
মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ সভ্যতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঘটেছে। আবারও আমরা এই চক্রের বৃত্ত পূরণের ধারায় আছি। মহামারী যেতে না যেতেই শুরু যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত বেজে চলছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার পটভূমি নিয়ে ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস লিখেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায় একে সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে এনেছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে সারা পৃথিবীতে খাদ্যসংকট নিয়ে বিস্তার আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বে ভয়াবহ রকমের খাদ্য সংকট ধেয়ে আসছে আর এর বড় ভুক্তভোগী হবে পৃথিবীর খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ।
খাদ্য সংকটের একটি বড় কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তবে দুর্ভিক্ষের বড় কারণ রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনা সংকট। দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, দুর্ভিক্ষ যতটা না খাদ্যদ্রব্যের সংকটের কারণে তার থেকে অনেক বেশি দায়ী মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি না থাকা এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় ত্রুটি। অন্যদিকে বিশ্বে এরকম দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি যেখানে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে খাদ্য সরবরাহ করা হয়নি বা সরবরাহ মাঝপথে আটকে দিয়ে একটি দেশকে এবং তার জনগণকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের বড় নিয়ামক হচ্ছে এই সব প্রতিকূলতা অতিক্রমের সক্ষমতা।
যুদ্ধে খাদ্যসংকটের কারণ বহুবিদ, একটি হচ্ছে উৎপাদন করতে না পারা, মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। এর সঙ্গে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় তাহলে পরিস্থিতি চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে যায়। ইউক্রেন-রাশিয়া বিশ্বের খাদ্যভা-ার। এই অঞ্চলের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে হচ্ছে সারা বিশ্বের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়া। এই দুটি দেশ মিলে পৃথিবীর ২৮ শতাংশ গম উৎপাদন করে এবং এর মধ্যে ১৫ শতাংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। তবে শুধুমাত্র উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানই যথেষ্ট নয়। জনগণের বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এবারের যুদ্ধের মূল সংকট হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাওয়া। বলা হয় বর্তমান পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদন করা হয় তা দিয়ে প্রায় দশ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব, যা মোট বর্তমান জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড়গুণ। বলা বাহুল্য উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ নষ্ট হয়। মূলত যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদনের পরও খাদ্য সংকটের জন্য দায়ী মুনাফাভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা, কিছু মানুষের অতিরিক্ত ভোগ, পাশাপাশি বিপুল খাদ্যদ্রব্যের অপচয়। আর এ কারণেই সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত থাকে, পুষ্ঠিহীনতায় ভোগে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অক্টোবর ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ এই সময়কালে বিশ্বের ১৯টি দেশকে হাঙ্গার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৫৩টি দেশ বা অঞ্চলে প্রায় ১৯৩ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ২০২৩ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংকট বহুমুখী। আমাদের দেশের জনসংখ্যা বেশি, এখানে রয়েছে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী, প্রয়োজনের তুলনায় কৃষিজমি অল্প এবং রয়েছে কিছু অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের জন্য বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীলতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরবরাহ সংকট ও খাদ্য অধিকারকে ন্যায্যতার দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখা। এক শ্রেণির মানুষের অতিরিক্ত লোভ ও ভোগের কারণে বণ্টনে ন্যায্যতার অভাবে বিশে^ লাখ লাখ মানুষ অনাহারে থাকে। খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ কমানোটাও খাদ্য ন্যায্যতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উদ্যোগ আছে। কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ বা মারাত্মক খাদ্য সংকট তৈরি হলে সেসব ক্ষেত্রে জরুরি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ লক্ষ করা যায় কিন্তু বিশ্বব্যাপী খাদ্যবণ্টন প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই। আর এর মূল কারণ খাদ্য সম্পর্কিত ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখা এবং ক্ষেত্রবিশেষে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।
মূলত শাসক শ্রেণির অবহেলা, অবজ্ঞা ও লুটপাটই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। যেমনটা হয়েছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা ১১৭৬ সালে), এটি বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিতি। এই দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় তিনভাগের একভাগ মানুষ মারা যায়। এর পেছনে দায়ী ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং একই সঙ্গে কোম্পানির দুঃশাসন। স্বাধীন নবাবদের পতনের পর, বাংলায় তখন দ্বৈত শাসন। নবাবের ওপর শাসনভার কিন্তু রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ব্রিটিশদের হাতে। আর এই দুই পেরেশানির মধ্যে জনগণ চিড়েচ্যাপ্টা। অন্যদিকে পঞ্চাশের মন্বন্তরে (১৯৪৩-৪৪) বাংলায় আবার ২০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। একদিকে জাপান অধিকৃত মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি বন্ধ, অন্যদিকে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদকরণ বাজারের খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি ব্রিটিশ রাজের ভুল নীতির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অনেকে এই দুর্ভিক্ষের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ভুল নীতিকে দায়ী করে থাকেন। অন্যদিকে চার্চিল উল্টো ‘নেটিভদের’ ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে, এই দুর্ভিক্ষ কোনো প্রাকৃতিক কারণে ছিল না, মানুষের জীবনকে নিয়ে অবহেলা ও অমানবিক আচরণই ছিল এর কারণ।
আমাদের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা মূলত উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ, ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ওপর নির্ভর করে। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার। পাশাপাশি শক্ত নজরদারি যাতে কোনোভাবেই খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়। কিন্তু এখানেই শেষ না, সরবরাহ প্রক্রিয়ায় মজুদদারির যেন কোনো সুযোগ না থাকে এবং যে যে খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল সেসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আমদানির উদ্যোগ আগেভাগেই গ্রহণ করতে হবে।
বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবি উঠলেও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। খাদ্য সংকটে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর ওপর যেমন একই প্রভাব ফেলে না, তেমনি এর প্রভাবও দরিদ্র দেশগুলোর ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একরকম নয়। ধনী দেশগুলো তার নাগরিকদের নানা ধরনের প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে এই সমস্যা উত্তরণের চেষ্টা করে, তাদের সেই সক্ষমতা আছে। পাশাপাশি প্রভাব খাটিয়ে তারা সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে পারে। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোকে অনেক সময়ে অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা কৌশলগত স্বার্থের কাছে বন্দি থাকতে হয় যেমনটা থাকতে হয় এর প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
করোনা মহামারীর সময় থেকেই দেশের মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। এ অবস্থা শুধু ব্যক্তিপর্যায়ের নয়, জাতীয়ভাবেও একই সমস্যা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত বছরের সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। সঞ্চয়পত্রে যত বেশি বিনিয়োগ, মুনাফার হার তত কম হবে। অবশ্য ১৫ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফা একই আছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। নতুন নিয়মে যাদের এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে সাড়ে ৯ শতাংশ। এতদিন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হলেও চলমান অর্থনৈতিক সংকট, রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতি এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা শর্তারোপের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি এখন তলানিতে ঠেকেছে।
সোমবার দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরকারি সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৩০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ৮ হাজার ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এই খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ মুনাফার সঞ্চয়পত্রে প্রকৃত সুবিধাভোগী বিনিয়োগ নিশ্চিতের পাশাপাশি সুদ ব্যয় কমাতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। সব শেষ ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমানো হয়। আবার ঘোষণার বাইরে সঞ্চয়পত্র থাকলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এসব কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে এ খাতে সরকারকে কোষাগার থেকে উল্টো ৭০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা দিতে হয়েছে; অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ করেছে বেশি। প্রতি মাসে বিক্রি হওয়া সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে প্রাপ্ত বিনিয়োগের হিসাব থেকে আগে বিক্রি হওয়া স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে নিট ঋণ হিসাব করা হয়। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়; অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছে সরকার।
অন্যদিকে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক খাতে আমানতও সেভাবে বাড়ছে না। কারণ, ব্যাংকে আমানত রেখে যে সুদ মিলছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় ব্যাংকগুলো আর আমানতের সুদহার বাড়াতে পারছে না। কারণ, ঋণের সুদহারের সীমা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশ্ন হলো, ঋণের সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে আমানতের সুদহার বাড়ানোর নির্দেশনা কার্যকর হবে কীভাবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সব মানুষের সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংকে নেওয়ার উদ্দেশে বেশি সুদের স্কিমগুলোর মুনাফার হার কমানো হচ্ছে। এতে মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমে গিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতেও। কারণ সঞ্চয় কমলে বিনিয়োগ সংকট আরও বাড়বে। এমনিতেই দেশে সঞ্চয়ের অর্থ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগের সুযোগ খুবই কম। সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক, শেয়ারবাজারের বাইরে বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ করে সঞ্চয়কারীরা বিভিন্ন সময় প্রতারিত হয়েছেন। ফলে একই সঙ্গে ব্যাংক ও ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় বিনিয়োগের দুটি ক্ষেত্র বাকি থাকছে। একটি সঞ্চয়পত্র, অন্যটি শেয়ারবাজার। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করায় সে ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়েছে। অন্যদিকে, শেয়ারবাজারও স্থিতিশীল নয়, সেখানে বিনিয়োগ করে বারবার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সহায়-সম্বল হারাতে হয়েছে। তাহলে সাধারণ মানুষ সঞ্চয় করবে কীভাবে আর বিনিয়োগ করবে কোথায়?
পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের অত্যন্ত উজ্জ্বল প্রতিনিধি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক জীবনে তিনি অব্যাহত আন্দোলন করেছেন, বহু রকমের দুর্ভোগ ও নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং বাঙালির জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন অনমনীয়। বাঙালি বলতে কেবল সুবিধাভোগীদের বুঝতেন না, সকল শ্রেণির বাঙালিকেই বুঝতেন। কারাবন্দি অবস্থায় লেখা তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বইয়ের পাতায় পাতায় এর পরিচয় পাওয়া যাবে। ১৯৬৬-তে যখন তাকে বন্দি করা হয় তখন তার বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১১টা, তাকে রাখা হয়েছিল অন্যসব কয়েদি ও বন্দির কাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে। সন্ধ্যা হলেই সেলের দরজা তালাবন্ধ হতো। সময় কাটানো অত্যন্ত কঠিন। কষ্ট হয়েছে, কিন্তু হতাশ হননি। কারাজীবনটা দাঁড়িয়েছিল নির্জন দ্বীপে রবিনসন ক্রুশোর দিনযাপনের মতো। এর মধ্যেও অক্ষুণœ রয়েছে তার সংবেদনশীলতা। বাইরের মানুষের কথা তো ভাবছেনই, ভেতরে যারা আছে, কয়েদি ও সিপাহি-জমাদার, যারা তার আশপাশে থাকে তাদের সঙ্গে নিজের খাবার ভাগ করে খান; রোজনামচায় লেখেন, ‘আমি না খেয়ে থাকতে রাজি, কিন্তু ওদের না দিয়ে খেতে পারব না।’ জেলখানায় কয়েদি ও সিপাহিদের কাছে মুড়ি দুর্লভ সামগ্রী। তিনি মুড়ি আনিয়ে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ মাখিয়ে নিজে খান এবং আশপাশের সবাইকে খাওয়ান। পাকের ঘরে মোরগ-মুরগি থাকে তিনটি। একটির অসুখ হলে কাতর হয়ে পড়েন। কবুতর ও তাদের বাচ্চাদের দেখেন, দেখেন কাকদের জীবনযাত্রা। সেলের সামনের ফুলগাছগুলোর যতœ নেন, আগাছা পরিষ্কার করেন। পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি থেকেই এসেছেন, কিন্তু সেই শ্রেণির সংকীর্ণতা ও অসংবেদনশীলতাকে সঙ্গে রাখেননি, সরিয়ে ফেলতে পেরেছেন, এবং সেজন্যই অত বড় হয়েছেন। কিন্তু অন্য অনেকেই তা পারেন না, পারেননি।
১৯৬২ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আটক ছিলেন ডা. এম এ করিম। তিনি বাম ঘরানার লোক; কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গেই তার খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কারাগারে তখন আওয়ামী লীগের বড় এক নেতা ছিলেন, একসময় যিনি মন্ত্রীও ছিলেন, প্রথমে প্রদেশের পরে কেন্দ্রের। তার সম্পর্কে করিম সাহেব লিখেছেন যে, ‘ভদ্রলোক চুলে সরষের তেল মাখতেন। জেলখানা থেকে বরাদ্দ করা ছিল। আর এই বরাদ্দ থেকে সরষের তেল বাঁচিয়ে প্রায় এক টিন জমিয়ে ফেললেন। এমনিভাবে নিজের বরাদ্দ মাখন থেকে বাঁচিয়ে জ্বালিয়ে ঘি তৈরি করেছেন। জেল থেকে বেরুবার সময়ে সাথে করে নিয়ে গেছেন একটিন সরষের তেল ও এক সের ঘি।...বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবার কথা। আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।’ এ ধরনের জাতীয়তাবাদীদের কাছে সবকিছুই ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এমনকি জেলখানার সামান্য সুযোগ-সুবিধাগুলোও। ওদিকে কারাযন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় কেউ কেউ হার মানতেন। কেউ-বা বন্ড দিয়ে বের হয়েছেন এবং রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীতে আছে শামসুল হক রাতভর জিকির করতেন। তাতে অন্যদের যে অসুবিধা হয় সেদিকে তাকাতেন না, বলতেন এ তার আধ্যাত্মিক সাধনা। জেল থেকে যখন বের হলেন তখন দেখা গেল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। অত্যন্ত মহৎ একটি সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেল।
জাতীয়তাবাদী ধারার প্রগতিশীল অংশের ভেতর এই উপলব্ধিটা তৈরি হচ্ছিল যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুক্তি নেই, সমাজতন্ত্রেই যেতে হবে। শেখ সাহেবের বই দুটিতে এমন চিন্তার আভাস পাওয়া যায়। ১৯৬৬-তে জেলে এসে তিনি দেখেন জেলের ভেতরেই পুঁজিবাদ কায়েম হয়ে গেছে। শিক্ষার কোনো দাম নেই, দাম টাকার, টাকা দিয়ে অনেক রকমের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আগে যখন এসেছেন দেখেছেন কিছুটা চক্ষুলজ্জা ছিল, এখন তাও নেই। আত্মজীবনীতে তিনি লিখছেন ১৯৫৩ সালে তিনি চীনে গিয়েছিলেন, বিশ্ব শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে। চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯-এ, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭-এ, অথচ ওই কবছরেই চীনের যে উন্নতি ও পরিবর্তন হয়েছে দেখে এবং কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুভূতি হয়েছিল এই রকমের : ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে তত দিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’ ১৯৬৬-এর কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন, আইয়ুব খানের শাসনে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভিক্ষুক হয়ে গেছে। আমেরিকার কাছে ভিক্ষা চাইছে। মন্তব্য করেছেন, ‘ভিক্ষুকের কোনো সম্মান নাই। তবে শোয়েব সাহেব (অর্থমন্ত্রী) যে অর্থনীতি এখানে চালাইতেছেন তাতে ইহা ছাড়া আইয়ুব সাহেবের উপায়ই বা কী ছিল? একমাত্র সমাজতন্ত্র কায়েম করলে কারও কাছে হেয় হয়ে সাহায্য নিতে হতো না।’
জেলখানায় কমিউনিস্ট রাজবন্দিরা থাকেন। তাদের আলাদা করে রাখা হয়, পাছে তাদের প্রভাবে পড়ে অন্যরা কমিউনিস্ট হয়ে যায়। শেখ মুজিবকে তারা তাদের বাগান থেকে কুমড়ার ডগা, ঝিঙে, কাঁকরোল এসব পাঠান। তিনি অভিভূত হন। তার প্রতিক্রিয়া, ‘এরা ত্যাগী রাজবন্দি। দেশের জন্য বহু কিছু ত্যাগ করেছেন। জীবনের সবকিছু দিয়ে গেলেন এই নিষ্ঠুর কারাগারে। আমি তাদের সালাম পাঠালাম।’ জন্মদিনে এরা তাকে পাঠিয়েছেন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। মুজিব লিখছেন, ‘তাদের এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান। শুধু মনে মনে বললাম, তোমাদের মতো ত্যাগ যেন আমি করতে পারি। তোমরা যে নীতিই মানো না কেন, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তোমরা দেশের মঙ্গল চাও, তাতে আমার সন্দেহ নাই।... তোমাদের আমি শ্রদ্ধা করি।’
কোনো দক্ষিণপন্থি জাতীয়তাবাদীর পক্ষে এমনটা ভাবা সম্ভব নয়। তা ছাড়া দক্ষিণপন্থিরা কমিউনিস্টদের কাছ থেকে এমন শুভেচ্ছাও আশা করতে পারতেন না। শেখ মুজিবেরই তো সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। জাতীয়তাবাদীও। তবে পুরোপুরি দক্ষিণপন্থি এবং পরিপূর্ণরূপে সুবিধাবাদী, নিজেকে তিনি নন-কমিউনিস্ট বলতেন না, বলতেন অ্যান্টি-কমিউনিস্ট। মোহাম্মদ তোয়াহা স্মরণ করেছেন যে ১৯৪৪-এ মুসলিম লীগ কর্মীরা যখন একত্রে কাজ করছেন তখনই দেখা গেছে দলের ভেতর ‘কমিউনিস্ট খেদাও’ তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে, এবং ঢাকায় সে-তৎপরতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন খন্দকার মোশতাক। শেষ পর্যন্ত তিনি কোন পরিণতিতে গিয়ে পৌঁছাবেন তার পূর্বাভাস সূত্রপাতেই দেখা দিয়েছিল। তা খন্দকার মোশতাকরা তো শুরু থেকেই দক্ষিণপন্থি ছিলেন, কিন্তু অলি আহাদ তো তা ছিলেন না; অন্য অনেকের তুলনাতেই তিনি ছিলেন অনেক অগ্রসর। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যখন গঠিত হয় তখন তাতে তিনি যোগ দিতে চাননি, সংগঠনটি অসাম্প্রদায়িক নয় বলে; একই কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগও তাকে আকর্ষণ করেনি। তিনি ছিলেন যুবলীগে, যেখানে আত্মপ্রকাশে-অসমর্থ কমিউনিস্টরা গোপনে কাজ করছিলেন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন-প্রভাবিত পূর্ব-এশীয় যুব সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৫০-এ নাচোলে কৃষকবিদ্রোহ হয়। নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির স্থানীয় নেত্রী ইলা মিত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং যেভাবে নির্যাতন করে তাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নৃশংস চরিত্রের প্রথম উন্মোচন ঘটে। রাজশাহী কোর্টে ইলা মিত্র একটি জবানবন্দি দেন। অলি আহাদ স্মরণ করেছেন যে ‘স্পর্শকাতর ও ক্ষুব্ধ মনের তাড়নায়’ তিনি ‘সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে’ অতিগোপনে বহু কষ্টে ঢাকার একটি ছাপাখানা থেকে ইশতেহারের আকারে জবানবন্দিটি ছাপিয়ে সন্তর্পণে সর্বত্র বিলি করার ব্যবস্থা করেন। জবানবন্দিটি ছিল ইংরেজিতে, ইশতেহারে ইংরেজির সঙ্গে বাংলায় অনুবাদও ছিল, এবং অনুবাদ তিনি নিজেই করেছিলেন। কাজটি সামান্য ছিল না। যেমন দুঃসাহসিক, তেমনি দুঃসাধ্য, এবং ঐতিহাসিক। একসময়ে আওয়ামী লীগের তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন, কিন্তু মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যখন ন্যাপ গঠিত হলো তখন আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপেই যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতর কমিউনিস্ট ঘরানার যারা ছিলেন সবাই ন্যাপে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে অলি আহাদ শুধু অ-কমিউনিস্ট নন, খন্দকার মোশতাকের মতোই অঙ্গীকারবদ্ধ কমিউনিস্ট-বিদ্বেষীতে পরিণত হয়েছেন। প্রমাণ আছে তার লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ বইতে। বইটি তিনি বাকশাল গঠনের পরে জেলখানায় থাকা অবস্থাতে লিখতে শুরু করেন। এই বইতে কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ জ্বল জ্বল করছে। ধরা যাক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনাকালের বিবরণ। তিনি এমন একটি তথ্য দিচ্ছেন, যা অন্য কেউ দেননি। সেটা হলো আন্দোলনে কমিউনিস্ট-বিরোধিতা। সরকারের পক্ষ থেকে বরং উল্টোটা প্রচার করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল যে এ আন্দোলন কমিউনিস্ট ও হিন্দুদের কাজ। হিন্দুদের ব্যাপারটা সর্বৈব মিথ্যা : কিন্তু কমিউনিস্টরা যে ছিল সেটা মোটেই মিথ্যা নয়। অলি আহাদ জানাচ্ছেন যে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় যে সাধারণ ছাত্রসভা হয় সেটাকে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা বানচাল করার চেষ্টা করেছিল, আর তাদের সঙ্গে ছিলেন পার্টির নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। ‘কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের সচেতন সংগ্রামী চেতনা উপরোক্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়া দেয়।’ সরদার ফজলুল করিম নাকি সেখানেই নিবৃত্ত হননি, পরের সভায়ও (১৭ মার্চ) তিনি ‘কতিপয় সমর্থকের সহায়তায় গোলযোগ সৃষ্টির প্রাণপণ চেষ্টা করেন। ইহা নাকি তাহাদের বিপ্লবের স্বার্থে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কর্মসূচিভুক্ত।’ অলি আহাদ আরও জানাচ্ছেন, ‘১৯৪৮ সালের ৩০ জুন কমিউনিস্ট পার্টি সদরঘাটের করনেশন পার্কে একটি জনসভা করার চেষ্টা করে, কিন্তু জনতার আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত কমিউনিস্ট কর্মীরা স্ব-স্ব প্রাণ বাঁচাইবার প্রয়াসে সভাস্থল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন। সরকার সমর্থক মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান বীরদর্পে বক্তৃতা মঞ্চে আরোহণ করিয়া জনতার উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দান করেন। এভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক বলিয়া অভিযুক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীবৃন্দ ধীরে ধীরে প্রকাশ্য কর্মসূচি বর্জন করিয়া গোপন সংগঠনের দিকে মনোনিবেশ করে। অলি আহাদের ভাবটা এই রকমের যে ভালোই হয়েছে, বেশ হয়েছে, যেমন কর্ম তেমন ফল।’
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আবুল হাসনাত আমাদের সময়ের একজন অনন্য সাহিত্য-সম্পাদকই কেবল ছিলেন না কিংবা কবি-প্রাবন্ধিক, শিশু-সাহিত্যিকই শুধু নন; মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন বেশ খানিকটা অন্যরকম মানুষ। যাকে কিনা শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বলতে পারি, ‘এই একজন মানুষের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল গোটা-মানুষের খানিকটা আদল।’ সেই ‘আদলে’র মধ্যে দেখা গিয়েছে বিষাদের পাশাপাশি একটি সংবেদনশীল মনের উজ্জ্বলতা, যা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে অনেকখানি ‘স্রোতময় করে তোলে’। অথচ তিনি যদি এর বিপরীত কিছু হয়ে উঠতেন, তাতেও আশ্চর্যের কিছুই ছিল না। কারণ, তিনি নিজেই আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘আমার জন্ম হয়েছে ১৯৪৩ সালে, মহাদুর্ভিক্ষের সময়ে।’ শুধু জন্মকালই নয়, বলা যায় যে, জীবন-সংগ্রামের এই কালো ছায়ায় তাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বসবাস করতে হয়েছে। আবুল হাসনাতের নিজের বয়ানে পাচ্ছি, ‘জীবন সংগ্রামে বিপর্যস্ত হওয়ায় আমি...‘সংবাদ’-এ চাকরি নিয়েছিলাম। দিনের বেলায় [ঢাকা] বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যয়ন করছি আর রাতে চাকরি করি বার্তা বিভাগে। যদিও অধ্যয়ন বা নিয়মিত ক্লাস করা সবসময় হয়ে উঠত না।’ সেইসঙ্গে আমরা এ-ও জানতে পারছি যে তিনি ভর্তি পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও রাজনীতি ও চাকরি সামলিয়ে পড়াশোনাটা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারেননি। এতে করে তার তেমন-একটা ক্ষতি অবশ্য হয়নি।
২. কেন বলছি যে, তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি? বলছি, তার কারণ হচ্ছে উচ্চশিক্ষার কাগুজে সার্টিফিকেট জোটাতে না-পারলেও, আমাদের অনেকেরই জানা আছে, আবুল হাসনাত আমৃত্যু ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের গভীর আর মনোযোগী একজন পাঠক। তার সাহিত্যবোধ ও সাহিত্যচিন্তার ধরনটা ছিল অনবদ্য, যা তাকে একজন অতুলনীয় সম্পাদক হিসেবে স্থান করে দিয়েছিল। শুধুই সাহিত্যবোধ নয়, সেইসঙ্গে তার শৈল্পিক বিবেচনাবোধ ও মাত্রাজ্ঞান ছিল যে-কোনো মানদ-ের বিচারে তুলনাহীন। নিজের কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি অনন্য ছিলেন ঠিকই, কিন্তু পূর্বসূরিদের কৃতিত্বের কথা সবসময়ই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন। দৈনিক ‘সংবাদে’ নিজের কাজের পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বারংবার স্মরণ করেছেন অগ্রজ কবি ও সম্পাদক আহসান হাবীবের কথা। আবুল হাসনাত বলেছেন, ‘দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক হিসেবে কবি আহসান হাবীবের সুনাম ও প্রতিষ্ঠা তখন তুঙ্গে...ষাটের দশক, মৃত্যুকাল অবধি এক বৈরী ও প্রতিকূল আবহে তিনি তার সম্পাদিত ‘দৈনিক বাংলা’ সাহিত্য বিভাগটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন।’ আর এরই সূত্রে নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমি তার [আহসান হাবীব] প্রবর্তিত কিছু বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে আরও প্রসারিত চেতনায় [সংবাদের] সাময়িকী বিভাগটিকে বিন্যস্ত করেছিলামএ কথা মনে পড়ে।’
৩. তার মানে আবার এটাও নয় যে, দৈনিকের সাহিত্যের পাতা সম্পাদনা করতে গিয়ে তিনি শুধুই আহসান হাবীবকে অনুসরণ করেছিলেন, তার নিজস্বতা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ব্যাপারটি সেরকম তো নয়ই, বরং এই আয়োজনে তার নিজস্বতা নানাভাবেই চোখে পড়ার মতো ছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, আবুল হাসনাত “দীর্ঘদিন ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করে...সাময়িকীকে একটি বিশেষ উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন।’ আবুল হাসনাতের স্বকীয়তার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে গুণটা সবচেয়ে বেশি থাকা দরকার সেটা হলো লেখা চেনার ক্ষমতা এবং লেখাটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। আবুল হাসনাত ভালো লেখা সহজে চিনতে পারতেন। তার সম্পাদনার মুনশিয়ানার কারণে ভালো লেখা পেতে সমস্যা হতো না।’ আর সেইসঙ্গে তিনি আবুল হাসনাতের যে-অসাধারণ গুণটির কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি, সেটি হচ্ছে সম্পাদনার ক্ষেত্রে তার নৈর্ব্যক্তিকতা। এই গুণটি আজকের দিনে, বলা যায়, প্রায়ই-বিলুপ্তির পথে!
৪. শুধু সম্পাদনার মধ্যেই নয়, আবুল হাসনাত তার কাজের পরিধিকে ব্যাপ্ত করেছিলেন সক্রিয় রাজনীতির মধ্যেও। অবশ্য তার জীবনের এই অভিজ্ঞতাটি সবসময় সুখকর কিছু হয়নি। কিন্তু তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, তিনি একেবারে ব্যর্থ হয়েছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি, আমাদের দেশে যে-দলটিকে বলা হতো মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি, সেটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখতে পাই যে, এই দলটির বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি আর আপসকামিতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, ছিল না। পার্টির এই সুবিধাবাদী পথ আবুল হাসনাতকে নানাভাবে আহত করেছে। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন পার্টি ছেড়ে দিতে, কিন্তু দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, ‘একদিনের জন্য কমিউনিস্ট আদর্শকে শত টালমাটালের মধ্যেও ত্যাগ করিনি কিংবা [অন্য] কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিইনি।’
৫. সিপিবির নেতাদের সুবিধাবাদিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন এ-প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘জিয়াউর রহমানের শাসনামলে হ্যাঁ-না ভোটের সময় মোহাম্মদ ফরহাদ পার্টি নেতা হিসেবে প্রায় এককভাবে জিয়াউর রহমানকে হ্যাঁ ভোট দেওয়ার যে অনমনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা অনেকের সঙ্গে আমার রুচিকে দারুণভাবে আহত করেছিল।’ আবার পার্টির আরেক নেতা সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘যখন বলা হলো, সোভিয়েত পার্টি ভেঙে যাওয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, তখন খুবই ব্যথিত ও দুঃখিত হয়েছিলাম।’ আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ক্ষমার অযোগ্য এক পাপ করেছিল...দীর্ঘদিনের একটি আদর্শবাদী দলের বৃহৎ অংশ ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের অব্যাহত অনুরোধে গণফোরামে যোগ দিল।’ এই ব্যাপারটিকে আবুল হাসনাতের মনে হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে...এক কলঙ্কজনক ঘটনা।’
৬. এসবের পাশাপাশি আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পেয়েছি, তার স্মৃতিকথায় আবুল হাসনাত পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাদী বিপ্লবী কমিউনিস্টদের প্রতি তার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। নকশাল আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি খানিকটা অনুতাপের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন, ‘আমরা তখন আশ্রিত ও মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে ব্যস্ত’, আর সেই কারণেই ‘এই আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের যুব ও ছাত্রসমাজের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষাকে, আত্মোৎসর্গকে কোনোদিক থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি। কারণ ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেস ছিল বাংলাদেশের বাঙালির ত্রাণকর্তা।’ পরবর্তী সময়ে তিনি তার সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। নকশাল বিপ্লবীদের সম্পর্কে তিনি মনে করতেন, ‘তাদের প্রত্যয় ও দেশচেতনা আমার কাছে ভিন্ন মর্যাদা দাবি করে।’ কারণ, আবুল হাসনাতের ভাষায়, ‘নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের পথ’। আর সেইসঙ্গে নকশাল বিপ্লবীদের ‘চেতনা ও মর্মবাণীতে সমাজ বদলের আকাক্সক্ষা কত তীব্র ছিল তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল তাদের জীবন উৎসর্গে।’ নকশাল বিপ্লবীদের নিয়ে এমন আন্তরিক মূল্যায়ন বাংলাদেশের আর কোনো মস্কোপন্থির লেখায় কখনো পড়েছি বলে ঠিক মনে করতে পারি না।
৭. অন্যদিকে আবার, আবুল হাসনাত ছিলেন একজন প্রকৃত কবি। তার কবিতার সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু আমৃত্যু তিনি কবিতাচর্চায় নিমগ্ন থেকেছিলেন। আমাদের অনেকেরই সম্ভবত জানা নেই যে, তিনি কবিতা লিখতেন ‘মাহমুদ আল জামান’ নামে। তার ‘নির্বাচিত কবিতা’র (২০১৭) ‘আত্মকথনে’ আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ‘কবিতা লিখছি ষাটের দশক থেকে। কেন লিখি এ-কখনো ভেবে দেখিনি। হৃদয়, মন, মস্তিষ্ক কখনো-সখনো দিনযাপনের দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, গ্লানি, আনন্দ কবিতা লিখতে প্রেরণা দেয়। কখনো অঙ্গীকারের তাগিদে, কখনো ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে।’ তার কবিতায় জীবনের এইসব উপাদানই বিচিত্রভাবে শৈল্পিক মর্যাদায় অভিব্যক্ত হয়েছে। যেমন ‘ছায়াময় ভুবনডাঙায়’ শীর্ষক কবিতায় তিনি বলেছেন : ‘আমি কখনো জীর্ণ, কখনো শীর্ণ;/কল্পলতায়/শুয়ে আছে মরদেহের প্রগাঢ় ঘুম!/কে তুমি মধ্যরাতে ফের কড়া নাড়ো?/কী খেলা যে খেলছো তুমি কে জানে।/বিষাদ প্রতিমা বুকে নিয়ে/আমি তো পড়ে থাকি এই ঘুমে।’ খুব সংগত কারণেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার একটি স্মৃতিমেদুর প্রবন্ধে লিখেছিলেন, আবুল হাসনাতের কবিতায় ‘তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আবেগ, মান-অভিমান জায়গা করে নিত।’ সেইসঙ্গে তিনি এই মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি যে, হাসনাতকে ‘আরও ব্যাপকভাবে খুঁজে পাওয়া যেত কবিতায়।’ আমরাও সেটি মনে করি।
৮. কবিতার প্রতি নানাভাবে সমর্পিত হয়েও, আবুল হাসনাত,
কথাসাহিত্য নিয়ে তার অনুরাগের কথা নানা জায়গায় ব্যক্ত করেছিলেন। উপন্যাস, বিশেষ করে মানিক-সতীনাথকে নিয়ে তার একটি আলাদা ধরনের আগ্রহ ছিল। তার লেখালেখিতেও এর নমুনা ছড়িয়ে আছে। ‘রবিশঙ্কর মানিক সতীনাথ ও অন্যান্য’ (অয়ন প্রকাশন : একুশে বইমেলা, ২০১৬) গ্রন্থটি প্রধানত আমাদের কথাসাহিত্যসহ নানা বিষয়ে আবুল হাসনাতের নিজস্ব ভাবনা নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধের সংকলন। এই গ্রন্থের ‘ভূমিকার বদলে’ তিনি বলেছিলেন, ‘এই প্রবন্ধগুলো নিয়ে বই বেরোবে তা কোনোদিন ভাবিনি এবং বইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে এসব লেখা হয়নি।’ এইসব প্রবন্ধ রচনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘কারুর ব্যক্তিস্বরূপ আমার কাছে হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়, কারুর সঙ্গ পেয়ে সাহিত্য ও শিল্পের অর্কেস্ট্রার ধ্বনি বেজে উঠেছে আমার হৃদয়ে। এতে সাহিত্যের রুচি, ধারণা ও রূপকল্পের এক প্রতিমা গড়ে উঠেছে।’ কথাগুলো তিনি এতটুকুও বাড়িয়ে বলেননি।
৯. আমরা আগেও বলেছি, আবুল হাসনাত ছিলেন দৈনিক পত্রিকার জগতের মানুষ। তিনি ছিলেন সম্পাদনার জগতের মানুষ। কিন্তু তারপরও তিনি মনে করতেন যে, ‘সাহিত্য ছাড়া আমার কোনো দ্বিতীয় প্রেম নেই।’ আর এই প্রেমের নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ তার রাজনীতি-সম্পাদনা-কবিতা-প্রবন্ধের মধ্যে বিচিত্রভঙ্গিতে নানান স্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তিনি লিখেছিলেন : ‘আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে/হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও সজীব/সহজ উজ্জ্বলতা।’ নিজের বিশ্বাসের ওপর ভরসা রাখতেন বলেই এমনভাবে তিনি সজীব উজ্জ্বলতাকে যাচ্ঞা করতে পেরেছিলেন। জীবনের ঔৎসুক্য, জীবনের নানাবিধ কৌতূহলের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বলেই মৃত্যুকে খুব সহজভাবে মেনে নিতে তার খুব কষ্ট হয়নি।
১০. আবুল হাসনাত ছিলেন সেই ব্যক্তি, যার মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম সত্যের প্রতি নিমগ্নতা, পেয়েছিলাম নৈর্ব্যক্তিক ধরন, পেয়েছিলাম সৌজন্য। জীবনের তাৎপর্যকে এমন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবার মতো মানুষ আজকের দুনিয়ায় খুব বেশি নেই। আজ তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা!
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর জন্ম ১৮৩০ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়ায়। তার পিতৃদত্ত নাম গন্ধর্বনারায়ণ। গ্রাম্য পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষে বাবার প্রচেষ্টায় স্থানীয় জমিদারের সেরেস্তায় ১৮৪০ সালে মাসিক আট টাকা বেতনে তিনি চাকরি শুরু করেন। কিন্তু তার মধ্যে ছিল উচ্চশিক্ষা লাভের তীব্র বাসনা। তাই পাঁচ বছর চাকরি করার পর বাবার অমতেই গোপনে তিনি চলে যান কলকাতায়। শুরু হয় তার উচ্চশিক্ষা লাভের প্রাণান্ত সংগ্রাম। কলকাতায় পড়াশোনার খরচ জোগাতে তাকে গৃহভৃত্যের কাজ করতে হয়েছে। প্রথমে তিনি রেভারেন্ড জেমস লংয়ের অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এ সময়ই তিনি দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করেন। পরে তিনি ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। সেখান থেকে ১৮৫০ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় পাস করে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। কলেজের সব পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৫৫ সালে তিনি পাটনায় পোস্টমাস্টার পদে যোগ দেন। এ বিভাগে বিভিন্ন স্থানে কাজের পর তিনি সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল হন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৮৭২ সালে তিনি ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ইন্সপেক্টর পদ লাভ করেন। কলেজে পড়ার সময়ই ঈশ্বরগুপ্তের সংস্পর্শে গিয়ে সংবাদ প্রভাকর, সাধুরঞ্জন প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। তবে নাটক ও প্রহসন লিখেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন। নীলদর্পণ তার শ্রেষ্ঠ নাটক। তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার মনে করা হয়। তিনি ছিলেন সমাজকল্যাণনিষ্ঠ শিল্পী এবং কৃত্রিমতার বিরোধী, সত্যের অনুসারী। ১৮৭৩ সালের ১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।