শিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষ কর্মীর ঘাটতি
লিপন মুস্তাফিজ | ৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
সম্প্রতি পত্রিকা মারফত জানতে পারি যে, আমাদের দেশে আরও ৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা আছে প্রধানমন্ত্রীর। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে যে তথ্য পাই, সে অনুযায়ী বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৫টি এবং আর্ন্তজাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩টি।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, সাধারণ কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, আইন কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, চারুকলা কলেজ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ইউনানী/আয়ুর্বেদিক কলেজ, লেদার টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল ভোকেশনাল সেন্টার, টেক্সটাইল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউট, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ক্যাডেট কলেজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, শারীরিক শিক্ষা কলেজ, সংগীত শিক্ষা কলেজ, গ্রাফিক্স আর্টস ইনস্টিটিউট, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইনস্টিটিউট, বাণিজ্য শিক্ষা কলেজ, এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির মূল উদ্দেশ্য হলো কর্মক্ষেত্রের জন্য শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করা। তবুও আমাদের দেশে দিন দিন শিক্ষিত বেকার বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও চাকরি মিলছে না এর কারণ কী? আমি একটি সরকারি ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে কর্মরত আছি, আবার মাঝে মাঝে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে যেতে হয় অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠ দানের উদ্দেশে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা হয়েছে, চাহিদা অনুযায়ী আমরা শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে পারছি না। যার কারণেই শিক্ষিত বেকার বাড়ছে বৈ কমছে না। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো, আগে এত বেশি গ্র্যাজুয়েট বের হতো না। বিগত দেড়-দুুই দশকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু ছাত্র-ছাত্রী পাস করে বের হচ্ছে। চাকরির চাহিদার তুলনায় শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটের জোগান এখন বেড়ে গেছে অনেক। ফলে এদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরির বাজার তৈরি না হওয়াতে বেকার বাড়ছে। হচ্ছে না নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কিছু ইন্ডাস্ট্রি। বরং যা আছে তা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন তৈরি পোশাক খাত। ২০১৯ সালটা কিন্তু তৈরি পোশাকের জন্য খারাপ গেছে, ব্যাংকিং খাত একটা বড় বাজার ছিল। খেলাপি ঋণসহ নানা কারণে ব্যাংকে চাকরির জায়গা কমে গেছে। টেলিযোগাযোগ খাতে আগে চাকরির জায়গা ছিল, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে আগে যেখানে ৫/৭ হাজার মানুষ স্থায়ী কাজ করতেন এখন তারা আউটসোর্স করে তাদের মাধ্যমে কাজ করাচ্ছে। ফলে সেখানে এখন চাকরি আছে ২/৩ হাজারের মতন।
এখন প্রতি বছর দেড় থেকে দুই লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। তাদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই কোনো চাকরি পাচ্ছে না। চাকরির বাজার গত ৩/৪ বছর বলতে গেলে একটু খারাপই। সুনির্দিষ্ট করে যদি বলি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে যারা গ্র্যাজুয়েশন করে বের হচ্ছে তাদের চাকরির ক্ষেত্র খুব কম তৈরি হচ্ছে। পড়াশোনার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে দক্ষতার ঘাটতি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুধাবন করছে না যে, তাদের পড়াশোনা চাকরির বাজারের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। মূলত তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ডিগ্রি ধরিয়ে দেওয়া। সে চাকরি পাচ্ছে কি পাচ্ছে না সেটা তারা দেখেন না। এটা তাদের করার কথাও না, এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ান তারা বই বা ক্লাসের বাইরে পাঠদান চিন্তা করেন না। আবার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যারা পরিবর্তন করেন তারা যে কোনো কারণেই হোক বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পারছেন না বা প্রয়োজন দেখছেন না। ফলে ক্লাসের থিওরি যেটা পড়ছে, শিক্ষার্থী সেটা বাস্তবে গিয়ে কাজে লাগাতে পারছে না। পাস হচ্ছে, ডিগ্রিও পাচ্ছে কিন্তু এর মূল্য থাকছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে উদ্যোক্তা হওয়া একটা নতুন ট্রেন্ড। বিদেশে উদ্যোক্তাদের অর্থসংস্থানের একটা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু এখানে সরকারি বা বেসরকারি খাত থেকে সেভাবে তারা অর্থ পান না। পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে কেউ কিছু শুরু করলে সেটা থেকে রিটার্ন আসতে কয়েক বছর লেগে যায়। সেই পর্যন্ত এই উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। যারা একটু বেশি টাকা নিয়ে শুরু করেন তারা হয়তো টিকে যাচ্ছেন। দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব আছে। কিছু কিছু খাতে এই অভাব প্রকট। যদি নির্দিষ্ট কোনো খাতে ৫/১০ জন দক্ষ কর্মীর চাহিদা থাকে তাহলে পাওয়া কঠিন নয়। কিন্তু যদি ৫০০ বা ১০০০ দক্ষ কর্মীর চাহিদা থাকে সেটা পাওয়াটা মুশকিল হবে।
দক্ষতার অভাব কেন? যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করছেন তারা হাতে-কলমের শিক্ষা ও দক্ষতা নিয়ে বের হচ্ছে না। পাশাপাশি শিক্ষার মানও ক্রমশ নিম্নমুখী। কারণ অভাব দক্ষ শিক্ষকের। ভোকেশনালসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আগে থেকে অনেক বাড়ছে। যদিও সেটা পর্যাপ্ত না, আরও দরকার। ভোকেশনাল ট্রেনিং নিয়ে যারা বের হচ্ছে তাদের চাকরি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া ছাত্রদের চেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের সমাজে মানসিকতা অন্য ধরনের। অভিভাবকরা মনে করেন ভোকেশনাল ট্রেনিং করে যে চাকরি পাবে সেটার সামাজিক মর্যাদা কম। সমাজ তথা পরিবার মূলত অফিসকেন্দ্রিক চাকরি চায়। যেখানে বসে কাজ করবে। যেহেতু আমাদের দেশ বর্তমানে আমদানিনির্ভর সেহেতু মার্কেটিংয়ে চাকরির বাজার আছে। সেখানে তারা যেতে চায় না। অনেকে চাকরি পেয়েও করে না। কারখানার চাকরিও তারা করতে চায় না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে গবেষণা করা দরকার। আমাদের দেশে অনেকে শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান ও নিয়োগের নীতিমালা পরিবর্তন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং দিন দিন আমরা পিছিয়ে পড়ছি। যারা শিক্ষাকে গ্রহণ করেছেন ভালোভাবে তারা উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে গিয়ে আর ফেরত আসেন না।
একদা রাজনৈতিক বিবেচনায় যে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। হয়তো তার কাঠামোগত কোনো উন্নতি হয়নি, ভালো শিক্ষকও নেই ফলে যারা বের হচ্ছে তারা প্রাপ্ত সার্টিফিকেটের জন্য না পারছে কর্মচারীর কাজ না পারছে অফিশিয়াল কাজে নিজেকে প্রমাণ করতে। ফলে দেশে ভালো কর্মীর ঘাটতি যা আছে তা আরও প্রকট হচ্ছে। দক্ষ কর্মী গঠনে যদি না আমরা এখনই পদক্ষেপ নিই, অচিরেই আমাদের মানবসম্পদ আমদানি করতে হবে। আর আমাদের মানবসম্পদ আমাদের বোঝা হয়ে যাবে।
লেখক : গবেষক ও ব্যাংকার
শেয়ার করুন
লিপন মুস্তাফিজ | ৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

সম্প্রতি পত্রিকা মারফত জানতে পারি যে, আমাদের দেশে আরও ৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা আছে প্রধানমন্ত্রীর। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে যে তথ্য পাই, সে অনুযায়ী বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৫টি এবং আর্ন্তজাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩টি।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, সাধারণ কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, আইন কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, চারুকলা কলেজ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ইউনানী/আয়ুর্বেদিক কলেজ, লেদার টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল ভোকেশনাল সেন্টার, টেক্সটাইল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউট, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ক্যাডেট কলেজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, শারীরিক শিক্ষা কলেজ, সংগীত শিক্ষা কলেজ, গ্রাফিক্স আর্টস ইনস্টিটিউট, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইনস্টিটিউট, বাণিজ্য শিক্ষা কলেজ, এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির মূল উদ্দেশ্য হলো কর্মক্ষেত্রের জন্য শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করা। তবুও আমাদের দেশে দিন দিন শিক্ষিত বেকার বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও চাকরি মিলছে না এর কারণ কী? আমি একটি সরকারি ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে কর্মরত আছি, আবার মাঝে মাঝে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে যেতে হয় অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠ দানের উদ্দেশে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা হয়েছে, চাহিদা অনুযায়ী আমরা শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে পারছি না। যার কারণেই শিক্ষিত বেকার বাড়ছে বৈ কমছে না। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো, আগে এত বেশি গ্র্যাজুয়েট বের হতো না। বিগত দেড়-দুুই দশকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু ছাত্র-ছাত্রী পাস করে বের হচ্ছে। চাকরির চাহিদার তুলনায় শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটের জোগান এখন বেড়ে গেছে অনেক। ফলে এদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরির বাজার তৈরি না হওয়াতে বেকার বাড়ছে। হচ্ছে না নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কিছু ইন্ডাস্ট্রি। বরং যা আছে তা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন তৈরি পোশাক খাত। ২০১৯ সালটা কিন্তু তৈরি পোশাকের জন্য খারাপ গেছে, ব্যাংকিং খাত একটা বড় বাজার ছিল। খেলাপি ঋণসহ নানা কারণে ব্যাংকে চাকরির জায়গা কমে গেছে। টেলিযোগাযোগ খাতে আগে চাকরির জায়গা ছিল, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে আগে যেখানে ৫/৭ হাজার মানুষ স্থায়ী কাজ করতেন এখন তারা আউটসোর্স করে তাদের মাধ্যমে কাজ করাচ্ছে। ফলে সেখানে এখন চাকরি আছে ২/৩ হাজারের মতন।
এখন প্রতি বছর দেড় থেকে দুই লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। তাদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই কোনো চাকরি পাচ্ছে না। চাকরির বাজার গত ৩/৪ বছর বলতে গেলে একটু খারাপই। সুনির্দিষ্ট করে যদি বলি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে যারা গ্র্যাজুয়েশন করে বের হচ্ছে তাদের চাকরির ক্ষেত্র খুব কম তৈরি হচ্ছে। পড়াশোনার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে দক্ষতার ঘাটতি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুধাবন করছে না যে, তাদের পড়াশোনা চাকরির বাজারের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। মূলত তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ডিগ্রি ধরিয়ে দেওয়া। সে চাকরি পাচ্ছে কি পাচ্ছে না সেটা তারা দেখেন না। এটা তাদের করার কথাও না, এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ান তারা বই বা ক্লাসের বাইরে পাঠদান চিন্তা করেন না। আবার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যারা পরিবর্তন করেন তারা যে কোনো কারণেই হোক বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পারছেন না বা প্রয়োজন দেখছেন না। ফলে ক্লাসের থিওরি যেটা পড়ছে, শিক্ষার্থী সেটা বাস্তবে গিয়ে কাজে লাগাতে পারছে না। পাস হচ্ছে, ডিগ্রিও পাচ্ছে কিন্তু এর মূল্য থাকছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে উদ্যোক্তা হওয়া একটা নতুন ট্রেন্ড। বিদেশে উদ্যোক্তাদের অর্থসংস্থানের একটা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু এখানে সরকারি বা বেসরকারি খাত থেকে সেভাবে তারা অর্থ পান না। পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে কেউ কিছু শুরু করলে সেটা থেকে রিটার্ন আসতে কয়েক বছর লেগে যায়। সেই পর্যন্ত এই উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। যারা একটু বেশি টাকা নিয়ে শুরু করেন তারা হয়তো টিকে যাচ্ছেন। দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব আছে। কিছু কিছু খাতে এই অভাব প্রকট। যদি নির্দিষ্ট কোনো খাতে ৫/১০ জন দক্ষ কর্মীর চাহিদা থাকে তাহলে পাওয়া কঠিন নয়। কিন্তু যদি ৫০০ বা ১০০০ দক্ষ কর্মীর চাহিদা থাকে সেটা পাওয়াটা মুশকিল হবে।
দক্ষতার অভাব কেন? যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করছেন তারা হাতে-কলমের শিক্ষা ও দক্ষতা নিয়ে বের হচ্ছে না। পাশাপাশি শিক্ষার মানও ক্রমশ নিম্নমুখী। কারণ অভাব দক্ষ শিক্ষকের। ভোকেশনালসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আগে থেকে অনেক বাড়ছে। যদিও সেটা পর্যাপ্ত না, আরও দরকার। ভোকেশনাল ট্রেনিং নিয়ে যারা বের হচ্ছে তাদের চাকরি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া ছাত্রদের চেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের সমাজে মানসিকতা অন্য ধরনের। অভিভাবকরা মনে করেন ভোকেশনাল ট্রেনিং করে যে চাকরি পাবে সেটার সামাজিক মর্যাদা কম। সমাজ তথা পরিবার মূলত অফিসকেন্দ্রিক চাকরি চায়। যেখানে বসে কাজ করবে। যেহেতু আমাদের দেশ বর্তমানে আমদানিনির্ভর সেহেতু মার্কেটিংয়ে চাকরির বাজার আছে। সেখানে তারা যেতে চায় না। অনেকে চাকরি পেয়েও করে না। কারখানার চাকরিও তারা করতে চায় না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে গবেষণা করা দরকার। আমাদের দেশে অনেকে শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান ও নিয়োগের নীতিমালা পরিবর্তন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং দিন দিন আমরা পিছিয়ে পড়ছি। যারা শিক্ষাকে গ্রহণ করেছেন ভালোভাবে তারা উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে গিয়ে আর ফেরত আসেন না।
একদা রাজনৈতিক বিবেচনায় যে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। হয়তো তার কাঠামোগত কোনো উন্নতি হয়নি, ভালো শিক্ষকও নেই ফলে যারা বের হচ্ছে তারা প্রাপ্ত সার্টিফিকেটের জন্য না পারছে কর্মচারীর কাজ না পারছে অফিশিয়াল কাজে নিজেকে প্রমাণ করতে। ফলে দেশে ভালো কর্মীর ঘাটতি যা আছে তা আরও প্রকট হচ্ছে। দক্ষ কর্মী গঠনে যদি না আমরা এখনই পদক্ষেপ নিই, অচিরেই আমাদের মানবসম্পদ আমদানি করতে হবে। আর আমাদের মানবসম্পদ আমাদের বোঝা হয়ে যাবে।
লেখক : গবেষক ও ব্যাংকার