থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) বংশগত এক রক্তের রোগ। এ রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। রক্তে যদি স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন কম থাকে তাহলে থ্যালাসেমিয়া হয়। এর ফলে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভোগেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে।
থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতা
থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে দিনের পর দিন রক্ত দিয়েই যেতে হয়। পানিবাহিত রোগের মতো নানা রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। জন্ডিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত রোগ। এ ছাড়া প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে জমা হচ্ছে ২০০ মিলিগ্রাম করে আয়রন। প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে ২০০ মিলিগ্রাম আয়রন জমা হলে ৫০ ব্যাগ রক্তের সঙ্গে ১০ গ্রাম আয়রন শরীরে জমা হচ্ছে। এই আয়রন আস্তে আস্তে লিভার প্যানক্রিয়াসের প্রতিটি কোষ ধ্বংস করে দেয়। ফলে ডায়াবেটিস, সিরোসিস রোগের উৎপত্তি হয়। থ্যালাসেমিয়ার রোগীর জীবনকাল ২০-৩০ বছর পর্যন্ত। এই স্বল্পকালীন জীবনে রোগীর নিজের ও পরিবারের যে মানসিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা হচ্ছে অন্যতম।
লক্ষণ ও উপসর্গ
থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত যেসব লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায় তার মধ্যে : অবসাদ অনুভব, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখম-ল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি, ত্বক হলদে হওয়া (জন্ডিস), মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত বা বৃদ্ধি পাওয়া, গাঢ় রঙের প্রস্রাব।
রোগ নির্ণয়
এই রোগ নির্ণয়ের জন্য হাইপাওয়ার লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি পরীক্ষা করতে হয়। এ ছাড়াও কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, ডিএনএ টেস্ট, হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস টেস্ট রয়েছে। করা হয় হাত ও মাথার এক্স-রেও।
চিকিৎসা কখন জরুরি
থ্যালাসেমিয়া মাইনরে সাধারণত চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কারণ তারা মূলত এই রোগের বাহক হন। রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ সেভাবে দেখা যায় না। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত চিকিৎসার দরকার।
ব্লাড ট্রান্সফিউশন : এ ক্ষেত্রে রোগীকে নিয়মিত রক্ত বদলাতে হয়। রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি ভাগ রয়েছে। শিশুর জন্মের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে মেজর থ্যালাসেমিয়ার জন্য সুপার ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। রক্তে হিমোগ্লোবিন ১২ গ্রাম/ডিএল-এর কমে নামতে দেওয়া হয় না। এই চিকিৎসার ফলে একজন রোগী তিরিশ বছর পর্যন্ত ভালো থাকতে পারেন। অন্যদিকে পূর্ণবয়স্কদের জন্য প্রয়োগ করা হয় হাইপার ট্রান্সফিউশন। এখানে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ গ্রাম/ডিএল-এর মধ্যে রাখা হয়। আরও একটি পদ্ধতি হলো সেফ লেভেল। এই স্তরে সপ্তাহে এক দিন রোগীকে হিমোগ্লোবিনের লেভেল বা স্তর ধরে রাখতে রক্ত দিতে হয়। তবে নিয়মিত রক্ত দেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অতিরিক্ত আয়রন জমে যায়। ফলে যকৃত বিকল হয়ে জীবননাশের আশঙ্কা থাকে।
মেডিকেশন ও সাপ্লিমেন্ট-আয়রন সিলেকশন : দেহের অতিরিক্ত আয়রন বের করে দেওয়ার জন্য আয়রন চিলেটিং দেওয়া হয়ে থাকে। আয়রনযুক্ত খাবার এবং ওষুধ খাওয়া চলবে না। এর সঙ্গে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে।
প্লীহা ও গল ব্লাডার বাদ : বারবার রক্ত দেওয়ার ফলে অনেকের প্লীহা বড় হয়ে যায়। তখন সেটি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাদ দিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গল ব্লাডারও বাদ দেওয়া হয়।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট : অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন কার্যকর চিকিৎসা। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক জটিল এবং খরচসাপেক্ষ।
প্রতিকার
চিকিৎসা অপেক্ষা প্রতিরোধই উত্তম। থ্যালাসেমিয়ার মহামারী হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য প্রথম প্রয়োজন থ্যালাসেমিয়া বহনকারী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ। দুজন বাহক যদি একে অন্যকে বিয়ে না করে তাহলে কোনো শিশুরই থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নেওয়া সম্ভব নয়। যদি কোনো কারণে দুজন বাহকের বিয়ে হয়েও যায়, তাহলে সন্তান গর্ভধারণের অনতিবিলম্বে গর্ভস্থিত সন্তানের পরীক্ষা করা সম্ভব এবং পরীক্ষায় যদি প্রমাণিত হয় যে, ভ্রুণটি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এবং বাবা-মায়ের ইচ্ছায় গর্ভপাত ঘটানো যাবে।