মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সেমিনারে জ্বালানি উপদেষ্টা

লোডশেডিং হবে সহনীয়, গ্রাম-শহরে থাকবে না বৈষম্য

আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২৩ এএম

এবারের গরমে বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে থাকবে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ কারণে বাড়তি এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আনা হচ্ছে। জ্বালানি তেল এখন যেটা পিডিবি নিচ্ছে না, সেটাও নেওয়া হবে। আশা করছি, অনেকটা ম্যানেজ করতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘এরপরও সামান্য পরিমাণে যে লোডশেডিং হবে, তা গ্রাম ও শহরে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো বৈষম্য থাকবে না।’

গতকাল শনিবার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনের বিজয় হলে ‘জ্বালানি সংকট উত্তরণের পথ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন ফাওজুল কবির খান। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের সহায়তায় এই সেমিনারের আয়োজন করে জ্বালানি খাতে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স, বাংলাদেশ (এফইআরবি)।

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, জ্বালানি খাতে বকেয়া পরিশোধে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার বকেয়া ছিল। এতে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় বেশি হচ্ছিল। ইতিমধ্যে পুরনো অনেক বকেয়া বিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তাই কয়লা, এলএনজি, জ্বালানি তেলের মতো প্রয়োজনীয় রসদ আমদানি করা যাবে। আশা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি সামলানো যাবে। ইতিমধ্যে দিনে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। লোডশেডিং হয়েছে ১৭৯ মেগাওয়াট।

বকেয়া শোধ করতে গিয়ে ভর্তুকি বেড়েছে, এটি আরও বাড়বে কি না; সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, চলতি অর্থবছরে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো হয়েছে। সাশ্রয় করা অর্থ বকেয়া শোধে কাজে লেগেছে। আগামী বছর তো বকেয়ার দায় নেই। তাই যতটুকু আমদানি হবে, ততটুকুর বিল। ভর্তুকি বাড়বে না, আরও কমবে।

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র জমা না দেওয়ার বিষয়ে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলার কমিটি কথা বলেছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সংশোধন করা হচ্ছে। এরপর নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।

তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হাতে দেওয়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বিইআরসিতে দিতে চান। তবে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে কী হবে? এখন তো সরকার ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করে। তাই এটা নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। এখন তেলের দাম কম। প্রতিবেশী দেশের দাম বিবেচনায় কমানো হচ্ছে না। এ রকম নানা বিষয় চিন্তা করতে হয়। নাজুক পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে কি না; সেটাও বিবেচনায় রাখতে হয়।

কাতারের জ্বালানিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বকেয়া শোধ করায় আমদানি করা এলএনজির দাম কমানোর বিষয়ে বলা হয়েছিল। কাতার বলেছে, বিদ্যমান চুক্তিতে কিছু করা যাবে না। তবে ভবিষ্যতে আরও এলএনজি আমদানি করা হলে, তারা কম দামে দেবে।

শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, বেশি দামে গ্যাস নেওয়ার জন্য ৬০০ থেকে ৭০০ আবেদন জমা পড়েছে। তারা প্রতি ইউনিট ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দিয়ে গ্যাস নিতে চায়। অথচ সবাই বলেছে, বিনিয়োগ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। আর বলছে বৈষম্য, কীসের বৈষম্য। যার প্রয়োজন সে যদি বেশি দামে নেয়, তাহলে কীসের বৈষম্য। গ্যাসের দাম বেশি হলে তারা বিকল্প জ্বালানি দেখবে।

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ খাতের মূল সমস্যা হলো ভোক্তাদের শোষণ করার জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তিগুলোয় ট্যারিফ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই ট্যারিফ পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি কাজ করছে। কয়লা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচকে বেঞ্চমার্ক ধরা হয়েছে।

সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা স্বল্প মেয়াদের সরকার। জ্বালানি খাতের উন্নয়ন সময়সাপেক্ষ। কোথাও গ্যাস পেলে তা উত্তোলন করে সরবরাহ করতেই কয়েক বছর লেগে যায়। দেশের জ্বালানি সমস্যা স্থায়ীভাবে দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ দরকার।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, এখন দেশে ব্যবহৃত গ্যাসের ২৫ শতাংশ আমদানি হয়। ২০৩০ সালে আমদানি করা এলএনজির অংশ হবে ৭৫ শতাংশ এটা বলেই শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল পেট্রোবাংলা। পুরোপুরি আমদানির দিকে চলে যাচ্ছে জ্বালানি খাত। কয়লা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার না করে বেশি খরচের তেলচালিত কেন্দ্র চালানো হচ্ছে। জ্বালানি শুধু উন্নয়নের বিষয় নয়, ন্যায়ের বিষয়, যা প্রতিষ্ঠা করা যুদ্ধের মতো।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যে লুটপাট করেছে, সেটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে পারেন। দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি করেছে, তার নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্র পড়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জ্বালানিনীতির সংস্কার দরকার। যেখানে জ্বালানি রূপান্তরের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে থাকবে। সংকট সমাধানে বর্তমান সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত জ্বালানি রূপান্তরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে আসছে। জ্বালানি চাহিদার প্রক্ষেপণ নতুন করে মূল্যায়ন করা দরকার। কোনোভাবেই এলএনজিকে উৎসাহিত করবেন না, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান বাড়াতে হবে।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দেশে নতুন গ্যাস কূপ খননে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উচ্চদামে এলএনজি আমদানি করে দেশের সংকট মোকাবিলার উদ্যোগ নিলেও মূলত তাদের লক্ষ্যই ছিল দুর্নীতি। বর্তমান সরকার সেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে সেই পুরনো নীতিই চালু রেখেছে।

ড. ইজাজ হোসেন তার মূল প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকট আসলে ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে, গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে এবং গ্যাসের পরিবর্তে জ্বালানি তেল ব্যবহার হচ্ছে, যার ফলে সরকারের জ্বালানি ভর্তুকির বোঝা বেড়ে গেছে। ভর্তুকির চেয়ে সাময়িক সময়ের জন্য কিছু লোডশেডিং অনেক ভালো।

তার প্রবন্ধে বলা হয়, ২০৩০ সালের পর বাংলাদেশকে প্রতিদিন ২৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হবে এবং জাতীয় গ্রিডে কমপক্ষে ১,৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের জন্য দুটি নতুন এফএসআরইউ তৈরি করতে হবে।

ড. ইজাজ ১০ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আবাসিক এবং যানবাহন ক্ষেত্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের পরামর্শ দিয়ে প্রয়োজনে এলপিজি ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলেন। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাকে ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে বড় আকারে গ্যাস অনুসন্ধান ও নতুন কূপ খননে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।

এফইআরবির চেয়ারম্যান মো. শামিম জাহাঙ্গীরের সভাপতিত্বে সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সেরাজুল ইসলাম। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান, পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম প্রমুখ।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত