
পৃথিবীর প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে এখন প্রাণের উল্লাস। অথচ সৃষ্টির গোড়াতে পৃথিবী ছিল নিষ্প্রাণ। তাহলে কীভাবে এই গ্রহে প্রাণের যাত্রা শুরু হল? এর চেয়ে বড় কোনো প্রশ্ন আর হতে পারে না। মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়জুড়েই প্রায় সবাই বিশ্বাস করতেন কোনো না কোনো ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা সমগ্র জীব জগৎ সহ আমাদেরকেও সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, এবং অন্য কোনো ব্যাখ্যা ছিল মানুষের কল্পনারও বাইরে।
কিন্তু ‘ঈশ্বর আমাদেরকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন’ এই কথাটা এখন অনেক বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। গত প্রায় একশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল তা খুঁজতে গিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে গেছেন এবং সেই গবেষণা বর্তমানেও চলমান আছে। এমনকি বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবীর যেমন পরিবেশ ছিল কৃত্রিমভাবে প্রায় তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রাণহীন বস্তু থেকে প্রাণ সৃষ্টি করার চেষ্টাও করেছেন।
কিন্তু আজও পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানী সেই কাজে সফল হতে পারেন নি। তবে এক্ষেত্রে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছেন তারা। বর্তমানে যেসব বিজ্ঞানী প্রাণের উৎপত্তির রহস্য সমাধানে গবেষণা করছেন তারা অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী যে তারা সঠিক পথেই রয়েছেন। বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই তাদের এই আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে।
প্রাণের উৎপত্তির প্রকৃত উৎস আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদের অন্বেষণের রয়েছে এক দীর্ঘ গল্প। প্রাণের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচন প্রচেষ্টার সেই গল্প মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ, সংগ্রাম এবং অসাধারণ সৃষ্টিশীলতায় পরিপূর্ণ। যার মধ্য দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের বড় বড় কয়েকটি আবিষ্কারও সম্ভব হয়েছে। বাস্তব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে মানব-মানবীকে যেতে হয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় এবং সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। অনেক বিজ্ঞানীকে শয়তান আখ্যা দিয়ে নিপীড়ন করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো বিজ্ঞানীকে কাজ করতে হয়েছে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী সরকারের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই রোমাঞ্চকর গল্প।
প্রাণ অনেক পুরনো। ডায়নোসর সম্ভবত পৃথিবীর বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে তারা দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে ছিল। কিন্তু প্রাণের উৎপত্তি খুঁজতে আরও সুদূর অতীতে যেতে হবে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের অনুমান, আজ থেকে প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিলো আমাদের এই মহাবিশ্বের। তার ৯৫০ কোটি বছর পরে আজ থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয় আমাদের পৃথিবীর। আর এই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো সম্ভবত আরো ৫০ থেকে ১০০ কোটি বছর পরে, সম্ভবত আজ থেকে ৩৫০-৪০০ কোটি বছর আগে।
আমাদের চেনাজানা সবচেয়ে পুরনো জীবাশ্মের বয়স প্রায় ৩৫০ কোটি বছর, যা কিনা সবচেয়ে পুরনো ডায়নোসরের থেকেও ১৪ গুণ বেশি পুরনো। তবে ভবিষ্যতে এরচেয়ে প্রাচীন জীবাশ্মের সন্ধানও হয়তো মিলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৬ সালের আগস্টে গবেষকরা ৩৭০ কোটি বছর আগেকার এক আণুবীক্ষণিক অনুজীবের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন।
আমরা ধরে নেই প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো পৃথিবীতেই; যা যুক্তিযুক্তও মনে হয়। কেননা এখনও পর্যন্ত আমরা পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাইনি। পৃথিবী সৃষ্টির পর এর বয়সের প্রথম ১০০ কোটি বছরের মধ্যেই হয়তো এতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো। আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয় আমাদের পৃথিবীর। আর প্রাপ্ত জীবাশ্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনটির বয়স প্রায় ৩৭০ কোটি বছর। আমরা যদি প্রাণের বিকাশ মুহুর্তের কাছাকাছি সময়েও যেতে পারি তাহলেও সৃষ্টিলগ্নে কেমন ছিল প্রাণের বৈশিষ্ট্য তার ধারণাও হয়তো পাবো।
১৯ শতক থেকে জীববিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবেই জানেন সব ধরণের জীবিত স্বত্বাই জীবন্ত ‘প্রাণকোষ’ দিয়ে গঠিত; যা মূলত বিভিন্ন রকম এবং আকারে অতি ক্ষুদ্র জীবিত অণুর সমষ্টি। ১৭ শতকে আধুনিক মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর প্রথম প্রাণকোষ আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু কোষ থেকেই প্রাণের উৎপত্তি সেটা বুঝতে আরো প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগে যায়। এখন প্রথম প্রাণের উৎপত্তি বা সৃষ্টির বিষয়টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নিরিখে প্রমাণ করতে গেলে অর্থাৎ শূন্য থেকে একটা কোষ সৃষ্টি করতে হলে সেই ৩৫০ কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর পরিবেশ যেমন ছিলো তেমন প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যা প্রায় অসম্ভব।
একজন মানুষ হয়ত দেখতে একটা শিং মাছ বা টাইরানোসোরাস রেক্স ডায়নোসরের মতো নয়, কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে গভীর পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাবো সব প্রাণীর দেহ প্রায় একই রকম জীবন্ত প্রাণকোষ দিয়ে গঠিত। এমনকি বৃক্ষ-লতা-পাতা, অণুজীব বা মাশরুম ইত্যাদি একই উপাদানে তৈরি। আর পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণীই আণুবীক্ষণিক; যাদের প্রায় সবাই একটি মাত্র প্রাণকোষ দিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া এককোষী প্রাণীদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত, সংখ্যায় বেশি এবং পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়।
২০১৬ সালের এপ্রিলে বিজ্ঞানীরা এক সেমিনারে ‘প্রাণের বংশলতিকার’ সর্বশেষ আধুনিক সংস্করণ উপস্থাপন করেন; যেখানে সব ধরণের জীবিত প্রাণীকে বংশলতিকায় ভিন্ন ভিন্ন পর্বের মাধ্যমে দেখানো হয়। প্রাণীপর্বের প্রায় সব শাখাতেই ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য। ফলে প্রাণীর বংশলতিকা দেখে মনে হয় সব জীবের আদিপিতা হলো ব্যাকটেরিয়া। অন্যভাবে বলা যায়, প্রতিটি জীবিত প্রাণ এমনকি আমি এবং আপনি নিজেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাকটেরিয়া জাতীয় জীবের বংশধর।
বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে আমরা এখন প্রাণের উৎস কোথায় এই প্রশ্নের আরও যথাযথ উত্তর নিশ্চিত করতে পারবো হয়তো। কিন্তু কীভাবে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হল তা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করতে গেলে তথা কৃত্রিমভাবে একটা প্রাণকোষ তৈরি করতে আমাদের প্রয়োজন হবে ৩৫০-৪০০ কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর নানা প্রাকৃতিক উপাদান এবং সে সময়কার প্রাথমিক প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশটিও হুবহু সৃষ্টি করতে হবে গবেষণাগারে। তাহলে একবার ভাবুনতো প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল কীভাবে তা প্রমাণ করা কতটা দুরূহ ব্যাপার?
প্রাথমিক পরীক্ষণঃ বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রাণের অলৌকিকতার ধারণার অবসান
প্রায় সমগ্র মানবেতিহাসজুড়েই পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ কীভাবে শুরু হয়েছিল, এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা কখনো বিবেচিত হয়নি। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে- উত্তর তো আগে থেকেই ধর্মতত্ত্বের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট ছিলো। এমনকি ১৮০০ শতকের আগে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীও ‘প্রাণবাদে’ (Vitalism) বিশ্বাস করতেন।
প্রাণবাদ মতে ধারণা করা হত, প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে রয়েছে এমন কোনো ‘অলৌকিক’ উপাদান, যা তাদেরকে জড় বস্তু থেকে আলাদা করেছে, যা হয়তো সৃষ্টিকর্তার দান। এই মতবাদ অনেক সময় ধর্মতত্ত্বের সঙ্গেও গাঁটছড়া বাধতো। ধর্মতত্ত্ব মতে, প্রথম মানবকে প্রাণ দান করতে ঈশ্বর তার মুখে ফুঁ দিয়েছিলেন। আর চির অমর আত্মা প্রাণীর দেহে অলৌকিকভাবেই বিরাজিত থাকে।
এরপর ১৮ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু বস্তুর সন্ধান পেলেন যেগুলোকে মনে হচ্ছিল প্রাণের জন্য অনন্য উপাদান। সেইসব উপাদানের মধ্যে ইউরিয়া অন্যতম; যা পাওয়া গিয়েছিল মূত্রের মধ্যে এবং তা ১৭৯৯ সালে প্রথম শনাক্ত করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা তখন পর্যন্ত জানতেন, শুধু জীবিত প্রাণীর দেহেই এই ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য উৎপন্ন হতে পারে। ফলে ধারণা করা হয় ইউরিয়া এবং ওইসব বস্তুর মধ্যেই হয়তো প্রাণের অলৌকিক শক্তি সঞ্চিত আছে। যে কারণে সেই বস্তুগুলোকেও মনে করা হতো অন্যদের তুলনায় বিশেষ কিছু বা অতিপ্রাকৃত, যেগুলো প্রাণীদেহ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। তখন পর্যন্ত প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানের যা কিছু অর্জন ছিল তা প্রাণের অলৌকিকতার ধারণার সাথেই বেশি মানানসই।
কিন্তু ১৮২৮ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ বোহলার একটি সাধারণ রাসায়নিক দ্রব্য- অ্যামোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। এই পদ্ধতির সাথে জীবিত প্রাণীর কোনো যোগসূত্র ছিল না। অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এলেন ফ্রেডরিখ বোহলারের পথ অনুসরণ করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, প্রাণের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এমন সাধারণ নিরীহ রাসায়নিক দ্রব্য থেকেও প্রাণের উপাদান তৈরি করা সম্ভব। এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রাণ বিকাশে অলৌকিকতার ধারণার অবসান ঘটে। কারণ এখন প্রমাণিত হয়ে গেল প্রাণের উপাদানগুলো একেবারেই বস্তুজগতীয় জিনিস। এর উৎস অবস্তুগত আত্মা বা অতিপ্রাকৃত কোনো স্বত্বা নয়। প্রাণীদেহের বাইরের চারপাশের বস্তুজগতেও প্রাণের উপাদান রয়েছে। এবং মানুষ সহ সকল প্রাণী সেই বস্তুজগত থেকেই আবির্ভূত হয়েছে।
কিন্তু মানুষ তার মনের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাণ বিকাশের ঐশ্বরিক ধারণা এত সহজে দূর করতে পারে না। অনেকেই বলতে থাকেন, রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে প্রাণ সৃষ্টির ধারণার মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই বরং তাদের কাছে মনে হয় তা প্রাণকে এর ম্যাজিক থেকে বঞ্চিত করেছে, আর আমরা যেন যন্ত্র। এছাড়া তা ধর্মতত্ত্বের সাথেও সাংঘর্ষিক।
এমনকি বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত প্রাণের অলৌকিকত্বকে রক্ষা করতে রীতিমত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। উদাহরণত ১৯১৩ সালের শেষ নাগাদ ব্রিটিশ জৈবরসায়নবিদ বেঞ্জামিন মূর ‘জৈব শক্তি’ (Biotic Energy) নামে একটা তত্ত্বের (হাইপোথিসিস) অবতারণা করেন, যেটা আসলে নতুন মোড়কে প্রাণের অলৌকিকতা প্রচারের প্রবল চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। বেঞ্জামিন মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্বে আবেগের প্রাধান্যও যথেষ্ট লক্ষ্যণীয় ছিল। বর্তমানে মূরের ‘জৈব শক্তি’ তত্ত্ব অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন, এমন অনেক সায়েন্স ফিকশন আছে যেগুলোতে দেখানো হয় একজন মানুষের জীবনী শক্তি বাড়ানো সম্ভব, অথবা জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেওয়া সম্ভব। উদাহরণত, ‘ডক্টর হু’ এর একটা চরিত্র টাইম লর্ডস এর কথা বলা যায়; যিনি পুনর্জন্ম শক্তি (regeneration energy) ব্যবহার করে বারবার জন্ম লাভ করছেন। এমনকি যেখানে দেখানো হয়, তার জীবনী শক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর তা বাড়ানোও হচ্ছে; যা ফের শীর্ষেও পৌঁছে যাচ্ছে। এই বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনীকে অভিনব মনে হলেও বাস্তবে এটা সেই পুরনো ধারণারই নতুন ভাবে উপস্থাপন মাত্র।
১৮২৮ সালের ওই আবিষ্কারের পর থেকেই প্রথম প্রাণের বিকাশ কীভাবে ঘটেছিলে তার বস্তুগত ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তারা কোনো উপায়ান্তর খুঁজে পেলেন না। বিজ্ঞানীরা হয়তো তাদের প্রাণের অলৌকিকত্বের ধারণা থেকে সহজেই বের হতে পারছিলেন না।
এই ক্ষেত্রে বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী ধারণাটি দিলেন প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন ব্যাখ্যা করে দেখালেন কীভাবে এই বিপুলা পৃথিবীর ততোধিক বিপুল পরিমাণ বিচিত্র প্রাণী জগতের উদ্ভব হয়েছে হয়তো একটা সাধারণ এককোষের আদিপিতা-মাতা থেকে। এই প্রথম কেউ বললেন কোনও ঈশ্বর প্রতিটি জীবকে আলাদা আলাদা করে সৃষ্টি করেননি। প্রাণিজগৎ সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর প্রাথমিক জৈব-রাসায়নিক উপাদান থেকে উৎপন্ন আদি প্রাণ থেকে। প্রাণী জগতের সবাই সেই আদি এককোষী প্রাণীর বংশধর।
চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব চারিদিকে বিতর্কের হৈচৈ ফেলে দিলো এবং বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণেই তা বিতর্কিত হয়। বিশেষত উগ্র ধর্মান্ধ খ্রিস্টানদের দিক থেকে ডারউইন এবং তার বিবর্তনবাদ ভয়ানক হিংস্র আক্রমণের শিকার হলো। অথচ বিবর্তনবাদের কোথাও বলা হয়নি কীভাবে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হয়।
ডারউইন জানতেন প্রশ্নটা অতীব গুরুতর, কিন্তু তিনি যথাসম্ভব সতর্কভাবে শুরু করেছিলেন তবুও খ্রিস্টানদের চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব হলো না। পরে অবশ্য ১৮৭১ সালে লেখা এক চিঠিতে আবেগমথিত ভাষায় ডারউইন বলতে চেয়েছিলেন, প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে এই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর তিনি জানতেন। প্রাণের উৎপত্তি একটা ছোট্ট উষ্ণ পুকুরে। যেখানে ছিলো পর্যাপ্ত অ্যামোনিয়া এবং ফসফরাস লবণ সেই সাথে আলো, উত্তাপ, বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিকভাবে স্বয়ং উদ্ভূত প্রোটিনের (আমিষের) জটিলযৌগ। যা আরও জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়ে প্রাণে পরিণত হয়।
ভিন্নভাবে বলা যেতে পারে, কী ঘটতে পারে যখন দীর্ঘদিন সাধারণ জৈব উপাদান পূর্ণ একটা ছোট জলাভূমি সূর্যালোকে ছিল? কিছু জৈব উপাদান হয়ত মিলেমিশে প্রাণের সদৃশ কোনো বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল আমিষ এবং আমিষ আরও জটিল কোনো বস্তুতে পরিণত হচ্ছিল। হতে পারে তা অস্পষ্ট ধারণামাত্র। কিন্তু ভবিষ্যতে এই অস্পষ্ট ধারণার উপর ভিত্তি করেই প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রথম তত্ত্বটি (হাইপোথিসিস) দাঁড়িয়ে যায়।
এই তত্ত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত একটি স্থানে। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন ঈশ্বরবিহীন প্রাণের উৎপত্তির মত সাহসী চিন্তা বিকশিত হয়েছে একটা গণতান্ত্রিক দেশে, যেখানে মানুষের বাক স্বাধীনতা সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। তা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? কিন্তু না, বাস্তব ঘটনা হলো অলৌকিকতাকে পাশ কাটিয়ে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে প্রথম তত্ত্বটি (হাইপোথিসিস) বিকশিত হয় নিষ্ঠুরভাবে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। যেখানে মুক্তচিন্তা ছিলো নিষিদ্ধ। তখন স্ট্যালিনের রাশিয়াতে সবকিছু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। মানুষের চিন্তা, এমনকি জীববিজ্ঞানের মতো পঠন পাঠনের বিষয়ও, যা কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, সেটাও ছিলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে!
সবথেকে আলোচিত ঘটনা ছিল স্ট্যালিন জীনতত্ত্বের প্রচলিত পঠন পাঠনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক জীববিজ্ঞানী এবং কৃষিবিদ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কো জোসেফ মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বাতিল করে বংশপরম্পরার উপর জোর দেন। তিনি মনে করতেন প্রাণী তার জীবনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করে যায়। লিসেঙ্কো দেখালেন উন্নতজাতের গম থেকে উন্নত এবং অধিকফলনশীল গম কীভাবে উৎপাদন করা যায়। স্ট্যালিন কমিউনিস্ট ভাবধারার সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ ট্রোফিম ডেনিশোভিচ লিসেঙ্কোর মতবাদকে চাপিয়ে দেন। জীনতত্ত্ব বা বংশগতিবিদ্যা নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন তাদেরকে জনসাধারণের কাছে লিসেঙ্কোর মতবাদকে সমর্থন এবং প্রচার করতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় তাদের স্থান হতো লেবার ক্যাম্পে।
স্ট্যালিনের দমন-নিপীড়নের শাসনের মধ্যেই আলেক্সান্ডার ওপারিন চালিয়ে যেতে লাগলেন তার জৈবরাসায়নিক গবেষণা। ওপারিন নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কারণ তার কমিউনিজমের প্রতি সন্দেহাতীত আনুগত্য ছিলো। তবে বংশগতির ক্ষেত্রে ওপারিন লিসেঙ্কোর মতবাদকে সমর্থন দেন এবং দেশের সেবা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘অর্ডার অফ লেনিন’ নামের সর্বোচ্চ পুরষ্কারে ভূষিত হন।
১৯২৪ সালে আলেক্সান্ডার ওপারিন প্রকাশ করলেন ‘দ্য অরিজিন অফ লাইফ’ নামে তার অমর বইটি। এতে ওপারিন প্রাণের উৎসের সন্ধানে যে প্রস্তাবনা হাজির করেন সেটা ডারউইনের বিবর্তনবাদের ‘একটি ছোট্ট উষ্ণ পুকুরে প্রাণের উৎপত্তি’ ধারণার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। ওপারিন কল্পনা করেছিলেন কেমন ছিল সদ্য গঠিত পৃথিবীর চেহারা। পৃথিবীর উপরিভাগ ছিল কল্পনাতীত গরম। মহাকাশ থেকে খসে পড়ছিলো জ্বলন্ত পাথরের খণ্ড। পৃথিবী তখন ছিল বিভিন্ন ধরণের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত অর্ধগলিত পাথরের বিশৃঙ্খল স্তুপ। পদার্থগুলোর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশী।
ধীরে ধীরে উত্তপ্ত পৃথিবী ঠাণ্ডা হলো, জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে প্রথম বৃষ্টি নামল পৃথিবীর বুকে, তরল পানিতে তলিয়ে গেল চরাচর। বৃষ্টি পড়ার আগেও সমুদ্র ছিল কিন্তু সেটা ছিলো প্রচণ্ড উত্তাপে গলিত কার্বননির্ভর ঘন তরল। এমতাবস্থায় দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে।
প্রথমত, বিভিন্ন রাসায়নিক নিজেদের মাঝে বিক্রিয়া করে অসংখ্য নতুন জটিল যৌগ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কিছু যৌগ আরও জটিল যৌগে পরিণত হবে। আলেক্সান্ডার ওপারিন ধারণা করেন, প্রাণের দুটো মৌলিক উপাদান চিনি (Sugar) এবং অ্যামাইনো অ্যাসিড আদিম পৃথিবীর সেই পানি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নতুন আণুবীক্ষণিক অণুজীবের কাঠামো তৈরি করতে শুরু করে। কিছু অণুজীবের জৈবরাসায়নিক উপাদান পানিতে দ্রবীভূত হয় না। যেমন তেল পানির উপর আস্তরণ সৃষ্টি করে ভেসে থাকে। কিন্তু যখন কিছু জৈবরাসায়নিক উপাদান পানির সাথে মিশে যায় তখন গোলাকার ‘কোয়াসারভেটিভ’ নামক বস্তুর রূপ ধারণ করে যেগুলো আয়তনে .০১ সেমি বা (.০০৪) ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। যেগুলো জীবন্ত কোষের মতো বেড়ে ওঠে। অবয়ব পরিবর্তন করে এমনকি মাঝেমধ্যে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তারা চারপাশের পানির রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। ফলে প্রাণসদৃশ রাসায়নিক উপাদান তাদের মাঝে সংগঠিত হতে থাকে। ওপারিন প্রস্তাব করেন এই কোয়াসারভেটিভ হলো আধুনিক জীবিত কোষের পূর্বপুরুষ।
এর পাঁচ বছর পরে ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন বারডন স্যান্ডারসন হালডেন একই মতবাদ নিয়ে র্যাশনালিস্ট অ্যানুয়াল জার্নালে একটা ছোট প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। হালডেন ইতিমধ্যেই বিবর্তনবাদে প্রভূত অবদান রেখে ফেলেছেন। তিনি ডারউইনের মতবাদকে বিকাশমান জীনতত্ত্বের আলোকে আরও সংহত করেন।
হালডেন ছিলেন তার জীবনের থেকেও বড় এক চরিত্র। একবার ডিকম্প্রেসন চেম্বারের কিছু পরীক্ষা চালাতে গিয়ে তার কানের পর্দায় ছিদ্র হয়ে যায়। কিন্তু পরে তিনি রম্য করে লিখেছিলেন, ‘কানের পর্দা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই সুস্থ হয়ে যায়। যদি পর্দায় ছিদ্র থেকেই যায় এবং তারফলে কেউ যদি বধির হয়ে যায় তাহলে সে কারো প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেই কান দিয়ে বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে পারবে, যেটা হবে একটা সামাজিক অর্জন!’
ওপারিনের মত হালডেনও বললেন, সমুদ্র প্রাথমিক অবস্থা থেকে স্থিতিশীল গরম ঘন তরলে পরিণত হলে কীভাবে সেখানকার পানিতে রাসায়নিক অনুজীব নিজে থেকেই সৃষ্টি হতে পারে। পৃথিবীর এরকম পরিবেশে প্রথম জন্ম নেয় প্রাণের অণুজীব অথবা অর্ধজীবন্ত বস্তু আর এরপরের স্তরে সৃষ্টি হয় স্বচ্ছ তেলতেলে জেলির মত থকথকে প্রাণবস্তু।
প্রাণের প্রথম বিকাশ ঘটেছে পুরোপুরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এবং এতে কোনো ঈশ্বরের হাত নেই বা এতে কোনো আগাম প্রাণশক্তিরও ভুমিকা ছিলো না, ওপারিন এবং হালডেনের এই ধারণাটিও ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতোই বিপ্লবী ছিলো। এই তত্ত্বও ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিমূলে চরম কুঠারাঘাত করলো।
ঈশ্বরবিহীন সৃষ্টিতত্ত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনো সমস্যা ছিলো না। কারণ কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত রাষ্ট্রীয়ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সেজন্যই কমিউনিস্ট নেতারা প্রাণের উৎপত্তি গবেষণায় এই বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়। হালডেন নিজেও ছিলেন একজন নাস্তিক এবং কমিউনিজমের কড়া সমর্থকও ছিলেন তিনি।
সে সময়ে সাধারণত বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট চিন্তা ধারার লোকজন এই ঈশ্বরবিহীন প্রাণ সৃষ্টির ধারণা মেনে নিত। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নে এই ধারণা বেশ সাদরেই গৃহীত হল। আর ইউরোপ-আমেরিকায়ও যারা এই তত্ত্ব মেনে নিয়েছিলো তারাও ছিলো বামপন্থী বা কমিউনিস্ট ভাবধারার লোকজন।
প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে পৃথীবির শুরুর দিকের জৈবরাসায়নিক ঘন-তরল স্যুপের মধ্যে- এই ধারণাটি ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব বলে ব্যাপক পরিচিত পেয়ে গেল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হলেও তত্ত্বটির একটি সমস্যা ছিল। ওপারিন-হালডেন তত্ত্বকেও নির্ভুল হিসেবে গণ্য করার জন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণালব্ধ প্রমাণ ছিলো না। পঁচিশ বছর পার হয়ে গেলেও তত্ত্বটির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দাঁড় করানো যায়নি।
সময়ের সাথে প্রাণের উৎপত্তির রহস্য সমাধানের গবেষণায় যোগ দেন ১৯৩৪ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান রসায়নবিদ হ্যারল্ড উরে। তিনি পারমাণবিক বোমা বানানোর দলেও কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ম্যানহাটন প্রকল্পে পারমাণবিক বোমার অতি প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম-২৩৫ সংগ্রহ করতেন তিনি। যুদ্ধের পরে তিনি নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকে সাধারণ জনগণের সমাজের নিয়ন্ত্রণে দেয়ার জন্য আন্দোলন করেন। প্রফেসর উরে ধারণা করেছিলেন, আমাদের পৃথিবী আদিম অবস্থায় সম্ভবত অ্যামোনিয়া, মিথেন এবং হাইড্রোজেনের মিশেলে পিণ্ডাকৃতির ছিল। এই মিশ্রণকে যদি বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ এবং পানির সংস্পর্শে আনা যায় তাহলে অ্যামাইনো অ্যাসিড উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা সর্বজনবিদিত যে, অ্যামাইনো অ্যাসিড হলো প্রাণের প্রথম উপাদান।
উরে এই সময়ে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশ এবং মহাকাশের ভাসমান বস্তুকণার রসায়ন নিয়ে আগ্রহী হন। বিশেষকরে দেখতে চেয়েছিলেন সৌরজগৎ যখন সবে সৃষ্টি হলো তখন ঠিক কী ঘটছিল। একদিন তিনি ক্লাসে বললেন, সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবীর বায়ুস্তরে সম্ভবত অক্সিজেনের অস্তিত্ব ছিল না। অক্সিজেন না থাকার কারণেই ওপারিন এবং হালডেনের তত্ত্বে প্রস্তাবিত আদিম জৈবরাসায়নিক ঘন তরলটি তৈরি হতে পেরেছিলো। কেননা অক্সিজেন থাকলে তার সংস্পর্শে এসে ভঙ্গুর রাসায়নিকগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেত।
প্রফেসর হ্যারল্ড উরের ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন পিএইচডি’র গবেষণারত এক ছাত্র- স্ট্যানলি মিলার। মিলার প্রফেসর উরেকে প্রস্তাব দেন পরীক্ষা করে দেখার জন্য আসলেই কেমন ছিল সেদিনের পৃথিবীর পরিবেশ। উরে নিজের ধারণার উপর কিছুটা সন্দেহ পোষণ করলেও মিলার অক্সিজেনবিহীন পৃথিবীর চিন্তায় তাকে আরো মনোনিবেশ করালেন। তাদের মাঝে বিস্তর আলোচনার পরে ১৯৫২ সালে প্রফেসর উরে এবং তার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্ট্যানলি লয়েড মিলার যৌথভাবে প্রথমবারের মত প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল তার খোঁজে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ শিরোনামে একটি পরীক্ষা শুরু করলেন।
পরীক্ষার যন্ত্রপাতি খুব সাধারণ ছিল। মিলার পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নের চারটি রাসায়নিক উপাদান- গরম পানি, হাইড্রোজেন গ্যাস, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন, চারটি কাঁচের জারে ভরে তাদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে দিলেন। কাঁচের জারের ভেতর মিলার বারবার তড়িৎপ্রবাহ দিতে লাগলেন যাতে বজ্রপাত ঘটে। আদিকালে পৃথিবীতে বজ্রপাতের ঘটনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক। এই পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সাধারণ পরিবেশেই প্রচুর পরিমাণ জৈব অনু উৎপাদন সম্ভব। মিলার দেখতে পেলেন প্রথমদিনেই কাঁচের জারের ভেতরের দ্রবণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গোলাপী আভা ধারন করেছে এবং সপ্তাহ শেষে ঘন তরল দ্রবণটি গাঢ় লাল হয়ে গেল। পরিষ্কার বোঝা গেল জারে জৈব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।
মিলার পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে মিশ্রণটিতে গ্লাইসিন এবং আলানাইন নামে দুইটা অ্যামাইনো অ্যাসিড পেলেন। অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলো হল প্রাণের প্রাথমিক উপাদান। অ্যামাইনো অ্যাসিড প্রোটিন (আমিষ) সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অ্যামাইনো অ্যাসিড আমাদের শরীরের শারীরবৃত্তিক এবং জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মিলার গবেষণাগারে জন্ম দিলেন প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে প্রাণ আরও জটিল, আমরা যতটা ভাবি তার থেকেও বেশি।
এই গবেষণার ফলাফল বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হলো ১৯৫৩ সালে। প্রাণের উৎপত্তির রহস্য সমাধানের অভিযানে ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ এক স্মরণীয় ঘটনা। প্রফেসর উরে এই গবেষণার সমুদয় কৃতিত্ব মিলারকে দান করেন এবং আর্টিকেল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। তবুও এই পরীক্ষা ‘উরে-মিলার এক্সপেরিমেন্ট’ হিসেবেই ইতিহাসে উচ্চারিত হয়।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানের গবেষক জন সাদারল্যান্ড বলেন, ‘উরে-মিলার পরীক্ষার গুরুত্ব এখানেই যে, এখন প্রমাণিত হল আপনি সাধারণ পরিবেশেও কোনো প্রাণী দেহের সংস্পর্শ ছাড়াই প্রচুর অণুজীব সৃষ্টি করতে পারবেন’।
কিন্তু পরবর্তীতে আরও গবেষণায় পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণও ছিল, এমন আবিষ্কারের কারণে আগের গবেষণা ভুল প্রমাণিত হয়। কিন্তু সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। জন সাদারল্যান্ড বলেন, ‘উরে-মিলার পরীক্ষা ছিল দৃষ্টান্তমূলক, তারা মানুষের কল্পনা জাগাতে পেরেছিলেন এবং এরপর প্রাণের উৎস সন্ধানের বিষয়টি নিয়ে লোকে ব্যাপকভাবে আলাপ-আলোচনা শুরু করে’।
মিলারের পরীক্ষার প্রভাবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এলেন ভিন্ন ভিন্ন মৌল থেকে অনুজীব সৃষ্টির গবেষণা করে প্রাণের উৎসের সন্ধানে। প্রাণের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের হাতছানি মনে হল সন্নিকটে। তবে প্রাণ আরও জটিল, আমরা যতটা ভাবি তার থেকেও অনেক বেশি।
এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে প্রাণ এত জটিল যে, তা আমারা চিন্তা করতেও সক্ষম নই। জীবন্ত কোষ শুধুমাত্র কিছু রসায়নের জটিল যৌগ নয় বরং এক সূক্ষ্ম শিল্পিত যন্ত্রবিশেষ। যা হঠাৎ করেই পারস্পরিক সম্পর্কহীন অনেক বস্তু থেকে সৃষ্টি হয়ে বিজ্ঞানীদের সামনে ধারণার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়।
(বিবিসি আর্থ-এ প্রকাশিত মাইকেল মার্শাল এর লেখা ’The secret of how life on earth began’ অবলম্বনে এই লেখা)
পরের পর্বে পড়ুন- ডিএনএ আবিষ্কারে যেভাবে পাল্টে গেল বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগত
আরও পড়ুন...
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (২য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (৩য় পর্ব)
প্রাণের উৎসের সন্ধানে সমুদ্রের তলদেশে অভিযান (৪র্থ পর্ব)
পূর্ণাঙ্গ প্রাণকোষ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম (৫ম পর্ব)
পৃথিবীর উপরে কী কী রয়েছে, তা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু ভূভাগের ভেতরে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত রয়েছে যে বিরাট জগত, তার কতটুকুই বা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন! নতুন এক তথ্য চমকে দিয়েছে সবাইকে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর উপরিভাগ যে অভিমুখে ঘুরছে, তার কেন্দ্র ঘুরছে ঠিক তার বিপরীত অভিমুখে। শুধু তাই নয়, কিছু দিন আগেই পৃথিবীর কেন্দ্র ঘোরা থামিয়ে দিয়েছিল। তার পর থেকেই এটি ঘুরছে উল্টো মুখে। কী হতে পারে এর ফলে? ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কি প্রাণীজগত? প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলেই।
সম্প্রতি নেচার জিয়োসায়েন্স একটি গবেষণার মাধ্যমে এই বিষয়টি তুলে ধরেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর কেন্দ্র এক দিকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল। তার পরেই হঠাৎ বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। এবং ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই। গবেষকদের দাবি, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল এখন ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। আর এটিই চিন্তায় ফেলেছে অনেককে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে পৃথিবীর কেন্দ্র হঠাৎ থমকে গিয়েছিল। তার পরে বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করে। সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, চিনের পিকিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই বিষয়টি জানতে পেরেছেন। এবং এটিও জানা গিয়েছে, মোটামুটি প্রতি ৩৫ বছর পরপর পৃথিবীর কেন্দ্রভাগ নিজের ঘোরার দিক পরিবর্তন করতে পারে। তবে কখনও কখনও ৭০ বছরও চলে এটি।
১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে প্রথমবার পৃথিবীর কেন্দ্রের ঘূর্ণনের কথা টের পান বিজ্ঞানীরা। তাদের অনুমান, আবার ২০৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রস্থল নিজের ঘোরার অভিমুখ বদলাতে পারে। পিকিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হওয়া সমস্ত ভূমিকম্পের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছেন, ঘূর্ণনের এই পরিবর্তন সম্ভবত দিনের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত। পৃথিবী নিজের অক্ষে যে ভাবে সারা ক্ষণ ঘুরে চলেছে, তার উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে কেন্দ্রের ঘূর্ণন।
কিন্তু এটি কি বড় কোনও বিপদ ডেকে আনতে পারে? এই ঘটনার ফলে প্রাণীকূলের অস্তিত্ব কি বিপন্ন হতে পারে? গবেষকরা অবশ্য জানিয়েছেন, তেমন কোনও আশঙ্কা নেই। পৃথিবীর উপরিতলে এই ঘূর্ণনের প্রভাব টেরও পাওয়া যাবে না। ফলে এই মুহূর্তে প্রাণীকূলের কোনও ভয় নেই বলে আশ্বাস দিয়েছেন তারা।
৫০ হাজার বছরে একবার পৃথিবী ও সূর্যের কাছে আসে এমন একটি ধূমকেতু আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে খালি চোখেই ধূমকেতুটি দেখা যাবে।
আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ধূমকেতুটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি দূরত্বে থাকবে। তখন বাইনোকুলারের সাহায্যে বা খালি চোখেই রাতের আকাশে এটি দেখা যাবে, যদি শহরাঞ্চলের বৈদ্যুতিক আলো বা চাঁদের আলো বেশি উজ্জ্বল না হয়।
তবে ওই সময়ে পূর্ণিমার কারণে ধূমকেতুটি দেখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে ২১ ও ২২ জানুয়ারি এটিকে দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্যারিস অবজারভেটরির জ্যোতির্পদার্থবিদ নিকোলাস বিভার।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক জুইকি ট্রানজিয়েন্ট ফ্যাসিলিটির নাম অনুসারে ধূমকেতুটির নাম রাখা হয়েছে সি/২০২২ ই৩ (জেডটিএফ)। গত বছরের মার্চে বৃহস্পতি গ্রহকে অতিক্রম করার সময় এটিকে প্রথম লক্ষ্য করে জুইকি ট্রানজিয়েন্ট ফ্যাসিলিটি।
বিভার জানান, ধূমকেতুটি বরফ ও ধুলাবালির সমন্বয়ে গঠিত এবং এটি এক ধরণের সবুজাভ আলো বিকিরণ করে। ধূমকেতুটির ব্যাস মাত্র এক কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দেখতে পাওয়া সর্বশেষ দুইটি ধূমকেতুর চেয়ে আকারে অনেকটাই ছোট এটি।
এর আগে ২০২০ সালের মার্চে নিওওয়াইজ ও ১৯৯৭ সালে হেল-বপ নামের ধূমকেতু পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা গিয়েছিল। হেল-বপের ব্যাস ছিল প্রায় ৬০ কিলোমিটার। তবে আকারে ছোট হলেও এই ধূমকেতুটি পৃথিবীর অনেক কাছে আসবে বলে সেটিকে খালি চোখে দেখতে পাওয়া যাবে।
এই ধূমকেতুটি উর্ট মেঘ (Oort cloud) থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়, যেটি পৃথিবীর সৌরজগতের চারপাশে অবস্থিত রহস্যময় বরফ দিয়ে গঠিত একটি বিশাল গোলক।
এর আগে এই ধূমকেতুটি সর্বশেষ পৃথিবীর কাছে এসেছিলো প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে, আপার প্যালিওলিথিক তথা প্রাচীন প্রস্তর যুগের তৃতীয় এবং শেষভাগে (৫০০০০-১২০০০ বছর আগে)।
স্ত্রী সাপের ভগাঙ্কুর বা ক্লিটোরিস রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এক গবেষণায় বিস্তারিত জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, পূর্ববর্তী গবেষণায় সাপের এ অঙ্গকে ঘ্রাণ গ্রন্থি বা পুরুষ লিঙ্গের (পেনিস) অনুন্নত সংস্করণ হিসাবে ধারণা করা করেছিল।
প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, স্ত্রী সাপের দুটি আলাদা ভগাঙ্কুর রয়েছে- হেমিক্লিটোরিস যা টিস্যু দ্বারা পৃথক এবং লেজের নীচের অংশে ত্বক দ্বারা লুকানো।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ত্রী সাপের যৌনাঙ্গ তাদের সমকক্ষ পুরুষের তুলনায় উপেক্ষিত হয়ে আসছিল। যার ফলে তাদের যৌন প্রজনন সম্পর্কে আমাদের বোঝার সীমাবদ্ধ তৈরি হয়।
পুরুষ সাপ এবং টিকটিকির হেমিপেনিস (একাধিক পুরুষাঙ্গ) আছে বলে জানা যায়। তাদের এক জোড়া লিঙ্গ প্রজননের সময় শরীরের বাইরে চলে আসে। অনেক প্রজাতির মধ্যে, হেমিপেনিস কাঁটা বা হুকের মধ্যে আবৃত থাকে।
গবেষণার প্রধান লেখক এবং অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্র মেগান ফলওয়েল বলেন, স্ত্রী যৌনাঙ্গ নিয়ে ট্যাবু থাকার কারণ সাপের ভগাঙ্কুর নিয়ে আগে তেমন ভাবনা তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, এটি খুঁজে বের করা সহজ জিনিস নয়। কারণ এ ক্লিটোরিস অত্যন্ত ক্ষুদ্র। প্রথমে একটি ডেথ অ্যাডারে (বিষাক্ত প্রজাতির সাপ) ভগাঙ্কুর পাই। যেখানে অঙ্গটি ‘হৃদয়ের মতো’ একটি ত্রিভুজ আকারের ছিল। আমার সৌভাগ্য যে ওই সাপের ক্লিটোরিস তুলনায় বড় ছিল।
সমীক্ষায় বলা হয়, মিলনের সময় সাপের যৌন অঙ্গগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ কার্যকারিতা রয়েছে।
সাপের আচরণ সম্পর্কে আরো গবেষণা প্রয়োজন জানিয়ে ফলওয়েল বলেন, যোনি শিথিলকরণ এবং তৈলাক্তকরণের জন্য এক ধরনের উদ্দীপনা সংকেত তৈরি হয় যা নারী সাপকে সহবাসে সহায়তা করে। ফলে সঙ্গমের সময় পুরুষ সাপের হেমিপেনিসের হুক এবং কাঁটার ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়। .
তিনি জানান, এ সময়ে ডিম্বাশয়কে ডিম্ব স্ফুটনের জন্য এবং ডিম্বনালীকে সম্ভাব্যভাবে শুক্রাণু সঞ্চয়ের জন্য প্রস্তুত করার সংকেত তৈরি হয়।
গবেষকরা নয় প্রজাতির ১০টি সাপকে ব্যবচ্ছেদ করেন।
গবেষণার সহ-লেখক এবং লো ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউরোইকোলজিতে পোস্টডক্টরাল গবেষক ডা. জেনা ক্রো-রিডেল বলেন, কিছু ভগাঙ্কুর বেশ পেশীবহুল এবং বড় হয়। যার আকার এক মিলিমিটারের কম থেকে সাত মিলিমিটার পর্যন্ত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে হেমিক্লিটোরাস ‘ইরেক্টাইল টিস্যু’ দ্বারা গঠিত যা স্নায়ুর সঙ্গে যুক্ত এবং এটি আনন্দদায়ক হতে পারে বলেও অনুমান গবেষকদের।
খবর: দ্য গার্ডিয়ান।
তাত্ত্বিক মহা সমন্বয়: আদি প্রাণকোষের সমস্ত মৌলিক উপাদান একসাথেই সৃষ্টি হয়েছিল
বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের সমর্থনে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বিজ্ঞানীদল তাদের নিজস্ব চিন্তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন, কিন্তু বেশিরভাগ যুক্তিই ছিল আকাশকুসুম অনুমানের অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। যদিও এই প্রক্রিয়া বেশ কাজে দিয়েছিল, কিন্তু প্রাণ বিকাশের প্রতিটি সম্ভাবনাময় ধারণা বা অনুমান শেষ পর্যন্ত নতুন কোনো বড় প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। যে কারণে কিছু গবেষক এবার প্রাণ বিকাশের গবেষণায় আরো সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে এতদিনের অমীমাংসীত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করলেন।
প্রাণের উৎপত্তির উৎস সন্ধানে এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার প্রয়াস কয়েক বছর আগে বেগবান হয়। সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির বিজ্ঞানীরা ইতিপূর্বের বহুল চর্চিত ‘আরএনএ প্রথম নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করেছিল’ মতবাদের উপর কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা আবার একটি বড় ধরণের সমস্যার মুখে পড়ে গেলেন। পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে ঠিক কীভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা তাদের মতবাদের পক্ষে প্রাণের মৌলিক উপাদান আরএনএ’র গাঠনিক উপাদান নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন। যে কারণে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ মোটেও আরএনএ থেকে হয় নি এমন ধারণাই করতে লাগলেন লোকে।
ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক জন ডেভিড সুদারল্যান্ড ১৯৮০ সাল থেকে এই সমস্যা অথবা সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জন ডেভিড সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আপনি যদি প্রমাণ করে দেখাতে পারেন, আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম তাহলে সেটা হবে অসাধারণ এক কাজ।‘ কিছুদিন পরেই সুদারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে গবেষণার চাকরি পান। বেশিরভাগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানই গবেষকদলকে নতুন উদ্ভাবনে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখে, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ‘মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি’ কখনো কাজের জন্য চাপ দেয় না। সুতরাং সুদারল্যান্ড কৃত্রিমভাবে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করা এত দুরূহ কেন সেটা নিয়েই গবেষণা শুরু করলেন এবং বছরের পর বছর পার করে দিলেন। এসময় তিনি ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে লাগলেন।
এই দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি সম্পুর্ন নতুন ধারণা প্রস্তাব করলেন। তিনি বললেন, আদি প্রাণকোষের সমস্ত মৌলিক উপাদান একসাথেই সৃষ্টি হয়েছিল।
জন সুদারল্যান্ড বলেন, ‘ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট ‘আরএনএ’র কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান ঠিকঠাক কাজ করে না।‘ প্রতিটি আরএনএ নিউক্লিওটাইড- শর্করা, একটি ভিত্তিমূল এবং ফসফেট দিয়ে তৈরি। কিন্তু গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে যে, আরএনএ’র মূল উপাদানের সাথে শর্করাকে মেলানো সম্ভব নয়। কারণ মলিকিউলের বেমানান আকার শর্করাকে মিশতে বাধা দেয়।‘
সুতরাং সুদারল্যান্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন উপাদান দিয়ে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করার জন্য গবেষণা শুরু করলেন। যথারীতি তার গবেষকদল ভিন্ন ধরণের শর্করা এবং সায়ানাইডের যৌগ সিনামাইডসহ পাঁচটি সাধারণ মলিকিউল দিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। গবেষক দল উপাদানগুলোকে কয়েক ধাপের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করলেন। ফলশ্রুতিতে চারটি আরএনএ নিউক্লিওটাইড এর দুটি উৎপন্ন হল। এই গবেষণা প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিলো সেই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিলো এবং জন ডেভিড সুদারল্যান্ডের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
অনেক পর্যবেক্ষক সুদারল্যান্ডের গবেষণার ফলাফলকে আরএনএ ঘরানার পক্ষে নতুন প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড নিজে ওই পর্যবেক্ষকদের সাথে একমত ছিলেন না। আরএনএ ঘরানার ক্ল্যাসিকাল তত্ত্ব অনুসারে, প্রথম অণুজীবের ভেতরে প্রাণের সব কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ছিলো আরএনএ। কিন্তু সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার গবেষক ও পর্যবেক্ষকদের সেই ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বললেন, তাদের মতামত ‘হতাশাজনকভাবে আশাবাদী’। তিনি বিশ্বাস করতেন আরএনএ সেখানে ছিলো কিন্তু তা একমাত্র উপাদান নয়।
সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার তত্ত্ব পরিহার করে সোসটাকের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেন। সোসটাক আরএনএ ঘরানার ‘নিজেই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে প্রথমে’ এবং ইতালির বিজ্ঞানী পিয়েরে লুইগি লুইজি প্রস্তাবিত ‘কোষের খোলস বা কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ এই দুই তত্ত্বের সমন্বয় করে মত দিয়েছিলেন দুটো কাজ একসঙ্গেই ঘটেছিলো।
তবে সুদারল্যান্ড আরও সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘প্রাণের সবকিছুই প্রথমে, একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল’। তিনি চেষ্টা করলেন পারস্পরিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন বস্তুগত উপাদান থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে একবারে স্বয়ং সম্পূর্ণ কোষ সৃষ্টি করতে। তার প্রথম সূত্র ছিলো নিউক্লিওটাইডের সংশ্লেষণ সম্পর্কে কিছুটা বেমানান বিবরণ, যেটাকে শুরুতে মনে হয়েছিল ঘটনাচক্রের ফল।
সুদারল্যান্ডের কর্মপ্রক্রিয়ার শেষ ধাপে সুদারল্যান্ড নিউক্লিওটাইডে ফসফেট যুক্ত করে দেন। কিন্তু তিনি গবেষণায় যা পেলেন তা হল বিক্রিয়ার শুরুতেই ফসফেট মিশিয়ে দিলে সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফল পেতে পারতেন, কারণ এতে নিউক্লিওটাইডের প্রাথমিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিক্রিয়ার জন্য আগেই ফসফেট যুক্ত করা অত্যাবশ্যকীয় হলেও কাজটি ছিল খুব ঝামেলাপূর্ণ, কিন্তু সুদারল্যান্ড ঝামেলার মাঝেই দেখতে পেলেন দারুণ সম্ভাবনা।
এ থেকেই সুদারল্যান্ড ভাবতে শুরু করলেন ফসফেটের মিশ্রণটি ঠিক কতটা জটিল এবং ঝামেলাপূর্ণ হতে পারে। পৃথিবীর শৈশবকালে অবশ্যই শত শত রকমের রাসায়নিক উপাদানের একত্রে উপস্থিতি ছিল এবং এদের মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল তরল গাদ বা কাদামাটির মত বস্তু এবং সেগুলো যথাসম্ভব পরস্পর বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। ১৯৫০ সালে স্ট্যানলি মিলার ঠিক একই ধরণের কাদার মিশ্রণ বানিয়েছিলেন। স্ট্যানলি মিলারের কাদার মিশ্রণ ছিল সুদারল্যান্ডের মিশ্রণ থেকেও জটিল ও ঘন। সেই কাদার মধ্যে ছিল অণুজৈবিক মলিকিউল। কিন্তু সুদারল্যান্ড বলেন, ‘কাদার মিশ্রণের মধ্যে প্রচুর অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানও মিশে ছিল যাদের বেশিরভাগই অজৈবিক।‘
সুদারল্যান্ডের নতুন গবেষণার অর্থ দাঁড়ায় মিলারের গবেষণা পদ্ধতি যথেষ্ট ফলপ্রসূ ছিল না। বরং মিলারের গবেষণার প্রক্রিয়া ছিল খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ফলে ভালো রাসায়নিক উপাদানগুলো মিশ্রণের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং সুদারল্যান্ড পৃথিবীর আদি অবস্থার সেই ‘গোল্ডিলকস কেমিস্ট্রি’ বের করার জন্য অনুসন্ধান শুরু করেন, যা এতটা বিশৃঙ্খল নয় যে তা অকেজো হয়ে পড়বে, আবার এতটাও সরল নয় যে তার সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে। রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণটিকে যথেষ্ট জটিল হতে হবে যাতে প্রাণের সব উপাদান একই সঙ্গে গঠিত হতে পারে এবং এরপর একসঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
অন্যভাবে বলা যেতে পারে, প্রায় চারশ কোটি বছর আগেকার আমাদের পৃথিবীতে ছিল একটি উত্তপ্ত পুকুরের মত জলাশয় এবং তা সেভাবেই পতিত অবস্থায় ছিল বছরের পর বছর, রাসায়নিক উপাদানগুলো প্রাণের বিকাশের জন্য উপযোগী হওয়ার অপেক্ষায়। তারপর একসময়ে হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রথম প্রাণকোষটি সৃষ্টি হয়ে যায়।
মনে হতে পারে এ-তো অসম্ভব, যেমন-ভাবে মধ্য যুগের অপরসায়নবিদেরা বলতেন নানা অলীক গল্প। তবে সুদারল্যান্ডের তথ্য-প্রমাণ কিন্তু ক্রমেই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিল। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি দেখাচ্ছেন, একই রাসায়নিক উপাদান যা তার গবেষণার জন্য দুটো আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করেছিল তারাই প্রাণের অন্যান্য অণুজীব উপাদান সৃষ্টিতে সমান ভূমিকা রাখতে পারে।
তাহলে অবশ্যই পরের পদক্ষেপ হবে আরও বেশি আরএনএ নিউক্লিওটাইড তৈরি করা। যদিও তিনি অধিক পরিমাণে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে পারেন নি। কিন্তু ২০১০ সালে তিনি প্রায় কাছাকাছি ধরণের অণুজীব সৃষ্টি করতে সক্ষম হন যেগুলোকে নিউক্লিওটাইডে রূপান্তর করা সম্ভব। একইভাবে ২০১৩ সালে সুদারল্যান্ড অ্যামাইনো অ্যাসিডের মূল উপাদান সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, যা প্রাণের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। এ-পর্যায়ে তিনি গবেষণায় বিক্রিয়া সুসম্পন্ন করতে আগের রাসায়নিক উপাদানের সাথে কপার সায়ানাইড যুক্ত করে দেন।
সায়ানাইডের সাথে সম্পৃক্ত রাসায়নিক উপাদানে প্রাণের কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রমাণ উঁকি দিয়ে যায় এবং ২০১৫ সালে সুদারল্যান্ড সায়ানাইডযুক্ত রাসায়নিক উপাদান নিয়ে পুনরায় গবেষণা করতে মনোনিবেশ করেন। গবেষণায় তিনি দেখালেন একই রাসায়নিক মিশ্রণ প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লিপিড সৃষ্টিরও পূর্ব শর্ত, লিপিড হল সেই মলিকিউল যা কোষের দেয়াল তৈরি করে। সুদারল্যান্ডের সব গবেষণার রাসায়নিক বিক্রিয়া অতিবেগুনি আলোর প্রতিফলনে সম্পন্ন করা হয় এবং বিক্রিয়াতে ব্যবহার করা হয় গন্ধক এবং বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ব্যবহৃত হয় তামা।
জ্যাক উইলিয়াম সোসটাক বলেন, ‘প্রাণ বিকাশের প্রতিটি উপাদান মূলত রাসায়নিক বিক্রিয়ার একটি সাধারণ মর্মস্থল থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।‘
যদি সুদারল্যান্ডের গবেষণা সঠিক হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে গত চল্লিশ বছর ধরে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে সে বিষয়ে যে গবেষণা চলমান সেটা ভুলভাবে চলছিল। কোষের জটিলতা এখন পরিষ্কার হয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা করছিলেন যে, আদি কোষের উপাদানগুলো পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হয়েছিলো একটি একটি করে।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আরএনএ প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল’ লেসলি ওরগেল এর এমন প্রস্তাবনার পরেই আসলে বিজ্ঞানীরা একটি উপাদানকে আরেকটি উপাদানের আগে পেতে চাইলেন এবং এরপর সেটি থেকে আরেকটি উপাদানকে উদ্ভাবন করতে চাইলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড মনে করলেন, প্রাণের উৎপত্তির রহস্য সমাধানের সবচেয়ে ভাল উপায় হল প্রাণের সব উপাদান একইসাথে সৃষ্টি হয়েছিল কী না সেটা আগে খুঁজে দেখা।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আমরা যেটা করলাম সেটা হল, একই সাথে প্রাণের সব উপাদান সৃষ্টি হওয়াটা অসম্ভব এই সেকেলে ধারণাকে বাতিল করে দিলাম।‘ প্রাণের সব মৌলিক উপাদানই একবারেই, একসঙ্গেই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সুদারল্যান্ড।
ফলে সোসটাক এখন সন্দেহ করছেন, প্রাণের অণুজীব উপাদানগুলো সৃষ্টি এবং সেগুলোকে একত্রিত করে জীবন্ত কোষে পরিণত করার যেসব গবেষণা চলছিলো সেসব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় একটি কারণে- গবেষণাগুলো ছিল অতি বেশি মাত্রায় সরল। এতদিন বিজ্ঞানীরা শুধু তাদের পছন্দের সামান্য কিছু রাসায়নিক উপাদান দিয়েই গবেষণা করতেন এবং পৃথিবীর প্রথমদিককার পরিবেশে হাজির ছিল এমন অন্যান্য সব রাসায়নিক উপাদানকে গবেষণার বাইরে রেখেছিলেন তারা। কিন্তু সুদারল্যান্ডের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রাণের উৎস সন্ধানে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াতে আরো কিছু রাসায়নিক উপাদান যোগ করলে বিক্রিয়ার ফলাফলে আরও জটিলতা এবং বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করা সম্ভব।
২০০৫ সালে আদি কোষে আরএনএ এনজাইমের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে গিয়ে সোসটাক এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এনজাইমের দরকার হয়েছিলো ম্যাগনেসিয়াম। কিন্তু তা আবার কোষের চারপাশের ঝিল্লির মতো আবরণটা ধ্বংস করে দেয়।
এই সমস্যার সমাধানে অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান যুক্ত করার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। একটি নির্ভেজাল ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে ভেসিকল সৃষ্টির পরিবর্তে বিজ্ঞানীরা দুটির মিশ্রণ থেকে ভেসিকল সৃষ্টি করলেন। এই নতুন জটিল যৌগের ভেসিকল ম্যাগনেসিয়ামের সাথে টিকে থাকতে পারে এবং তার মানে হল তারা কার্যকর আরএনএ এনজাইমকেও ধারণ করতে পারবে। প্রথম জিনও সম্ভবত এই জটিলতাকে ধারণ করেছিল।
আধুনিক অণুজীব তাদের জিন বহনের জন্য নির্ভেজাল ডিএনএ ব্যবহার করে। কিন্তু প্রাণের উৎপত্তির সময় সম্ভবত নির্ভেজাল ডিএনএ’র অস্তিত্ব ছিল না। সেসময় সম্ভবত আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণ ছিল। ২০১২ সালে সোসটাক দেখালেন, আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের এই জটিল মিশ্রণ ‘মোজাইকের’ মত দেখতে মলিকিউলে একত্রিত হয়েছিলো এবং এর আচার-আচরণ প্রায় খাঁটি আরএন’র মতই ছিলো। এই আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণের শিকল ভাঁজও হতে পারতো।
এ থেকে বুঝা যায় আদি প্রাণকোষ খাঁটি আরএনএ বা ডিএনএ তৈরি করতে পারলো কি পারলো না সেটা কোনো সমস্যা ছিলো না। সোসটাক বলেন, ‘আদি কোষে হয়তো আরএনএ সদৃশ কোনো উপাদান ছিলো, যা আরএনএ’র আরো জটিল কোনো সংস্করণ।‘
হয়তো গবেষণাগারে সৃষ্ট টিএনএ এবং পিএনএ-র মতো আরএনএ-র বিকল্প কোনো উপাদানের জন্যও জায়গা ছিলো। টিএনএ এবং পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, ফলে পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ত্ব কখনো ছিলো কিনা নিশ্চিত নয়। তবে তারা যদি থেকে থাকে তাহলে প্রথমদিককার প্রাণকোষগুলো হয়তো আরএনএ-র পাশাপাশি তাদেরকেও ব্যবহার করেছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই ধারণা ঠিক নয়, বরং সেখানে আরএনএ ছাড়াও আরো নানা উপাদান ছিলো।
এই গবেষণাগুলোর শিক্ষা হল যে, আদি প্রাণকোষ সৃষ্টি করে দেখানোর কাজকে একসময় যতটা কঠিন মনে হয়েছিল বাস্তবে তা হয়তো ততটা কঠিন নয়।
কিন্তু একটা সমস্যার সমাধান সুদারল্যান্ড বা সোসটাক কেউই দিতে পারেন নি এবং সেটা অনেক বড় একটা সমস্যা। প্রথম প্রাণের অবশ্যই শক্তি উৎপাদনের জন্য যেকোনো ধরণের বিপাক ক্রিয়ার ব্যবস্থা ছিল। যেখান থেকেই শুরু হোক না কেন প্রাণকে অবশ্যই শক্তি আহরণ করতে হয় আর নয়তো তা বেঁচে থাকতে পারবে না।
এই ইস্যুতে মাইক রাসেল, বিল মার্টিন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ‘বিপাক ক্রিয়া প্রথমে’ এই তত্ত্বের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেন সুদারল্যান্ড। সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা যখন বিপাক ক্রিয়া প্রথমে উদ্ভূত হয়েছে এমন ধারণা পোষণকারী বিজ্ঞানীদের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন তখন তারা একটা বিষয়ে একমত হন যে, যেভাবেই হউক না কেন, প্রথম প্রাণের উৎপত্তির সময় সেখানে বিপাক ক্রিয়ার উপস্থিতিও থাকতেই হবে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার শক্তির উৎস কী ছিলো সেটাই হল বড় প্রশ্ন। ‘
এমনকি যদি মার্টিন এবং রাসেলের তত্ত্ব- প্রাণের সূচনা হয়েছিল সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত খনিজ পানিতে, এমন তত্ত্ব যদি ভুলও হয় তবুও তাদের তত্ত্বের অনেক উপাদান সঠিক। এর মধ্যে একটি হল- প্রাণের বিকাশে নানা ধাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।
প্রকৃতিতে, অনেক এনজাইমেরই কেন্দ্রে একটি ধাতুর অণু পাওয়া যায়। অনেক সময় এই ধাতব অংশটাই এনজাইমের সবথেকে সচল এবং কর্মক্ষম অংশ, আর বাদবাকি অংশ এর সহায়ক কাঠামো হিসেবে কাজ করে। প্রথমদিকের প্রাণের এত জটিল এবং উন্নত এনজাইম ছিল না বরং প্রথম প্রাণ সম্ভবত আবরণবিহীন ধাতুকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
জার্মান বিজ্ঞানী গুনটার ভাসটারশাওজার এই বিষয়টির উল্লেখ করেন। যখন তিনি দাবি করেছিলেন, প্রাণের সূচনা হয়েছিল লোহার পাইরাইটের ভেতর। একইভাবে রাসেল জোর দাবি তোলেন, সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত গরম পানিতে প্রচুর পরিমাণ ধাতব ছিল এবং সেগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করত। এদিকে মার্টিন তার গবেষণায় দেখান পৃথিবীতে প্রাপ্ত সব প্রাণীর সাধারণ পূর্ব পুরুষ যেই আদি-কোষ তাতে প্রচুর পরিমাণে লোহাভিত্তিক এনজাইম অবশ্যই থাকতে হবে।
এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সুদারল্যান্ডের সৃষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো তামা এবং ঘটনাচক্রে গন্ধকের উপর নির্ভর করে। ভাসটারশাওজারও বিক্রিয়াতে গন্ধকের নির্ভরতার উপর জোর দিয়েছিলেন এবং সোসটাকের আদি-কোষের আরএনএ’র জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন হয়।
তবুও প্রাণের উৎপত্তির গবেষণায় সমুদ্রের গভীরের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সোসটাক বলেন, ‘আপনি যদি আধুনিক কোষের বিপাক ক্রিয়ার দিকে তাকান তাহলে সেখানে লোহা এবং গন্ধকের মিশ্রিত উপস্থিতি দেখতে পাবেন। যা থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় যে, প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশে, যেখানকার পানিতে প্রচুর পরিমাণে লোহা এবং গন্ধক ছিলো।
তবে সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশের পানিতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে এমন ধারণা একটি কারণে ভুল হতে বাধ্য। কেননা, গভীর সমুদ্রে কখনো প্রাণের বিকাশ সম্ভব নয়। সুদারল্যান্ড বলেন, আমরা প্রথম প্রাণের যে রসায়নটি উদঘাটন করলাম তা কিন্তু অতিবেগুনী রশ্মির ওপর খুবই নির্ভরশীল। আর অতি বেগুনী রশ্মির একমাত্র উৎস হল সূর্য। ফলে সুর্যের আলো পৌঁছাতে পারে এমন জায়গাতেই প্রাণের উৎপত্তি হতে হবে। কিন্তু গভীর সমুদ্রেতো তা পৌঁছাতে পারে না।‘
সোসটাক স্বীকার করে নেন, গভীর সমুদ্রে প্রাণের বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে অসম্ভবের বিষয় হল সমুদ্রের তলদেশ প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে, যেখান থেকে সায়ানাইডের মত প্রচুর পরিমাণ শক্তি উৎপাদনকারী উপাদান যোগ হতে পারে না। কিন্তু এই সমস্যার কারণে সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা থেকে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এমন তত্ত্বকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। হতে পারে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখগুলো ছিল সমুদ্রের অগভীর পানিতে যেখানে সূর্যের আলো এবং বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিক পরিবেশ থেকে সায়ানাইড সহজেই প্রবেশ করতে পারে।
আরমেন মালকিদজানিয়ান বিকল্প একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, সম্ভবত সমতল ভূমিতে পুকুরের মতো কোনো অগভীর জলাশয়ে, যেখানে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে বের হওয়া লাভা এসে জমা হত, এমন কোনো স্থানে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।
আরমেন মালকিদজানিয়ান গভীরভাবে কোষের রাসায়নিক গঠন পর্যবেক্ষণ করলেন- বিশেষত কোন ধরণের রাসায়নিক উপাদানকে কোষ নিজের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় আর কোনোগুলোকে বাইরে রাখে। তিনি দেখলেন, সব ধরণের প্রাণকোষ প্রচুর পরিমাণে ফসফেট, পটাশিয়াম এবং আরও কিছু ধাতব উপাদান ধারণ করে কিন্তু সেখানে সোডিয়ামের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
আজকের দিনের কোষগুলো পাম্প করার মাধ্যমে কোষের ভেতরে প্রয়োজনীয় উপাদান ঢুকাতে পারে আবার বাইরে বেরও করে দিতে পারে। কিন্তু আদি প্রাণকোষের এই সুবিধা ছিল না কারণ আদি কোষে এমন কাজের জন্য সহায়ক যন্ত্রপাতি বা অঙ্গ ছিল না। সুতরাং মালকিদজানিয়ান দাবী করেন, আদি কোষ এমন কোনো স্থানে বিকশিত হয়েছিল যেখানে আধুনিক কোষগুলোর রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণের মতো মিশ্রণের উপস্থিতিও ছিল। সুতরাং এখানেই গভীর সমুদ্রে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছে, এমন ধারণা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কারণ, প্রতিটি কোষ অতি উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম এবং ফসফেট এবং খুব অল্প পরিমাণ সোডিয়াম বহন করে। অথচ সমুদ্রের পানিতে সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি।
এ থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, সমুদ্রের তলদেশে থাকা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এই তত্ত্ব ঠিক নয়। তার বদলে বরং ভূ-পৃষ্ঠের কোনো সক্রিয় আগ্নেয়গিরির পাশের অগভীর গরম জলাশয়ে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে বললে সেটাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। এমন জলাশয়েই দেখা যায় তেমন পরিবেশ ঠিক যেমনটা প্রাণ বিকাশের জন্য দরকার। কারণ এমন জলাশয়েই পাওয়া যায় সেসব ধাতব উপাদানের সমস্ত মিশ্রণ যেগুলো আধুনিক কালের প্রাণকোষে দেখা যায়।
সোসটাক নিজেও এমন দৃশ্যের ভক্ত। তিনি মজা করে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার মনে হয় আমার প্রিয় দৃশ্য হতে পারে সমতল ভূপৃষ্ঠে সক্রিয় কোনো আগ্নেয়গিরি এলাকার অগভীর হ্রদ বা পুকুর। সেখানে হয়ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে গরম তরল প্রবাহ আছে কিন্তু সেগুলো গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরি নয়, বরং আমেরিকার মনটানা এবং আইডাহো প্রদেশের ইয়েলোস্টোন পার্কের অগভীর জলাশয়ের তলদেশে থাকা জ্বালামুখের মত।‘
সুদারল্যান্ডের প্রস্তাবিত প্রাণ সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্ভবত এরকম পরিবেশেই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে। বসন্তকালেই প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানের মেলবন্ধন ঘটে, কারণ তখন পানির স্তর কমে যায় এবং কিছু স্থান শুকিয়ে যায় এবং সেখানে প্রচুর পরিমাণে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি পড়ে। এ ছাড়া, সোসটাক বলেন, ‘অগভীর হ্রদ বা জলাশয়ই হতে পারে আদি প্রাণকোষের উৎপত্তির জন্য উপযুক্ত স্থান। যেখানে আদি প্রাণকোষ বেশিরভাগ সময় অপেক্ষাকৃত শীতল ছিল। আর এই পরিবেশ আরএনএ-র প্রতিরূপ সৃষ্টি এবং অন্যান্য সরল বিপাক ক্রিয়ার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু ওই পরিবেশেই মাঝে-মধ্যেই আদি কোষ কিছুটা সময়ের জন্য উত্তপ্ত হত, যার ফলে আরএনএ সূতাগুলো আলাদা হয়ে যেত এবং পরের ধাপে প্রতিরূপ সৃষ্টি করার জন্য তৈরি হয়ে যেত। সেই অগভীর জলাশয়ে গরম পানির স্রোত ছিল ফলে সেখানে হয়তো বিদ্যুৎশক্তি তৈরি হতো যা আদি কোষগুলোর বিভাজনে সাহায্য করত।
তবে সুদারল্যান্ড প্রাণের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে তৃতীয় একটি সম্ভাবনার প্রস্তাব করলেন। তিনি বললেন, ‘উল্কা পতনের স্থানগুলোতেও প্রাণের বিকাশ ঘটে থাকতে পারে।’
পৃথিবীর জন্মের পর প্রথম পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে শুধু এতে উল্কাপাত ঘটেছিল এবং আমরা এখনো মাঝে মাঝে উল্কা পতন দেখতে পাই। বড়সড় একটি উল্কার আঘাতে সমতলে সৃষ্টি হতো বিশালাকার গর্ত, গর্তে পানি জমে যে হ্রদের সৃষ্টি হয় সেখানেই হয়তো দেখা দেয় আরমেন মালকিদজানিয়ানের প্রস্তাবিত প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। প্রথমত, উল্কাপিণ্ডগুলো প্রধানত ধাতব উপাদানে তৈরি ছিলো। সুতরাং উল্কার আঘাতে সৃষ্ট গর্তে বিপুল পরিমাণ লোহা এবং গন্ধকের উপস্থিতি থাকার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উল্কার আঘাতে এবং অতি উচ্চ তাপে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পাথরের আবরণ (Earth's Crust) গলে গিয়েছিল। যার ফলে পাথরে ফাটল ধরে ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো সৃষ্টি হয় এবং পানি গরম হয়।
সুদারল্যান্ড কল্পনা করেন ছোট ছোট নদী এবং পানির প্রবাহ উল্কার আঘাতে সৃষ্ট খাড়ির ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে, আর পাথর থেকে বয়ে আনছে সায়ানাইডভিত্তিক রাসায়নিক, আর উপর থেকে সূর্য ঢালছে অতিবেগুনী রশ্মির বিকিরণ। প্রতিটি স্রোতেই ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রণ আছে ফলে প্রতিটি স্রোতের মিলনে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে এবং এভাবে সময়ের হাত ধরে জলাধারে উৎপাদিত হচ্ছে প্রথম প্রাণের আধার।
সবশেষে ওই স্রোতগুলো সেই গর্তের তলদেশে প্রায় সমুদ্রের তলদেশের মতো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো জলাশয় বা পুকুরে গিয়ে মিলিত হচ্ছে। এমন কোনো একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার পুকুরেই হয়তো পৃথিবীর প্রথম প্রাণকোষটি এর সবগুলো উপাদান সহ সৃষ্টি হয়।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘এটা প্রাণ সৃষ্টির খুবই সুবিন্যস্ত একটি দৃশ্য।‘ আর পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভিত্তিতেই এই দৃশ্যটি কল্পনায় আঁকলেন সুদারল্যান্ড। তিনি বললেন, ‘এই দৃশ্যটাই একমাত্র দৃশ্য যা কেউ রসায়নের সূত্র অনুযায়ী কল্পনা করতে পারেন।‘
সোসটাক কিন্তু কোনোটার সঙ্গেই পুরোপুরি একমত পোষণ করলেন না। তবে তিনি বললেন, সুদারল্যান্ডের তত্ত্ব গভীর মনোযোগের দাবীদার। সোসটাক বলেন, ‘আমি মনে করি, উল্কার আঘাতে সৃষ্ট গভীর খাদের দৃশ্যকল্পটি বেশ সুন্দর। সেখানে জমা হওয়া রাসায়নিক মিশ্রিত পানিতেও হয়তো প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব। একই সাথে আমি এও মনে করি যে, সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পরিবেশেও প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে। দুটি বিতর্কের স্বপক্ষেই প্রচুর যুক্তি আছে।’
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিজ্ঞান-সভার বিতর্ক এবার যুক্তির লড়াইয়ের মঞ্চের মত চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কিন্তু মনে হয় না কোনো পক্ষই দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন। সিদ্ধান্ত হবে রসায়ন এবং আদি কোষের বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে। তবে এই দুটো স্থানের কোনো একটিতে যদি প্রাণ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর কোনো একটি উপস্থিত ছিলো না বলে প্রমাণ হয় তাহলে সেটি প্রাণের সম্ভাব্য উৎপত্তি স্থলের মর্যাদা হারাবে এবং অপরটি গৃহীত হবে।
এই বিতর্কের ইতিবাচক দিক হল, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম দীর্ঘদিন ধরে চলমান পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে বিতর্কের একটি ব্যাপকভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখতে যাচ্ছি আমরা। সুদারল্যান্ড বলেন, প্রাণের উৎপত্তির রহস্যটি এখন আরো বেশি সমাধানযোগ্য মনে হচ্ছে।
তবে সোসটাক এবং সুদারল্যান্ডের প্রস্তাবিত ‘প্রাণের সবকিছু একবারেই, একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব এখনো অসম্পুর্ণই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এটি আমাদের সামনে শুধুই একটি রেখা চিত্রের মতো একটি আখ্যান উপস্থাপন করে মাত্র। তবে এই দুই বিজ্ঞানীর পদক্ষেপগুলো বিগত কয়েক দশক ধরে চলমান নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষার ফলাফল দিয়ে সমর্থিত। ‘সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত সবগুলো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি সমন্বয়ও সাধন করে। এটি অন্যান্য প্রতিটি তত্ত্বের ইতিবাচক দিকগুলোকে একই সূতায় বাঁধার চেষ্টা করে এবং একই সাথে সেগুলোর সমস্যাগুলোও সমাধানের চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ‘সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব রাসেলের সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত গরম পানির স্রোতের এলাকায় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল সেই তত্ত্বকেও ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে না বরং সেটার সবচেয়ে ভালো দিকগুলোকে গ্রহণ করে নেয়।
পরিশেষে বলা যায়, আমরা আসলে কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত করে জানতে পারবো না ৪০০ কোটি বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল। মার্টিন বলেন, ‘যদি কৃত্রিমভাবে এখন আদি পৃথিবীর সেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা যায় এবং এসচেরিচিয়া কোলি নামের ব্যাকটেরিয়া উঁকি দেয় অন্য প্রান্তে তবুও প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে আমরা (প্রাণ) ওভাবেই আবির্ভুত হয়েছিলাম।‘
আমরা সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হল, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে তার একটা সঙ্গতিপূর্ণ চিত্রকল্প আঁকতে পারি। গবেষণাগারে যেসব রাসায়নিক বিক্রিয়া ভিত্তিক পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালানো হয়েছে, আদি পৃথিবী সম্পর্কে আমরা যেসব তথ্য জানতে পেরেছি, এবং জীব বিজ্ঞান প্রাণের সবচেয়ে প্রাচীন গঠন সম্পর্কে যা কিছু উদঘাটন করেছে সেসবের ভিত্তিতেই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত এই চিত্রকল্পটি তৈরি করতে হবে।
অবশেষে, গত প্রায় ১০০ বছর ধরে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নানা গবেষণা প্রচেষ্টার পর পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রকল্প দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
তার মানে, আমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এক বিভক্তির কাছাকাছি চলে আসছি, বিভক্তিটি হল- একদল মানুষ যারা প্রাণের যাত্রা শুরুর কাহিনী জানে আর অপর একদল যারা তা কখনোই জানতে পারেনি। ১৮৫৯ সালে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশের আগে যারা মারা গেছে তাদের প্রতিটি মানুষ নিজেদের প্রকৃত উৎসের ইতিহাস না জেনেই মরে গেছে, কারণ তারা কেউ বিবর্তনের বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানত না। কিন্তু বর্তমান কালের সকল জীবিত মানুষ, কিছু বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বাদে, চাইলেই প্রাণী জগতের সাথে আমাদের সম্পর্ক তথা আত্মীয়তার বিষয়টি জানতে পারবে। অনুরূপভাবে ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিনের পৃথিবী প্রদক্ষিণের পর যারা জন্মেছে তারা এমন একটা সমাজে বসবাস করছে যে সমাজ মহাবিশ্বে ভ্রমণ করছে। এমনকি আমরা যদি কখনো সশরীরে মহাশূন্যে নাও যাই তবুও মহাকাশ ভ্রমণ একটি বাস্তব সত্য, বিভিন্ন নভোযান কিন্তু ঠিকই বাস্তবে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই বাস্তব সত্য ঘটনাগুলো দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমুল বদলে দিচ্ছে। আমাদেরকে আরো বুদ্ধিমান বা বিজ্ঞ করে তুলছে। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব আমাদেরকে এবং আর আর সকল প্রাণকেও আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই সংরক্ষণের শিক্ষা দেয় ও তাগিদ যোগায় কেননা তারাও আমাদের মতোই। মানুষ সহ প্রাণিজগতের সকল জীবই একই আদি প্রাণ থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। বিবর্তনবাদ আমাদেরকে প্রতিটি প্রাণীকে মূল্যায়ন করতে শিখিয়েছে, কারণ মানুষ জানতে পেরেছে সব প্রাণীই তাদের দূর সম্পর্কের বা নিকটাত্মীয়। মহাকাশ ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা আমাদের বিশ্বকে দূর থেকে সার্বিকভাবে দেখত পারি এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারি; যা থেকে আমরা আমাদের পৃথিবীর অনন্যতা এবং তা যে কতটা ভঙ্গুর ও অসহায় তাও উপলব্ধি করতে পারি।
পৃথিবীতে আজ যারা জীবিত আছে তাদের মাঝে কিছু মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত সততার সাথে বলতে পারবে কোথা থেকে তারা এসেছে। মানুষ জানতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষ কে এবং কোথায় ছিল তার বসবাস।
এই জ্ঞান আমাদেরকে আমূল বদলে দেবে। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা হয়তো জানতে পারবো কীভাবে মহাবিশ্বে প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে এবং কোথায় তাকে খুঁজতে হবে। একইসাথে এ থেকে আমরা প্রাণের মর্মগত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট সম্পর্কেও জানতে পারব। কিন্তু প্রাণের উৎপত্তির পর কীভাবে জন্ম নিলো প্রাণের প্রজ্ঞা, সে সম্পর্কে আমরা এখনো প্রায় কিছুই জানতে পারিনি।
(বিবিসি আর্থ-এ প্রকাশিত মাইকেল মার্শাল এর লেখা ’The secret of how life on earth began’ অবলম্বনে এই লেখা)
আরও পড়ুন…
পূর্ণাঙ্গ প্রাণকোষ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম (৫ম পর্ব)
প্রাণের উৎসের সন্ধানে সমুদ্রের তলদেশে অভিযান (৪র্থ পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (৩য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (২য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার গল্প (১ম পর্ব)
২০০০-এর প্রথম দশকের প্রথমদিকে প্রাণের প্রথম পথ চলা কীভাবে শুরু হয় এই বিষয়ে প্রধানত দুটো তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা মনে করতেন প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে এমন অণুজীব থেকে। ইতিমধ্যে যেসব বিজ্ঞানী ‘বিপাক ক্রিয়া’ প্রথমে শুরু হয়েছিল বলে মনে করতেন তারা গভীর সমুদ্রতলে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে গরম তরল প্রবাহে কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ হাজির করলেন। যাইহোক, চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই সামনে হাজির হয় তৃতীয় আরেকটি মতবাদ।
আমরা জানি পৃথিবীতে জীবন্ত সব প্রাণই কোষ দিয়ে গঠিত। প্রতিটি কোষই মূলত নরম তুলতুলে ছিদ্রযুক্ত গোলাকার বস্তু যার চারপাশ শক্ত পর্দার আবরণে ঘেরা। কোষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল কোষ প্রাণের সব প্রয়োজনীয় উপাদান একত্রে ধরে রাখে। যদি কোষের দেয়াল কোনো কারণে জীর্ণ হয়ে ধ্বসে যায় তাহলে কোষের মূল উপাদান বেরিয়ে পড়ে এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন, যদি কোনো মানুষের উদর থেকে নাড়ীভুঁড়ি কেটে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না।
কোষের বাইরের আবরণ এতোটাই প্রয়োজনীয় যে প্রাণের উৎস সন্ধানী কিছু গবেষক যুক্তি দেখালেন যে, কোষ সৃষ্টির আগেই কোষের বাইরের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করতেন ‘বংশগতিই প্রথম’ এবং ‘বিপাক ক্রিয়াই প্রথম’ এই দুটি তত্ত্ব বিভ্রান্তিকর। তাদের বিকল্প মতবাদটি ছিল প্রাণের উৎপত্তিতে ‘কোষের কাঠামো গঠন প্রথম’ ঘটনা। এই মতবাদের পুরোধা ব্যক্তি হলেন ইটালির রোমে অবস্থিত রোমা ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়েরে লুইগি লুইজি।
লুইজির মতবাদের স্বপক্ষে যুক্তি ছিলো যথেষ্ট সহজ সরল এবং এর বিপক্ষে বিতর্ক করাও কঠিন। কারণ ‘বিপাক ক্রিয়া’ বা ‘নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম আরএনএ’ যেভাবেই প্রাণের যাত্রা শুরু হোক না কেন তার জন্য দরকার প্রচুর রাসায়নিকের একজায়গায় জড়ো হওয়া, যার জন্য আবার সবার আগে দরকার পড়ে একটি কনটেইনার বা ধারকের।
এই যুক্তি অনুযায়ী তাহলে প্রাণের যাত্রা শুরু হওয়ার একটাই মাত্র উপায় আছে, সেটা হল, যেকোনোভাবে আদি পৃথিবীর উত্তপ্ত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও প্রাণ সৃষ্টির কিছু কাঁচামাল একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ বা প্রাথমিক কোষের জন্ম হওয়া। কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জ হল এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে হলে ল্যাবরেটরিতে একটা সরল এককোষী প্রাণ সৃষ্টি করে দেখাতে হবে।
লুইজি তার সব চিন্তার যোগসূত্র খুঁজে পেলেন আলেক্সান্ডার ওপারিনের কাছে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রাণের সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনে পরিচালিত গবেষণার শুরুর দিকে। আলেক্সান্ডার ওপারিনের গবেষণার বিষয় ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে। ওপারিন গুরুত্বের সাথে দেখিয়েছিলেন কিছু রাসায়নিক জড়ো হচ্ছে থকথকে জেলি সদৃশ বস্তু বা কোয়াসারভেটের মধ্যে; যা এর কেন্দ্রে আরো কিছু বস্তু ধারণ করতে পারে। তিনি দাবী করেন কোয়াসারভেটগুলোই আসলে প্রাণকোষের প্রথম নমুনা।
যেকোনো চর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত বস্তু পানিতে এমন থকথকে জেলি সদৃশ বস্তু সৃষ্টি করে। আর এইসব রাসায়নিক উপাদান একসাথে লিপিড নামে পরিচিত। আর এভাবেই প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এই মতবাদকে নাম দেওয়া হয় ‘লিপিড ঘরানা’।
কিন্তু শুধু এই থকথকে জেলি সদৃশ বস্তু (Blob or Film) বা কোয়াসারভেট সৃষ্টি করলেই সব সমাধান হয়ে গেল এমন নয় বিষয়টা। সেগুলোকে স্থিতিশীল থাকতে হবে এবং বিভাজিত হয়ে নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারতে হবে। এবং তাদের ভেতরে কী কী উপাদান পরিবাহিত হচ্ছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এতকিছু করতে হবে, কিন্তু বর্তমানে একটা কোষ যে পরিণত প্রোটিন ব্যবহার করে তা ছাড়াই।
সঠিক উপাদান সহ গবেষণাগারে প্রাণকোষের সেই প্রাথমিক নমুনা সৃষ্টি করা খুবই কঠিন কাজ। কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন বস্তু ব্যবহার করেও লুইজি এমনকিছু বানাতে পারলেন না যা দিয়ে প্রাণ-সদৃশ কিছু উপস্থাপন করা যায়।
এরপরে ১৯৯৪ সালে লুইজি এক সাহসী প্রস্তাবনা রাখলেন। তিনি বললেন, আদি প্রাণকোষে অবশ্যই আরএনএ থাকতে হবে। তিনি আরও দাবী করেন, এই আরএনএ নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতেও সক্ষম ছিল। লুইজির প্রস্তাবনা বিজ্ঞানে অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিলো। লুইজির প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমলে নিলে প্রাণের উৎপত্তিতে ‘কোষের কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ এই তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে হয়। তবে লুইজির কাছে উপযুক্ত যুক্তিও ছিল।
ভেতরে জীন ছাড়া শুধু চার পাশের আবরণ সমেত একটি কোষ খুব বেশী কিছু করতে পারে না। সেই কোষ হয়তো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করতে পারবে কিন্তু তার নিজের বংশগতির কোনো তথ্য-উপাত্ত পরবর্তী কোষের মাঝে সঞ্চারিত করতে পারবে না। প্রাণকোষ কেবল তখনি বিবর্তিত হতে শুরু করবে এবং ক্রমাগত জটিলতর হয়ে উঠতে পারবে যখন কোষের ভেতরে জীন থাকবে।
এই তত্ত্ব খুব দ্রুত জ্যাক সোসটাকের সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আমরা ইতিমধ্যে সোসটাকের আরএনএ নিয়ে গবেষণা তুলে ধরেছি। যখন লুইজি ছিলেন ‘কোষের কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ তত্ত্বের প্রথম দিককার সমর্থক ঠিক তখন সোসটাক সমর্থন করতেন জীনতত্ত্বকে।
সোসটাক বলেন, ‘আমরা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের গবেষণায় বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হয়েছি এবং এই দীর্ঘ বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি, কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ বা কোনটা আগে শুরু হয়েছে। এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারলাম আদি কোষে দুটোরই উপস্থিতি ছিলো। আমরা সম্মত হলাম যে, প্রাণ সৃষ্টির জন্য কোষের কাঠামো গঠন এবং বংশগতি দুটোই একসঙ্গে সৃষ্টি হওয়া দরকার।‘
২০০১ সালে সোসটাক এবং লুইজি তাদের তত্ত্বের আরো সমন্বয় করলেন। বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘নেচার’-এ তারা এ বিষয়ে একটি লেখাও লিখলেন। সেখানে তারা বললেন, আদি প্রাণকোষ হয়তো এর ভেতরে নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে সক্ষম এমন আরএনএ সহই সৃষ্টি হয়েছিলো।
তাদের এই তত্ত্ব প্রাণের উৎস গবেষণার ক্ষেত্রে ছিলো একটি যুগান্তকারী ধারণা। সোসটাক শিগগিরই সিদ্ধান্ত নিলেন এই তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ যোগাড়ের জন্য গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করবেন। কারণ এমন একটা তত্ত্বের সমর্থনে অবশ্যই প্রমাণ দরকার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিক কোষ নিয়ে গবেষণা শুরু করবেন।
এর দুই বছর পর সোসটাক এবং তার দুই সহকর্মী গবেষণায় একটি বড় সাফল্যের ঘোষণা দেন।
সোসটাক এবং তার গবেষক-দল কোষের ভেসিকল (কোষের তরল ধারক) নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ভেসিকল দেখতে অনেকটা সর্পিল ঘন তরলের আকার যার গভীরে এবং বাইরের আবরণে দুটো ফ্যাটি অ্যাসিডের স্তর আছে। ভেসিকলের উৎপাদন ত্বরান্বিত করার উপায় খুঁজতে গিয়ে সোসটাকের গবেষক-দল অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার মত দেখতে থকথকে একটা বস্তুকে (Montmorillonite) বিক্রিয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন। এই যৌগের মিশ্রণ যোগ করার পরেই ভেসিকলের উৎপাদন ১০০ গুণ দ্রুততর হয়ে গেল। কাদার মত বস্তুর পৃষ্ঠতল ভেসিকল উৎপাদনে অনুঘটকের কাজ করে, ঠিক যেমনটা এনজাইম করে থাকে।
এ ছাড়াও, ভেসিকল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার (Montmorillonite) কণা এবং কাদার পৃষ্ঠতল থেকে আরএনএ সূতা গ্রহণ করতে পারে। এইসব আদি কোষের নমুনা এখন বহন করছে জীন এবং অনুঘটক। আর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে একটা সরল কাঠামোর মধ্যে।
প্রাণের উৎপত্তি গবেষণায় অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদা (Montmorillonite) প্রয়োগের সিদ্ধান্ত কিন্তু হঠাৎ করেই নেওয়া হয়নি। কয়েক দশক ধরে চলমান গবেষণায় দেখা যাচ্ছিলো যে, প্রাণ সৃষ্টিতে এই যৌগ হয়ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো।
অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের এই যৌগ (Montmorillonite) একটি সহজলভ্য দ্রব্য। এখনকার সময়ে আমাদের ব্যবহার্য নিত্যদিনের জিনিসপত্রে এটা হরহামেশা ব্যবহৃত হয়, এমনকি বিড়ালের বিছানা বানাতেও এটার ব্যবহার দেখা যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ছাইয়ের ধুলা পৃথিবীর আবহাওয়াতে ভেঙ্গে-মিশে এই যৌগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পৃথিবীর শৈশবে অনেক আগ্নেয়গিরি ছিল সেহেতু অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ প্রচুর পরিমাণে ছিলো।
ফিরে যাই ১৯৮৬ সালে, তখন আমেরিকান রসায়নবিদ জেমস ফেরিস দেখালেন অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আসলে এমন একটি অনুঘটক, যা জৈব-কণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরও পরে তিনি আবিষ্কার করেন অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আরএনএ সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। এই থেকে জেমস ফেরিস ধারণা করেন গড়পড়তা দেখতে কাদার মত এই যৌগটি আসলে প্রথম প্রাণ সৃষ্টির স্থান।
জ্যাক সোসটাক ফেরিসের এই ধারণা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ব্যবহার করে আদি কোষের নমুনা সৃষ্টি করতে কাজে লেগে গেলেন। এক বছর পরে সোসটাকের গবেষক-দল প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, প্রথমদিকের কোষ নিজের মতো করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এমনকি আদি-কোষে আরএনএ সংরক্ষিত থাকে এবং সময়ের হাত ধরে কোষের দেয়ালের বাইরের দিকটা অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন আদি-কোষ একটা ফুলে ওঠা পাকস্থলী এবং যেকোনো সময় সশব্দে ফেটে পড়বে। ফেটে পড়া রোধ করতে গিয়ে কোষ অধিকমাত্রায় ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করে এবং তাদের সমন্বয়ে নিজের দেয়ালকে আরও মজবুত করে তোলে, ফলে কোষ আরো ফুলে আকারে আরো বড় হয় এবং ফেটে পড়ার আশংকা দূর হয়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদি-কোষ যেসব কোষের আরএনএ কম তাদের থেকে ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করে, ফলে সেই কোষগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ে। তার মানে এ থেকে বোঝা যায় আদি-কোষগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং যে কোষের আরএনএ বেশী স্বাভাবিকভাবে সে কোষটিই জিতে যায়। এই অনুসিদ্ধান্ত আরও বিস্ময়কর কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে। যদি আদি-কোষ বেড়ে উঠতে পারে তাহলে সেটা বিভাজিতও হতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিরূপ কোষও সৃষ্টি করতে পারে। তবে কি সোসটাকের গবেষণালব্ধ প্রাথমিক কোষ নিজের প্রতিরূপ বানাতে পারবে?
সোসটাকের প্রথম পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে কীভাবে আদি-কোষ বিভাজিত হয়। আদি-কোষকে যদি ছোট ছিদ্র পথে ঢুকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে টিউবের ভেতর দিয়ে প্রসারিত করে চালিত করা হয় তাহলে তা বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি হয়। কিন্তু এভাবে কৃত্রিম চাপ প্রয়োগ করার পরই শুধু সোসটাকের তৈরি আদি কোষের নমুনা নিজের প্রতিরূপ বানাতে পারে, যা কোনো ভালো সমাধান নয়।
তবে, এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া একেবারে নির্ভেজাল, কারণ এখানে কোনো যান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম জড়িত নাই। এখানে শুধু চাপ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। কারণ এই প্রক্রিয়ায় আদি কোষ তার নিজস্ব কিছু উপাদান হারায়। এছাড়াও এই পরীক্ষায় দেখা গেল সোসটাকের তৈরি আদি-কোষ শুধু তখনই বিভাজিত হতে পারে যখন ছোট ছিদ্রপথে বল প্রয়োগে প্রবেশ করানো হয়।
ভেসিকলকে বিভাজিত করার আরো উপায় আছে। যেমন কোষকে পানির প্রবল স্রোতে যুক্ত করা যাতে প্রচুর শক্তির সৃষ্টি হয়। এই কৌশল অবলম্বন করা হয় আদি-কোষের অভ্যন্তরীণ উপাদান বের হতে না দিয়ে কোষকে বিভাজিত করার জন্য।
অবশেষে ২০০৯ সালে জ্যাক সোসটাক এবং তার সহযোগী ছাত্র টিং ঝু একটা সমাধান বের করতে সক্ষম হন। তারা সামান্য একটু জটিল আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন যার চতুর্দিকে একাধিক দেয়াল, যেন অনেকটা পেয়াজের মত। তবে গঠনে জটিলতা থাকলেও সহজেই তাদেরকে সৃষ্টি করা সম্ভব।
টিং ঝু যখন আদি-কোষের সাথে আরও বেশী ফ্যাটি অ্যাসিড যোগ করলেন তখন আদি-কোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে গেল, সূতার মত দেখতে প্রান্তগুলো আরও লম্বা হয়ে গেল। আদি-কোষের আকার যথেষ্ট লম্বা হয়ে গেলে অল্প চাপেই তা বিভাজিত হয়ে কয়েক ডজন ছোট ছোট আদি-কোষে রূপান্তরিত হতে সক্ষম। নতুন সৃষ্ট কোষগুলোর প্রতিটিতেই আরএনএ রয়েছে। একটিতেও আরএনএ হারিয়ে গেল না বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র আদি-কোষ তার পিতৃ-কোষ থেকে আসা আরএনএ’র প্রতিরূপ বহন করতে লাগল। তাছাড়া, আদি-কোষ নতুন কোষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া পৌনঃপুনিকভাবে চালিয়ে যেতে পারলো। নতুন সৃষ্ট কোষগুলোও বেড়ে উঠলো এবং বিভাজিত হতে শুরু করলো। ফলে আরো নতুন কোষ সৃষ্টি হতে লাগলো।
পরবর্তী পরীক্ষায় ঝু এবং সোসটাক আদি-কোষ ভেঙে নতুন কোষ জন্ম দেয়ার আরো ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। গবেষণার এই পর্যায়ে মনে হচ্ছিল অবশেষে সমস্যার বুঝি সমাধান পাওয়া গেল। প্রাণের উৎপত্তির রহস্য বুঝি উদঘাটিত হতে চলেছে।
কিন্তু তাদের সৃষ্ট আদি-কোষ যথেষ্ট কার্যকরী ছিল না। লুইজি ভেবেছিলেন, আদি-কোষ আরএনএ প্রতিরূপ সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু যতদূর বোঝা যায় তাদের সৃষ্ট আদি-কোষে আরএনএ শুধু অলস বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ করে না।
তাদের সৃষ্ট এই আদি-কোষের মতো কোষ থেকেই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে গেলে সোসটাককে দেখাতে হবে সেই কোষের ভেতরে থাকা আরএনএও নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে। কিন্তু তা প্রমাণ করে দেখানো এত সহজ নয়। কারণ দশকব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পরেও কোনো বিজ্ঞানী এমন কোনো আরএনএ সৃষ্টি করে দেখাতে পারেননি যা নিজেই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যার কারণেই প্রাণ বিকাশে আরএনএ তত্ত্ব ঘরানার গবেষণার কাজ প্রথমদিকে ব্যাহত হচ্ছিল এবং তখন পর্যন্ত কেউ এই সমস্যার সমাধান বের করতে পারেননি। এমনকি সোসটাক নিজেও চেষ্টা করেছিলেন তেমন আরএনএ তৈরি করতে কিন্তু পারেন নি।
সুতরাং সোসটাক লেসলি ওরগেলের গবেষণার ফলাফল ও তার লিখিত কাগজপত্র পুনরায় পড়তে শুরু করলেন। আমরা জানি লেসলি ওরগেল দীর্ঘদিন আরএনএ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। পুরনো ধুলো পড়া কাগজের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রাণের উৎস গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র।
ওরগেল ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আরএনএ’র সূতার মত প্রান্তগুলো কীভাবে নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করে সেই গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ওরগেলের গবেষণার সারাংশ ছিল খুবই সহজ সরল এবং সাধারণ। একটি আরএনএ’র সূতা এবং একতাড়া আলগা নিউক্লিওটাইড তুলে নাও। এরপর নিউক্লিওটাইডগুলো ব্যবহার করে আরেকটি আরএনএ সূতা জড়ো কর। যা প্রথম আরএনএ’র পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। উদাহরণস্বরূপ, ধরি একটা আরএনএ’র সূতার প্রান্তে ‘CGC’ লিখিত আছে, যা থেকে উৎপাদিত হবে অনুরূপ আরেকটা সূতার মত প্রান্ত; যেটাতে লেখা থাকবে ‘GCG’। এই প্রক্রিয়াটা দুবার চালালেই মূল ‘CGC’ এর প্রতিরূপ পাওয়া যাবে।
ওরগেল বুঝতে পারলেন যে, কোনো অনুকূল পরিবেশে আরএনএ’র সূতা এই প্রক্রিয়ায় এনজাইমের সাহায্য ছাড়াই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভবত এভাবেই প্রথম প্রাণ নিজের জীনের প্রতিরূপ তৈরি করত।
১৯৮৭ সালে ওরগেল ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা আরএনএ সূতা এবং অনুরূপ ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা পরিপুরক আরএনএ সূতাও সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন। তিনি এর থেকে বেশী লম্বা আরএনএ বানাতে পারেননি। কিন্তু সোসটাকের চিন্তাকে আলোড়িত করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল।
সোসটাকের ছাত্রী ক্যাটারজিনা আদি কোষেও একই বিক্রিয়া চালাতে চাইলেন। কিন্তু তারা দেখলেন এর জন্য দরকার ম্যাগনেসিয়াম। যা একটি বড় সমস্যা। কারণ, ম্যাগনেসিয়াম আদি কোষকে ধ্বংস করে ফেলে।
সব সমস্যারই সমাধান আছে। এবং এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা হল সাইট্রাইট। যা লেবু, কমলা জাতীয় ফলে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিডের মতোই। প্রতিটি জীবন্ত কোষেই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাইট্রিক অ্যাসিডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটা গবেষণা নিবন্ধে গবেষক-দল উল্লেখ করেন তারা বিক্রিয়ার সময় সাইট্রাইট যুক্ত করে দেন ফলে বিক্রিয়াতে অংশগ্রহণ থেকে ম্যাগনেসিয়ামকে বিরত রাখা সম্ভব হয়। এতে আদি-কোষ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং কোষের প্রতিরূপ সৃষ্টির প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলতে থাকে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এই গবেষক-দল ১৯৯৪ সালে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী পিয়ের লুইগি লুইজির প্রস্তাবিত তত্ত্বকেই পরীক্ষার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলেন। জ্যাক সোসটাক বলেন, ‘আমরা কোষের ফ্যাটি অ্যাসিড ভেসিকলের ভেতরে আরএনএ’র অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করালাম।‘
এভাবে মাত্র এক দশকের বেশী কিছু সময়ের গবেষণায় জ্যাক সোসটাকের গবেষক-দল প্রাণের উৎস সন্ধানে যুগান্তকারী অর্জন সম্পন্ন করে ফেললেন।
তারা এমন কিছু আদি-কোষের নমুনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন, যারা নিজেদের জীন বহন করে এবং বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় মলিকিউল সংগ্রহ করতে পারে। এই আদি-কোষ নিজেরাই নিজেদের বৃদ্ধি এবং বিভাজন করতে পারে এমনকি নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতাও পর্যন্ত করতে পারে। আর কোষের ভেতরে চলতে থাকে আরএনএ’র অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টির অবিরাম কর্মযজ্ঞও। যেকোনো বিচারেই তারা ছিলো প্রাণের মতোই।
তারা টিকেও থাকতে পারে। ২০০৮ সালে সোসটাকের গবেষক-দল আরেক পরীক্ষায় জানতে পারলেন, তাদের সৃষ্ট এই আদি-কোষ প্রায় ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে। অথচ এই পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রায় বর্তমান সময়ের বেশীরভাগ কোষই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ফলে সোসটাকের ধারণা আরও জোরালো হয় যে, তাদের সৃষ্ট আদি-কোষের সাথে প্রথম প্রাণের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় অবিরাম চলতে থাকা উল্কা পতনের প্রভাবে সৃষ্ট গরমেও আদি-কোষ বহাল তবিয়তে টিকে ছিল।
আরমিন মুলকিদজানিয়ান বলেন, ‘সোসটাক এক মহা কাজ করে ফেলেছেন।‘
কিন্তু তবুও সোসটাকের গবেষণার ফলাফল প্রায় ৪০ বছর ধরে চলমান প্রাণের উৎস গবেষণার বিপরীতে চলে গেল। ‘নিজেই নিজের প্রতিরূপ জন্ম দেওয়ার সক্ষমতা প্রথমে’ বা ‘কোষের খোলস বা কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ এই দুই তত্ত্বের কোনো একটিকে প্রাধান্য না দিয়ে এই দুই মতবাদের সমন্বয় সাধন করে তিনি বলতে চাইলেন এই দুই প্রক্রিয়া সমান-তালে একসাথে চলছিল।
দুই মতবাদের সমন্বয় করার এই প্রচেষ্টা প্রাণের উৎস গবেষণায় আরো নতুন সমন্বিত প্রস্তাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। নতুন এই তত্ত্বে প্রাণ সৃষ্টির সংশ্লিষ্ট সব কর্মকাণ্ড এক সঙ্গেই শুরু হয়েছিলো বলে প্রস্তাব রাখা হয়। এই ‘সবকিছুই প্রথমে’ ধারণা ইতিমধ্যে যোগাড় করে ফেলেছে তথ্য-প্রমাণের বিশাল জ্ঞান সম্পদ। এবং তা হয়তো প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে চলমান গবেষণার সব বিতর্কের সম্ভাব্য সমাধান দিতে পারবে।
(বিবিসি আর্থ-এ প্রকাশিত মাইকেল মার্শাল এর লেখা ’The secret of how life on earth began’ অবলম্বনে এই লেখা)
শেষ পর্বে পড়ুন- তাত্ত্বিক মহা সমন্বয়: আদি প্রাণকোষের সমস্ত মৌলিক উপাদান একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল
আরও পড়ুন...
প্রাণের উৎসের সন্ধানে সমুদ্রের তলদেশে অভিযান (৪র্থ পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (৩য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (২য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার গল্প (১ম পর্ব)
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।