বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

জুলাইয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ 

হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত

  •  হত্যাকাণ্ডে উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশসহ ৫ অভিযোগ
  • একই মামলার আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন 
আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ১২:৫০ এএম

জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রধান আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। 

অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘নির্দেশদাতা’ ও ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও ঘটনার সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকেও আসামি করা হয়েছে। 

সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের টিনশেড কোর্ট রুমে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত সাংবাদিকদের অবহিত করেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এতে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে হাজারের বেশি মানুষ হত্যার অভিযোগ উঠে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গুলি ও নির্যাতনে ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়।

ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকার এসব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে গত বছরের অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে পুনর্গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ অক্টোবর এই মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারির আবেদনের পরে ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের হাতে হাসে। 

প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। এ সময় প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীমসহ ১৪ প্রসিকিউটর উপস্থিত ছিলেন। 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত বছরের ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। এর ভিত্তিতে ১৪ অক্টোবর তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শুরু করার ৬ মাস ২৮ দিনের মধ্যে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গুলি করে আহত করা, লাশ পুড়িয়ে ফেলাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের এ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। 

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, তদন্তে প্রধান মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা এবং সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা। রিপোর্টটি হাতে পাওয়ার পরে এই রিপোর্টের সঙ্গে দাখিলকৃত যে সব তথ্য প্রমাণাদি, ডকুমেন্টস, আলামত, সবকিছু আইন অনুযায়ী বিশ্লেষণ করে যদি মনে করা হয়, যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেছে, তাহলে এগুলোর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনাল বরাবরে বিচারের জন্য দাখিল করা হবে। এটি করতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। ফরমাল চার্জ দাখিলের পরে বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে যত লোক মারা গেছে, যত লোক আহত হয়েছে প্রত্যেকটার বিষয়ে তার (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হলেও সংবাদ সম্মেলনে দুটি অভিযোগের বিষয় তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। প্রথম অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) মানবতাবিরোধী অপরাধের উসকানি ও প্ররোচনা দিয়েছিলেন। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ ‘রাজাকার’ এসব বলেছিলেন এবং বলার মাধ্যমে তাদের (শিক্ষার্থী) বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগকে অক্সিলারি ফোর্স (সহযোগী বাহিনী) হিসেবে এই আন্দোলনকারীদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হত্যা ও আহত করে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্ররোচনা, উসকানি, ষড়যন্ত্র, সম্পৃক্ততা এ সব কয়েকটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। 

দ্বিতীয় অভিযোগের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনা সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত সংস্থার তদন্তে শেখ হাসিনার অনেকগুলো টেলিফোন কনভারসেশন, যেখানে তিনি (শেখ হাসিনা) রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র নিরীহ আন্দোলনকারীদের যারা বাংলাদেশে একটি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে রত ছিলেন, তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশের সরাসরি প্রমাণপত্র ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার হাতে পাওয়ার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগটি দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা। সেখানে হত্যার নির্দেশ, গুলি করে আহত করা, অঙ্গহানি করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বাকি তিনটি অভিযোগ বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে। কিভাবে শেখ হাসিনার নির্দেশে মানুষকে মারা হয়েছে, আহত করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট ঘটনাকেন্দ্রিক। তবে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কতজন সাক্ষী এবং কারা সাক্ষ্য  দেবেন, তাদের নাম ও পরিচয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে জানান তিনি। 

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, এই প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় প্রায় দেড় হাজার আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করা, শিশুদের টার্গেট করে হত্যা, আহতদের হাসপাতালে নিতে বাধা, যারা শহীদ হয়েছেন তাদের ময়নাতদন্তে বাধা দেওয়া এবং শেখ হাসিনা নিজে হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সে তথ্য আমরা পেয়েছি। 

প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, আন্দোলনকারীদের ওপর অপরাধের দায় চাপানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোক দিয়ে আগুন লাগিয়ে সেটার দায় চাপানোর ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রধান আসামি শেখ হাসিনার যে বক্তব্য টেলিফোনের নির্দেশ এগুলো আমাদের তদন্ত সংস্থার হস্তগত হয়েছে। সেগুলো প্রমাণের জন্য আমাদের কাছে তারা (তদন্ত সংস্থা) দাখিল করেছেন। 

‘মাস কিলিং’ ও ‘জেনোসাইড’ এক নয়: সংবাদ সম্মেলনে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা গণহত্যার কোনো চার্জ (অভিযোগ) নিয়ে আসিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, প্রচলিত ভাষায় একসঙ্গে বেশি মানুষ মারা গেলে আমরা গণহত্যা বলি। কিন্তু এটাকে (জুলাই-আগস্ট গণহত্যা) মাস কিলিং বা ম্যাসাকার বলতে পারেন। কিন্তু আইনে যেটি জেনোসাইড সেটা কিন্তু এটা নয়। ধরুন ১০০ লোককে মেরে ফেলা হলো, এটাকে আমরা বাংলা ভাষায় বলি গণহত্যা হয়েছে। কিন্তু এটা ইন্টারন্যাশনাল আইনে জেনোসাইড বা গণহত্যা নয়। সুতরাং আমরা যদি আমাদের স্বাভাবিক পরিভাষায় গণহত্যা বলিও, সেটা বলতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আইনে অপরাধ হিসেবে জেনোসাইড যে জিনিসটা সংজ্ঞায়িত আছে সেটা হওয়ার জন্য কিছু উপাদান থাকতে হয়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মাস কিলিং হয়েছে। ব্যাপকভিত্তিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। দেড় হাজার মানুষকে মারা হয়েছে। এটা ম্যাসাকার। এটা ব্যাপক হারে হত্যা মার্ডার। কিন্তু এটি জেনোসাইড নয়। আইনে জেনোসাইড এবং মাস কিলিং এক জিনিস নয়।’

রাজপথের চাপে বিচার সম্ভব নয়: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার কবে শুরু হবে, রায় কবে হতে পারে- সংবাদ সম্মেলনে এমন বিষয়ে জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে চাহিদা আছে দ্রæত বিচারের জন্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, এটা কোনো সাধারণ বিচার নয়। রাজপথের চাপের প্রেক্ষিতে কোনো বিচার সম্ভব হবে না। সেটা করতে গেলে সঠিকভাবে বিচার করা সম্ভব হবে না। এখানে তদন্ত ও আইনের অনেক জটিল বিষয় আছে। চাপ দিয়ে এটা কখনো করা যাবে না। সুতরাং, আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। সঠিক বিচারটা যাতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মামলাটি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে জাতির আকাক্সক্ষা কখনো পূরণ হবে না এবং সেটি ন্যায়বিচার হবে না। এ জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন হয়, ততটুকু সময় এই ট্রাইব্যুনালকে, প্রসিকিউশনকে, তদন্ত সংস্থাকে দিতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘আমরা চাইব, বিচারে কোনো রকম অনিয়ম না হোক, মানবাধিকার লঙ্ঘন না হোক, বিচারে কোনো ত্রæটি-বিচ্যুতি না হোক এবং কোনো প্রশ্ন না উঠুক।’ তিনি বলেন, ‘রায় পেতে কতদিন সময় লাগবে এটা বলার ক্ষমতা চিফ প্রসিকিউটরের নেই। এটি নির্ধারণ করবে আদালত ও পরিস্থিতি। কতজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেবেন, কতটুকু সাক্ষী নেওয়ার প্রয়োজন হবে। মামলা প্রমাণে যতদিন যেতে হবে ততদিন সময় প্রসিকিউশনকে দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে কখনোই বিচারকার্য পরিচালনা করা যায় না। এটা উচিতও নয়।’ 

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর প্রসঙ্গ: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার উদ্যোগের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আইনের সংশোধনী হয়েছে। সেটা আমরা দেখেছি। এখন আমরা ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেব যেকোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে কি না, তাদের বিচারের মধ্যে আনা হবে কি না, এটা আমরা প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আমাদের তদন্ত সংস্থার কাছে যদি মনে হয়, এ দলটি রাজনৈতিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা দরকার, তাহলে আইন অনুযায়ী তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং যা যা আইনের ব্যবস্থা আছে সেগুলো চলমান হবে।’ 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত