ইরানের অন্তত আটটি লক্ষ্যবস্তুতে আজ শুক্রবার ভোরে পাঁচ দফায় শতাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তেহরান জানিয়েছে, এই হামলায় দেশটির ইসলামিক রেভ্যুলিউশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)-এর প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত দুই শীর্ষ বিজ্ঞানীও।
ইসরায়েলের ইংরেজি দৈনিক দ্য টাইমস অব ইসরায়েলকে দেওয়া বিবৃতিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আজ ভোরে চালানো এই সমন্বিত হামলায় ইরানের একাধিক সামরিক, পারমাণবিক ও কৌশলগত স্থাপনায় আঘাত হানা হয়েছে।
ইরানের আধা-সরকারি সংবাদমাধ্যম তাসনিম এবং তেহরান টাইমস নিশ্চিত করেছে, হামলায় নিহত দুই শীর্ষ বিজ্ঞানী হলেন—ড. মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি এবং ড. ফেরেইদুন আব্বাসি। তাঁরা দুজনই ইরানের পরমাণু প্রযুক্তি উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করছিলেন।
আইআরজিসির পক্ষ থেকে নিহত হোসেইন সালামিকে ‘জাতির আত্মরক্ষার অগ্রভাগের যোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও ইসলামি বিপ্লবী জাতি নিশ্চিত থাকতে পারে, আইআরজিসির নেতৃত্ব, অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনী এবং ইসলামী উম্মাহর যোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে জিওনবাদী শত্রুর আগ্রাসনের যথোপযুক্ত জবাব দিতে প্রস্তুত।”
হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করেছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “প্রিয় মাতৃভূমি ইরানের ওপর জিওনবাদী সরকারের আগ্রাসনের সুদূরপ্রসারী ও ভয়াবহ পরিণতির দায় কেবল ইসরায়েল নয়, বরং তাদের মদদদাতা রাষ্ট্রগুলোকেও নিতে হবে।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “এই হামলাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন ও সমন্বয় ছাড়া চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং ইসরায়েলের প্রধান মিত্র হিসেবে ওয়াশিংটনকেও এই বিপজ্জনক অভিযানের জন্য সমানভাবে দায় নিতে হবে।”
মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের সংঘর্ষ বড় আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে—এই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তাঁর মুখপাত্র ফারহান হাকের মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে। সামরিক উত্তেজনার ফলে অসংখ্য নিরীহ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের এই হামলা উদ্বেগজনক।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়ায়াল জামির বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি বলেন, “ভোররাতে চালানো এসব হামলা ছিল আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের অংশ। আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম, যেখান থেকে আর ফিরে আসার সুযোগ নেই।”
তিনি আরও বলেন, “যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে আসবে, তাকে চড়া মূল্য দিতে হবে।”
এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান আরও প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস সদস্য মারজোরি টেইলর গ্রিন ও রক্ষণশীল ভাষ্যকার টাকার কার্লসন প্রকাশ্যে সতর্ক করেছেন, যেন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কারণে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে না জড়ায়।
এক পোস্টে মারজোরি লেখেন, “আমেরিকানরা ইরানকে বোমা মারতে চায় না, শুধু এ কারণে যে ইসরায়েলের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার বলছে, ইরান যেকোনো দিন পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলবে—এ কথা তো আমরা গত ২০ বছর ধরে শুনে আসছি।”
উল্লেখযোগ্যভাবে, ট্রাম্প যখন কূটনীতির মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে সমঝোতার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন, তার মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল এই হামলা চালায়।
যদিও মার্কিন রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলপ্রীতি স্পষ্ট, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে প্রগতিশীল ডেমোক্রেটদের মধ্যে তা দুর্বল হতে শুরু করেছে। এবারকার হামলা বহু মার্কিন নাগরিকের মনে প্রশ্ন তুলছে—ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আদৌ এক কি না।
এই বাস্তবতায় ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মতাদর্শে বিশ্বাসী অনেক রিপাবলিকানও ইসরায়েল-মার্কিন সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। এতে করে ইসরায়েলকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক, নিরঙ্কুশ সমর্থনের ভিত দু’দলেই কিছুটা নড়বড়ে হয়ে উঠতে পারে।