গ্রেডে পদোন্নতি পাবেন। উন্নত গ্রেডে ছয় বছর পূর্ণ করার পর তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরে আরেকটি পদোন্নতির সুযোগ পাবেন। এ ব্যবস্থায় প্রত্যেকের চাকরিজীবনে দুটি পদোন্নতির সুযোগ তৈরি হত। এত কর্মচারীদের ক্ষোভ থাকত না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আগের পে কমিশনগুলো চার সদস্যের পরিবার ধরে বেতন বাড়ালেও সর্বশেষ পে-কমিশন বাবা-মাসহ ছয় সদস্যের পরিবার ধরে শতভাগ বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করে। পে-স্কেলের ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১৬টি গ্রেড করার সুপারিশও করে। এটাও আমলে নেয়নি সরকার। অথচ ১৯৭৩ সালে শতাধিক স্কেল ভেঙে মোট ১০টা গ্রেডে বেতনভাতা চালু করা হয়েছিল।
পে-স্কেলে গ্রেডের সংখ্যা কম থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য কম হয়। এ কারণেই আপাতত ১৬টি গ্রেড করে পরে তা আরও কমিয়ে আনার সুপারিশ করে পে-কমিশন। এ সুপারিশও মানেনি সরকারি কর্মকর্তারা।
নতুন পে-স্কেলের আওতায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় শতভাগ বেতন বাড়ানোর পরে নির্বাহী আদেশে সেবাখাতে যে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে তার প্রভাব কর্মচারীদের ওপর পড়েছে বেশি। সপ্তম বেতন স্কেলে সর্বোচ্চ বেতন ছিল ৪০ হাজার টাকা। অষ্টম বেতন স্কেলে তা হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা। অন্যদিকে সর্বনিম্ন ধাপে বেতন বাড়ে ৪ হাজার ১৫০ টাকা। এ কথা জানিয়ে এক কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০১৫ সালে নতুন পে-স্কেল কার্যকরের পর গ্যাস বিল ছিল ৪৫০ টাকা। সেটা এখন হয়েছে ৯৭৫ টাকা। অর্থাৎ নতুন বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর ৫২৫ টাকা গ্যাস বিল বেড়েছে। যাদের বেতন ৩৮ হাজার টাকা বেড়েছে তাদের গ্যাসবাবদ ব্যয় বেড়েছে বর্ধিত বেতনের মাত্র ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে যাদের বেতন বেড়েছে ৪ হাজার ১৫০ টাকা তাদের এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ১২ দশমিক ৬৫ টাকা। বিদ্যুৎ বিলে ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেও কর্মচারীদের একই পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।
ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদ শূন্য না থাকার পরও সুপার নিউমারারি হিসেবে যথাসময়ে পদোন্নতি হচ্ছে। তাদের আর্থিক সুবিধা বাড়ছে। সর্বশেষ বেতন স্কেল কার্যকরের পর উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে দফায় দফায় পদোন্নতি হয়েছে। আর কর্মচারীদের পদোন্নতিযোগ্য পদ শূন্য হলেও তারা পান না।
সর্বশেষ পে-স্কেল অনুযায়ী উপসচিবদের গাড়িসেবায় নগদায়ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তারা ৩০ লাখ টাকা বিনা সুদে ঋণ পান। এ টাকার ১০ ভাগ অবচয়সুবিধা হিসেবেও নিচ্ছেন। এতে কর্মকর্তাভেদে ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়। বাকি টাকা পরিশোধ করতে হয় না। গাড়ি চালানোর জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ পান। বিভিন্ন বিভাগীয় পদোন্নতি সভায় (ডিপিসি) অংশ নেওয়ার জন্য অবস্থানভেদে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা সম্মানী পান কর্মকর্তারা। আগে ডিপিসিতে অংশ নেওয়ার জন্য সম্মানী ছিল না। এ সম্মানীর পরিমাণও বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সরকারি টেলিফোন, সেলুলার ফোন, ফ্যাক্স ও ইন্টারনেট বিষয়ক নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে ২০১৮ সালে। নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি টেলিফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের বিল কর্মকর্তাদের বেতনের সঙ্গে পরিশোধ করা হয়। তারা অপারেটরকে পরিশোধ করেন। এর আগে সরকার বিটিসিএল বা প্রাইভেট অপারেটরকে বিল পরিশোধ করত। কর্মকর্তাদের নামে টেলিফোন সংস্থাগুলো যে বিল করত তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অফিসে জমা দিতেন। অফিস পরিশোধ করত। এখন সচিবদের টেলিফোনসুবিধা সীমাহীন।
গৃহ পরিচারক/পরিচারিকা সুবিধারও নগদায়ন হয়েছে। তাদের মাসোহারার টাকা সচিবের অ্যাকাউন্টে যায়। আগে পরিশোধ করত সরকার। অথচ কর্মচারীদের কিছু সুবিধা খর্ব করা হয়েছে। কম্পিউটার অপারেটর, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের দুটি উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের দুটি অগ্রিম ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করা হয়েছে।