
রায়েরবাজার স্লুইসগেট থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত মোট ১২ কিলোমিটারের ইনার সার্কুলার রোড করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। খরচ প্রায় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিভিন্ন খাতের ব্যয় চোখ কপালে ওঠার মতো। এ প্রকল্পে একজন পরামর্শকের বেতন ধরা হয়েছে মাসে ৮৭ লাখ টাকার বেশি। একটি সাধারণ প্রকল্পের জন্য বিপুল বেতনের পরামর্শক নিয়োগের এমন প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শুধু পরামর্শক নিয়োগ নয়, প্রকল্পটির বিভিন্ন অংশের অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রস্তাবও অযৌক্তিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে রিটেইনিং ওয়াল ও অন্য ওয়াল নির্মাণে ব্যয় হবে ৪০৬ কোটি টাকা। আর শুধু বিদ্যুতের খুঁটি সরাতে ব্যয় হবে ১২০ কোটি টাকা। অস্বাভাবিক ব্যয় থাকায় ব্যয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে।
সম্প্রতি প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ৮৯৮ কোটি টাকা, বাকি ৯৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থায়ন করবে ডিএসসিসি নিজেরাই। কোনো প্রকল্প প্রস্তাব করার নিয়ম হলো, সেটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু প্রকল্পটি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই।
প্রকল্পটি পিইসি সভায় উপস্থাপন করেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী (সিইও) মো. মিজানুর রহমান। পিইসি সভায় তিনি বলেন, এ সড়কটি উন্নয়ন করা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-মাওয়া সড়কের আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ শতাংশ গাড়ি এ সড়ক ব্যবহার করবে। এখন নিয়মিত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি জেলা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৬টি জেলার যানবাহনগুলো ঢাকায় আসছে।
প্রকল্পটিতে পরামর্শক খাতে ৩০ জন মাসের জন্য ২৬ কোটি ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। অর্থাৎ প্রতি মাসে একজন পরামর্শকের বেতন হবে ৮৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া পরামর্শকের কার্যপরিধি কী তাও ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ প্রকল্পে রাজস্ব খাতে পরামর্শক রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে দক্ষিণ সিটির সিইওকে।
এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সঙ্গে কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। কথাও বলতে পারব না।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ইনার সার্কুলার রিং রোডের রায়েরবাজার সøুইসগেট থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত অংশের অর্থাৎ প্রায় ১২ কিলোমিটার উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সড়কের উন্নয়ন কাজটি প্রথম ধাপে রায়েরবাজার স্লুইসগেট থেকে লোহার ব্রিজ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন করা হবে এবং দ্বিতীয় ধাপে লোহার ব্রিজ থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন হবে।
এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। কিন্তু ডিপিপিতে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের যে তথ্য যুক্ত করা হয়েছে, তা মূল প্রতিবেদন নয়। ফিজিবিলিটি স্টাডি পরিপত্রে উল্লিখিত ফরম্যাট অনুযায়ী করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয় বলে মনে করছে কমিশন।
ডিপিপিতে কিছু অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে রয়েছেÑ ডিপিপিতে ৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৩৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে অর্থাৎ ১ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে খরচ পড়বে ৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পে তিনটি ভেহিক্যাল ওভারপাস, তিনটি ফুটওভার ব্রিজ, আটটি সøুইসগেটসহ পাইপ কালভার্ট, বাস বে, যাত্রী ছাউনি, ফুটপাত কাম ড্রেন, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য ৪০৬ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কয় লেনের কী ধরনের রাস্তা নির্মাণ করা হবে, এর ধারণাগত নকশা ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গের সংখ্যা ও পরিমাণ এবং দর প্রাক্কলনের ভিত্তি স্পষ্টভাবে ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়নি।
ডিপিপিতে রাজস্ব খাতে বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং টাওয়ার স্থানান্তর খাতে ১২০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শুধু খুঁটি সরাতে এত ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্প প্রস্তাবে অবকাঠামো ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কী ধরনের কতগুলো অবকাঠামোর জন্য এ প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং এ প্রাক্কলনের ভিত্তি কী, তাও স্পষ্ট নয়।
এ ছাড়া ডিসম্যানট্যলিং অব স্ট্রাকচার খাতে ৮০ লাখ টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হলেও কী ধরনের কতটি স্ট্রাকচার ডিসম্যানট্যালিং বা সরাতে হবে সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেয়নি ডিএসসিসি। এ দুই খাতে কতটি বা কী পরিমাণ বৈদ্যুতিক খুঁটি, টাওয়ার স্থানান্তর করা হবে ও কী ধরনের কতটি স্ট্রাকচার সরাতে হবে এবং এতে কী পরিমাণ ব্যয় হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে পিইসি সভায়।
প্রকল্পের এত বেশি ব্যয় প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ব্যয় বেশি হওয়ায় আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। সড়কের সঙ্গে সমন্বয় করে এ কমিটি করা হয়েছে। তারা দেখে যেটি বাস্তবসম্মত হয় সেটি নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কমিটির সিদ্ধান্তের পর দরকার হলে আমরা আবার এ প্রকল্পের জন্য আরেকটি পিইসি করব।’ তিনি বলেন, ‘তারা তাদের প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। তবে আমাদের কাছে বেশি মনে হয়েছে তাই আমরা সেটিকে গ্রহণ করিনি। সড়ক ও জনপথের সঙ্গে সমন্বয় করা জরুরি। তাছাড়া এত ব্যয়ের প্রকল্পটির ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের কোনো অনুমোদন নেয়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে কী অর্জন হলো এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা যত না, তার চেয়ে বেশি বাইডেনের সেলফি নিয়ে। এ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে অন্য যুক্তি তুলে ধরে আওয়ামী লীগের শীর্ষসারির নেতারা দাবি করেন, নির্বাচনের আগে ভারত সফর বিশ্ব রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চাপমুক্ত করতে পেরেছে। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধু ভারতই করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সমাধান করতে হবে। এগুলো বিদেশিদের সামনে এনে সমাধান হবে না।
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি তোলার ঘটনা প্রচার করে আওয়ামী লীগ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আদতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের নড়চড় হয়নি।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতিতে জটিলতা চলছে। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, মন্ত্রী ও সরকারি দল, বিরোধ দল ও মাঠের বড় দল বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে এক দফা দাবিতে অনড়। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে রাজি নয়। এ অবস্থায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগ চাপে রয়েছে, এমন খবর গণমাধ্যমে আসে। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কয়েকজন মন্ত্রী নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের মোদি সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূতিয়ালি করছে বলে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
এ প্রেক্ষাপটে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার ও আওয়াম লীগ। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা ও সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালি হাতে ফেরেননি। ভারত সফরে গিয়ে ভারত জয় করে এসেছেন তিনি।
তারা দাবি করছেন, ভারতকে যেমন ‘মুঠোবন্দি’ করেছেন তেমনি সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব দূর করার ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত মাঠের বিরোধী দল বিএনপি দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল তাতে হোঁচট খেতে হলো দলটিকে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে সফরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী তা পূরণ হয়েছে। এর প্রকাশ ঘটতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সাধারণ মানুষকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শেষ কথা হলো বাংলাদেশের জন্য পরম মর্যাদা নিয়ে ফিরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।’
কূটনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এমন এক নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্ব নেতাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই দেশটির সবচেয়ে কাছের মিত্র। তিনি এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে।’ এর সঙ্গে দুটি ঘটনা তুলে ধরে এ নেতা আরও বলেন, ‘প্রথমত দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশ জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি। ভারত বাংলাদেশকে যে গুরুত্ব দেয়, এটি তার প্রমাণ। আরেকটি বিষয় হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির নিজের বাড়িতে দাওয়াত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খাওয়ানো। সেখানে অন্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান থাকলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু তার দৃষ্টান্ত দেখালেন মোদি। তিনি বোঝালেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক নিয়ে নানা গুজব থাকলেও সেটি মিথ্যা। প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবে ভারত সরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান জো বাইডেন সেলফি তোলায় রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র জয় করার যে উত্তাপ দেখাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা, তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলী ও সম্পাদকম-লীর দুজন সদস্য। তারা বলেন, সেলফি বড় কোনো বিষয় নয়। এ সেলফি নিয়ে যারাই যে ব্যাখ্যা দিয়ে বেড়াক, সেটা গুরুত্বহীন। কারণ এ ধরনের অনুষ্ঠানে সেলফি তোলাতুলি হয়ই। তবে এ অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের যে কথোপকথন হওয়ার সুযোগ মিলেছে, সেলফির চেয়েও সেটা বড় ঘটনা। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এ দুই নেতা আরও বলেন, জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মকান্ডে এ দাবি করা যায় যে, ভারত জয় করেই ফিরেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক নেতা দাবি করেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এখনকার চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষমতাশালী ছিল। যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশটির বিরোধিতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। শক্তির বিবেচনায় তখনকার তুলনায় এখন যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এ নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। এর অন্যতম হলো খাদ্যদ্রব্যের দাম জনগণের নাগালে রাখা। জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা। মোটামুটি অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, সেখানে ৫০ ভাগ ভোটার ভোট দেয় তাতেই সব ঠিক করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে যেকোনো কৌশলে সব দলকে নির্বাচনে আনতে পারলে সব প্রতিকূল পরিস্থিতিই ‘ওভারকাম’ (জয়) করা সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে এ নেতা বলেন, ‘এসব অনুষ্ঠান ফরমাল। এখানেই সব ডিলিং হয়ে যাবে ব্যাপারটা এরকম ভেবে নিলে হবে না। তবে এ সফরের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হলে সবচেয়ে বড় সফলতা এসেছে, সেটি মানতেই হবে।’
তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তিনি মূলত বিশ্ব নেতাদের অবহিত করেছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। এ বিষয়টি বাংলাদেশের উত্তাল রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ফেবার (সুবিধা) দেবে।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য ঠিক এমন বোঝাপড়ার কথা তুলে ধরে দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে প্রতিবেশী দেশটি নিয়ে যেসব গুঞ্জন মাঠে ছিল, সেটা আর ধোপে টিকবে না।
ভারত সফর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মি আহমেদ কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কেও টানাপড়েন কখনো ঘটেনি, সামনেও ঘটবে না সে বিষয়টা বিশ্ববাসীকে বুঝতে সুবিধা করে দিয়েছে এই জি-২০ সম্মেলন।’ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে মাঠে আন্দোলনরত বিএনপি বুঝলে তাদের জন্য ভালো হবে। না বুঝতে পারলে যা হওয়ার কথা তাই হবে মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এ নেতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত পরমবন্ধু তা সর্বজনবিদিত। গত ১২-১৩ বছরে সম্পর্কের উষ্ণতা উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে সেটাও সবাই দেখেছে। তবে সর্বশেষ সফরে কী নিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গেলে আমি বলব, আরও সময় নিয়ে বলা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এ সফরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে যা এসেছে, দেখেছি ও পড়েছি; তাতে এটুকু বলতে পারি। এখানে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার দেখা যায়নি। সম্পর্ক স্বাভাবিকই রয়েছে। এজ ইট ইজ।’
সম্পর্ক ঠিকই আছে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদও। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত একে অন্যের অকৃত্রিম বন্ধু। সে সম্পর্কে কোনো হোঁচট খেয়েছে এটা বলা যায় না।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এসব বিষয়গুলো জি-২০ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আর এ বিষয়গুলো নিয়ে যেহেতু সরকার কাজ করেছে এ ধরনের বিশ্বসভায় সেসব বিষয়ে আলোচনা হওয়া খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটা বিশ্বসভায় বিশ্বের বহু নেতার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় বৈঠক হবে এটাই স্বাভাবিক। সে অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে আমার মনে হয় না। হলেও খুব সামান্য সময়ের জন্য হয়েছে। সেটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।’
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ যেসব সমস্যা রয়েছে, সেসব দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সমাধান করতে হবে আমাদের। এটাই প্রধান সোপান। অহেতুক যুক্তরাষ্ট্র বলেন, ভারত বলেন বা অন্যান্য দেশকে সামনে এনে এর সমাধান হবে না, বরং জটিল হয়ে পড়ে।’
আওয়ামী লীগকে ‘সেলফি রাজনীতির’ খোঁচা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাইডেনের সঙ্গে একটা সেলফি তুলে এখন ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন, আহা, আমরা জিতে গেছি। জেতাবে তো বাংলাদেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে। সেই ভোটটা ঠিকমতো হওয়ার ব্যবস্থা করেন। তা না হলে কোনো বাইডেনেই আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না, সেলফিও রক্ষা করতে পারবে না।’
ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন শেষে দুদিনের সফরে ঢাকা এসেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। প্রায় ৩৩ বছর পর কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এলেন। গতকাল রবিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে মাখোঁকে বহনকারী বিমানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফরাসি প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে মাখোঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
সফরসূচি অনুযায়ী, গতকাল রাতে রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশ নেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। এ সময় তিনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। এরপর রাতের ঢাকা দেখার অংশ হিসেবে মাখোঁর ধানমণ্ডি লেক পরিদর্শন এবং ধানমণ্ডিতে গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দের স্টুডিওতে যাওয়ার কথা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট সফরের দ্বিতীয় দিন আজ সোমবার সকালে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি স্যাটেলাইট এবং উড়োজাহাজের বিষয়ে এয়ারবাসের সঙ্গে দুটি এবং স্থানীয় সরকার প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য একটি সম্মতিপত্র সই হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতা, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে ফ্রান্সের আগ্রহ এবং আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ সফর গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত চাপের বিষয়ে প্যারিস কী বার্তা দেয়, সেটাই দেখার বিষয়। কারণ কয়েক দিন আগে ঢাকা সফর করে গেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। ঢাকার সঙ্গে মস্কোর রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারের বার্তা দিয়ে গেছেন তিনি। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা ছাড়ার দুদিন পর মাখোঁর ঢাকা সফর নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালি উর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ফ্রান্স। ভূরাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াও নানা কারণে মাখোঁর এ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সফরে ঢাকা-প্যারিস রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদারের সুযোগ রয়েছে।’
জানা গেছে, আজকে শেখ হাসিনা-মাখোঁর বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণা আসবে। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার সফরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স একটি প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক সই করে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনায় গুরুত্ব থাকবে এবার। কয়েকটি দ্বিপক্ষীয়ও চুক্তি হতে পারে। এয়ারবাস থেকে স্যাটেলাইট কেনার বিষয়ে একটি চুক্তি হতে পারে। একই কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কেনার যে কথা উঠেছে, সে ব্যাপারে কিছু অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফ্রান্সের সাহায্য সংস্থা এএফডি থেকে ২০ কোটি ডলার সহায়তা নিয়েও একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে মহাকাশ প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ক্রয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার, নির্বাচন ও ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুর মতো বিষয়গুলোতে আলোচনা হতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মাখোঁর সফরে নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। দুই শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। গুরুত্ব পাবে রাজনৈতিক বিষয়ও। এ ছাড়া বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়তা, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ রোহিঙ্গা ইস্যু দুই সরকারপ্রধানের আলোচনায় থাকবে।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আজ দুপুরের পর ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে মাখোঁর। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
বাংলাদেশ সফরে মাখোঁর সঙ্গে রয়েছেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাথেরিন কলোন্না। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সরকারের আশা, মাখোঁর এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হবে ও নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সফর করেন। ১৯৯০ সালের ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা বাংলাদেশ সফরের পর মাখোঁই প্রথম নেতা যিনি বাংলাদেশ সফর করছেন। মিতেরার ওই সফরের পর থেকে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়েছে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ২১০ মিলিয়ন থেকে ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে ও ফ্রান্স রপ্তানির ক্ষেত্রে পঞ্চম দেশ। ফরাসি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশের প্রকৌশল, জ¦ালানি, মহাকাশ ও পানিসহ বিভিন্ন খাতের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশের উন্নয়নে মুগ্ধ ফ্রান্স : মাখোঁ
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের এই উন্নয়নে মুগ্ধ ফ্রান্স। গতকাল রাতে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তার সম্মানে দেওয়া ভোজসভায় যোগ দিয়ে এ কথা বলেন তিনি। মাখোঁ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাত ১০টার দিকে নৈশভোজ শুরু হয়। তার আগে চলে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
ফ্রান্স আমাদের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটি কৌশলগত অংশীদারত্বে পৌঁছাবে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইন্দো-প্যাসিফিক এবং এর বাইরেও সবার অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য কৌশলগত সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যেতে পারে বলে আমি আত্মবিশ্বাসী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা কৌশলগত সম্পদ ও উন্নত প্রযুক্তিতে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র খুলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান বিশে^ যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের একাধিক সংকট মোকাবিলায় আমাদের অংশীদারত্ব একটি অর্থবহ শক্তি হতে পারে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে ফ্রান্স বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী। আমরা দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনার দিকে আলোকপাত করে একটি শক্তিশালী বাণিজ্য অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছি।
শেখ হাসিনা জানান, এই ভোজসভায় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে আতিথ্য দিতে পেরে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করছেন। তিনি বলেন, আমি ২০২১ সালের নভেম্বরে এলিসি প্যালেসে আপনার উষ্ণ আতিথেয়তার কথা স্মরণ করছি। আমি আনন্দিত যে, আপনি আমার ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
‘ফ্রান্স আমাদের হৃদয় এবং কল্পনায় একটি বিশেষ স্থানে রয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারপ্রধান জানান, তারা ফরাসি প্রেসিডেন্টের জন্য বাংলাদেশের অদ্বিতীয় জনপ্রিয় খাবার কাচ্চি বিরিয়ানির স্বাদ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের উভয় জাতিই আমাদের রন্ধনপ্রণালি, সংস্কৃতি এবং ভাষাগত ঐতিহ্যের জন্য অত্যন্ত গর্বিত। আমাদের দুই জনগোষ্ঠীকে একে অন্যের কাছাকাছি আনতে আমাদের দুটি সংস্কৃতির মধ্যে আরও পদ্ধতিগত পন্থা এবং সংমিশ্রণকে উন্নীত করার সময় এসেছে। তিনি আরও বলেন, আমি কি আমাদের আরেকটি সুস্বাদু খাবার স্থানীয় জনপ্রিয় ফল আমড়ার জুস দিয়ে টোস্ট করার কথা বলতে পারি!
শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরাসি বিপ্লবের চেতনায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধের প্রসারে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে)’-এর প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার আহ্বান আন্দ্রে মারলোর মতো বিশ্ব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল যারা আমাদের উদ্দেশ্যে সাধনে লড়াই করার জন্য অনেক তরুণকে সংগঠিত করেছিলেন।
তিনি বলেন, এটা প্রায়ই আমার মনে হয় যে, প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তার ফরোয়ার্ড মার্চ আন্দোলনের মাধ্যমে মারলো ও তার অনুসারীদের গর্বিত উত্তরাধিকার বহন করছেন। তিনি আরও বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সে আপনি যে সাহসী সংস্কার করেছেন তার জন্য আমরা আপনাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা আপনাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশুদ্ধ বাতাসের নিঃশ্বাস হিসেবে দেখি। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য আপনার (ফরাসি প্রেসিডেন্ট) গুরুত্ব আরোপ মূলত আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভোজ সভাস্থলে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুলের তোড়া দিয়ে মাখোঁকে স্বাগত জানান। এ সময় জাতির পিতার ছোট মেয়ে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।
পেঁয়াজুসহ ধূমায়িত ইলিশ এবং সমুচা, স্যুপ, রুটি এবং মাখন দিয়ে মাখোঁকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হয়। খাদ্য তালিকায় প্রধান উপাদান ছিল খাসির মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানি, গরুর কাবাব, চিকেন কোর্মা, ঐতিহ্যবাহী লুচি ও রোস্টেড লবস্টার। ডেজার্ট আইটেমের মধ্যে ছিল পাটিসাপটা পিঠা, মিষ্টি দই, রসগোল্লা, তাজা ফল, পানীয় এবং আনারের জুস, তাজা জুস, কোমল পানীয়, চা ও কফি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, গত আগস্ট মাসে বিশ্বে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বনিম্নে। এটি গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সংস্থাটি বলছে, এ সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। তবে পুরো উল্টোচিত্র বাংলাদেশে। বিশ্বে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভোক্তা মূল্য ও মজুরি সূচক (সিপিআই) ইনডেক্সের আগস্ট মাসের তথ্য অনুযায়ী, গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের কোনো নীতিই কাজে আসছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়াটা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ সুদহার বাড়িয়ে যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছে সেখানে বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টো পথে। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে এখনো কৌশলে সুদহার কমিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া বাজার অব্যবস্থাপনার কারণেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
যদিও সরকার দাবি করছে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে তারা সদা সচেষ্ট। কিন্তু বাজারের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ সত্ত্বেও, আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশের উচ্চতা ছুঁয়েছে। এতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে গেছে।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা আছে। উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এ বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা প্রকট। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার ব্যবস্থাপনায় যে নজরদারি ও খবরদারি দরকার সেগুলো ঠিকমতো করতে পারছে না বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, নজরদারির ক্ষেত্রে আমদানি কত, উৎপাদন কত, গ্যাপ কত এসব তথ্য-উপাত্ত নির্ভর নীতিমালা দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দুর্বলতার কারণে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ। রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাটা সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নির্ভর করছে।
সরকারের হিসাবে শহরের চেয়ে গ্রামে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে। আগস্টে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। শহরে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। আগের মাস অর্থাৎ জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে মূল্যস্ফীতি। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এটি আরও বেশি বেড়েছে। এটাকে চিন্তা করতে হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ওপরে আবার মূল্যস্ফীতি হিসেবে। চাল ১০০ টাকারটা ১১০ টাকা হয়েছে, তারপরেও আবার ১১২ টাকা হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষকে খুবই যাতনা দিচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ নামকাওয়াস্তে সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মুদ্রানীতিতে ১০ শতাংশের কিছু বেশি ধরা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এটিও যথেষ্ট নয়।
বিবিএসের হিসাবে, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে জানুয়ারিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এরপর থেকেই সূচকটি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করে এবং চলতি বছরের মে মাসে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উন্নীত হয় সার্বিক মূল্যস্ফীতি। এ সময়ে অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলেও গত আগস্টে বাংলাদেশে সামান্যই কমে। তবে আগস্টে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে, আগের মাস জুলাইয়ে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে বিবিএস খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের যে চিত্র দিয়েছে, তার সঙ্গে বাজারের কোনো মিল নেই। বেশিরভাগ খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যেরই দাম লাগামের বাইরে চলে গেছে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একেক প্রতিষ্ঠান একেক রকম তথ্য দেয়। যার ফলে নীতিনির্ধারকরা কখন আমদানি করতে হবে, কতটুকু করতে হবে এটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। এটাও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ। তিনি বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। টাকার মান যত কমছে সেটিও আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়াতে অবদান রাখছে।
তবে মূল্যস্ফীতির সার্বিক অবস্থার চেয়ে মজুরি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশের নিম্ন-অবস্থানে ছিল আগস্টে। অবশ্য এই হার আগের মাসের তুলনায় দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেড়েছে।
গত আগস্টে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যসারণী দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন অবস্থানে আসে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মূল্যসারণীতে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় এমন খাদ্যপণ্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আগস্টে মূল্যসারণীর গড় ছিল ১২১.৪ পয়েন্ট, যা আগের মাসে ছিল ১২৪ পয়েন্ট। ২০২১ সালের মার্চের পর গত আগস্টেই সর্বনিম্ন ছিল জাতিসংঘের খাদ্য মূল্যসারণীর গড়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের মার্চে এটি সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়, আগস্টে এর চেয়ে ২৪ শতাংশ কমেছে।
কিন্তু, বাংলাদেশে বৈশ্বিক এই অবস্থার প্রতিফলন হয়নি। বরং, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দরিদ্র্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারের খাদ্য সহায়তার মাত্রা কমায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি চড়া হয়েছে, বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে রাজধানীর শাহবাগ থানায় নিয়ে বেধড়ক পিটুনির ঘটনায় আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদকে ঢাকা মহানগর পুলিশ থেকে (ডিএমপি) সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার রাতে শাহবাগ থানায় নিয়ে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে মারধরের পর ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনারের দায়িত্বে থাকা হারুন অর রশিদকে গতকাল রবিবার দুপুরে প্রথমে ডিএমপির পিওএম (পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে) উত্তর বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। পরে সন্ধ্যার দিকে পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রজ্ঞাপনে
তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করার কথা জানানো হয়। এর আগে শনিবার রাতে পুলিশের এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুনের আড্ডা দেওয়া নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে তার কথা-কাটাকাটি হয়। পরে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। মারধরের শিকার ছাত্রলীগ নেতারা হলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ। তাদের দুজনকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দুদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের কঠোর শাস্তি দাবি করেছে ছাত্রলীগ। আর খোঁটার সুরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার বিচার চেয়েছে ছাত্রদলও।
জানা গেছে, শাহবাগ থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে পুলিশের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য মিলে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। এ খবর পেয়ে রাতেই শাহবাগ থানার সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভিড় করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও পুলিশের কর্মকর্তারা থানায় গিয়ে মধ্যরাতে ঘটনার প্রাথমিক মীমাংসা করেন।
রাজধানীর মগবাজারে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আহত ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন নাঈম। তিনি গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক তার এলাকার বড় ভাই। তাদের দুজনেরই বাড়ি গাজীপুরে। আজিজুল শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে তাকে ঢাকার শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে যেতে বলেন। রাত ৮টার দিকে তিনি সেখানে যান। পরে আজিজুল বারডেম জেনারেল হাসপাতালে আছেন জেনে সেখানে ছুটে যান। হাসপাতালের চারতলায় গিয়ে তিনি দেখেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক ও পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশিদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা চলছে। এ সময় আনোয়ারসহ ছাত্রলীগের আরও দুই নেতা মিলে তাদের নিবৃত্তের চেষ্টা করেন।
তিনি আরও জানান, এডিসি হারুন একপর্যায়ে শাহবাগ থানার ওসিকে (তদন্ত) ফোন করে হাসপাতালে ডেকে নেন। পুলিশ গিয়ে আজিজুল, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে মারধর করে। পরে হাসপাতাল থেকে পুলিশ জোর করে আজিজুলসহ তিন-চারজনকে গাড়িতে থানায় নিয়ে যায়।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ফোনে রমনা বিভাগের উপকমিশনারকে (মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন) মারধরের ঘটনাটি জানিয়ে শাহবাগ থানায় যাই। গিয়ে দেখি ওসি তদন্তের কক্ষে সবাইকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে। এডিসি হারুন ও ওসিও মারধর করছেন। ওসির কক্ষের দরজা টেনে ভেতরে ঢুকতেই ১০ থেকে ১৫ জন আমার ওপর হামলা করেন। আমার মুখে কিল-ঘুসি মারেন। একপর্যায়ে আমাকে নিচে ফেলে পা দিয়ে লাথি মারেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নির্যাতনের এ ঘটনার বিষয়ে গতকাল আফতাবনগরে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস উদ্বোধনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘এটা যে করেছে, সে পুলিশের হোক বা যেই হোক না কেন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে। কেন করেছে, কী করেছে, আমরা জিজ্ঞাসা করব। তার ভুল কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের প্রতিবাদ : পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের বিচার দাবিতে ফুঁসে উঠেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাকে শুধু প্রত্যাহার নয়, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন ছাত্রলীগের বর্তমান-সাবেক নেতাকর্মীরা। যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সমালোচনা করেছেন অনেকেই।
গতকাল রবিবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। এ সময় তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তাসহ নির্যাতনে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান। তা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।
এদিকে অনেকটা খোঁটার সুরে ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর হামলার বিচার চেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। এক বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদল বলেছে, ‘ছাত্রলীগের মদদে ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের কলঙ্কজনক সংস্কৃতির শিকার এখন খোদ ছাত্রলীগ। গত ১৫ বছর ধরে পুলিশের সহযোগিতায় ছাত্রলীগ সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করেছে। ছাত্রদলসহ সব বিরোধী ছাত্রসংগঠন এবং সাধারণ ছাত্রদের নির্মম নির্যাতন করেছে। বিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর অমানবিক পুলিশি নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে বুনো উল্লাস করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আজ তাদের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও ছাত্রলীগের কেউ কোনো প্রতিবাদ জানাতে সক্ষম হয়নি। একজন নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ভয়ে সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্রলীগ তটস্থ। ওই পুলিশ কর্মকর্তা যাবজ্জীবন কারাদ-যোগ্য অপরাধ করার পরও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ন্যূনতম সাহস ছাত্রলীগের নেতারা দেখাতে পারেননি। ছাত্রলীগের মতো একটি পুরনো ছাত্রসংগঠনের এহেন অমর্যাদাকর অবস্থানের কারণে নিন্দা ও হতাশা প্রকাশ করি।’
এর আগেও পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। গত বছর ১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যকার সংঘর্ষ থামাতে যাওয়া এক পুলিশ কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারেন হারুন। যার ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে শাহবাগে সমাবেশকারীদের পেটানোর ঘটনা, এমনকি তিনি নিজেই লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছেন এমন ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। তবে হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
‘দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, চাম্পু ও চুম্পু’ এমন সব হরেক নামে পরিচিত চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম ভূঁইয়া। তিনি সেখানে আছেন এক যুগের বেশি। শুধু তাই নয়, একই দায়িত্ব পালন করেন মতলব পৌরসভায়ও। যেখানে সার্ভিস রুলে তিন বছর পূর্ণ হলে বদলি হওয়ার কথা। কিন্তু আবুল কালাম চাঁদপুরে কীভাবে খুঁটি গেড়ে আছেন সে নিয়েও আলোচনা আছে। তার দুর্নীতি-অনিয়মে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তার নাম দিয়েছে ‘আকাম ভূঁইয়া’।
পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে দাবি করেছেন, সর্বোচ্চ ব্যক্তি মেয়র হলেও পৌরসভায় আকাম ভূঁইয়ার কথাই শেষ কথা। মেয়র বললেও অনেক কাজ হয় না। কিন্তু আকাম ভূঁইয়া বললে হয়ে যায় এবং দ্রুতগতিতে হয়।
দেশ রূপান্তরের হাতে আসা নথি অনুযায়ী, তার দুর্নীতির পরিমাণ শতকোটি টাকার কম নয়। জানতে চাইলে চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আবুল কালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে আমি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আশা করছি এক দেড় মাসের মধ্যে রিপোর্ট চলে আসবে। তারপরই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করলেও তিনি বলেন, সবই হয়েছে তিনি মেয়র পদে আসার আগে।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৌরসভার বিজ্ঞাপন থেকে বড় অঙ্কের টাকা লুটপাট হয়েছে। এ টাকা পৌরসভার ফান্ডে না এসে কারও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অথবা বিকাশে গেছে, এর সত্যতা আছে। মাস্টার রোলের নামে নয়-ছয় করে লোক নিয়োগের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার সময়ে একজনও অ্যাডহক বা মাস্টার রোলে লোক নিয়োগ দিইনি। পৌরসভার অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছি।’ তার পরিচালনাধীন চাঁদপুর পৌরসভায় মাস্টার রোলে এখন ৭৩ জন কর্মচারী চাকরি করছে বলে স্বীকার করেন।
পৌরসভা থেকে পাওয়া গাড়ি নিজের পরিবারের জন্য ব্যবহার না করা এ মেয়র বলেন, ‘অনেক কিছুর বদলানোর উদ্যোগ আমি নিইনি কেন জানেন, সিস্টেমে চুরির সুযোগ থাকলে চোর চুরি করবেই। সিস্টেমে চুরির সুযোগ না থাকলে চোর কোনোভাবেই চুরি করতে পারবে না। আমি এতে ভীষণ বিশ্বাস করি।’
বদলি প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবর্তন করিনি। এটা করতে গেলে ঝক্কি-ঝামেলাও হয়। আমি চেয়েছি, এগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাজ, তারাই করুক।’
মাস্টার রোলে নিয়োগ অবৈধ হলেও নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মফিজ হালদার ৭৩ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। বিজ্ঞাপন থেকে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ও বিকাশে ১৫ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। জ্বালানি তেলের খরচ দেখিয়ে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা লোপাটের ঘটনা সবার জানা।
এ বিষয়ে মেয়র জুয়েল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তেল ব্যবহারে প্রত্যেক পৌরসভায় বাজেট থাকে। মাসে ২১০ লিটার। যে হিসাবকে সিলিং বলে। এ পৌরসভায় জ্বালানি তেল ব্যবহারের কোনো সিলিং ছিল না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তা চালু হয়েছে।’
আবুল কালাম ওরফে আকাম সিন্ডিকেটের লোপাটের অন্য ক্ষেত্রগুলো হলো পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন দেখিয়ে মাসিক ১৪ লাখ করে ১০ বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। পাশাপাশি ‘সুইপার বিল’ নাম দিয়ে মাসে দুই বা ততোধিকবার প্রায় ৫ লাখ টাকা করে ১০ বছর ধরে তুলেছে চক্রটি। অর্থাৎ এ খাতে ১৫-২০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জাল নথি বানিয়ে ২০ বছরে নামে-বেনামে মফিজ হালদার প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। এ ছাড়া টেন্ডার/কোটেশন ছাড়াই মফিজ হালদার শতকোটি টাকার কেনাকাটা দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
‘আকাম’ সিন্ডিকেট একটানা গত ১০ বছরে উৎকোচ গ্রহণ করে পৌরসভার সম্প্রসারিত বা বর্ধিত বহুতল ভবনগুলো করের আওতাভুক্ত করেনি। এভাবে তারা প্রতি বছর ৫-৬ কোটির ক্ষতি করেছে পৌরসভার। সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য নাসির উদ্দিন খান পৌর তহবিলের কোটি টাকা ও লিজ দেওয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ অভিযোগে বাজার পরিদর্শককে শুধু বরখাস্ত করেই কর্তব্য শেষ করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
দুর্নীতির অভিযোগে পৌরসভার কর্মকর্তা (অ্যাসেসর) সুলতান আহমেদকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে একটি স্কুলে পদায়ন করেছে পৌরসভা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আকাম ভূঁইয়ার খপ্পরে পড়েই আজ আমি সাজাপ্রাপ্ত। আমাকে পৌরসভার বিজ্ঞাপন বিল নিয়ে লুটপাট করার কর্মকৌশল শিখিয়ে দিয়েছে এই চক্র। বিজ্ঞাপন করের নথি এনে দিয়েছে আমাকে। দুজনের নির্দেশমতো এ দুর্নীতি-লুটপাট করতে বাধ্য হয়েছি। আকাম ভূঁইয়ার কথা না শুনে আকাম না করলে চাকরিও করতে পারতাম না।’
আত্মীয়স্বজন কাউকে মুখ দেখাতে পারেন না উল্লেখ করে সুলতান বলেন, ‘পৌরসভার লোকজন, বন্ধুবান্ধব দেখলে পালিয়ে বেড়াই। এমনও হয় কখনো মাদ্রাসার মেসে, কখনো মসজিদে রাত কাটাই। আমাকে বিজ্ঞাপনের টাকা লুটপাট করতে বাধ্য করেছে, বাজার করের টাকা নয়-ছয় করার নির্দেশ দিয়েছে। এখন আমি শাস্তির আওতায় অথচ যারা আমাকে দিয়ে বাধ্য করিয়েছে তারা বহাল তবিয়তে পৌরসভার টাকা আত্মসাৎ করেই চলেছে।’
মেয়র এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৌরসভায় অনিয়ম করার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় সুলতানকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।’
পৌরসভার সাধারণ নাগরিকরাও জানেন বর্তমান ও সাবেক দুই মেয়রই ‘আকাম ভূঁইয়া’র হাতের পুতুল। নাম প্রকাশ না করে এক বাসিন্দা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চাঁদপুর পৌরসভার অনেকেই জানে পৌরসভার সম্পত্তি লিজ দেওয়ার নামে মানুষজনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও টিকে আছেন আকাম-মফিজ সিন্ডিকেট।’
কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, মেয়র জুয়েল পৌরসভার সিন্ডিকেট ভাঙা, দুর্নীতি দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। তারা দাবি করেন, আকাম ভূঁইয়াা-মফিজ চক্র মেয়রের নিজস্ব লোকজনকে দলে ভিড়িয়ে সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করেছে।
জানা গেছে, ‘আকাম ভূঁইয়া’ এখনো উৎকোচ নিয়ে সম্প্রসারিত ভবনের পৌর কর নেন না, নতুন হোল্ডিং, মিউটেশন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ, ভবনের নকশা অনুমোদন, যৌথ জরিপ, ট্রেড লাইসেন্স দিতে ঘুষ নেন। দিনে দিনে তার ঘুষের রেট বেড়েছে। তার অবৈধ আয়ের আরও খাতের মধ্যে আছে হাট-বাজার, গরুর বাজারের ইজারার কোটি কোটি টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না দেওয়া, পৌরসভার ভূমি লিজ-দোকান বরাদ্দ ও মিউটেশনে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া। অটোরিকশা, টমটম এসব গাড়ির লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে দৈনিক ১৫০ ও মাসিক ৪ হাজার টাকা করে নেন। আবার অবৈধ যানের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।
অবৈধ আয়ের টাকায় ‘আকাম ভূঁইয়া’ চাঁদপুর পৌরসভায় বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন। শহরের নাজিরপাড়ায় এই বাড়ির নাম রেখেছেন তাজ ভিলা। ওই এলাকায়ই একই আদলে একই মাপে বাড়ি করেছেন মফিজ হালদার।
দুজনের বাড়ি একই রকম হলো কীভাবে এ প্রশ্নে আবুল কালাম ওরফে আকাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই বিষয়টি মফিজকেই জিজ্ঞেস করেন। আমি আমার পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করে ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এ বাড়ি করেছি।’
দুর্নীতি ছাড়াও আবুল কালাম পৌর কর্মচারী সংসদের সভাপতি পদ দখল করে আছেন। মফিজসহ তারা দুজন মিলে লাখ লাখ টাকা বিলিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ফরিদগঞ্জ ফাউন্ডেশন, নাইট রাইডার্স ক্লাব, অফিসার্স ক্লাবের আদলে এলিট প্রশাসনিক/ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘এভারগ্রিন ক্লাব’ ‘ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমি’।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা।’
তবে এ চক্রের দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ পৌর বাসিন্দা কামরুল বলেন, ‘সামনে ইলেকশনে আকাম-মফিজরা নৌকায় ভোট দিলেই হইবো, আমাগো আর লাগবো না।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।