সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) মাধ্যমে দেশে বর্তমানে ১২টি রোগপ্রতিরোধে ১০ ধরনের টিকা দিচ্ছে সরকার। প্রতিবছর ৩৭ লাখের বেশি শিশু নিয়মিত এসব টিকা পাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে টিকাদানের হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। সেটি এখন ৮৪ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে দুর্গম ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং মাতৃশিক্ষার অভাবের কারণে এখনো টিকার সুবিধা ও গ্রহণযোগ্যতায় বৈষম্য রয়েছে।
টিকা ব্যবস্থাপনার বৈশ্বিক জোট ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন’ বা গ্যাভির সিএসও স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ এক প্রবন্ধে এসব তথ্য জানান। লেখায় তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচও র উদ্যোগে শুরু হওয়া বিশ^ টিকাদান সপ্তাহ উপলক্ষে তিনি বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি তুলে ধরেন। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই সপ্তাহ চলবে।
এই বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৭৯ সালে পাঁচটি টিকা দেওয়া। এগুলো হলো যক্ষ্মার বিসিজি টিকা, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস (ধনুষ্টঙ্কার) ও হুপিং কাশির ডিপিটি টিকা, পোলিও রোগের ওপিভি টিকা, টিটেনাস রোগের টিটি টিকা ও হামের টিকা। এরপর ২০০৩ সালে হেপাটাইটিস বি, ২০০৯ সালে হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে এইচআইবি টিকা, ২০১২ সালে রুবেলা টিকা, ২০১৫ সালে নিউমোনিয়া ও মেনিনজাইটিস রোগের জন্য পিসিভি, পোলিও রোগের আইপিভি টিকা, হাম এবং রুবেলার এমআর দ্বিতীয় ডোজ টিকা এবং ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর পোলিও রোগের এফআইপিভি টিকা দেওয়া শুরু হয়।
টিকাদান কর্মসূচিতে শিগগিরই আরও টিকা যুক্ত করতে যাচ্ছে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ৪৬ বছরে বাংলাদেশ টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৮৪ সালে টিকাদানের হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। সেটি এখন ৪৭৬টি উপজেলা, ৯২টি পৌরসভা এবং ৬টি সিটি করপোরেশনে সম্প্রসারিত হয়েছে। ১৯৯০ সালের মধ্যে সব লক্ষ্যগোষ্ঠী, অর্থাৎ নবজাতক ও গর্ভবতী মায়েদের কাছে টিকা পৌঁছে যায়।
দেশে টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য তুলে ধরে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশে সর্বশেষ পোলিওভাইরাসের ঘটনা রেকর্ড করা হয় ২০০৬ সালে এবং ২০১৪ সালে দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালে রুবেলা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যও অর্জিত হয়। ইপিআই কর্মসূচির অসাধারণ সাফল্যের জন্য ২০০৯ ও ২০১২ সালে গ্যাভি সেরা পারফরম্যান্স পুরস্কার দেয় বাংলাদেশকে।
অবশ্য এখনো টিকাদান কর্মসূচির কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলেও জানান ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মানবসম্পদের ঘাটতি, পর্যাপ্ত টিকার সরবরাহের অভাব, দুর্গম অঞ্চলে পরিবহন সমস্যা এবং সীমিত বাজেট বরাদ্দের কারণে শতভাগ টিকা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া, ২০২৯ সালের মধ্যে গ্যাভির অর্থায়ন পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশকে টিকাদান কর্মসূচির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে স্ব-অর্থায়নে রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’
চ্যালেঞ্জ কাটাতে পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ভবিষ্যতের জন্য কিছু স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের অগ্রাধিকার আমরা দিতে পারি। যেমন : টিকাদানের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য জাতীয় সমন্বয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সেবা প্রদানের কৌশল উন্নয়ন, বেসরকারি সংস্থা, উন্নয়ন অংশীদার ও বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণ, গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ শূন্যতা পূরণ। নিয়োগ প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ, নজরদারি ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার, সর্বস্তরে সমন্বয় উন্নয়নের মতো কিছু মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ আরও বেশি সাফল্য এনে দিতে পারে।’
এ ছাড়া ইপিআইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদসহ একটি কার্যকর অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন, সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, মাইক্রোপ্ল্যানিং পরিমার্জন, টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, রোগপ্রতিরোধ ও টিকা-পরবর্তী প্রতিকূল ঘটনার নজরদারি শক্তিশালীকরণ, সারা দেশে কোল্ড চেইন অবকাঠামো আধুনিকীকরণ গড়ে তোলারও পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।