বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

চাঁদরাতের গল্প

আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৬ এএম

রবি, শশীদের বাড়ির একটা চকচকে, ঝকঝকে কাঠের আলমারি। তার ভেতরে নতুন জামা, জুতো, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, লেহেঙ্গা, টুপি। কেউ হেলান দিয়ে বসে আছে, কেউ শুয়ে আছে। শুয়ে-বসে খুব আড্ডা হচ্ছে ওদের। আড্ডার বিষয় আগেরকার দিনের ঈদ। ওদের তখন জন্মই হয়নি। মা, মামা, কাকা, দাদা, নানির মুখে শোনা ঈদের গল্প করছে নিজেরা নিজেরা। জামা বলল, ‘গল্পটা নানির কাছে শুনেছি। এক ঈদে তাকে যার জন্য কেনা হয়েছিল সেই ছোট তুলতুলে বাবুটার নাম নাসিমা। নানিকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর থেকেই নাকি নাসিমা হাতছাড়া করে না। একটা ব্যাগে ভরে ব্যাগটা বগলে নিয়ে ঘুরে। পিছে কেউ দেখে ফেলে তাই...’।

কথার মাঝখানে জামাকে থামিয়ে দিয়ে জুতো বলল, ‘একদম! একদম! আমার দাদার বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছিল। দাদা যে বাবুটার জুতা ছিল ওর নাম রফিক। রফিকের জুতো, মানে দাদাকে কেউ দেখে ফেলবে তাই রফিক জুতোজোড়া সাথে নিয়েই ঘুমাতো হা হা হা।’

জামা, জুতোর কথা শুনে টুপি অবাক হয়ে বলল, ‘মামা ঈদের কত গল্প করেছে আমার সাথে। কই! এ রকম কিছু বলেনি তো! তোমাদের জামা নানি, আর দাদা জুতোকে লুকিয়ে রাখতো কেন শুনি?

জামা বলল, ‘লুকিয়ে না রাখলে কেউ যদি দেখে ফেলে! তখন পুরনো হয়ে যাবে যে! তাই নাসিমা ওর ঈদের জামা মানে নানিকে প্রথমে ব্যাগে করে নিয়ে ঘুরতো, পরে আলমারিতে লুকিয়ে রাখত’।

জুতো জোড়ার দিকে তাকিয়ে টুপি বলল, ‘তোমার দাদারও তাহলে একই ঘটনা?’

জুতো জোড়া বলল, ‘হ্যাঁ! এটাই কারণ। তবে একবার নাকি কে রফিকের জুতো মানে দাদাকে ঈদের আগেই দেখে ফেলেছে, তখন থেকে রফিকের সে কী কান্না! গল্পটা বলতে বলতে দাদা খুব হাসছিল।’

শুনে টুপিও মিটমিটিয়ে হাসে। প্যান্টের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী প্যান্ট বাবু! তোমার কোনো গল্প নাই?’

‘আলবাত আছে! মামার কাছে শোনা। এখন বেশ বয়স হয়েছে তার। এখানে ছেঁড়া, ওখানে ছেঁড়া, পেছনের দিকে একটুখানি পুড়েও গেছে। এ রকম নানা অসুখ-বিসুখে ভরা মামার শরীর। অনেক দিন দেখা নেই মামার সঙ্গে। কই যে থাকেন কে জানে!’

জামার যেন ধৈর্য ধরে না আর। বলল, ‘সে আমার নানিরও বয়স হয়েছে। তারও অসুখ-বিসুখ আছে শরীরে। এখন তোমার মামার ঈদের গল্পটা বলো শুনি।’

‘বেশ! বলছি। মামা ঈদে যার হয়ে বাড়ি গেল সেই বাবুর নাম আলফাজ। ঈদের আগের দিন, মানে চাঁদরাতে ইফতারের পর বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আলফাজ আনন্দে নাচছে আর ‘চাঁদ উঠবে’ ‘ঈদের চাঁদ উঠবে’ বলে হইচই করছে। বাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় পশ্চিম আকাশে ঈদের চাঁদ দেখার জন্য। আলফাজ তো ছোট! অত নিচে থেকে বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখতেই পারছে না। তাকে ধরে উঁচু করে ঈদের চাঁদ দেখায় আলফাজের বাবা। চাঁদ দেখতে পেয়ে আলফাজ তখন কী খুশি!’

লেহেঙ্গা বলল, ‘আমার এই গল্পটা মায়ের কাছে শুনেছি। মাকে কেনা হয়েছিল যে বাবুর জন্য! ওর নাম রাইসা। সে নাকি একটু পর পর বিছানার ওপর মাকে ট্রায়াল দিত আর বারবার দেখত। মা লেহেঙ্গাকে পেয়ে খুশিতে ঘুমই হতো না রাইসার।’

শুনে টুপি বলল, ‘তোমাদের মা, মামা, দাদা, নানির ঈদ কত্তো মজার ছিল!’

পাশ থেকে পাঞ্জাবিটা বলে উঠে, “আমার কাকার ঈদও খুব মজার ছিল। বলছি শোনো, ঈদে কাকা ছিল তামিম নামের এক বাবুর নতুন পাঞ্জাবি। ফজরের আজানের পর মাইকে ‘ঈদ মোবারক’, ‘ঈদ মোবারক’ ডাক বেজে উঠতেই তামিমের ঘুম ভেঙে গেল। আধো-অন্ধকারে আলো দেখার চেষ্টা করে তামিম। দেখে ভোর হওয়ার আগেই তামিমের আম্মা নতুন বিছানার চাদর বিছানোর জন্য ঝাড়– নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তামিমকে ডাকছে উঠো উঠো উঠো। ঈদের দিন সকালে মায়ের অমন ডাকে সে কী আনন্দ তামিমের!”

তারপর সবাই একযোগে টুপিকে জোর করেই ধরে বলল, ‘আমরা তো আমাদের মা, মামা, দাদা, নানি, কাকার ঈদের গল্প শোনালাম। তোমার কাছে কারোর ঈদের গল্প নেই বুঝি!’

টুপি মুখ টিপে হেসে বলল, ‘নেই আবার! আমি বাবার ঈদের গল্পও জানি, নানারটাও জানি। আগে নানার গল্পটা বলি শোনো। ঈদে নানা পাঞ্জাবিকে কিনে দেওয়া হয়েছিল হিটলু নামের এক বাবুকে। তো হিটলু আর ওর কাজিনরা মিলে হাট থেকে চানাচুর, বিস্কুট, সন্দেশ, হজমি, মনেক্কা, চকোলেট কিনত। কিনে বাড়িতে এসে একজনের পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখত। সাজিয়ে রাখা পড়ার টেবিলটা আসলে দোকান। দোকানে ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই বেছা শুরু হতো। কিনতো ওদের বয়সী বাচ্চারাই। ঈদে ওদের সেই দোকান দোকান খেলা ভারি মজার ছিল। আর আমার বাবা কী বলত জানো! বলত বাবা ছিল পুতুল নামের একটা বাবুর মাথায়। তাকে আসলে কেনা হয়েছিল পুতুলের ভাই সোহাগের জন্য। কিন্তু বাবা টুপিটাকে পুতুলের এতই পছন্দ হয়েছে যে টুপিটা তার চাই-ই চাই। এমন বায়না শেষে পুতুলের মাথায়ই জায়গা হয় বাবার। বাবাকে মাথায় নিয়ে পুতুলও ভাইয়ের সাথে সাথে বড়দের সালাম করছে। ঈদ সালামির জন্য। বড়দের সালাম করা শেষে পুতুলরা ভাইবোনেরা গুনত কে কত সালামি পেল। কারও এক টাকা বেশি হলে সে কী আনন্দ তার!’

এতটুকু বলে টুপি চুপ হয়ে গেল। জামা, পাঞ্জাবি, প্যান্ট, জুতো, লেহেঙ্গাও চুপ। কিছুক্ষণ নিরবতা শেষে জামা বলল, ‘আচ্ছা! আমরা নিজেদের ঈদের গল্প রেখে আমাদের বাপ-দাদার সময়কার ঈদ নিয়ে কেন গল্প করছি’?

জুতো বলল, ‘কেন আবার! তাদের সময়কার ঈদ প্রাণবন্ত ছিল তাই। তাদের নিয়ে বাবুরা কত মজা করত! এখনকার বাবুদের কোথায় সেই আনন্দ! রাত পোহালে ঈদ, অথচ দেখো আমাদের আলমারি বন্দি করে রবি, শশী দিব্যি মোবাইলে গেম খেলে বেড়াচ্ছে, ট্যাব নিয়ে পড়ে আছে। চাঁদরাত, নতুন জামা, জুতো তো দূরের কথা! ঈদের  সালামি নিয়েও এখনকার বাবুবের তেমন উৎসাহ নেই’।

পাশ থেকে পাঞ্জাবিটা ফট করে বলে উঠল, ‘আছে! আছে! এখনকার বাবুরা ভেরি স্মার্ট! ওরা ট্যাবে, মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে সালাম করে, সালামিও চায়।’

পাঞ্জাবির কথা শুনে সবাই হাহা হিহি করে হেসে উঠল।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত